কান্তিকুমার মেয়ের এই ছেলেমানুষিতে হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, কেন? এমন অদ্ভুত খেয়াল কেন?
বাঃ, বেশ কেমন মজা হবে। সবাই বলবে, এরকম হবেই জানতাম। একেবারে পড়ে না!…ছোটকাকা বলবেন, আড্ডাটা একটু কমাও হে। পরীক্ষা জিনিসটা ছেলেখেলা নয়। পরীক্ষার সময় গান স্পোর্টস আড্ডা! হল তো?
হেসে কুটি কুটি হয়েছিল সুমনা, ছোটকাকার সুরের নকল করে।
আজ সুমনা বাবাকে ডাকতে পারছে না।
যেন সুমনা সত্যিই অশুচি।
এ অবস্থার কি প্রতিকার সম্ভব নয়?
অন্ধকার সেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের আলোয় বুদ্ধিকে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে পরিষ্কার করে নেয় সুমনা। বাবার কথাই শুনবে। এম. এ. পড়বে। সহজ হয়ে উঠবে। বাবাকে ডেকে সেই কথাই বলবে এক্ষুনি। আর বলবে, ওর জন্যে সেই যে কী আয়ার কথা বলেছিলে বাবা
হঠাৎ কান্তিকুমারের গম্ভীর মৃদুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বাড়ি গিয়ে সকলকে প্রণাম কোরো সুমনা।
চমকে উঠল সুমনা।
না, এই কণ্ঠের সামনে সহজ হওয়া সম্ভব নয়।
তবু একটু পরে আস্তে বলল, বাবা, ইউনিভার্সিটিতে শিগগির চেষ্টা করাই ভাল।
কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা হলে পড়বেই ঠিক করছ?
হ্যাঁ।
আর একটু চুপ করে গাড়ি চালাবার পর প্রায় বাড়ির দরজায় এসে উত্তর দেন, চেষ্টা করবার কিছু নেই। রেজাল্ট ভাল হয়েছে। সহজেই হবে।
কথাগুলো যেন যন্ত্র থেকে বার হচ্ছে। স্ক্রু ঢিলে শিথিল যন্ত্র।
বাবার ওপর কি করুণা করবে সুমনা?
বাবার সঙ্গে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, যেমন করে হোক সে ব্যবধান দূর করবে? বাবাকে—
বাড়ির দরজায় এসে গাড়ি থামল।
আর
বাড়ি ঢুকেই ব্যর্থ হয়ে গেল সমস্ত সংকল্প। টানটান করে বাঁধা তারের বাজনা ছিঁড়ে, ছড়িয়ে পড়ল খানখান হয়ে।
দরজায় পা দিয়েই শুনতে পেল শিশুকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ। উপর উপর কেঁদেই চলেছে।
কান্তিকুমার সে কান্না সম্পর্কে কোনও ব্যস্ততা দেখালেন না। তিনি এখন গাড়িতে চাবি লাগাবেন। ধীরেসুস্থে বাড়ি ঢুকবেন। ঢুকে নীচতলার অফিসঘরে বসবেন। যেখানে মক্কেলের দল বসে আছে ভিড় করে।
সুমনা বিদ্যুৎগতিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। আর শুনতে পায় এক তীক্ষ্ণ বিষাক্ত ভাষা। যে বিষের জ্বালায় মুহূর্তে এম. এ. পড়ার সংকল্প ত্যাগ করে সুমনা। ত্যাগ করে বাবার পয়সায় ঝি রেখে বাবার বাড়িতে থেকে ছেলে আর নিজে দুজনে মানুষ হয়ে ওঠবার বাসনা।
সুজাতা।
হ্যাঁ, সুজাতার গলাই শুনতে পেয়েছে প্রথমে সুমনা। সে গলা তীব্র অসহিষ্ণুতার সঙ্গে মন্তব্য করল, এই হয়েছে শিক্ষা! কান মলছি বাবা, আর যদি কোনওদিন স্বীকার পাই। এরপর থেকে সুমি যদি বেরোয় যেন ছেলে গলায় ঝুলিয়ে বেরোয়।
দোতলার বারান্দায় পা দিয়েই শুনতে পায় ঠাকুমার কথা, তুমি আর পাড়া জানিয়ে ছেলে ছেলে কোরো না বউমা। শুনলে ঘেন্না করে। সেদিন অমনিই কার সামনে যেন বলে বসলে, সুমি ছেলে নিয়ে ঘরে বসে আছে। ইচ্ছে করে আর পাঁক তুলে গায়ে মেশোনা বাছা।
তা ছেলে না বলে নাম একটা দিলেই হয়, হেসে ভেঙে পড়ছে ছোটখুড়ি, আমরা তো ওকে যিশু বলতে শুরু করেছি।
শিশুকণ্ঠের কান্না ছাপিয়ে ওর হাসিটা তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
মালবিকাও বদলে গেছে।
বোধ করি মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে।
অথবা সুমনার উগ্র প্রখর প্রবল মাতৃস্নেহের ভঙ্গি লক্ষ করে করে। ওইটাই তো বেশি সন্দেহজনক।
বুঝি ঝিটা পর্যন্ত বলে, আইবুড়ি মেয়েছেলের এত ছেলের আঁট! বাবার জন্মে দেখিনি বড়মা।
যন্ত্রণা ওদেরও কি কম?
জেঠি খুড়ি ঠাকুমা পিসি জেঠা কাকার? ওরা তো ভেবে ঠিক করতে পারছে না, কোন্টা বেশি অপবিত্র? মাতৃপরিত্যক্ত রাস্তার জঞ্জাল, না কুমারী কন্যার কলঙ্কচিহ্ন?
সন্দেহের ফল অবিরত ছোবল দিচ্ছে তাদের।
সুমনা দোতলায় পৌঁছে কেমন করে মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ছেলেটাকে, আর কেমন করে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই ধমাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, না, তার নিজেরই মনে পড়ছে না।
শুধু সুমনার স্পর্শমাত্র যে আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল ছেলেটা, এই এক আশ্চর্য অনুভূতি অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রইল তাকে।
সে অনুভূতি পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকল সমস্ত পরিমণ্ডলে।
একে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে আবার সহজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে তোলবার ইচ্ছে পোষণ করছিল বলে ধিক্কার দিল নিজেকে।…
ফিকে হয়ে গেল বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল সোনালি রং।
এই ঘরের বাইরের পৃথিবীকে আর মনে রাখতে পারল না সুমনা।
মনে রইল না বাবার নির্দেশ।
মনে পড়ল।
অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ল।
যখন ফুড তৈরি করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে পারল ছেলেটাকে।
কিন্তু তখন কি আর ঘরের দরজা খুলে বাড়ির সবাইকে প্রণাম করতে যাবে সুমনা?
শুধু দেরি হয়ে যাওয়ার বাধা নয়, প্রধান বাধা দরজা বন্ধ করার সেই দুম শব্দটা!
হাতুড়ির ঘায়ের পর কি প্রণাম চলে?
.
কান্তিকুমার অনেক পরে ভিতরবাড়িতে ঢুকলেন। আশা করেছিলেন আজকের আবহাওয়া একটু অন্যরকম দেখবেন। আজ সুমনা কিঞ্চিৎ সহজ বুদ্ধিতে এসেছে, এভাবে নিজেকে একটা ভাবপ্রবণতার কাছে বিকিয়ে দেওয়া যে বোকামি তা বুঝতে পেরেছে, অতএব আজ অবশ্যই তার সেই উগ্র জেদের চেহারাটা বদলেছে।
আর তার পরীক্ষার এই সাফল্যের খবর নিশ্চয়ই বাড়ির অন্যান্য সদস্যকেও নরম করেছে। তাই নিজেই অনেকটা আগের মতো নরম আর প্রসন্ন মন নিয়ে বাড়ির মধ্যে এলেন কান্তিকুমার।