শিক্ষিত পরিবার।
তাদের মেয়েরাও সব এম-এ বি-এ পাস।
ইলার চোখের সামনে সম্বুদ্ধর বিদ্বেষ-বিদ্দিষ্ট মুখটা ভেসে ওঠে, আমাদের বাড়ির কথা আর তুলো না। অর্ধশতাব্দী পূর্বের মনোভাব নিয়ে কাল কাটাচ্ছেন তাঁরা দু-চোখে ঠুলি এঁটে।
ইলার কণ্ঠে অবশ্য নীরবতা।
নীলা আবারও বলে, ওরা বিয়ের জন্যে ব্যস্ত। কারণ ছেলে আবার মাস আষ্টেক পরে আমেরিকায় চলে যাবে। অবিশ্যি বউ নিয়েই যাবে। মা-বাপের ইচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিয়ে, এই কটা মাস সাধ-আহ্লাদ করা। এমন সম্বন্ধ আর জুটবে চট করে?
ইলাকে কষ্ট করে হাসতে হয়।
আর সেই কষ্ট হাসির সঙ্গে বলতে হয়, তোমার যা উৎসাহ দেখছি দিদি, মনে হচ্ছে তোমার বিয়েটা হয়ে গেছে বলে আপশোস হচ্ছে।
মা শুনছ! শুনছ তোমার ছোটোমেয়ের কথা?
নীলা বকছে, হাসছে, একটা কড়া বর, আর জাঁদরেল শাশুড়ি হচ্ছে তোর উপযুক্ত।
দিদি এলেই বাড়িটা সরগরম হয়। হাওয়ায় আনন্দ ভাসে।
কারণ দিদি সুখী।
কিন্তু দিদি ভীষণ জেদীও। এই বিয়ে নিয়ে যখন লেগেছে, উঠে পড়ে চেষ্টা করবে। গোড়াতেই তবে মূলোচ্ছেদ করা উচিত।
কিন্তু কখন? কোন্ অবসরে?
কিভাবে পাড়বে কথাটা? ঝপ করে? বিনা ভূমিকায়? বলবে বিয়ে বিয়ে করে অস্থির হয়ো না দিদি, সে-কাজটা আমি তোমাদের জন্যে রেখে দিইনি।
নাঃ! হচ্ছে না।
তবে কি ভূমিকা করে? দিদি, একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। মাকে তো বলতে সাহস হচ্ছে না, তোমাকেই বলি—
বলল।
কিন্তু তারপর? দিদির আর জামাইবাবুর ঘৃণার চোখ থেকে কোথায় সরে যাবে ইলা। মা-বাবার সামনে কি করে মুখ তুলে দাঁড়াবে? ছোটো ভাই রমুটা পর্যন্ত হয়তো ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইবে ছোড়দির দিকে।
ইলা যদি প্রেমে পড়ে গিয়ে ব্যক্ত করত সেই পড়ে যাওয়ার খবর, ইলার জন্যে বিরক্তি জমে উঠতে পারত, কিন্তু ঘৃণা নিশ্চয় নয়। ইলা তা করেনি। ইলা নিজের জন্যে সঞ্চয় করেছে ঘৃণা, করেছে তাদের কাছ থেকে, যারা ইলাকে প্রাণতুল্য ভালোবাসে।
একটু পরেই ইলার বাবা এলেন বাজার করে।
রবিবারের বিশেষ বাজার।
রবিবারে দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খায় দিদি-জামাইবাবু। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ওর আর নড়চড় নেই।
ইলার বাবা ভোরবেলা বাজারে চলে যান, বেছে দেখে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান মাছ-তরকারি মেয়ে যা ভালোবাসে, জামাই যা ভালোবাসে।
এত স্নেহ নীলা-ইলার বাবার।
এতদিন এমন স্পষ্ট করে অনুভবে আসেনি ইলার। ওই শান্ত স্বল্পভাষী মানুষটার মধ্যে কী অগাধ স্নেহসমুদ্র! খুব একটা অবস্থাপন্ন অবস্থা নয় বাবার, তবু সন্তানদের কোনোদিন বুঝতে দেননি সে-কথা। নীলা ইলা রমু যখন যা প্রয়োজন সব পেয়েছে। বিশেষ করে ইলা।
দিদির তো আই-এ পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তবু তত খরচের দায় ছিল না।
ইলার জন্যে বাবা কত খরচ করে চলেছেন। এম-এ পড়ল, রিসার্চ করছে, একদিনের জন্যে বাবার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হতে শোনেনি ইলা আর পারা যাচ্ছে না।
অথচ ইলার বরাবরের সহপাঠিনী দীপা?
বাবা তার কত বড়লোক, তার পোশাক-পরিচ্ছদ আর টিফিন দেখে তাক লেগে যেত এদের।
কিন্তু বইখাতা কিনতে হলেই নাকি তার মা-বাপ খেপে উঠতেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির নামে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করতেন, এবং অন্য মেয়েদের কাছ থেকে পুরানো বই কিনতে পাওয়া যাবে কি না তার সন্ধান নিতে বলতেন মেয়েকে।
ইলার বাবা চিরদিন মাসকাবার হলেই নিজে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ইলুবাবু, তোমার কি কি চাই?
বাবার ইলুবাবু তার প্রতিদান দিল বাবাকে।
বাবাকে দেখে মন কেমনের বাষ্পে বুকটা উথলে ওঠে ইলার।
আর হঠাৎ আজই প্রথম এমন স্পষ্ট করে মনে হল, এই সমস্ত কিছুর বদলে আমি কী পেলাম? এই অগাধ স্নেহ-সমুদ্র, এই ভালোবাসায়-ভরা মাতৃহৃদয়। এই আমার চিরদিনের পরিবেশ, আর আমার চিরদিনের সুনাম, এতগুলোর বিনিময়ে?
প্রেম?
এই সমস্ত কিছুর পূরণ হবে সেই প্রেমে? সম্বুদ্ধর আছে তেমনি প্রেম? প্রেমের শক্তি?
আর কিছুক্ষণ পরে হেমন্ত এল।
বলল, ইলা, ভাগো। তোমরা উপস্থিতি এখানে নিষ্প্রয়োজন।
ইলা বলল, নিষ্প্রয়োজন কাজই তো সর্বদা করে থাকি আমরা জামাইবাবু!
তবে শোন বিয়ের গল্প। কান পেতে শোন।…বুঝলেন মা, ইলার ছবি দেখেই ওদের মতো হয়ে গেছে, বলছিল, আর কি দরকার নিয়মমাফিক কনে দেখায়? আমিই বললাম, তা হোক, ও কোনো কাজের কথা নয়, চোখে দেখে যান একবার।..ছেলেকেও নিয়ে আসুন, দু-পক্ষেরই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ-ভঞ্জন হয়ে যাক।
ছেলে।
মানে, সেই ছবির মানুষটা।
না না, এভাবে ইলা ঘটনার স্রোতে ভেসে যেতে পারবে না।
ইলা জামাইবাবুকে বলবে।
বলবে সকলের আড়ালে। এই একটা জায়গাই তবু সহজ মনে হচ্ছে। যাক, এখন সকলের সামনেও তো সম্মতি লক্ষণের লক্ষণ দেখানো যায় না। তাই বকে উঠে বলে, ধন্যবাদ জামাইবাবু, আপনাদের রুচিকে ধন্যবাদ। এখনও ওই পচা-পুরনো ঘৃণ্য প্রথাটাকে কি করে যে বরদাস্ত করেন আপনারা! ছিঃ!
হেমন্ত অবশ্য এই ছিঃতে বিচলিত হয় না। হেসেই ওঠে বরং। বলে, এখনও যখন সেই পচা-পুরনো ঘৃণ্য প্রথায় দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খাই, সেই পচা-পুরনো সেকেলে প্রথায় বালিশে মাখা রেখে ঘুমোই, বরদাস্ত করতে বাধে না, তখন এ-সব ছোটোখাটো ব্যাপারগুলোকে বড়ো করে দেখে লাভ কি?…বিয়ে হেন ব্যাপার, নিজের চোখে একবার দেখে নেবে, এটা কি খুব অস্বাভাবিক?