কী মুশকিল! গা জ্বলবার কী আছে? বরং তাতেই তো আরও মজা। যে মেয়ে রাজপুত্তুরের যুগ্যি, সে মেয়েকে তোমাদের এই হতভাগা ছেলেটা লুঠে আনবে, এতে গা জ্বলবার কথা তো ওদেরই।
তুই যতই নিশ্চিন্দি থাক সিধু-মা বলেন, আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ওরা তোকে আমল দেবে না।
ওরা কে? সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, ওদের দেওয়া না দেওয়ার ওপর নির্ভর নাকি? তবে হ্যাঁ, স্বয়ং রাজকন্যাই যদি হঠাৎ
পিসি বলে উঠতেন, এখন এতসব ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে। কানে নেওয়া হচ্ছে না, পরে দেখবি
.
আজও রাত্রে বাড়ি এলে খেতে বসিয়ে সেই কথাই পড়েন সিদ্ধার্থের মা আর পিসি।
কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে, আর কোনও দিকে তো চোখ দিতে দিলি না এ যাবৎ। এবার বিবেচনা কর। ও মেয়ে তো শুনছি কাঠ কবুল, নাকি জগৎ ছাড়বে তবু ওই কুড়োনো ছেলেটাকে ছাড়বে না। জানি না বাবা ভিতরের রহস্য কী! তা সে যাই হোক ওর ভরসায় থাকবার আর দরকার কী?
সিদ্ধার্থ ভুরু কুঁচকে বলে, তা এখুনি তাড়াহুড়ো করে ভরসা ছাড়বারই বা দরকার কী?
দরকার কী, দুচার কথার শেষে কিছুক্ষণ পরেই প্রকাশ হয়। পিসিমার এক ভাগ্নে এসে ধরে পড়েছে মেয়ের জন্যে। সুন্দর মেয়ে, বি. এ. পাস, গানবাজনায় পটু ইত্যাদি ইত্যাদি
পিসিমা সতেজে বলেন, ও তোর সুমনার চেয়ে একশো গুণে ভাল।
সিদ্ধার্থ হেসে ওঠে, একশো গুণ বহন করা বড় শক্ত পিসিমা। ওসব চেষ্টা করতে যেয়ো না।
মা কুদ্ধকণ্ঠে বলেন, তুই কি এখনও ভাবছিস ওকে বিয়ে করবি?
ভাবছি বইকী মা।
ওই একটা ছেলেসন্ধু মেয়ে, রাগের সময় ভাষার শালীনতা হারান মা, ভগবান জানেন,কার ছেলে, কাদের ঘরের ছেলে।
ওটা খুব একটা বাধা নয়।
নয়?
আমি তো মনে করি, না।
তোর মাথার উপর বাপ, দাদা, তাদের কথা ভাবিস। উনি বলে দিয়েছেন, কান্তিবাবুর মেয়ের আশা তোমায় ত্যাগ করতে হবে।
রাগ করে উঠে যান মা।
সিদ্ধার্থের কাছে খুব একটা প্রতিবাদের ভাষা নেই। সে তো এই সমাজেই মানুষ। জানে তো সমাজ-মন।
উঃ সেই ছেলেটাকে ছিনিকেই নেওয়া যায় না সুমনার কাছ থেকে!
তা হলে হয়তো সুমনা সহজ হয়ে যায়।
.
মনের কথাটা বুঝি মুখে ধরা পড়ে।
রমলা এসে বলে ওঠে, যা দেখছি সহজে হবে না।
সিদ্ধার্থ চমকে উঠে বলে, কী সহজে হবে না?
চমকাচ্ছ কেন ভাই? আমি বলছি, তোমার প্রেয়সীটি পরিস্থিতি যেমন ঘোরালো করে তুলেছে, তাতে এ পক্ষের মত পাওয়া সহজ হবে না।
মত পাওয়ার আশা আর করছি না।
সে বুঝতেই পারছি। কিন্তু ঠাকুরপো
কী!
ও শুনছি ওই ছেলেটাকে উপলক্ষ করে ভীষণ জেদ ফলাচ্ছে, মা বাপ ঠাকুমা জ্যাঠা কারও কথা শুনছে না। তাই ভাবছি অত জেদি মেয়েকে নিয়ে।
আহা বউদি, সে তো পড়েই আছে কথা। জীবন মহানিশা। কিন্তু করা যাবে কী, ভাগ্য বলে কথা। এই যে তুমি–
সিদ্ধার্থ মৃদু হেসে থামে।
ওমা! আমি আবার কী?
আহা, মানে তুমি কিছু আর আমার দাদাটিকে আদর্শ পুরুষ বলে মনে করো না! তবু তো দাদাকে বহন করতে হচ্ছে তোমায়।
শোনো কথা। কীসে আর কীসে! আমার সঙ্গে তোমার তুলনা? বিয়ের পর ঘর করতে করতে দেখছি মানুষটার কতটুকু দোষ, কতখানি গুণ।
উঁহু, ঠিক হল না। বরং বলতে পারো কতখানি দোষ, কতটুকু গুণ।
রমলা হেসে ফেলে বলে, দাদা গুরুজন তা মনে রেখো!
অলওয়েজ মনে রাখি। তবে ধরে নিতে হবে কথাটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। বিয়ের পর বলেই ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে, আর বিয়ের আগে হলেই ভাবতে হবে ভাগ্য হাতের মুঠোয়, তা হয় না। প্রেমে পড়াও একরকম নিরুপায়তা।
নাঃ, তোমার ওপর আর আশা নেই। বৃথাই মা আর পিসিমা আমাকে উকিল খাড়া করেছেন।
ওঃ! বটে, তাই নাকি। তাই ভাবছি তোমার কথার মধ্যে এমন বিজাতীয় বিজাতীয় গন্ধ কেন!
না না ঠাকুরপো! আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা আমি একবার ওর কাছে যাব?
গিয়ে?
গিয়ে বুঝিয়ে বলব।
পাগল হয়েছ? আরও খেপে যাবে। তোমাকে আমার চর ভাববে।
তা হলে তোমার সিদ্ধান্তটা কী? কী করবে?
আপাতত ওর মনের গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করব না।
এরপরে আর কনে জুটবে না।
রমলা বকে ওঠে।
তা আমার বাজারদর যে হঠাৎ এত পড়ে যাবে, তাই বা ধরে নিচ্ছ কেন? চুপচাপ থাকোই না বাবা একটু?
হুঁ, এদিকে তোমার দাদা রোজ শাসাচ্ছেন, আমি যেন কান্তিবাবুর মেয়ের দিকে না ঢলি। যেন তোমাকে সদুপদেশ দিয়ে দিয়ে।
সেরেছে। দাদা আবার এর মধ্যে কেন, আমার তো ধারণা, বিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মহিলা মহলের এলাকা।
বাঃ, উনি হচ্ছেন বংশের মানী পুরুষ, বংশের মান মর্যাদা দেখবেন না? ওঁদের তো প্রায় ধারণা জন্মে গেছে
হঠাৎ চুপ করে যায় রমলা।
সিদ্ধার্থ বলে, কী ধারণা জন্মে গেছে?
নাঃ সে তোমায় বলা যাবে না। যতসব বাজে বিচ্ছিরি কথা।
সিদ্ধার্থ একটু হাসে। কথাটা বুঝতে দেরি হয় না। সকলের মনেই সন্দেহের প্যাঁচ।
তা হলে সুমনার সেই তীব্র ব্যঙ্গটা মিথ্যা নয়।
ও ঘর থেকে মা আর একবার এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখ। বললেন, সিধু, উনি বলছেন তোমার পিসিমার সেই ভাগ্নের মেয়েটিকে আজই দেখতে যাবেন। আর পছন্দ হলে পাকা কথা দিয়ে আসবেন।
সিদ্ধার্থ হেসে বলে, তা তোমাদের এইসব পাকা কথাটথার ব্যাপার এই কাঁচা ছেলেটাকে শোনাতে এলে যে?
একটু শুনিয়ে রাখছি–
না। কোনও দরকার নেই। তোমরা যখন সবই পাকা করে তুলবার সাহস রাখছ, তখন বাকি দায়িত্বটাও নিয়ো। আমায় কেন জড়াচ্ছ বাবা!