- বইয়ের নামঃ নতুন প্রহসন
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সময়ের সুতোর গুলিটা
সময়ের সুতোর গুলিটা যেন গড়িয়ে পড়ে গেছে কার কোল থেকে, সুতো খুলতে খুলতে এগিয়ে যাচ্ছে লাফ খেতে খেতে, ঘণ্টা-মিনিটগুলোর উপর দিয়ে। বড়ো যেন তাড়াতাড়ি লাফাচ্ছে।
সকাল থেকে দুপুরে পৌঁছে গেল দিনটা এর মধ্যেই।
আর একটু পরেই চারটে বাজবে।
বিকেল চারটে।
ইলাকে পৌঁছতে হবে সেইখানে সম্বুদ্ধ এসে অপেক্ষা করবে। অথচ ভয়ানক এখন আলস্য হচ্ছে ইলার, ইচ্ছে হচ্ছে এই নরম বিছানাটায় পড়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে নেয়।
ঘুম। নরম মিষ্টি আর নিরুদ্বেগ একটু ঘুম। কত দিন যেন তেমন একখানা ঘুম ঘুমোয়নি ইলা। অনেক দিন। সেই যেদিন থেকে সম্বুদ্ধকে দেখেছে, সেদিন থেকে। দিনের শান্তি আর রাতের চিন্তা। কেড়ে নিয়েছে সম্বুদ্ধ ইলার।
ইলার পাহাড়ি ঝরনার মতো বাধাবন্ধহীন নিরুদ্বেগ কৈশোর জীবনটা তরতরিয়ে এগিয়ে চলছিল নুড়ি ছাপিয়ে ওঠার গুঞ্জন গান গেয়ে, সম্বুদ্ধ এসে সামনে দাঁড়াল বড়ো একখানা পাথরের চাইয়ের মতো।
ওকে অগ্রাহ্য করে ভেসে বহে যাবে, এ পারছে না ইলা। আবর্ত উঠেছে ওকে ঘিরে ঘিরে। যন্ত্রণা আছে তার, আছে অস্বস্তি।
তবু সুখও আছে। অসহ্য সুখ!
পূর্বজন্ম মানতে হচ্ছে আমায়, ইলা বলেছিল সম্বুদ্ধকে, শত্রু ছিলে তুমি আমার। মহাশত্রু ছিলে পূর্বজন্মে।
সম্বুদ্ধ অবশ্য এ অপমানে ক্ষুব্ধ হয়নি, বরং হেসেই উঠেছিল। হেসে হেসে বলেছিল, অথবা মহাজন। অধমর্ণ ছিলে তুমি আমার। ধার রেখে মরেছিলে। এ-জন্মে সেই ধার শোধ নিচ্ছি কড়ায়-গণ্ডায়।
মায় সুদ। ইলা বলেছিল রেগে উঠে। আরওঁ বলেছিল, কে আসতে বলেছিল তোমাকে আমার সামনে? কত সুখে থাকতাম যদি জন্মেও তোমার ওই হাড়-বিচ্ছিরি মুখটা না দেখতাম।
আমিও তোমার সঙ্গে একমত, সম্বুদ্ধ গম্ভীর মুখটা নিয়ে বলেছিল, আমারও মনে হয় ও-কথা। ওই পোড়া কাঠের মতো তুমি কে যদি না দেখতাম। এতদিনে
এই, ভালো হবে না বলছি।
ভালো হবার কিছুই তো রাখনি। তোমার কবলে না পড়লে জীবনে কত কি ভালো ভালো ঘটতে পারত।
বটে না কি! ইলা চোখ কুঁচকেছে, শুনি সেই ভালোর লিস্টঃ
যথা, ভালো কনে, ভালো একখানা শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরের দেওয়া ভালো ঘড়ি, ভালো আংটি, ভালো ভালো যৌতুক
ইস্! আশা কত! কোন্ শ্বশুরের দায় পড়ত তোমাকে জামাই করে ওই সব ভালো ভালো দিতে! কারুর যদি কানা-খোঁড়া একটা মেয়ে থাকত, হয়তো ভুলিয়ে-ভালিয়ে গছিয়ে দিত।
দেখা হলেই ঝগড়া করা একটা রোগ ওদের। আর দেখা করবার জন্যেই ছটফটানি।
সকালবেলা ঘুম ভাঙা থেকে ঘুমের মধ্যের স্বপ্ন সব ভরে থাকে সেই চিন্তায়। কিন্তু শুধু এক-আধবার দেখা হওয়ায় কদিন আশ মেটে? সর্বদা দেখতে ইচ্ছে করে, আরও নিবিড় করে পেতে ইচ্ছে করে, কেড়ে নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে ইলাকে ইলাদের বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে।
কিন্তু ইলা বলেছে, ওই বর্বর ইচ্ছেগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। কেড়ে নিয়ে পালাতে গেলে ছেড়ে দেবে না তোমাকে কেউ, তেড়ে গিয়ে হাতে হাতকড়া লাগাবে।
ওই তো! ওই দুঃখেই তো! দৈবাৎ তুমি এই বাইশের তিন রামদয়াল রোডে জন্মে ফেলেছে। বলে যে, এদেরই সম্পত্তি হয়ে গেছ, এ-কথায় বিশ্বাসী নই আমি, অথচ মানতেই হচ্ছে সেই কথা।
তা হোক–ইলা বলে, কোনো কিছু মানব না, এ-ইচ্ছেটা বুদ্ধিমানের ইচ্ছে নয়।
.
অতএব বুদ্ধিমানের মতোই ইচ্ছেটা করে ওরা। সম্পর্কটা আইনসঙ্গত করে নেবার ব্যবস্থা করে। যাতে ইচ্ছে করলেই ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেই চেষ্টাই করছে। কিন্তু সেটা কি এমন লুকিয়ে-চুরিয়ে ছিচকে চোরের মতো?
ইলা বলে, তুমি আমায় নিয়ে যাবে দেউড়ি দিয়ে রাজসমারোহে, সেটাই সুখ, সেটাই গৌরব—
সম্বুদ্ধ হেসে ওঠে, দেবে সেই পাসপোর্ট তোমার রামদয়াল রোড?
তবু ইলা বলেছিল, না হয় দিদি-জামাইবাবুকে বলি।
সম্বুদ্ধ বলেছিল, খেপেছ! এ-সব ক্ষেত্রে কেউ নিরাপদ নয়। দিদি-জামাইবাবু তোমায় নিয়ে ফর অ্যাডাল্ট দাগা বিলিতি প্রেমের সিনেমা দেখতে যায়, অথবা লেডি চ্যাটার্লির প্রেম নিয়ে আলোচনা করে তোমার সঙ্গে বলে, ভেব না, তোমার প্রেমে পড়াকে অ্যালাউ করবে। সেরেফ তোমার মা-বাবাকে লাগিয়ে দিয়ে আমাদের পারানি নৌকোখানাকে বিশবাঁও জলে ফেলে দেবে।
ইলা মুখ ভার করে বলে, সত্যি, কি সেকেলেই আছে এখনও আমাদের দেশ! বিশেষ করে এ-ব্যাপারে!
সমুদ্ধ অবশ্য হাসে। বলে, শুধু আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই।
সব দেশেই? কী যে বল? ওদেশে–
ওদেশের প্রগতিশীলতার নমুনা শুধু এইটুকু—গার্জেনের অনুমোদিত পাত্র-পাত্রীর সঙ্গে যদি ওদের মেয়ে-ছেলেরা প্রেমে পড়ে, তাহলে ওরা খুব পিঠ চাপড়ায়। নচেৎ রাগারাগি, বকাবকি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ইত্যাদি পুরনো পদ্ধতিগুলো ঠিকই আছে। আর আমাদের দেশে প্রেমটাই অননুমোদিত। সবটাই রাগারাগির–
তবু ওরা রাগারাগির ধার ধারে না। নিজেরা বেরিয়ে পড়ে।
সেটা আমরাও করতে পারি। কোনো কিছুর ধার না ধরলে আর চিন্তা কি? তবে আমরা না হোক, তোমরা অনেক ধার ধারতে চাও।
সম্বুদ্ধ হেসে কথাটা শেষ করে, মা-বাবা যদি আর তোমার মুখ না দেখেন, এই ভেবে তোমার ভয়, দিদি-জামাইবাবু পাছে তোমায় ধিক্কার দেয়, তাতে তোমার ভয়, অতএব এই চোরের পথ ধরা।