একবার চোখে দেখলেই সব বুঝে ফেলা যায়?
হেমন্ত একবার নীলার দিকে কটাক্ষপাত করে, জীবনভোর দেখলেই কি বুঝে ফেলা যায়? বোঝাবুঝিটা তুলে রাখতে হয় বিবাহ-পরবর্তী কালের জন্য। বোঝাবুঝি সারাজীবন।…তুমি যদি কারও সঙ্গে প্রেম করে দু-চার বছর কাল পূর্বরাগ চালিয়ে যাও বুঝতে পারবে তাকে?
ইলা কেঁপে ওঠে।
একি সাধারণ তর্ক-যুক্তির কথা? না, কোনো উদ্দেশ্যমূলক কথা? জামাইবাবু কি সব জেনে ফেলেছেন? কিন্তু তাই কি? তাহলে জামাইবাবু তার বন্ধুর ভাইপোর সঙ্গে এ-সব কথা চালাচ্ছেন কেন?
নাঃ, সাধারণ তর্কেরই কথা।
ওই যে বলেই চলেছেন জামাইবাবু ইলার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি না ফেলেই।
বলছেন, পারা যায় না। যতক্ষণ না তুমি তার স্বার্থের সঙ্গে মুখোমুখি হচ্ছ, তার আটপৌরে জীবনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছ, পাঁচ বছর মেলামেশা করলেও বুঝতে পারবে না তাকে। অতএব ও তোমার গিয়ে শীতকালে ঠাণ্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো একবার চোখ-কান বুজে ঝাঁপিয়ে পড়াই ভালো।
ইলা ঈষৎ শ্লেষের সুরে বলে, তারপর ভাগ্য, কি বলুন?
এই স্বভাব ইলার, শ্লেষাত্মক বচনে মনোভাব প্রকাশ। বিশেষ করে জামাইবাবুর সঙ্গে।
ঝগড়া। কেবল ঝগড়া চলে।
জামাইবাবুর সঙ্গে ঝগড়া না করলে দিনটাই বৃথা যায় ইলার।
কিন্তু কিছুদিন থেকে নিজেই কেমন ভিতরে ভিতরে অপ্রতিভ হয়ে গেছে ইলা। ঝগড়া জমাতে পারে না।
প্রেমে পড়ে বুঝি কথার তীক্ষ্ণতাও হারিয়ে ফেলেছে সে।
প্রেমে পড়েও ততটা নয়, ওই রেজিস্ট্রির ব্যাপার ঠিক হয়ে গিয়ে পর্যন্ত। অথচ ইলার জানাশুনো বেশ দু-চার জন মেয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়ে অবলীলায় হাসছে খেলছে বেড়াচ্ছে। আসল কথা উপাদান।
সকলের উপাদানে সব কিছু খাটে না। ছেলেবেলায় ইলা একবার বাবাকে লুকিয়ে কুলপি বরফ খেয়েছিল। খাবার পর থেকেই উথলে উথলে কান্না উঠেছিল ইলার বুক থেকে, মাথার ভিতর থেকে, বাবা বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হাউহাউ কেঁদে বলে ফেলেছিল ইলা বাবাকে, বাবা, আমি কুলপি বরফ খেয়েছি।
সেই উপাদান।
তবু এখন জোর করে পুরনো সহজ কৌতুকের অভ্যাসকে ফিরিয়ে আনে। বলে, তারপর ভাগ্য, কি বলুন?
হেমন্তও জোর দিয়ে বলে, নিশ্চয়? তারপর ভাগ্য, আবার কি? তবে হ্যাঁ, যারা তোমার হিতৈষী, যারা তোমার প্রিয়জন, তাদের শুভেচ্ছার ওপর একটু আস্থা রেখ।
জামাইবাবু আজ রেখেছেন।
পাগল, রাগ কিসের! হেমন্ত হাসে, তুমি অবশ্য ভেবেছিলে রাগিয়ে দিয়ে কাজ পণ্ড করে দেবে—সেটি হবে না।
হল না পণ্ড।
আরও বহুবিধ কথার পরও সেই কথাই স্থির রইল। কাল কনে দেখবে ওঁরা।
তবে কি আর সেই ঘাড় গুঁজে বসে, ভয়ে ভয়ে বরপক্ষের বিটকেল বিটকেল সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া? না, অতটা নয়। ভদ্রলোক বেড়াতে আসার মতো আসবে, ইলা বাড়ির মেয়ে হিসেবে, স্বচ্ছন্দ গতিতে চা-খাবার এগিয়ে দেবে, এই পর্যন্ত।
ইলার আপত্তি? মানছে কে?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব একটা আপত্তিই কি করল ইলা?
ইলা ভাবল যাক গে এটুকু একবার দেখাই যাক! হাজার লোকের সামনে বেরোচ্ছি, দু-একটা লোক এলই বা বাড়িতে। বেরোলাম বা তাদের সামনে। ক্ষয়ে যাব না তো।
বরং সম্বুদ্ধকে খেপাবার একটা বিষয়-বস্তু পাওয়া যাবে।
নিজে থেকে আর যাব না ওর কাছে—এ সঙ্কল্প করেছিল ভুলে গেল। ভাবতে লাগল হোক কালকের মজাটা, তারপর আচ্ছা করে রাগানো যাবে।
এতক্ষণ পরে মন কেমন করল সম্বুদ্ধর জন্যে। বেচারা!
ওর কি কাল কম কষ্ট হয়েছে? নেহাত অসুবিধেয় আছে তাই।
দাদারা আছে সম্বুদ্ধর, এবং বড়দার প্রকাণ্ড একটি আইবুড়ো মেয়ে আছে। সেইটির জন্যেই আরও জ্বালা। অতবড়ো ভাইঝি পড়ে থাকতে নিজে বিয়ে করল সম্বুদ্ধ, এত স্বার্থপরতা নাকি কেউ ক্ষমা করবে না।
অথচ নিজেরাও কিছু কম স্বার্থপরতা দেখাচ্ছেন না।
তারপর ইলা স্পন্দিত হতে লাগল, এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবার আশায়। আবার হাসলও মনে মনে।
যাক, কিছুই তো হয়নি আমার। কোনো পরিচিত অনুষ্ঠান। এ-একটা হয়ে যাবে তবু। কনে দেখা।
কুমকুম বিবেকের দংশনে দগ্ধাচ্ছিল।
বেচারী ইলা!
সারারাত বাইরে কাটিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরে না জানি কী অভ্যর্থনা জুটেছিল তার ভাগ্যে। সম্বুদ্ধ কি সঙ্গে গিয়ে লুকোচুরির পালাটা সাঙ্গ করে ফেলেছে?
নাকি ইলার মা-বাবা এই অনিয়মের মূর্তি দেখে শাসনে আগুন হয়ে উঠেছিল। গিয়ে খবর নেবার সাহস হল না অথচ। তার চেয়ে সম্বুদ্ধর বাসায় যাওয়া সোজা।
সেদিনই পারল না। পরদিন সন্ধ্যায় গেল।
আর সমুদ্ধর মুখে প্রকৃত ঘটনা শুনে গালে হাত দিল।
রাতেই ফিরিয়ে দিয়ে এলে তুমি তাকে? বলিহারী! এত কাণ্ড, এত ইয়ে করবার দরকার কি ছিল তাহলে?
সম্বুদ্ধ লজ্জা পেল।
নিজের মান বাঁচাতে অনৃতভাষণের আশ্রয় নিল। বলল, আর বল না। যা অস্থিরতা করছিল। আশ্চর্য ভয়।
তুমি একটা কাওয়ার্ড। অসীম বলে ওঠে, আমি বলব, তোমার এখন বিয়ে করা উচিত হয়নি। নিজেরই যখন দাঁড়াবার জায়গা নেই।
সম্বুদ্ধ বলে, ভালো লাগছিল না। না করে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
এখন খুব স্বস্তি পাবে? আকণ্ঠ পিপাসা, সামনে অগাধ সমুদ্র, কিন্তু লবণাক্ত।
করা যাচ্ছে কি! ইলা যে একবারে মা-বাপের ভয়ে তুমিও দাদা-বউদিদের ভয়ে—
সেটা ভয় নয়, বিতৃষ্ণা।
ফলাফল একই। ক্রমশ ইলারও তোমার প্রতি বিতৃষ্ণা আসবে দেখ।