-তবে ওই দেখুন। না, না দাদা লেন্স ড্রপ দ্য হোল আইডিয়া। ধরুন যদি অডিয়েন্স হয়? ওই সতী পেল না পতি যদি ওড়িয়া বাঙালিদের রুচিসম্মত নববর্ষ অনুষ্ঠান, তা হলে শুভম-এর নাটক দেখবে কারা? হ অর্ধেক খালি থাকলে একটা নামকরা গ্রুপ ইনসাল্টেড ফিল করবে না? আমরাই বা তাদের কাছে মুখ দেখাব কী করে? অমলের ধৈর্যচ্যুতি হয়,
—এসব কথা আগে ভাবোনি তো। স্থানীয় বাঙালিরা কী মাল তো জানতেই। এই ভুবনেশ্বরেই তো কালীবাড়ি আছে একটা। পুজোটুজোতে তো যাও। দেখনি কী পদের। যত সব এল (লোয়ার) এম (মিডল) সি (ক্লাস)র আচ্ছা। বাংলায় ঠিক মতো কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। যেন অমল বরাবর পারে।
-তখন দাদা কেমন একটা বাঙালি বাঙালি এনথু এসে গিয়েছিল। ওই ফিয়ারলেসের ভদ্রলোকের কথাতে আর কি। রণজিতের বিশ্লেষণে সকলের সায়।
অনেক দিন বাদে সন্ধেয় বাড়িতে অমল একা। সাধারণত সে বাড়িতে থাকে না, একা প্রায় কখনওই নয়। তার জীবিকা, তার কর্ম অন্যকে টাকা ধার দেওয়া। পৃথিবীতে সর্বদা ধার চাওয়া লোক প্রচুর। অতএব প্রায় সন্ধেয় তার নিমন্ত্রণ। ভুবনেশ্বরে এখন বেশ কটি তারাওয়ালা হোটেল এবং প্রতিটিতে এক বা একাধিক বাররেস্তোরাঁ। এন্টারটেইনিং বা খাদ্যপানীয় সহকারে সেবা আর্থিক লেনদেনের প্রচলিত অনুষঙ্গ। আজও অমলের যাওয়ার কথা ছিল। হোটেল স্বস্তিতে—একমাত্র ওড়িয়া মালিকানার হোটেল-হোটেল প্রাচী তো প্রাক্তন রাজন্যবর্গের একজনের অতএব খাঁটি ওড়িয়া মনে হয় না। খাওয়াটা ভাল। বিশেষ করে চিংড়ির পদগুলি। অমলের প্রিয়, কলকাতায় বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিতে যে মাছটি এখন শুধুই স্মৃতি, কালেভদ্রে বিশেষ অনুষ্ঠানে কেনা ও রান্না। অতএব ভুবনেশ্বরে বাজোরিয়া সিংহানিয়া অরোরা বা নন্দ কি সান্ত্র আতিথেয়তা অমল নির্লজ্জভাবে এই মাছটির দিকে চালিত করে। সত্যি বলতে কি তারাও মাইন্ড করে না। কেনই বা করবে। খরচ তত শেষ পর্যন্ত উঠবে অমলের ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া ধার থেকে। টাকা দিচ্ছে গৌরী সেন। এ জন্মে ধোঁদোল চোষ পরজন্মে ফলার খাবে—এ ধরনের সনাতনী নীতিবোধ টোধের ধার সে ধারে না।
কিন্তু আজকে সেই চিংড়িতেও তার আগ্রহ নেই। কিছু ভাল লাগছে না। গতকাল একতার জরুরি বৈঠকে মীমাংসা কিছুই হল না। ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সেই অনিশ্চিত রয়ে গেল। একতার এক যুগের ইতিহাসে এই প্রথম কার্যকরী সমিতির বৈঠক শেষ হল সিদ্ধান্ত ছাড়া। এই প্রথম অমল কুমার দাসের মতামত গ্রাহ্য হল না। রাতে সোজা বাড়ি ফিরে এসেছিল অমল। গোটা চারেক হুইস্কি ও যথারীতি সুপ সহকারে মাংসরুটি খেয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছে। সামনে ড্রেসিং টেবিল, আয়না। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কেমন যেন কমে গেছে না? টেলিফোন লাগায় মৈত্রেয়ীকে।
–শোনো একটা অসুবিধা হয়ে গেছে, অমল যথাসম্ভব উত্তেজনাহীন গলায় শুরু করে, গভর্মেন্ট আমাদের ওই স্ট্যাচুটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারবে না। আসলে ওদের কি রুলটুল-এ বাধছে। রবীন্দ্রমণ্ডপ সরকারি জায়গা তো, আর আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই আমাদের দান নেওয়াটা ভাল দেখায় না।
–দান তো নয়, উপহার, মৈত্রেয়ীর প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী সুলভ ভ্রম সংশোধন।
–ও সেই এক কথা। মোটের ওপর ধরে নাও ২২শে শ্রাবণ ফাংশানটা হচ্ছে না।
—সয়োজদার নাটক তো নিশ্চয় হচ্ছে? ওটা তো সরকারি কিছু নয়।
-না, ওটাও আর করা সম্ভব হচ্ছে না। কার্ডে তো মূর্তি প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠান লেখা, না? মূর্তি নেই, অনুষ্ঠান হবে কী করে। একতার সকলেরই খুব মন খারাপ। ক্লাব থেকে শুভম-এ অফিসিয়াল লেটার অফ রিগ্রেট যাবে। তবে তুমি একটু ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বল। অবশ্য তোমার পক্ষে খুবই এমব্যারাসিং হবে, এ দুমাসে এত ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলে…
-ঠিক আছে। অনেক রাত হল। কাল সকালে স্কুল আছে। ছাড়ছি। বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় মৈত্রেয়ীর উত্তর। অমলের বুকের ভেতর সিরসির করতে থাকে। এখনও। এই ১৯১৪ সালের জুন মাসেও করে।
শুভম নাট্যগোষ্ঠীর বলাবাহুল্য শো বাতিল হওয়াটা একেবারেই ভাল লাগেনি। তবে ভদ্রলোকের পেশাদারী দল, মঞ্চস্থ করার পুরো দক্ষিণা ক্ষতিপুরণ হিসেবে চায়নি। চাইতে পারত। অমল বুদ্ধি করে লিখেছিল যে অভাবনীয় পরিস্থিতির জন্য নাটকটি মঞ্চস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না তার জন্য যেহেতু শুভম-এর কোনওই দায়িত্ব নেই অতএব আগাম টাকাটি ফেরৎ দেবার প্রয়োজন নেই তো বটেই বরং ভুবনেশ্বর যাত্রার প্রস্তুতিতে তাদের যে ব্যয় হয়েছে তার অঙ্কটি যদি তার বেশি হয়ে থাকে একতা তার ভার নেবে। শুভম দুঃখ এবং হতাশা প্রকাশ করেছে কিন্তু টাকা চায়নি। ভবিষ্যতে নাটক করার সুযোগ হবে আশায়।
তাদের অবশ্য রবীন্দ্রমূর্তি নিয়ে এত সব কাণ্ডের কথা বলা হয়নি। বললে হয়তো বুঝতও না। মূর্তি স্থাপন করা না করার সঙ্গে তাদের নাটক মঞ্চস্থ হওয়া না হওয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই। তাদের কাছে এটাই বাস্তব। সত্য। কিন্তু অমলের কাছে, একতা ক্লাবের সদস্যদের কাছে নয়। তাদের বাস্তব ভিন্ন। বাস্তব তো একটা নয়, অনেক। যার কাছে যা। অতঃপর বাস্তব বা সত্যের তত্ত্ব বিশ্লেষণে না গিয়ে শুভমকে বলা হয়েছে যে শেষ মুহূর্তে রবীন্দ্র মণ্ডপ হলটা পাওয়া যায়নি, ভুলে একই দিনে দুটো পার্টিকে বুকিং দিয়ে দিয়েছে। একটা স্থানীয় অন্যটা বাইরের। বাইরের দল জোগাড়যন্ত্র করে এসে অসুবিধায় পড়বে কাজেই তাদেরই বারণ করে দেওয়া হল। কদিন আগে সত্যি এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত একজন কথক নাচিয়ে অনুষ্ঠান করতে এসে দেখে ঠিক সেই দিন সেই সময়ে মঞ্চে চলছে কোন আই এ এস না আই পি এস লেখকের শৌখিন ওড়িয়া নাটক অভিনয়। খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল। অমল বুদ্ধি করে ঘটনাটা কাজে লাগিয়ে ফেলে। অর্ধসত্য তো পূর্ণ সত্যের চেয়েও শক্তি ধরে, ফলে শুভম নাট্যগোষ্ঠী আশায় রইল ভবিষ্যতে হল খালি পেলে সুযোগমতো নিশ্চয়ই আমন্ত্রণ পাবে।