- বইয়ের নামঃ জহুরী
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কাঠামো দেখলে বোঝা যায়
জহুরী – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
কাঠামো দেখলে বোঝা যায়–এক সময় লোকটার চেহারায় দীপ্তি ছিল, জৌলুস ছিল, আকর্ষণের উপাদান ছিল। এখন একটু ঢিলে, একটু বিবর্ণ, একটু বা স্তিমিত। সামনের চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় মাথায় টাকের আভাস, আর ঠোঁটের কোণাটা বাঁকাটে হওয়ার দরুন মুখে একটু সকৌতুক বিষণ্ণ হাসির আভাস।
আগেও ওর ঠোঁটের গড়ন এমনিই ছিল, যেন সেখানে সব সময় উঁকি দিচ্ছে একটা সূক্ষ্ম হাসির ব্যঞ্জনা। কিন্তু সে ব্যঞ্জনা ছিল তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের, এমন বিষণ্ণ কৌতুকের নয়।
বদলালো কেন?
ও কি তারপর থেকে আত্মদর্শনের চর্চা করে করে দার্শনিক হয়ে উঠেছে। প্রায় সকলেই একথা ভাবল।
আজকের উৎসব উপলক্ষে জানলার কাছে কাছে বাড়তি যে ছোট ছোট সীটগুলো আলাদাভাবে পাতা হয়েছে, তারই একটায় বসেছিল ও ঘরের সকলের দিকে সোজাসুজি চোখ চেয়ে। ওকেও তাই সকলে দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে পাচ্ছিল ওর ভাঁজহীন ট্রাউজার আর বোতামবিহীন বুশ কোট এবং পালিশ-বিহীন চপ্পল জোড়াটার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান দামী আর শৌখিন চশমা জোড়াটা, দেখতে পাচ্ছিল ওর ঈষৎ শীর্ণ ফর্সা ফর্সা আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখা ধার-ঘসা, কোণ-ক্ষওয়া, ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার অ্যাটাচি কেসটা, যেটা নাকি মিসেস পালিতের এই শৌখিন ভোজ-সভায় প্রায় বিদ্রোহের মত।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে সকলেই তাই দেখছিল ওকে, আর ভাবছিল, এর মানে কী! ও এখানে কেন! কে নেমন্তন্ন করেছে ওকে? আর যদি বা কেউ করেছে, ও এসেছে কি বলে!
ঘর থেকে উঠে গেল নীলাঞ্জনা আর বীথিকা। বারান্দার একান্তে এসে বলল, ব্যাপার কি বল তো?
বোঝা অসম্ভব! আমি তো ঘরে ঢুকেই দেখে একেবারে পাথর বনে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা, নেমন্তন্নটা করল কে? মিস্টার না মিসেস?
মিস্টার পালিত নেমন্তন্ন করবেন ওকে? মাথা খারাপ নাকি তোর?
কিন্তু মিসেসই বা কী করে? জানিস তো সবই।
জানি, কিন্তু আজ স্রেফ গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি।
আচ্ছা, ঠিক কতদিন হয়ে গেল বল দিকি?
ঠিক? খুব সঠিক বলতে না পারলেও বলি এক হাজার চুরানব্বই দিন সাড়ে বাইশ ঘণ্টা
থাম। দিন মাস বচ্ছর গুনতিস নাকি?
আহা, ওর আর কি, ঘটনাটা তো ঘটেছিল ঠিক তিন বছর আগে মিসেস পালিতের ওই আহ্লাদী মেয়ের এই জন্মদিনের উৎসবেই। সেদিনও ঠিক এই এই লোকগুলোই উপস্থিত ছিল, বাড়তির মধ্যে পালিত-গিন্নীর ন্যাকা মেয়ের ওই নতুন গানের মাস্টারটি, আর অশোকের বৌ। তখন অশোকের বিয়ে হয়নি।
আর ওই রোগা কালো মেয়েটা? ওই কোণের দিকে যে বসে আছে? ওকে তো কোনদিন এ বাড়িতে দেখিনি।
কী আশ্চর্য! ও তো মিস্টার পালিতের ভাগ্নী হেনা। ওকে দেখিসনি তুই?
কি জানি, মনে পড়ছে না। ও এ বাড়িতে আসে?
মাঝে মাঝে। গরীব বলে দেখতে পারেন না মিসেস পালিত, তবে নেহাৎ নাকি মামার বাড়ি।
আর পালিত একটু স্নেহ করেন। সেদিন অবশ্য আসেনি। তিন বছর আগের সেই ঘটনার দিন। আমি যেন চোখের ওপর সেদিনের সব দেখতে পাচ্ছি। ডানদিকের ওই দেয়ালটার ধারে যেখানে আজ অশোক আর সুকান্ত বসে রয়েছে ওই দুটোতে বসেছিলেন মিস্টার রাহা আর তার ওই সুটকি মেয়ে, এদিকে মিসেস রাহা জমিয়ে বসেছিলেন সুকান্তর সঙ্গে, সামনে ওই যেখানে মিসেস ক্ষেত্রী বসে রয়েছেন, ওখানে বসেছিল সোনালী চাকলাদার। অদ্ভুত ধরনের একটা জমকালো শাড়ি পরে এসেছিল, আর কানে দুটো লম্বা রূপোর ঝুমকো, হাতে
ঈস! এত ডিটেল মনে রাখতে পারিস তুই! আমার বাবা এত সব মনে থাকে না।
বাঃ, সেদিনের দিনটা ভাব। ছবির মত সবটা যেন
তা বটে। কিন্তু আমি ভাবছি ওই নির্লজ্জ আর দুঃসাহসী লোকটার বেপরোয়া সাহসের কথা। কতখানি বুকের বল থাকলে আবার এ বাড়িতে মাথা গলাতে পারা সম্ভব হতে পারে সেদিনের সেই ঘটনার নায়কের পক্ষে!
তা সাহস না থাকলে সে ঘটনাটাই বা ঘটল কি করে? কিন্তু আমি ঘুরে ফিরে শুধু ভাবছি ওকে এ বাড়িতে ডাকল কে?
এই তো! আমিও তো দেখে অবধি ভেবে কূল পাচ্ছি না।
.
ভেবে কূল পাচ্ছে না এ ঘরের প্রত্যেকটি লোক।
সোনালী চাকলাদার। যে আজও অদ্ভুত ধরনের জমকালো একটা শাড়ি পরে এসেছে, আর কানে প্রকাণ্ড দুটো চাকার মত রিং পরেছে, সে সেই অবধি তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, এই তিন বছরে লোকটার চেহারার বেশ একটু পরিবর্তন হয়েছে। প্রকৃতিরও। ভাবা যায় না যে কনক মিত্তির এ রকম ঢিলেঢালা আধময়লা পোশাক পরে মিসেস পালিতের পার্টিতে এসেছে। পটপ সাজসজ্জায় যে লোকটা ভয়ঙ্কর রকম খ্যাতিমান ছিল।
সোনালী চাকলাদার ভাবতে থাকে, সেদিন কনক মিত্তির একটা মাখন-রঙা ডেক্রনের স্যুট পরেছিল। ভয়ানক রকমের ভাল দেখাচ্ছিল ওকে। মেয়েদের রীতিমত মুগ্ধ করবার মত। কিন্তু কেবলমাত্র একটি মেয়েমানুষকে মুগ্ধ করেই ও যেন জীবনের সব পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল, তাই আর কারও দিকেই তেমন করে তাকাত না। শুধু ওর ওই ঈষৎ বঙ্কিম ঠোঁটের রেখায় একটু বিদ্রুপের হাসির ছিটে মাখিয়ে অলসভাবে তাকাত সকলের দিকে একইভাবে।
কাজেই সোনালী চাকলাদার বেশীক্ষণ আর মুগ্ধভাব বজায় রাখতে পারে নি। নিজের সুর্মাটানা চোখ দুটোয় বিলোল বিহ্বলতার ভঙ্গী এনে অনেকক্ষণ ধরে চোখাচোখি হবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিরক্ত চিত্তে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিল। তারপর–ঠিক খাওয়া দাওয়ার শেষের দিকে সেই গোলমালটা উঠল।
টেবিল ছেড়ে ওঠেনি তখনও কেউ। আর সোনালী ভাবছিল প্রত্যেক পার্টিতেই পুডিং এত কম কম করে কেন! অথচ সোনালী ওটা কী পছন্দই যে করে! ওর তো মনে হয় টেবিলে যতটা রাখা থাকে, সবটাই ও একা খেয়ে নিতে পারে। তাই আর সবাই যখন পুডিংয়ে চামচ বসায়, বুকের মধ্যে কী একরকম যেন যন্ত্রণা হতে থাকে সোনালীর।
ইচ্ছে করলেই তো এই চমৎকার সুখাদ্যটা একটু বেশি বেশি মজুত রাখা যায়। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তখন ভাবছিল সোনালী, বেশ মনে আছে। আর মনের অগোচর পাপ নেই, কাজেই এটুকুও মনে আছে, ওই গোলমালটা শুনে সকলে যখন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে শব্দ লক্ষ্য করে মিসেস পালিতের শোবার ঘরের দিকে ছুটেছিল, তখন সোনালী একটু দেরি করেছিল। উগ্র কৌতূহল চেপেও শেষ লোকটি পর্যন্ত ঘর থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করেছিল। কারণ, পুডিংয়ের পাত্রটার ভিতরে তখনও খানিকটা লেগেছিল, যেটা চামচে করে তোলা যায় নি।
তবু ওই লোকটা, ওই কনক মিত্তির নামক দুঃসাহসী লোকটা সেদিন কোথায় যেন ট্রেন ধরতে যাবে বলে আগে আগে খেয়ে নিয়েছিল, তাই একটু স্বস্তি করে খেতে পেরেছিল সোনালী। নইলে কনক মিত্তির থাকলেই একটু ইয়ে করে খেতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কী রকম যে ব্যঙ্গ হাসি মাখা মুখে ঠিক সোনালীর খাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে লোকটা।
.
কনক মিত্তির এ বাড়ির কে, সে কথা সোনালী জানে না। ওর মনে আছে প্রথম যখন কাউকে জিজ্ঞেস করেছে সোনালী, মিসেস রাহাকে কি তার পুঁটকি মেয়েকে, নীলাঞ্জনা কি বীথিকাকে, কেমন করে যেন মুচকে হেসেছে ওরা, আর বলেছে–কে কার কে হয়, সে হিসেব দেওয়া কি সোজা!
অথচ, কনক মিত্তিরের সামনে ওরা মুখের চেহারায় বিনয় আর সমীহের আলপনা কেটে তবে কথা বলেছে। বরং কনক মিত্তিরই সকলের দিকে তাকিয়ে থাকত-সোনালীর তো মনে হয় বিশেষ করে তার দিকেই, ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে। নাকি, দৃষ্টিতে নয়, যা কিছু ভঙ্গী ওর ওই বাঁকানো ঠোঁটের কোণাতেই। যে কোণাটায় আজ সকৌতুক বিষণ্ণতার আভাস।
কিন্তু এই তিন বছর সুখে ছিল না লোকটা, ভাবল সোনালী। সুখে থাকলৈ চেহারায় এমন বয়সের ছাপ পড়ে না।
.
ঠিক এই কথাই ভাবছিলেন মিসেস রাহাও।
যিনি নাকি এতক্ষণ ফিসফিস করে সুকান্তর রীত-চরিত্তিরের নিন্দে করছিলেন মিসেস ক্ষেত্রীর কাছে। বলছিলেন, মানুষকে বিশ্বাস করবেন না মিসেস ক্ষেত্ৰী। বরং বিশ্বাস করবেন সাপকে, বাঘকে, বিছেকে। ওই সুকান্ত সিদ্ধান্তর সত্যিকার চেহারা যদি আপনার কাছে খুলে ধরি, ঠিক আপনি সেন্সলেস হয়ে যাবেন। অথচ দেখুন বাইরে কী সুন্দর অমায়িক মার্জিত সভ্য। কিন্তু রুচি? থাক সে কথা। কি বলছেন? আমি আগে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতাম? মিশতাম বৈকি। আমার সরল মন, সহজ ভাবেই সকলকে বন্ধু বলে গ্রহণ করি। আর লোকের স্বরূপ চিনে ফেলি তাতেই ঘনিষ্ঠ ভাবে না মিশলে কী করে টের পেতাম বলুন মিস্টার সিদ্ধান্তর প্রকৃতি কি?
মিসেস ক্ষেত্রী প্রতিবাদে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় সামনের জানলার ওই নীচেটায় লোকটা এসে বসল। যার ভাঁজহীন ট্রাউজার, বোতামবিহীন বুশ কোট, পালিশছাড়া চপ্পল আর হাতে ধরা ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার এটাচি কেসটা ঘরের সমস্ত শৌখিন পরিবেশকে যেন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।
তারপর পরিবেশ সমেত সমস্ত মানুষগুলো পাথর বনে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে।
কনক মিত্তির না?…ওকে কে ডাকল?
…এতদিন ছিল কোথায়?
তারপর থেকেই ভাবছেন মিসেস রাহা, সুখে ছিল না। সুখে থাকতে পারে না। সুখে থাকলে কখনও এই দু-তিন বছরে বুড়িয়ে যায় মানুষ? ভাবছেন–তবু উঁটটি বজায় আছে ষোল আনা। তাকিয়ে আছে দেখ, যেন কোন্ স্বর্গলোক থেকে তুচ্ছ এই মর্ত্যলোককে করুণাকটাক্ষ বিতরণ করছে!
মুশকিল! কাকে জিজ্ঞেস করা যায়, কার নেমন্তন্নে এখানে এসে মাথা গলিয়েছে ও। সেদিনের কথা এক্ষুনি ভুলে গেল কে!
.
মিস্টার রাহা ভাবছিলেন অন্যকথা।
ভাবছিলেন, সত্যিই কি লোকটা সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়ক? ওর মুখ দেখে কি সে কথা বিশ্বাস হয়? অবশ্য ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়করা প্রায়শই পাকা অভিনেতা হয়, সমস্ত বিদেশী নভেলে তো এই কথাই বলে। তবু ওই বিষণ্ণ কৌতুকমণ্ডিত মুখটায় যেন এমন একটা কিছু রয়েছে, যাতে বিশ্বাস করা শক্ত–লোকটা অপরাধী।
তাছাড়া অপরাধী হলে কোন সাহসের বশে ও আজ এই ভোজসভায় এত লোকের সামনে এসে হাজির হয়েছে? আশ্চর্য, পুলিসের ভয়ও কি নেই লোকটার? কিন্তু নেই-ই বা বলা যায় কি করে? না থাকলে এই তিন বছর নিরুদ্দেশ হয়েছিল কেন? অনুতাপে দগ্ধ হয়ে হয়ে আত্মসমর্পণ করতে এল নাকি আজ?
দেখা যাক শেষ পর্যন্ত।
মনে হচ্ছে আজ মজাটা জমবে ভাল।
.
অশোকের নতুন বৌ এক সময় ইশারায় বরকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, বল কি? সত্যি? এই সেই লোক? কিন্তু আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মুখ দেখে
মুখ দেখে চরিত্র-নির্ণয়ের ক্ষমতা রাখ বুঝি? অশোক হেসে বলে, আমিই যে কোন সাংঘাতিক ঘটনার নায়ক নই, কে বলতে পারে?
নও একথা অন্তত আমি বলি না, বৌ-ও হাসে, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ডাকাতি করে মেয়ে-চুরির নজীর আমার জানা। কিন্তু বল দিকি, ওই কনক মিত্তির না কি ওর সত্যি ব্যাপারটা কি?
আহা, সে তো বলেইছি তোমায়। নতুন আর কি বলব। নতুনের মধ্যে আজ ওঁর আবির্ভাব।
কে ডেকেছে?
আর কে ডাকতে পারে বল, কাকীমা ছাড়া?
কাকাবাবু চুপ করে আছেন কেন তাহলে?
বোধ করি এত লোকের মাঝখানে আর সীন ক্রিয়েট করতে চান না।
তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস কর না সোজাসুজি।
জিজ্ঞেস করব? কাকে জিজ্ঞেস করব?
কেন, ওই ওঁকে।
ওঁকে জিজ্ঞেস করব? কি জিজ্ঞেস করব বল তো?
স্পষ্ট জানতে চাইবে, আপনাকে আজ এখানে ডাকল কে।
মাথার চিকিৎসা করা দরকার তোমার।
কেন, খুব একটা অযৌক্তিক কথা হল?
সম্পূর্ণ।
বেশ, তবে কাকীমাকেই জিজ্ঞেস কর না।
নাঃ! হেসে ওঠে অশোক, চিকিৎসায় কোন কাজ হবে বলে আশা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ডাকাতি করে আনা রত্নটিকে পাগলা গারদে উৎসর্গ করতে হবে মনে হচ্ছে।
ঈস্! কেন? এত ভয়টা কিসের শুনি? কাকীমাকে যে কেন এত ভয় কর তুমি! এক বাড়িতে থাকলে তো বোধহয় আমার জীবন মহানিশা করে তুলত। দূরে থেকেই এই! অথচ উনি তোমার থেকে এমন কিছু বড় না।
এমন কিছু বড় নয় বলেই তো! অনেকখানি বড় হলে বরং কিছুটা সাহসের প্রশ্রয় থাকে। এদিকে কাকা বেশ বড়। কিন্তু চল, ওদিকে সবাই কি ভাবছে।
যাচ্ছি। কাকীমার মেয়েটি যে একেবারে আহ্লাদী-মার্কা হাঁদা। কিছু যে জেনে নেব ওর কাছ থেকে তার উপায় নেই। যা জিজ্ঞেস করব, ঠিক বলবে, কি জানি–মা জানেন।
ওঃ, কাবেরীর কথা বলছ? ও তো ছেলেবেলা থেকেই অমনি। নিজের কোন বুদ্ধি নেই। কাকীমা যেদিকে চালান সেদিকে চলে, যা বোঝান তাই বোঝে।
উঁহু, আরও আছে। যা খাওয়ান তাই খায়, যা পরান তাই পরে। যা ভাবান তাই ভাবে, যা দেখান তাই দেখে।
ইডিয়ট আর কি।
ওই রকম বাপ-মায়ের কী করেই যে এরকম মেয়ে হয়।
বলতে গেলে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তির দাপটে সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হতে পায় না। এমন কি স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও অনেক সময় এ দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অবিরত একজনের মতের প্রাবল্যে অপরজনের বুদ্ধিবৃত্তি আর চিন্তাশক্তি হ্রাস হতে থাকে।
এত স্বামী-স্ত্রী দেখলে কোথায়? জগতে দেখবার মধ্যে দেখেছ তো ওই কাকাকে আর কাকীমাকে।
কেন, এতগুলো বছর চোখ বুজে পৃথিবীতে বিচরণ করেছি বুঝি?
আমার তো তাই মনে হয়।
মনে হয়? সত্যি? তাহলে এ হেন রত্নটিকে কি করে চক্ষুগোচর হল?
আসলে রত্নই নয়। মুদিত চক্ষু একবার খুলেই যা দেখেছ, মোহিত হয়েছ।
হুঁ, তাই দেখছি। বড় ভুল হয়ে গেছে। আরও দেখে বেড়ানো উচিত ছিল।
ঈস, তাই বৈকি। আচ্ছা আমাদের মধ্যে প্রবল কে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যাব, এতবড় বোকা আমি নই। কিন্তু চল চল, ওঘরে চল।
আমি কিন্তু ঠিক করেছি, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করব।
পাগলামী করো না।
কেন, পাগলামী কিসের? আমি নতুন মানুষ, আগের কিছু দেখিনি, আগের কিছু জানিও না। অতএব কাছে গিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে বলব, আচ্ছা, আগে তো কই আপনাকে দেখিনি এখানে।
তারপর?
পরের কথা পরে।
এই, ওসবের কিছু করতে যেও না। আমার মনে হচ্ছে, আজকের ব্যাপারটা খুব একটা হালকা নয়। বাতাসে কিছু একটা যেন থম্ থম্ করছে। মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ আসছে।
.
পালিতের ভাগ্নী হেনা ভাবছিল, আমি সেদিন ছিলাম না। আমাকে সেদিন ডাকা হয়নি। আমি থাকলে হয়তো সেদিনের সব রহস্য ধরে ফেলতাম। কনক মিত্তিরকে তো আমি জানতাম। লোকমুখে পরে সব শুনেছি, কিন্তু আসল রহস্যটা ঠিক বুঝতে পারিনি। আর কেউ না জানুক আমি তো জানতাম, লোকটা মামীর পেয়ারের লোক। অথচ ব্যাপারটা ঘটল অদ্ভুত। সস্তাদরের নাটকের নাটকীয়তার মত একেবারে। সেদিনের সেই উৎসবে আমি আসিনি, কিন্তু তার কদিন আগেই যে সেই একদিন এসেছিলাম, সেদিন তো দেখেছিলাম ড্রইংরুম ছেড়ে পিছনের ওই ব্যালকনিতে গিয়ে গল্প করা হচ্ছে দুজনে।
না, আড়ি পাততে আমি যাইনি। সে প্রবৃত্তিও নেই আমার। ঈশ্বর করুন, কোনদিন যেন না হয়, সে প্রবৃত্তি। তবু আমি সেদিন ওদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলাম। হঠাৎই পেয়েছিলাম। নীচে চাকরদের কাছে শুনে এলাম মেমসাহেব বাড়িতেই উপস্থিত আছেন, কিন্তু উপরে উঠে দেখতে পেলাম না কোথাও। তাই না পিছনের ওই ব্যালকনির দিকে! সত্যি বলতে অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি ওদিককার ওই প্যাসেজটার কাছে, যেটায় নাকি তখন আলো জুলছিল না। হ্যাঁ, অন্ধকার সেই প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম কনক মিত্তিরকে কী যেন একটা ব্যাপার নিয়ে মিনতি করছেন মামী। কারণটা কি! অবাক হয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম কিছুটা দূরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে চাইছে ভদ্রলোক, কানপুর কানপুর শুনলাম মনে হল; মামী তাকে নিবৃত্ত করতে চাইছেন। যেন চাইছেন, তা অবশ্য বুঝতে বাকী রইল না আমার, আর বুঝে মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। মানি, মামার সঙ্গে ওঁর বয়সের তফাৎ অনেকটা, মনের মিল হওয়া হয়তো শক্ত, তবু
ওই তবুটা বুদ্ধি আর যুক্তির ধার ধারে না।
যাই হোক, মামীর সেই অভিমান আর অনুযোগের, মিনতি আর শাসনের মানেটা তো বুঝতে পারা শক্ত হয়নি, কিন্তু কাবেরীর জন্মদিনের ব্যাপারটা? ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাটা? তার মানে কে বুঝবে?
আমি উপস্থিত থাকলেই কি পারতাম?
শুনে প্রথমে তো আমি বিশ্বাসই করিনি। বলেছিলাম, এটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। বাইরের কোন লোক এসেই ওই দুঃসাহসিক কাজটা করে গেছে। তাক বুঝেই ছিল সে, জেনেছিল বাড়িতে একটা ভোজসভা আছে, বাড়ির লোক ওদিকে ব্যস্ত থাকবে, কাজেই শোবার ঘরগুলো থাকবে খালি পড়ে। দৈব যোগাযোগে ঠিক সেই সময় মামী গিয়ে পড়ায়–কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারিনি, মামী কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে খেতে বসেন নি, এটা কী করে হল?
কারণ শুনেছিলাম বটে, খেতে বসেন নি হঠাৎ শরীরটা অসুস্থ বোধ হচ্ছিল বলে। কিন্তু কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কি না তা ভেবেছি অনেকবার। মহোৎসাহে যিনি অতক্ষণ অত হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছিলেন! মানে, হেনা ঠিক সেদিন না দেখুক, আরও অনেক দিন তো দেখেছে। দেখেছে পার্টি দেওয়ায় মামীর কী অগাধ উৎসাহ। হেনাকে অবশ্য সাহায্য করতে ডাকেন না কখনও, তবে হেনা নিজে থেকে এগিয়ে এসে কিছু করলে খুব অমায়িক গলায় বলেন, এটা করে ফেলেছ? ভালই হল, একা হাতে এত ব্যবস্থা, মারা যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ কী, কি করে এমন মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে হেনা? এ যে একেবারে অচল। সত্যি হেনা, বুদ্ধিসুদ্ধি আর তোমার হবে না কোনদিন। তা, তোমারই বা দোষ কি দেব বল? ভাল পার্টি তো আর দেখছ না হামেসা। আমার এখানে এলেই যা।
মিসেস পালিতের সেই মারাত্মক ভুলটা হয়তো ফুলদানিটার একটু স্থানচ্যুতি, কি নুন আর মশলাডোর পাত্রগুলোর জায়গায় একটু হেরফের। হৈ চৈ করে সব কিছু ফের নিজে গোছাতে শুরু করেন মিসেস পালিত। যাঁর নিজস্ব নাম নাকি নর্মদা দেবী।
.
হেনা যখন নির্লিপ্তের মত উদাসীন মুখে বসে বসে এত কথা ভাবছিল, তখন মিস্টার পালিতও ভাবছিলেন, নর্মদা এতটা বোকামী না করলেও পারত। আজ এত লোকের মাঝখানে কী দরকার ছিল ওই হতভাগা লোকটাকে ডাকবার? কেলেঙ্কারী যা হবার তার তো চূড়ান্ত হয়েছে, তবু যা হোক পাঁচ জনে আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছিল সব কিছু, আর নর্মদাও নূতন উৎসাহে কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মেতে কিছুটা ভুলে ছিল। হঠাৎ আবার নিভে যাওয়া ছাইকে খুঁচিয়ে আগুন বার করতে গেল কোন্ বুদ্ধিতে? আশ্চর্য! মেয়েগুলো কি এত নির্বোধও হয়! অথচ নিজেদেরকে কী বুদ্ধিমানই না ভাবে।
নাঃ, নর্মদার বুদ্ধিকে কিছুতেই প্রশংসা করা চলে না।
কিন্তু আরও আশ্চর্যজনক লোকটার নির্লজ্জ ধৃষ্টতা। এল কি বলে! এসে সভার মধ্যে বসল কি বলে! হাতেই বা এনেছে কি? পচা ওই অ্যাটাচিটায় কী থাকা সম্ভব? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? তাই সম্ভব। মানুষের ধৃষ্টতার তো সীমা থাকে না।
এখন বোঝা যাচ্ছে, নর্মদা এ-যাবৎ ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এসেছে, নইলে হঠাৎ ঠিকানা পাবে কি করে নিরুদ্দিষ্ট লোকটার। তবু মনে মনে মৃদু একটু হাসলেন মিস্টার পালিত, লোকটার ওপর আমার করুণাই হচ্ছে। আগেও অবশ্য হত, অসার এক ভালবাসার পাত্রীর মোহে অমন একটা বিদ্বান বুদ্ধিমান ছেলে কিভাবে নিজের কেরিয়ারটা নষ্ট করছে, আর মনে ভাবছে খুব জিতছি, এটা আমায় যেমন হাসাত তেমনিই করুণাও জাগাত। ওর বাবুয়ানার খরচা, ওর বাহারে সাজ-পোশাক কোথা থেকে আসে সে কথা যে আমার অজানা নয়, এটা ওর অজানা–এ দেখেও কৌতুকের শেষ ছিল না আমার। কিন্তু সেদিন? তিন বছর আগের সেই দিনটায় বরং একটু দুঃখই হয়েছিল ওর জন্যে। ওর এত ভালবাসা যদি সত্যিকার সারালো একটা মেয়ের ওপর পড়ত।
সত্যিকার সারালো! ভাবলেন মিস্টার পালিত, ধারে কাছে কোথায় বা পাবে দুর্লভ সেই বস্তু। হেনাকে একটু শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু হেনা নিজের দারিদ্রের অহঙ্কার আর দারিদ্রের কুণ্ঠায় দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আমি মামা–আমার সাহায্য নে না তুই, মা-বাপ মরা মেয়ে। তা নেবেন না। অথচ এই সব পার্টিতে আসতে সাজসজ্জায় যে প্রাচুর্য থাকা দরকার তার অভাব বলে সে সব জায়গায় আসতেই চান না বাবু। হ্যাঁ, বুকের পাটা থাকে তো পাঁচ টাকার শাড়ি পরে চলে আয় রাজসভায়। এ-ও নয়, ও-ও নয়। মেয়েটা আমাকে হতাশ করেছে।
আর, আমার ওই মেয়েটা!
আজ নাকি ষোল বছর পূর্ণ হল ওর।
লোকে বলে, এত সরল যে দশ বছরের বাচ্চা বলে মনে হয়। আমার কিন্তু মনে হয় না। আমি ওকে বুঝতে পারি না।
হ্যাঁ, আমার ওই ষোল বছরের মেয়েটাকে আমি বুঝতে পারি না।
আচ্ছা, কনক মিত্তিরকে গিয়ে কি আমি সরাসরি প্রশ্ন করব, কি খবর? এতদিন ছিলেন কোথায়? না কি মৃদু হেসে বলব, জাত গিয়ে পেট না ভরাটা ভারি লোকসান, না হে মিত্তির? না নর্মদাকেই একটু ভয় পাওয়াব?
.
কনক মিত্তির কি অনন্তকাল ধরে বসেছিল?
আর ঘরের সবাই অনন্তকাল ধরে তার কথা নিয়ে মনকে তোলপাড় করছিল? তা অবশ্য নয়। কিন্তু বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী যে কে, তার উত্তর তো দ্বাপরে স্বয়ং যুধিষ্ঠির দিয়ে গেছেন।
সময় খুব বেশি কাটেনি।
এতগুলো লোকের এত চিন্তা দৌড়চ্ছিল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
.
অন্য ঘরে বেশ কয়েকটি কিশোর-কিশোরী কাবেরীকে ঘিরে হৈ-হুল্লোড় করছিল। উপহারে পাওয়া কি একটা নতুন ধরনের খেলার সরঞ্জাম খুলে বসেছিল কাবেরী, ওরা খেলছিল। মাঝে মাঝে ওদের উল্লাসধ্বনি ভেসে আসছিল এ-ঘরে। ওরা আসেনি একবারও।
তবু কাবেরী জানে।
কাবেরী কখন কোন কাজে একবার এসেছিল এ ঘরে, কে জানে। কাবেরী অবাক হয়নি। কাবেরী কোন কিছুতেই অবাক হয় না। ও অদ্ভুত রকমের সরল। যা দেখে শুধু দেখেই চুপ হয়ে থাকে, স্থির হয়ে থাকে।
আজও চুপ হয়ে গিয়েছিল। নতুন খেলনাটা মেলে দিয়েছিল বন্ধুদের সামনে, আর সেই অবসরে ভাবছিল। কাবেরী নিজে কিছু ভাবে, ভাবতে পারে–একথা কেউ ভাবে না। সবাই জানে, মা যা ভাবায় তাই সে ভাবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক কথা? কাবেরী ভাবে বৈ কি। এই তো আজ ভাবছে। ভাবছে, আমার মন বলছে আজও একটা কিছু ঘটবে। সেদিনও আমার মন একথা বলেছিল। সেদিন উৎসব-আয়োজনের তলায় তলায় আর একটা কিসের যেন আয়োজন চলছিল।
তাই যখন মার ওই বন্ধু বলল, ট্রেন ধরতে হবে, খাবার সময় নেই, পালাই, আর মা ব্যস্ত হয়ে একটা প্লেটে করে সব কিছু ভাল ভাল জিনিস এনে ধরে দিল ওর হাতে, তখনই মনে। হয়েছিল আমার, এইবার সেই একটা কিছুর সূচনা দেখা দিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ট্রেনে চড়ে ও একা পালাবে না। আরও কেউ ওর সঙ্গী হবে।
কেন এমন কথা মনে হয়েছিল, তা জানি না। তবে তার কদিন আগে থেকে মার মধ্যে যে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস টের পাচ্ছিলাম সেটাই বোধহয় আমাকে এমন কথা ভাবিয়ে তুলেছিল। সেদিন যখন দেখলাম মা অতিথিদের সঙ্গে টেবিলে বসল না, বলল মাথা ঘুরছে, বলল শরীর খারাপ লাগছে, বলল অতিথিরা যেন কিছু মনে না করেন-মা মিনিট কয়েক বিশ্রাম করে নেবে, তখনই আমার সেই ধারণা বদ্ধমূল হল। ঠিক বুঝলাম, অতিথিদের খাওয়ার অবসরে মা পালাবে।
কথাটা বুঝে ফেলেই ভয়ানক একটা যন্ত্রণায় বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যেতে থাকল আমার। আর একটু আগেই আমরা ছোটরা খেয়েছি, আমার জন্মদিনের ভোজের ভাল ভাল সব রান্না, সেগুলো যেন পেটের মধ্য থেকে উঠে আসতে চাইল সব গায়ের মধ্যে মোচড় দিয়ে দিয়ে।
মা যে আমাকে ফেলে চলে যাবে এই কষ্টটাই শুধু নয়, ভয়ানক একটা ভয়ও তার সঙ্গে এসে জুটল। মনে হল, মা চলে গেছে এই খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি অবস্থা হবে আমাদের। আমার আর বাবার ওই সব অতিথিরা তখন কেমন করে মুচকে মুচকে হাসবে, আর কেমন করে আহা করে আমাদের সহানুভূতি জানাতে আসবে–সে কথা ভেবে চেঁচিয়ে কান্না পেল আমার।
আশ্চর্য! মা-র ওই বন্ধুকে ছোটবেলায় আমি কি ভালই না বাসতাম। ও এলে যেন আহ্বাদে নেচে উঠতাম। তার কারণ ছোট ছেলেদের মন ভোলাবার অনেক সব কায়দা ও জানত। মজার মজার কত যে গল্পের স্টক ছিল ওর। আর ও এলেই এত সুন্দর হয়ে উঠত মা। ছোটবেলায় সেই সুন্দর মা, আর সেই সুন্দর হয়ে ওঠার কারণস্বরূপ মানুষটা, দুজনকেই তাই ভীষণ ভাল লাগত।
কিন্তু একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনটা একেবারে উল্টো হয়ে গেল। মনের এই বদলে নিজেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। মা-র ওই বন্ধুকে দেখলেই রাগে সমস্ত শরীর জ্বালা করে উঠতে আরম্ভ করল, আর ওকে দেখে মা-র সেই সুন্দর হয়ে ওঠাটা বিষ লাগতে লাগল। কিন্তু এসব কিছু প্রকাশ করার উপায় ছিল না আমার। আমাকে সরল থাকতে হবে, বাচ্চা মেয়ে থাকতে হবে। আমাদের বয়সের মেয়েদের তাই নাকি নিয়ম। তাদের বুদ্ধির প্রকাশ ধরা পড়লেই সেটা নাকি নিন্দনীয় পাকামী। আমার বয়সী অন্য যে সব মেয়েরা সাধারণ, বয়সের উপযুক্ত বুদ্ধিমতী, মা তাদের দেখতে পারে না। বলে, ওরা অকালপক্ক। আমি আদর্শ বেবি। আমি অবোধ। অবিশ্যি লেখাপড়ায় দস্তুরমত বুদ্ধি সুদ্ধি থাকা চাই। সে না থাকলে আবার মা-র মুখ থাকে না।
বাধ্য হয়ে আমাকে তাই কিম্ভুতকিমাকার আদর্শ বেবি হয়ে থাকতে হয়েছে! বছর বছর স্কুলে ফাস্ট হই, নির্বিচারে দেখি-বিদেশী সাহিত্য গিলি, লুকিয়ে প্রেমের কবিতা লিখি, আর বিশ্ব সংসারের সব কিছুতে অনভিজ্ঞ আহ্লাদে খুকীর অভিনয় করে চলি। লোকে বলে, মেয়েটা একেবারে বাচ্চা!
তবু মা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে।
মা যখন আমার গানের মাস্টারমশায়ের সঙ্গে নাচতে নাচতে জলসা শুনতে যায়, তখন আমি যদি মা-র সঙ্গে যাবার জন্যে খুকীমাফিক বায়না ধরি, তা হলে মা কেমন ঝাল ঝাল তেতো তেতো চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে, তুমি আবার কি যাবে! রাত হয়ে যাবে, ঠাণ্ডা লাগবে না?
অগত্যাই আমাকে মায়ের সন্দেহ ঘোচাবার জন্যে আরও খুকী হতে হয়। আঁ আঁ করে কেঁদে ফেলতে হয়, বারে, আমার বুঝি একা বাড়িতে খারাপ লাগে না?
অবিশ্যি একথা জানি, গানের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এত মেশামেশি মা করে, সে শুধু মনের শূন্যতার পূরণ করতে। মা-র ওই বন্ধু চলে গিয়ে পর্যন্ত মন সব সময় খাঁ খাঁ করে। বুঝতে পারি, কিন্তু ভাল লাগে না। মনে হয় ঐ খাঁ খাঁ করাটা খারাপ।
তবু মা-র ওই বন্ধুকে আমি ভক্তি করেছিলাম, ওর চলে যাওয়াটাই এই ভক্তির কারণ। ভাবতাম, ভয়ঙ্কর একটা বিপদকে যেন ও সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে। উঃ, কি বিপদই হত যদি সেদিন ও একা না যেত!
অবিশ্যি অনেক কিছু জিনিস নিয়ে গেছে ও। তা যাক্, সব নিয়ে যাক ও। শুধু আমাদের মানসম্ভ্রম যে নিয়ে যায়নি, এর জন্যেই আমি ওর উপর কৃতজ্ঞ। আবার এল কেন? কে ডাকল ওকে? নিশ্চয় মা। তাছাড়া আর কে। কিন্তু ওকি ওর ভয়ঙ্কর অপরাধটা অস্বীকার করবে? বলবে–আগে ভাগে খেয়ে ও তো ট্রেন ধরতে চলে গিয়েছিল। তার পর কি ঘটে গেছে কিছুই জানে না। এত দিন যে আসেনি তার কারণ অন্য। হয়তো সেই কারণ নিয়ে এমন গল্প ফঁদবে যে সবাই ভাববে, ছি ছি, এতদিন কী ভুল ধারণাই না করে এসেছি আমরা! বাবা ভাববে, ছি ছি, তাইতো। ভারি অন্যায় হয়ে হয়ে গেছে তো পুলিসে খবর না দিয়ে।
কিন্তু তাই কি? ওর মুখটা যেন বদলে গেছে।
মনে হচ্ছে, ও আর কোন গল্প ফাঁদবে না। এ বাড়িতে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার বাসনা আর নেই ওর।
কিন্তু যদি থাকে? তখনও কি আমি আদর্শ বেবি সেজে বসে থাকব? জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠব না না, মোটেই ও সেদিন তখুনি ট্রেন ধরতে যায়নি। বলে দেব না–আমি সব ঘটনা জানি, আমি ছাতের সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ভেন্টিলেটারে চোখ রেখে সব দেখেছিলাম? পারব কি?
সে সাহস কি আমার আছে?
এতগুলো লোকের চোখের সামনে হঠাৎ আমার এই বাচ্চা মেয়ের খোলশটা খুলে ফেলে স্বরূপ প্রকাশিত হবার সাহস? না না, পারব না বোধহয়। অনবরত মাকে ভয় করে করে আমার মেরুদণ্ডে জোর নেই।
সেদিনের মত আমার আজকের জন্মদিনটাও বোধহয় মাটি হবে। ওই লোকটা যেন আমার শনি।
.
সবাই এত কথা ভাবছিল, তবু সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি কাজও চলছিল। চাকর-বাকরদের কাজ চাকর-বাকররা করছিল, গিন্নীর কাজ গিন্নী। অর্থাৎ, তখনও মার্কেট চষে বেড়াচ্ছিলেন মিসেস পালিত। বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতদের ডাকলে, মহামুহূর্তে একবার মার্কেট ঘুরে আসতে যাওয়া মিসেস পালিতের চিরাচরিত রীতি। যাওয়ার কারণটা আবশ্যকীয় বা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক যাই হোক। এমনও হতে পারে ফুলদানিতে ফুল কিছু কম দেখাচ্ছে বলে চট করে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মহিলা।
ফিরবেন হাঁপাতে হাঁপাতে, অতিথিদের সামনে চেয়ারে এলিয়ে বসে পড়বেন, কিছুক্ষণ হাওয়া খাবেন, আর তিনি যেটি না দেখবেন, সেটিই যে একেবারে মার্ডার কেস হয়ে বসে থাকবে এই তথ্যটি পরিবেশন করবেন প্রায় কেঁদে, আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সবাইকে ধরে ধরে জানাবেন–তার স্বামীটি কিছু না। তারপর ভয়ঙ্কর রকম ক্লান্ত আর দুর্বলের ভূমিকা নিয়ে সহানুভূতি কুড়োবেন অতিথিদের। সকলে ওঁকে বলবে, থাক থাক, তুমি উঠো না; থাক থাক, আপনি খাটবেন না, আর উনি যেন মরে মরে, তা কি হয় বলে উঠবেন, খাটবেন।
এই এক নেশা মিসেস পালিতের। সবাই ওঁকে আহা আহা করুক।
আজও তাই খানিক আগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর সময়ের স্রোত যেন . নিথর হয়ে পড়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।
.
শুধু চারিদিকে চাপা ফিস ফিস গুনগুন। সে গুঞ্জনধ্বনি দাসীচাকর মহলেও উঠেছে।
রাতদিনের ঝি কানন মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমরা দাসী-বাঁদী, মনিবের ঘরের কথায় থাকবার দরকার নেই, তবু বলি-যে লোকটা অমন কাণ্ড করে গেল, তাকেই আবার আদর করে ডেকে আনতে প্রবৃত্তি হল! এই দু বছরেই সব বিস্মরণ!
বাসন-মাজা ঝি সুখদা বলে, তুমি তো বললে কাননদি সেকাজ ওই বাবুটাই করেছে; কিন্তু এ-ও বলি, গিন্নীর সঙ্গে যার এত আসনাই, এত দিনের এত ভালবাসা, সে কখনও তা করতে পারে?
তুই থাম, কানন ঝঙ্কার দেয়, বলে মন্দিরের পূজুরী পুরুত আজন্ম বিগ্রহসেবা করে সে বিগ্রহের গয়না চুরি করে পালায়, আর এ তো পরস্ত্রীর আসক্তি। কর্তা যে কি করে সহ্য করে তাই ভাবি।
বড়মানুষ তমন সহ্য করে থাকে। না করে গতি কি? সেকালে রাজা-জমিদারের ঘরে পরিবারদের সোয়ামীদের বেচাল সহ্য করতে হত, একালে সাহেব সুবোদের ঘরে সোয়ামীদেরই পরিবারের বেচাল সহ্য করতে হয়। সহ্য না করে চেঁচামেচি করলেই তো লোকজানাজানি। আপনার মুখে আপনিই চুনকালি মাখানো।
কিন্তু আদর-সোহাগেও তো কমতি দেখি না কিছু। একটু মাথা ধরল তো ডাক্তার এনে হাজির করল। একটু রান্নাঘরে এল তো মাথা ধরবে বলে বকাবকি। তার ওপর তোমার গে, গয়নার ওপর গয়না, শাড়ির ওপর শাড়ি।
ধন্যি কপালখানা বটে!
.
এমনি আলোচনার গুঞ্জনের মাঝখানে বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। পরিচিত শব্দ। অতএব বোঝা গেল গিন্নী ফিরলেন।
নিথর সমুদ্রে ঢিল পড়ল।
অস্ফুট একটা ধ্বনি উঠল, মিসেস পালিত এলেন।
সকলেই যেন নতুন করে নড়ে-চড়ে বসল। সেই অবাঞ্ছিত অতিথিও।
হাতের সেই অ্যাটাচি-কেসটা একটু যেন বিশেষ করে বাগিয়ে ধরল, আর একটু যেন খাড়া। হয়ে বসল।
মিসেস পালিত যথারীতি হাঁপাতে হাঁপাতে একগোছা চামচ হাতে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিলেন, হঠাৎ মিস্টার পালিত সামনে দাঁড়ালেন; গম্ভীরভাবে বললেন, ও-ঘরে নয়, এ-ঘরে।
কেন, এ-ঘরে কি? ভুরু কোচকালেন মিসেস পালিত।
দরকার আছে।
থাম। রাখ তোমার দরকার। আমি বলে এখন মরছি।
পাগল হয়েছ! অমন অমঙ্গলের কথা বলতে আছে! এখুনি মরবার কি হয়েছে? না না, ওদিকে না এদিকে।
কি আশ্চর্য! তোমার কি এখন রঙ্গ-তামাসা করবার সময় হল? অতিথিরা বসে রয়েছেন।
থাক না। বসে যখন রয়েছেন, আর কিছুক্ষণ না হয় থাকলেন। আমার কথাটা হয়ে যাক।
মিসেস পালিত বিরক্ত আর বিচলিত স্বরে বলেন, তা অত গৌরচন্দ্রিকার দরকার কি? যা বলবার বলে ফেল।
উঁহু–এখানে নয়, ওদিকে।
আশ্চর্য! এরকম ঢঙের মানে? তোমার দরকারী কথা থাক, যেতে দাও আমাকে!
যাবে যাবে। যার জন্যে এত ব্যস্ততা সে ঠিকই এসে গেছে। কিন্তু নর্মদা, ভাবছি তোমরা মেয়েরা এত বোকা হও কেন? আজ এতলোকের মাঝখানে ওকে ডাকবার হেতু কি? বেশ নিরালায় একদিন ডাকলেই তো
কি বকছ বাজে-বাজে? কাকে ডেকেছি?
ওঃ, বুঝতে পারছ না বুঝি? আমি বলছিলাম মিস্টার মিত্তিরের কথা। শ্রীকনক চন্দ্র মি—
তার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?
আহা-হা, অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উত্তেজিত হবার কি আছে? আমি শুধু একটি নিরীহ প্রশ্ন করছিলাম। বলছিলাম, ওর সঙ্গে যে এ-যাবৎ যোগাযোগ রেখেছিলে সে খবরটা যখন এতদিন চেপে রেখেছিলে, তখন আজ হঠাৎ
তোমার এইসব অর্থহীন কথা শোনার মত প্রচুর সময় আমার নেই! বলে ঠিকরে ও-ঘরে গিয়ে পড়েন নর্মদা। আর গিয়ে পড়েই সহসা যেন পাথর হয়ে যান।
কে? কে? কে এখানে?
এই যে শ্রীমতী নর্মদা দেবী! আমন্ত্রিত অতিথিদের ফেলে এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?
কনক মিত্তির উঠে দাঁড়ায়। বিনয় নমস্কারের ভঙ্গিতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে।
রান্নাঘরের চাকর নতুন বেহারার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, তুই তার কি জানিস! আমি এদের হাড়হদ্দ সব জানি, সব দেখেছি। আজকে তত আসি নি এ বাড়িতে! সেদিন ওই বাবুটাকে পিছনের ওই ঘুরনো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল কে? এই আমি, বুঝলি? অবাক। হয়ে হাঁ করে দেখেছি–মানুষটা ট্রেন ধরবে বলে মেমসাহেব তাড়া দিয়ে আগে-ভাগে ওর জন্যে ফ্রাই কাটলেট সব ভাজিয়ে নিয়ে গেল, অথচ এতক্ষণ ও রইল কেন? তারপর থালা থালা চপ কাটলেট-ফ্রাই ভাজলাম, সব ভস্মকীটেদের পেটে ঢুকে গেল, দুখানা রইল না আমাদের জন্য। হাঁড়ি-ভর্তি মাংস-পোলাও সব পাচার হয়ে গেল, ও কোথায় ছিল? কি করছিল? আর রইলই যদি, সামনের সিঁড়ি দিয়ে না গিয়ে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে কেন, আর হাতেই বা কি ওর? কি বলছিস? আসলে লোকটা এ বাড়ির কে? ও কথাটা জিজ্ঞেস করিস না, ওইটি বলতে পারব না। সব জানি, ওইটি জানি না। হা! কি বলছিলাম, হাঁ করে ভাবছি, স্বপ্নেও জানি না ওকে চেপে ধরে চেঁচালে ভাল হত, হঠাৎ শুনি ভেতর বাড়িতে হৈ-হৈ। পড়ি তো মরি করে ছুটে গিয়ে দেখি মেমসাহেব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে, ঘরে অজ্ঞানের ওষুধের বিটকেল-বিটকেল গন্ধ আর মেমসাহেবের লোহার আলমারির পাল্লা দুহাট করে খোলা।
বুঝতে দেরি হল না এ ঘটনার কর্তা কে। আর পালাবার সময় হাতেই বা কি ছিল ওর! আর কিছু নয়, ছোট একটা সুটকেস। তার মধ্যে করেই মেমসাহেবের যথাসর্বস্ব নিয়ে গেছে। উঃ, কম গয়না ছিল মেমসাহেবের! আর সবই হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্নার। গিন্নীর তাবন্ত জন্মদিনে, তারপর তোমার গে, নতুন বছরে, পূজোর সময় একখানা করে গয়না বরাদ্দ ছিল তো কর্তার। গিন্নী বলত, এবার আমায় সোনার গয়না দিতে হবে। কর্তা বলত, সোনা! ও কি আর ভদ্রলোকে পরে? গাঁইয়ারা পরে। জড়োয়াই আসল ভাল।
তা সত্যি, কথাটা মিথ্যে নয়।
গিন্নী যখন কোথাও যেত যা ঝকমকাত, যেন মহারাণীর মত!
সেই সমস্ত গয়না নিয়ে গেল বাবুটা?
হ্যাঁ, এতদিনের এত চেনা-জানা, এত খাওয়া-মাখা, এই তার প্রতিদান! ছোটলোকরাই নাকি ছোটলোক নেমকহারাম। হু! কি বলছিস? বলে দেওয়ার কথা কি বলছিস?
বলছি, বাবুটার কথা সবাইকে বলে দিলি না?
আরে বাবা, তখন আমার মধ্যে বুদ্ধির জিলিপি খেলে গেছে। বলি, আমি চাকর-নফর মানুষ, আমার অত বাহাদুরী দেখাবার কি দরকার? শেষকালে আমাকে নিয়েই টানাটানি করুক আর কি। যত দোষ নন্দ ঘোষ তো এই চাকর-বাকররা। ভদ্দরলোকে যত কাণ্ড করছে, সব ধামাচাপা। জাহির হতে এই ছোটলোকদের দোষ ঘটে। কাজ কি আমার সত্যিকথা প্রকাশ করায়? চোখ দেখল, মন জানল, চুকে গেল ল্যাঠা। মুখ যদি বলে ফেলল, তাহলেই তো খাল কেটে কুমীর আনা!
তা ধম্মের কল বাতাসেই নড়ল। দেখবি ত দে গিন্নীর ভগ্নিপতিই দেখল। ডাক্তার মানুষ কাজে আটকা পড়ে সময়ে আসতে পারে নি, পরে আসছিল, গেটে ঢুকতে গিয়ে দেখেছে মিত্তিরবাবু একটা ছোট সুটকেস হাতে করে চোরের মতন পালাচ্ছে। চেনা-জানা তো আছে, তবু যেন চিনতেই পারল না। সেই কথাই বলল ডাক্তার ভগ্নীপতি। তা যাই এসে পড়েছিল তাই মেমসাহেবের সময়ে অজ্ঞান ভাঙল, নইলে আরও যে কী হত!
অবিশ্যি জ্ঞান ফিরেই মেমসাহেব কেঁদে কেঁদে এই কথাই বলল, কে এমন কাজ করল টেরই পায়নি সে। মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে বলে, একটু জিরিয়ে নিতে এসেছিল, হঠাৎ পেছন থেকে ওষুধের রুমাল নাকে ঠেকিয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে কোমরে গোঁজা চাবির তোড়া খুলে নিয়ে এই কাজ করেছে।
কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ও জামাইবাবু, আমার কতদিনের কত স্মৃতি মাখানো কতটাকার গয়না। সব গেল। কে এমন কাজ করল। চারিদিকে লোকের ভীড়, তার মধ্যে এত সাহস কার হল!
মেসোমশাই গম্ভীর মুখে বলল, কার সাহস হল তা আমি জানি। নিজের চক্ষে দেখেছি। ভীড়ের মধ্যেই তো সাহস। কার দোষ কার ঘাড়ে চাপে। বলল, অত চালিয়াৎদের এই অবস্থাই ঘটে। তারা চালবাজীর খরচ জোগাতে বাপের বাক্স ভাঙে, লক্ষ্মীর কৌটোয় হাত দেয়। তোমাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে ওই চালিয়াৎ কনক মিত্তির।
মেমসাহেব অবিশ্যি রেগে আগুন হয়ে বলেছিল, এ হতে পারে না! কিন্তু হতে যদি পারে না তো মানুষটা ফেরার হল কেন? বিদেশে চাকরি করতেই যদি গিয়ে থাকে, চিঠি তো দেবে? যাদের সঙ্গে এত ভালবাসা! পৃথিবী উল্টে গেলেও তো নিত্য দিন আসার কামাই ছিল না। আমাদের আর বলবার কি আছে? বড়লোকের বাড়ির চাকর চোখ থাকতেও কানা, স্বর থাকতেও বোবা। এই চা, এই কফি, হুকুম আসে তামিল করি, ব্যস।
কিন্তু জগৎ সংসার তো আর কানাও নয় বোবাও নয়। তারা বলল পুলিসে হুলিয়া কর। সাহেব বললেন, থাক, লোক জানাজানিতে দরকার নেই–যতই হোক এতদিনের বন্ধুলোক।
আসল কথা ঘরের কথা জানাজানির ভয়। ওরা অবিশ্যি ভাবে, কেউ কিছু জানে না, কেউ কিছু বোঝে না, বুঝলি নিধু? মনে করে চাকর বাকর ক্লাস সব নীরেট গাধা। আরে বাবা, যে যতই গবেট গাধাই হোক, আর কিছু না বুঝুক, মেয়ে-পুরুষের ভাবভালবাসার খবর ঠিক বোঝে। মরুক গে যাক। তবে একথা বলব, মিত্তিরবাবু লোকটা খুব খারাপ ছিল না। তবে নাকি মেয়েছেলের কবলে পড়লে মুনি-ঋষিরও মতিচ্ছন্ন ঘটে, তা এ তো তুচ্ছ মানুষ। ওই ধিক্কারে বিয়ে করিনি বুঝলি নিধু? বিয়ে করলে তো আর আমাতে আমি থাকব না।
বুকের বল থাকলে থাকবি না কেন শুনি? শুনবি কেন মেয়ে ছেলের কথা?
তুই আর হাসাস নে নিধু। তিন-ভুবনে যা হয়ে আসছে, আমার জন্যে তা পাল্টাবে? তবে হ্যাঁ, পরস্ত্রীর পোষা বাঁদর হওয়ার চাইতে নিজের বিয়ে করা পরিবারের কেনা গোলাম হওয়াও ভাল। আমি তো এই বুঝি!
নিধুকে আর বেশি ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠে না, নিধু ছুটে চলে যায় দোতলা থেকে ডাক পেয়ে।
জল চাই! জল!
মেমসাহেব মূর্ছা গেছেন।
.
তাক বুঝে মূর্ছা যেতে পারলে সংসারের অনেক অসুবিধেজনক অবস্থার হাত এড়ানো যায়। নীলাঞ্জনা বলে বীথিকাকে। হিসেব মত যে মহিলা দুটি নাকি নর্মদার বান্ধবী।
কিন্তু বান্ধবী বলে যে আড়ালে সমালোচনা করবে না, এমন ভাববার কোন হেতু নেই। মেয়েদের স্বধর্ম সমালোচনা। এতে তাদের স্বাভাবিক পটুত্ব। একমাত্র আত্মসমালোচনা বাদে আর কার না সমালোচনা করে তারা?
গুরুর করে না? ইষ্টের করে না?
বীথিকা নাক কুঁচকে বলে, তা যা বলেছিস! কিন্তু ওই পতন ও মূৰ্ছা, এ তো সেকেলে হয়ে গেছে
হুঁ! আর সেই হাত-পা মাথা বাঁচিয়ে কায়দা করে ঢলে পড়া। আমার বিশ্বাস হাতের কাছে ডানলোপিলো দেওয়া ওই ডিভানটা না থাকলে নির্ঘাৎ, ও পিছু হঠতে হঠতে, সুবিধে-মাফিক জায়গা বেছে নিয়ে তবে পড়ত।
মনে করে সবাই ওর অভিনয়ে ভোলে। নেহাৎ নাকি চুপ করে থাকা।
ওই তো মজা। তুমি ভদ্রতার দায়ে চুপ করে থাক, যারা নিজেকে ভারি বুদ্ধিমান ভাবে, তারা ভাববে তুমি বোকা।
কিন্তু আমি শুধু ভাবছি মিস্টার পালিতের সহ্যশক্তির কথা। কি করে এই অভিনয়, এই ন্যাকামী আর এই যথেচ্ছাচার সহ্য করে আসছেন।
কি করবেন, ওই ভদ্রতার দায়।
তা বাপু আকুলি-বিকুলিও তো কম না। স্ত্রীর মূৰ্ছায় ব্যস্ততার বহরটা দেখলি তো?
ওর সবটাই খাঁটি ভেবেছিস!! তিনভাগ শো, বুঝেছিস?
আরে বাবা, আমার মতে এই চর্মচক্ষে যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় সেটাই খাঁটি। হৃদয়ের গভীর গুহায় কী আছে তা কে দেখতে যাচ্ছে? আর দেখতে যাওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ? সেখানে কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরোবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু ভদ্রলোকের জীবন কী দুর্বহ!
আহা, বিগলিত হচ্ছিস যে একেবারে। জীবনটা সুবহ করে তোলার ভার নিয়ে দেখবি নাকি?
থাক, ঢের হয়েছে। চল, ভিতরে গিয়ে বসি। দেখি আরও কি তামাশা হয়!
বান্ধবীকৃত্য সমাপন করে, মহিলা দুটি বারান্দা থেকে ফের ঘরে গিয়ে বসেন।
এই নিয়ে তিনবার তাদের জায়গা বদলাবদলি।
ওরা অনেক বাজে কথা বলে, তবে মাঝে-মাঝে কিছু সত্যি কথাও বলে। তাক বুঝে মূৰ্ছা যেতে পারলে জগৎ-সংসারের অনেক ঝড়-ঝাপটার হাত এড়ানো যায় বৈকি।
এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে নর্মদাকে কে রক্ষা করত ওই মূৰ্ছা ছাড়া?
এই মূৰ্ছার অবসরে, জগৎ-সংসারের চোখের সামনে থেকে চোখটা বুজে থাকার অবসরে আকাশ-পাতাল কত কথাই ভাবতে পারছেন নর্মদা।
ভাবছেন, আর ঘরে যে কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে তাকে অজ্ঞান-অচৈতন্য ভেবে, সেগুলো শুনেছেন শ্রবণশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে।
.
ঠিক যে মুহূর্তে মূর্ছা গেলেন নর্মদা, ভয়ঙ্কর একটা হৈ-চৈ উঠল। প্রায় সেই তিন বছর আগের মতই। তবে এটা থেমে গেল তাড়াতাড়ি। সেদিনকার ঘটনা ছিল আলাদা। সেদিন মূৰ্ছাটা ছিল গৌণ। কাজেই ঘরে একটা উগ্র ওষুধ-মাখা রুমাল পড়ে থাকলেই ঘরে থাকা মানুষটার একেবারে জ্ঞান-চৈতন্য হারিয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। উত্তেজনার কারণ রয়েছে অন্যত্র। সেদিনের মুখ্য ব্যাপার ছিল দু-হাট করে পাল্লা-খোলা গডরেজের আলমারিটা।
মিস্টার পালিতের অনেক আদরের আর অনেক ধনবত্তার সাক্ষ্য নর্মদার জড়োয়ার গয়নাগুলি থাকত যে আলমারিতে।
চোখ বুজে সেদিনের সমস্ত ছবিটা আগাগোড়া ভাবতে লাগলেন নর্মদা, সিনেমার ফ্লাশ ব্যাকের মত।
নিমন্ত্রিতেরা খেতে বসেছে, নর্মদা উঠে গেলেন ক্ষমা চেয়ে আর দুঃখ জানিয়ে। বললেন, অসম্ভব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, একটু শুয়ে না নিলে
হ্যাঁ, একটু শুয়ে নেবার জন্যে নিজের শোবার ঘরে চলে এলেন নর্মদা। চাকর-বাকররা সকলেই ওদিকে কাজে ব্যস্ত, এ তল্লাটে কেউ নেই। এদিকটা নির্জন।
অতএব ঘরের আলো নিভিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেওয়া যায়। কমিয়ে নেওয়া যায় মাথার যন্ত্রণা। কিন্তু ঘর তো অন্ধকারই ছিল। নর্মদা ঘরে ঢুকতেই একটা মৃদুকণ্ঠ অসহিষ্ণু হয়ে বেজে উঠল, আমায় কেন আটকে রাখলে? এ ট্রেনটা বোধকরি আর ধরা হল না–
এ ট্রেন ধরতে হবে না। সামান্য ওই চাকরিটার জন্যে অতদূরে চলে যেতে তোমায় দেব না আমি। নিজের গলার সেই চাপা ফিসফিস শব্দটা যেন এখন আবার নতুন করে শুনতে পাচ্ছেন নর্মদা। তুমি কি জান না, তোমায় না দেখতে পেলে আমি মরে যাই?
কিন্তু কতদিন আর এমন করে তোমায় ভাঙিয়ে চলবে নর্মদা? নিজের উপর ঘৃণা আসছে। তোমার টাকায় পোশাক কিনে সেজে তোমার বাড়িতে বাহার দিই, তোমার দেওয়া টাকায় তোমাকে উপহার কিনে দিয়ে লোকের কাছে মুখ রাখি, এ জীবন আর ভাল লাগছে না।
জানি জানি, আমি টের পেয়েছি তোমার আর ভাল লাগছে না। কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচব কনক? দেখেছ তো আমার ঘর, আমার সংসার? কিন্তু বেশি কথা বলবার সময় আর নেই, ওরা ওঠবার আগে পালাতে হবে তোমায়। ওরা জানে তুমি চলে গেছ, এতক্ষণে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছ। এই নাও, এগুলো নিয়ে যাও। অনেক গহনা আছে এতে, সব দামী জড়োয়ার। এগুলো বিক্রী করে তুমি একটা ব্যবসা করে। ব্যবসায় পয়সা আছে। মফস্বল শহরের ওই সামান্য চাকরিতে তোমার কি হবে? কিন্তু যাও, যাও, পালাও। ধরো, এই অ্যাটাচিটায় পুরে দিয়েছি। আলমারি এমনি খোলা পড়ে থাক, চাবি ঝুলুক। এই নাও ওষুধ-মাখা রুমালটা। এটা আমার নাকের কাছে ফেলে রেখে যাও। রোসো রোসা, বরং আরও ভাল হবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আমাকে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে গেলে। পারবে না? কী আশ্চর্য! আমার বিপদটা বুঝছ না? আমি সজ্ঞানে জেগে বসে থাকলে তো সব প্রকাশ হয়ে পড়বে। মনে রাখো, বাইরের চোর এসে আমাকে ক্লোরোফর্ম করে বেঁধে রেখেও কনক, যা বলছি কর। দেরি করো না, দেরি করো না। দেরি করলে দুজনকে মরতে হবে। আমার মেয়েটা কোথায় আছে। দেখতে পাচ্ছি না, কে জানে কখন এসে পড়বে। ওকে আমার বিশ্বাস নেই। মনে হয় ও সব বোঝে। কনক নাও! ধর এটা। তারপর মনে আছে তো? ওখানে গিয়ে তুমি একটা চিঠি লিখবে। লিখবে চাকরি খারাপ, থাকা অসম্ভব। চলে আসছি। তারপর তোমার দূর গাঁয়ের কোন দূর সম্পর্কের দিদিমার সম্পত্তি পাবে তুমি। লুকনো টাকার গাদা। সেই দিয়ে ব্যবসা কাঁদবে তুমি। মনে রাখছ তো সব? যাও, যাও শীগগির। এই যে এইটা দিয়ে বাঁধো, আমারই আলনার এই শাড়িটা দিয়ে। ওই কে যেন আসছে। এটা নাও কনক, তোমার পায়ে পড়ি। কিন্তু না না, সত্যি অজ্ঞান করে ফেলো না আমায়, তাহলে বুঝতে পারব না কে কী বলছে। শুধু নাকের কাছে ফেলে রাখ। হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। ওই ওরা উঠে পড়েছে বোধহয়। এক্ষুনি আমায় খুঁজতে আসবে, দেখতে আসবে আমি কেমন আছি। আচ্ছা, আবার শীগগির দেখা হবে। দ্বিধা করো না কনক, তোমার কাছে তো আমি আর কিছু চাই না, চাই শুধু রোজ একবার তোমায় দেখতেতার বিনিময়ে আমার সব কিছু দিয়ে দিচ্ছি। পালিত আমায় ভালবাসা দিতে পারে না, শ্রদ্ধা-সম্মান দিতে পারে না, তাই অনেক গহনা দেয়। ভাগ্যিস দেয়। ওর বদলে আমি তোমাকে পাবো কনক। দেখ, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি আমি। এ রকম কেন হচ্ছে বল তো?
না, তবু সেদিন সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাননি নর্মদা। অসম্ভব স্নায়বিক উত্তেজনা, অন্ধকার ঘর আর খোলা মেজেয় পড়ে থাকা, এই তিন মিলিয়ে নর্মদাকে যেন এই পরিচিত জগৎ থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল। তবু সব টের পাচ্ছিলেন তিনি। টের পাচ্ছিলেন রাতদিনের ঝি কানন কি যেন বকবক করতে করতে ঘরে এল, এসেই ফট করে ঘরের আলোটা জ্বালল, তারপর হাঁকপাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল।
তারপর হুড়মুড় করে ও-ঘর থেকে এসে পড়ল আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাদের উত্তেজিত কলকোলাহল বোধকরি একটা মরা মানুষকেও সাড়া এনে দিতে পারত, কিন্তু নর্মদা অসাড় হয়েই পড়ে থাকলেন, যতক্ষণ না মুখে জল পড়ল, বাতাস পড়ল, ওষুধ পড়ল। আর জ্ঞান হতেই গহনার শোকে কাঁদতে হল নর্মদাকে। তার জন্মদিনে আর বিবাহবার্ষিকীর দিনে স্বামীর কাছে পাওয়া ভালবাসার উপহারগুলি এমন করে চুরি হয়ে যাওয়ার শোকে এত বেশী ব্যাকুল কাতর হয়ে উঠলেন তিনি যে, পালিতসাহেবকে বলতে হল, সামান্য গহনার জন্যে এত ভাববার কি আছে? জুয়েলারীর দোকানগুলো তো আর রাতারাতি উঠে যাচ্ছে না? আমিও কিছু দেউলে হয়ে যাচ্ছি। না। তোমার প্রাণটা যে বেঁচেছে এই ঢের। ভাব দেখি, যদি তোমায় মেরেকেটে এ কাজ করত?
তারপর অবশ্য আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। ডা
ক্তার ভগ্নিপতি বললেন, তিনি দেখেছেন চোরকে। পরিচিত চোর।
নর্মদা বললেন, অসম্ভব।
কিন্তু নর্মদার আর সে জোর বজায় রইল কই?
আচ্ছা, নর্মদা কি সত্যিই আশা করেছিলেন সে জোর তার বজায় থাকবে? সত্যিই তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ হতে থাকবে? বিদেশ থেকে চিঠি আসবে চলে আসছে কনক, চলে এসে দূর সম্পর্কের দিদিমার টাকা পাবে সে, আর সেই টাকায় ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে কলকাতাতেই চিরস্থায়ী বসবাস করবে নিত্য একবার নর্মদাকে দেখা দেবার জন্যে। এমন অদ্ভুত কথা ভাববেন, সত্যিই কি আর এমন বোকা নর্মদা?
না, এখন অন্তত সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিলেন নর্মদা। ভাবছিলেন, এতদিন পরে ও আবার এল কেন? আমি তো ধারণা করিনি ও আবার আসবে। আসবে না ভেবেই তো নতুন করে নিজের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর এখন ওকে দেখার কী আছে আমার? কিন্তু ও আবার এসেছে। ঈশ্বর জানেন কী মতলবে।
ভাবছিলেন, কতক্ষণই বা মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়ে থাকা চলে? আর একটু পরেই তো আস্তে আস্তে কাঁপাতে হবে চোখের পাতা, কাঁপাতে হবে লালরঙে ছোপানো ঠোঁট দুখানি, তারপর মুদিত কমল-কলির মত খুলতে হবে চোখের সেই কাঁপা-কাঁপা পাতা দুটি। ক্ষীণকণ্ঠে বলতে হবে, আমার কী হয়েছে?
কিন্তু তারপর?
তারপর ও যদি সব প্রকাশ করে দেয়? এই এত লোকের মাঝখানে যদি উদঘাটিত হয়ে যায় সব সত্য, সব বানানো গল্প।
যদি ধরা পড়ে যায়, চোর আর কেউ নয় স্বয়ং নর্মদা নিজে?
কী বলবে এরা? চোর চোর চোর! এই তো।
আশ্চর্য, এ সংসারে নিজের জিনিসও নিজে নেওয়া যায় না। ব্যবহার করার বাইরে আর কিছু করতে গেলেই, চুরি করে নিতে হয়। নিজের জিনিস কথাটার অর্থ কী তাহলে?
না, সত্যকার অর্থ কিছু নেই।
কনক মিত্তির যদি সেদিনের কথা সব প্রকাশ করে দেয়, এরা সকলেই বলবে, ছি ছি, মিসেস পালিত এই।
মূছার অবসরে তাই মনকে দৃঢ় করতে থাকেন নর্মদা। ভাবতে থাকেন কেমন করে সরাসরি অস্বীকার করবেন কনকের সেই অভিযোগ। কেমন চড়া আর কড়াগলায় বলবেন, অনেক ঘাটের জল খেয়ে এসে বুঝি খুব চালাক হয়ে উঠেছ তুমি? চমৎকার একটি গল্প বানিয়ে ফেলার মত চালাক?
কিন্তু না বোধহয়। ও বোধহয় কিছু প্রকাশ করবে না।
চোখ বুজে আর শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ করে শুয়ে থাকা মানুষটা শুনতে পায় পরিষ্কার ঘসা-মাজা একটি গলা, নমস্কার মিস্টার পালিত, আমি বলছিলাম কি, আমি তাহলে এবার উঠি। মনে হচ্ছে ওঁর চৈতন্য ফিরতে একটু দেরীই হবে। আমি আর ততক্ষণ না বসলাম। চৈতন্য ফিরলে ওঁকে এটা দিয়ে দেবেন।
দিয়ে দেবেন!
কী দিয়ে দেবেন? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? বুকের ভিতরটা আকুলি-বিকুলি করে ওঠে নর্মদার। কী করে দেখা যাবে? চোখটা একটু খুলবেন? না কি সহসা ধড়মড়িয়ে উঠে বসবেন?
ভেবে ঠিক করার আগে পালিতসাহেবের ভারী গলার উত্তরটা শোনা গেল, চৈতন্য ফেরার কথা বলা বড় শক্ত মিস্টার মিত্র। ও যে কখন ফেরে আর কখন না ফেরে। কিন্তু এখুনি চলে যাবেন কি বলছেন? যে ভদ্রমহিলা এত যত্ন করে আপনাকে তার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন। করলেন, তার সঙ্গে দেখা করুন, নেমন্তন্ন খান, তবে তো?
নেমন্তন্ন আমাকে কেউ করে নি, মৃদু হাসির সঙ্গে বলে কনক, মেয়ের জন্মদিন সেটাও আমার স্মরণ ছিল না। যদিও স্মরণ থাকা উচিত ছিল। তা উচিত কাজ আর কটাই বা হয়ে ওঠে? স্মরণ ছিল না, এসে দেখলাম বাড়িতে উৎসব। ঠিক যে রকম উৎসবের দিন লাস্ট দেখা হয়েছিল আপনাদের সঙ্গে।
হ্যাঁ, ঠিক যেদিন থেকে আপনি ফেরার হলেন।
জোর গলায় হেসে ওঠেন পালিতসাহেব।
আর কত পারা যায় চোখ বুজে পড়ে থাকতে?
সেই অসতর্কতার অবসরে ওই দস্যু নিশ্চয় সব বলে দেবে। সেই খাতেই আলোচনাকে এনে ফেলছে।
নর্মদা চোখ খুললেন। মুদিত কমল-কলির ধীর প্রস্ফুটনের মত নয়, খুললেন আচমকা ঘুম ভাঙার মত।
বলে উঠলেন, জল খাব।
.
তারপরের কথা ভাবতে পার তুমি?
বীথিকার স্বামী সভায় আসে নি, তাই বাড়ি ফিরে স্বামীর কাছে বিশদ বর্ণনায় মুখর হয়ে ওঠে বীথিকা। তারপর, জল খাবার পর, ওঃ নর্মদাটা যে এমন হতে পারে কে কবে ভেবেছে? স্কুলে কলেজে অনেকগুলো বছর তো কাটিয়েছি ওর সঙ্গে? বলেওছি তোমায়, লেখাপড়ায় কত ভাল ছিল, চাল-চলন সভ্য, কথাবার্তা মার্জিত, গান জানত সুন্দর। এক কথায় রীতিমত একটি বিশিষ্ট মেয়ে। সে কি না জীবনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠল একটি অভিনেত্রী! ওই মূৰ্ছা, ও কি সত্যি মূৰ্ছা? মূৰ্ছার অভিনয় করে পুরুষকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মেয়েদের যায় না। মেয়েদের চোখ বড় তীক্ষ্ণ।
পুরুষদের তীক্ষ্ণ নয়, একথা তোমাকে কে বলেছে? হেসে ওঠে বীথিকার বর বিকাশ।
পুরুষরা ভদ্রতার বশে অবোধ সেজে থাকে। জীবনের ক্ষেত্রে মেয়ে-পুরুষ সবাই আমরা অভিনয় করে চলেছি।
ওঃ, তাই নাকি? তাহলে আমারও ভরসা করবার কিছু নেই?
কিছু না।
বকো না, থাম। যার কথা হচ্ছে, তার কথাই হোক। সত্যি বলতে কি, আসলে মেয়েটা ভালই কিন্তু কাল করল ওকে ওর ওই প্রেম।
প্রেম তো চিরকালই কাল করে এসেছে। ও আর নতুন কি। সেই শ্রীরাধিকার আমল থেকে
আহা মশাই, সে নয়। প্রেমে পড়া নয়, প্রেম খোঁজা।
প্রেম খোঁজা! বিকাশ হেসে উঠে বলে, গরু খোঁজা বলে একটা কথা আছে শুনেছি। কিন্তু
নাঃ, তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা কইবার জো নেই। ওর বাসনা কি ছিল জান? একখানি নির্ভেজাল খাঁটি প্রেম। সেই বস্তু খুঁজে বেড়াত ও। ছেলেবেলা থেকে। বন্ধুদের মধ্যে, সখীদের মধ্যে–
আর বড় হয়ে বোধ করি সখাদের মধ্যে?
হা মশাই, তাই। কিন্তু সবাই ওকে হতাশ করত। তবু ও আবার নতুন অন্বেষণের পথে পা বাড়াত। বলত কি জান? জীবনের শেষদিন পর্যন্তও যদি খুঁজতে হয়, তবু খুঁজে নেব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।
তোমার বান্ধবীর বুঝি ঠাকুমা ছিলেন না?
ঠাকুমা! ঠাকুমা মানে? বীথিকা অবাক হয়ে বলে, মা বাপ ছিলেন না, ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিলেন তাই জানি। ঠাকুমার প্রশ্ন ওঠে নি কোনদিন। হঠাৎ ঠাকুমা প্রসঙ্গ কেন বল তো?
না, মানে, আমার ঠাকুমা বলতেন কি না ঘরে নেই যা, ছেলে চায় তা। ওর ঠাকুমা বোধহয় ওকে সময়ে এ সুশিক্ষা দেন নি। মনের মানুষ! বাপস!
হুঁ, বুঝছি, সব বুঝছি, তুমি কি চীজ একখানি। তা ঠাকুমা না থাক আমরাই ওকে জ্ঞান দান করতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, ও সব বাজে পাগলামী ছাড়, এবেলা ওবেলা প্রেম-পাত্র বদলে বদলে আর নির্ভেজাল প্রেম খুঁজে বেড়াস নে বাবা, দেখে-শুনে ভালমত একটা বিয়ে কর। দেখবি প্রেম-বাই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না।
তা তোমাদের নিজেদের তখনই এতটা জ্ঞান জন্মেছিল?
বীথিকা সগর্বে বলে, নিশ্চয়! জ্ঞান নিয়েই জন্মেছি, বুঝলে? কিন্তু ও আমাদের কথায় শুধু আমাদের প্রতি করুণার কটাক্ষ নিক্ষেপ করত। ভাবটা যেন আমরা কোথায় আর ও কোথায়। তারপর নিত্যি নানা রকম। একবার এক প্রফেসরের সঙ্গে প্রেম এমন জমে উঠল, আমরা ভাবলাম, যাক বাবা, এতদিনে হল সুরাহা। এবার খুব একটা নেমন্তন্ন। ওমা, কদিন পরে হঠাৎ দেখি একা একা ঘুরছে নর্মদা। চুল রুক্ষু, মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?
না, ধিক্কার হয়ে গেছে।
বললাম, কেন, কী করল প্রফেসর?
ও বলছে, বিয়েতে ওর মা টাকা চান।
অ্যাঁ! বল কি? বিকাশ চোখ কপালে তোলে।
তাই তো বললে। ও নাকি বলেছিল, আমার বাবা নেই, টাকা দেবার লোক নেই, এ কথাটাই আসল কথা নয়। বিয়ের কর্তা কাকা হয়তো গতানুগতিক নিয়মে টাকা দিতে প্রস্তুত হতেও পারেন, কিন্তু ঘুষ নিয়ে তুমি আমায় গ্রহণ করবে?
প্রফেসর বলেছিল, ঘুষের কথা কি আছে? এ তো সাধারণ একটা প্রথা মাত্র। মা সেকেলে লোক, প্রথাটাই বোঝেন। মাকে অসন্তুষ্ট করে আমি কি করে
নর্মদা বলল, ঠিক আছে।
তারপর কিছুদিন কাটল একা একা, আবার দেখি ক্লাসের একটা ছেলের সঙ্গে খুব মাতামাতি জুড়েছে। হাঁদা নাম্বার ওয়ান ছেলেটা কৃতার্থন্মন্যের মত ওর পায়ে পায়ে ঘোরে, নর্মদা তাতেই বিভোর।
আমরা বলি, কি রে, এতদিনে পেলি খুঁজে?
নর্মদা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। ঢলঢলে চোখে বলে, সত্যি ভাই, ছেলেটা যথার্থ খাঁটি। দেখছি, একটু অবোধ একটু বোকাদের মধ্যেই সত্যি ভালবাসা থাকে। ওকে নিয়েই গড়ব আমার ঘর।
তারপর যথারীতি।
আবার নর্মদা একা ঘুরছে। এবার আর রুক্ষু চুল শুকনো মুখ বিষণ্ণ নয়, যেন ক্ষিপ্ত ক্ষুব্ধ চঞ্চল। জিগ্যেস না করতেই নিজে থেকে এসে বলল, ওই লক্ষ্মীছাড়া ছেলেটা কি করেছে জানিস? লুকিয়ে একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েকে লাভ-লেটার দিতে শুরু করেছে।
শুনে সত্যিই হাঁ হয়ে গেলাম। বললাম, বলিস কি?
ও বলল, হ্যাঁ। আবার তাকে নাকি বলেছে, নর্মদা? সে তো একটা আস্ত পাগল।
ওই হাঁদার এই কথা?
না রে বীথি, হাঁদা ও নয়, হাঁদা আমিই। বলল নর্মদা।
বলে, কিন্তু খুঁজে বেড়ানোর কামাই দেয় না।
এদিকে বাড়িতে অভিভাবক কাকা বিয়ে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, কারণ মেয়ের নিয়ে কান পাতা দায় হচ্ছে তার। অতবড় মেয়ে, তায় আবার নিজের মেয়ে নয়, ভাইয়ের মেয়ে, তাকে এঁটে ওঠা শক্ত। সে যুগ নয় যে অভিভাবকগিরির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখাতে মেরে ধরে ঘরে বন্ধ করে আটকে রাখবেন।
পড়ুয়া মেয়েকে পড়তে যেতে দিতে হয়, কিন্তু লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে যদি প্রেমেও পড়তে শুরু করে, কি করবে অভিভাবক? বড় জোর করতে পারে বিয়ের চেষ্টা।
চেষ্টা তো করতেই হবে। কারণ নর্মদার দ্বারা সে সুরাহাও তো হয় না। নিজেই সে জলে নেমে হাবুডুবু খায়, ছিপ ফেলে মাছ টেনে তুলতে পারে না একবারও।
কাকা যাহোক করে একটা সম্বন্ধ যখন প্রায় পাকা করে এনেছেন, এমন সময় নর্মদা বেঁকে বসল। বললে, এ বিয়ে হতে পারে না।
সত্যিই হতে পারে না। কারণ মুখপুড়ি তখন কলেজ লাইব্রেরির এক লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে তোলপাড় কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে।
সবাই ছি-ছিক্কার করছে আর বলছে, কী নির্লজ্জতা! কী হ্যাংলামি!
হ্যাংলামি ছাড়া আর কি বলবে? লোকটা যে বিবাহিত!
সহপাঠিনীরা, মানে আমরা যখন তাকে ঘেন্না দিয়ে বলছি, ছি ছি, শেষকালে কি না একটা এঁটো পাত! আর লোকটাই বা কী চরিত্র, তা ভাব।
নর্মদা একটি মধুর স্বর্গীয় হাসি হেসে, দেশের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত অধ্যাপক কবি সুধীজনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। যাঁরা জলজ্যান্ত স্ত্রী বর্তমান থাকতে, নবীনা দ্বিতীয়ার প্রেমে লোকলজ্জা আহুতি দিয়ে দিব্যি খোসমেজাজে নতুন সংসার করছেন।
আমরা বলতাম, ওটা মানুষের দুর্বলতার দৃষ্টান্ত, আদর্শের দৃষ্টান্ত নয়।
নর্মদা বলত, আদর্শ হচ্ছে ঠাকুর ঘরের জিনিস, তাকে বেদীতে স্থাপন করে ফুল চন্দনে পূজো করা চলে। জীবন সার্থক করবার জন্যে যা চাই সে হচ্ছে রক্তমাংসের মানুষ, দোষে গুণে ভুলে দুর্বলতায় সুন্দর মানুষ। ও যে বিবাহিত, সে একটা দৈবাতের ঘটনা মাত্র। ওর যে স্ত্রী আছে, সেটা বিধাতার একটা হাস্যকর কৌতুক, ওর জন্যে আমি আর আমার জন্যে ও পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। সেটাই শেষ কথা।
কিন্তু এসব উচ্চাঙ্গের শেষ কথা কে শুনছে কান পেতে? লোকে বহিদৃশ্যটাই দেখে। আর সেই দেখার ফলশ্রুতিতে কাকার কান পাতা দায় হয়।
তাই কাকা যখন শুনলেন, ভাইঝি গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করেছে–এ বিয়ে হতে পারে না, তখন কাকা সমস্ত গাম্ভীর্য ভুলে তার আদিম পিতামহের ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে আর লাফিয়ে উঠে বললেন, হতে পারে না, এ কথাটা এতদিন বলতে পারনি? আমি যে এই হন্যে হয়ে পাত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, সে খবর জানতে না তুমি?
জানবার দরকার বুঝিনি। কারণ আপনিও আমাকে জিগ্যেস করবার দরকার বোঝেননি।
ও হ্যাঁ, অফিসিয়ালি জিগ্যেস করা হয়নি বটে। কিন্তু তুমি যে আয়োজনটা টের পাচ্ছ, অথচ না করছ প্রতিরোধ, না করছ প্রতিবাদ, এটাকেই সম্মতি বলে ধরে নেওয়া কি খুব ভুল হয়েছে?
আমার ধারণায় ভুল হয়েছে।
ঠিক আছে। বাধ্য হয়েই বুঝতে হবে আমায়, তুমি আর আমার অভিভাবকত্বের অধীনে থাকতে চাও না। বেশ, সেই মত ব্যবস্থাই করব। হিসেবমত বাড়ির অর্ধাংশ তোমার, সেটা আইনসিদ্ধ করে তোমার সঙ্গে সংস্রব মুছে ফেলতে চাই।
বীথিকার বর বাধা দিয়ে বলে, ওদের ঘরের কথা তুমি জানলে কি করে?
যে করে বিশ্ব-সংসারে একে অন্যের ঘরের কথা জানে। কথা এ-কান থেকে ও-কান, পাঁচ কান থেকে দশ কান হেঁটে বেড়ায় জান না? আবার কথা শুধু কানেই হাঁটে না, বাতাসেও হাঁটে। তার উপর আবার এমন মজাদার কথা জানতে আর বাকী ছিল না কারুর।
তা, বীথিকার কথা অত্যুক্তি নয়। ওদের ধারে কাছে জানতে আর বাকী ছিল না কারুর নর্মদার সেই কাহিনী। আমরাও জেনেছিলাম।
তবে এদিকে মজা এই, আলাদা করে দেব, সম্পর্ক মুছে ফেলব-বলে কাকা যতই চোখ রাঙান, মূল কথা হচ্ছে, বাড়ির অর্ধাংশ নর্মদার নয়, সম্পূর্ণাংশই তার। কারণ বাড়িটা কাকাদের পৈত্রিক নয়, তৈরি হয়েছিল নর্মদার বাবার সম্পূর্ণ একার স্বাপার্জিত অর্থে এবং দলিল আছে নর্মদার মায়ের নামে। কিন্তু এসব রহস্য নর্মদার অজানা, কারণ মা-বাপ দুজনেই মরেছেন তার নিতান্ত বাল্যে। হিতৈষী আত্মীয়স্বজন যদি বা কখনও তার কানে তুলতে এসেছেন, নর্মদা কানে তোলেনি! বলেছে, যা বুঝবেন কাকা বুঝবেন।
তা কাকা এই বুঝলেন, রাগ করে আখের খুইয়ে কাজ নেই, কেঁচো খুঁড়তে সাপ খুঁড়ে দরকার নেই।
একখানা ঘর বাদে সারা বাড়িটাতেই তিনি, অথবা তার সংসার।
ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটাকে একবার বিয়ে দিয়ে ফেলতে পারলেই নিষ্কণ্টক। যথানিয়মে সে পতিগৃহে যাত্রা করবে, তিনি কম্বঋষির মত আশীর্বাদ করবেন, পতিগৃহে অচলা হও। লেখাপড়ায় যাই হোক আর অন্যদিকে বেপরোয়া হোক, এদিকে–সংসার-জ্ঞানে তো মেয়েটা সরল অবোধ, কাকার কাছ থেকে সে বাড়ির দলিল দেখতে চাইবে, এমন মনে হয় না।
কাজেই রাগের সময়ের কথা বাতাসে উড়ে গেল, কাকা অন্য পন্থা খুঁজতে লাগলেন।
কিন্তু সত্যিই কি নর্মদা এমন একটা নীচ মেয়ে, যে একজন বিবাহিত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়?
তা বহিদৃশ্যে তো তাই বলতে হয়।
নীচ, লোভী, হ্যাংলা, স্বার্থপর–এক্ষেত্রে এছাড়া আর কি বলে লোকে?
কিন্তু বিভিন্ন মনোজগৎবাসী বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা, চিন্তাধারা আলাদা। তাই নিজের কাজকে সমর্থন করবার যুক্তিও থাকে তাদের ভঁড়ারে মজুৎ।
নর্মদা ভাবে, লোকে তো বলবেই, বলবার জন্যেই আছে লোক। কে কার ভিতর দেখে? ওই যে মানুষটা, যার বুদ্ধি চিন্তা রুচি পছন্দ বিকশিত হবার আগেই, মা-বাপে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নিতান্ত গ্রাম্য একটা মুখ মেয়ের সঙ্গে, তার জীবনটা কি কিছুই নয়? সে জীবন অপচয়িত হলে কিছুই এসে যায় না?
সেই গ্রাম্য মেয়েটা যদি তার চিত্তের ক্ষুধা মেটাতে না পারে, যদি হতভাগ্য মানুষটার সমস্ত অন্তর পিপাসিত হয়ে থাকে একটি মার্জিত শিক্ষিত হৃদয়ের সঙ্গলাভ-আশায়, সে পিপাসা মেটাতে চাওয়া কি অপরাধ?
জগতের বহুবিধ অ্যাকসিডেন্টের মত ওই গাঁটছড়ার অ্যাকসিডেন্টটাই পরম সত্য? আর সবই মিথ্যা? এইসব যুক্তি নর্মদার।
নর্মদার সেই নতুন প্রেমাস্পদ খুব একটা রূপবান নয়, অতএব এটাকে রূপের মোহের কোঠায় ফেলা যায় না, এ একপ্রকার ভাবের মোহ।
বন্ধু-বান্ধবের কাছে নর্মদা তার নিজস্ব চিন্তাধারা আর অভিজ্ঞতার গল্প করে বেড়াত, এই ছিল তার একটা পাগলামী। হয়তো সে মানুষকে শ্রদ্ধা করত, তাই মানুষকে অবজ্ঞা করে যা খুশি করতে না চেয়ে, তাদের বোঝাতে চাইত। চাইত তাদের সহানুভূতি, সমর্থন।
কিন্তু জগতে কে এই বিশ্বস্ততার মূল্য দেয়?
কে বুঝতে চায় সরল চিত্তের সৃষ্টিছাড়া মতবাদ?
কাজেই কেউ বা তাকে ন্যাকা বিশেষণে বিভূষিত করত, কেউ বলত পাকা শয়তান, ইচ্ছে করে ন্যাকামি করে। যে মেয়ে লেখাপড়ায় প্রথম সারিতে থাকে, গানে বাজনায় খেলায়-ধূলায় রীতিমত চটপটে চৌকস, সে যে যেখানে সেখানে কেবল তার হৃদয়তথ্য উদ্ঘাটন করে বেড়ায়, এটা ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি ছাড়া আর কি?
নর্মদা যে বন্ধুদের বিশ্বাস করতে চাইত, একথা কেউ বিশ্বাস করত না।
বন্ধুরা বলত, সে লোকটাকেও বলিহারী দিই। বিবাহিতা স্ত্রী থাকতে–এ তো দস্তুরমত চরিত্রহীনতা।
নর্মদা বলত, সেই বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যদি মনের মিল না হয়, তার সঙ্গে কেবলমাত্র দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ঘর-সংসার চালিয়ে যাওয়াটাই কি মহৎ চরিত্রের স্বাক্ষর? আমি তো বলি, সেও একরকমের চরিত্রহীনতা।
এরা বলত, ওসব কথা বস্তাপচা। ঢের শুনেছে লোকে। তুমি এমন কিছু নতুন থিওরি আমদানী করছ না। সোজা কথা হচ্ছে, সমাজের মুখ চাইতে হবে, আইনের দায় মানতে হবে।
নর্মদা বলত, তা বটে! শুধু চাইতে হবে না মানুষের মুখ, মানতে হবে না হৃদয়-সত্যের দায়!
লেখাপড়া শিখেছিল, বই পড়ত দেদার, ভাল ভাল কথা বলতে পারত সহজেই।
শুধু বুঝতে পারত না, হৃদয়-সত্যের দায় পোহানোর ঝক্কি কতখানি।
বুঝতে পারত না সবাইয়ের সাধ্য নেই সে ঝক্কি সামলাবার। সাধ্য নেই, তাই মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, হৃদয়-দ্বন্দ্ব আর সমাজ-দ্বন্দ্ব সব কিছুকে লোকচক্ষু নামক পাকযন্ত্রে চড়িয়ে একটা পাঁচন তৈরি করে করে গিলে জীবন-জ্বরের শান্তি খোঁজে।
২. পাকা জহুরী
হয়তো সেই লাইব্রেরিয়ান বিরাম বক্সী নর্মদার অকপট হৃদয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করেছিল, হয়তো বুদ্ধি আর সরলতা এই দুটো বিপরীত বস্তুর একত্র সমাবেশ দেখে সে কিছুটা অভিভূত হয়েছিল, হয়তো বা তার মূল্যহীন একঘেয়ে জীবনের মাঝখানে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে-এসে-পড়া এই ঐশ্বর্যের লোভ সে সামলাতে পারে নি, তাই বেশ কতকগুলো দিন সে ওই নতুন সমুদ্রের তরঙ্গে ওঠা-পড়া করেছে, মাঝে মাঝে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে গেছে তীর ছাড়িয়ে, কিন্তু একেবারে নোঙর ছাড়লে তার চলবে কেন? লোকচক্ষুর সামনে নিজেকে খাড়া রাখবার চেষ্টা না করলেই বা টিকবে কি করে?
তাই এক ছুটির দিন, সারাদিন দুজনে কোথায় না কোথায় ঘুরে, ছোট রেলে চড়ে এক অখ্যাত গ্রামে বেড়িয়ে, একরাশ বুনো ফুল মাথায় গুঁজে, হাত ভর্তি নতুন ধানের শীষ আর মন ভর্তি আনন্দের আবেগ নিয়ে ছলছলিয়ে এসে ওর সঙ্গে যখন স্টেশনে নামল নর্মদা, তখন পেল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত।
যে আঘাতে তার সোনারঙা পৃথিবী হঠাৎ যেন হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাচের বাসনের মত গুঁড়ো হয়ে গেল।
এর চাইতে কেন ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হল না তার, কেন মাথায় নেমে এল না ভারী কোন লোহার বীম। ভাবল নর্মদা, তাহলে সোনারঙা পৃথিবীর কোলে পরিপূর্ণ আনন্দের পরম প্রসাদ নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারত সে।
অথচ আঘাত যে দিল সে জানতেও পারল না আঘাত হেনেছে সে। জানতে পারল না, কারণ সে শুধু তার সামাজিক চেহারাটা লোকচক্ষে অবিকৃত রাখতে চেয়েছিল, এর বেশি আর কিছু না। ভয়ানক একটা পাষণ্ডজনোচিত কাজ কিছু করেনি। মানুষ মাত্রেই এইরকম অবস্থায় পড়লে এরকম করে থাকে।
নর্মদা আর বিরাম, এদের পাশাপাশি দেখতে দেখতে লোকের চোখ ক্ষয়ে গেছে। ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে, পায়ে হাঁটায়, কিসে নয়? আর কোথায় নয়? হাতের কাছে যতগুলো বেড়াবার ঠাই আছে, বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর, দমদম, ডায়মণ্ড হারবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বোটানিক, আর সিনেমা জলসা, এসব পুরোনো করে ওরা ছুটির দিনে পাড়াগাঁ বেড়াতে শুরু করেছে। এবং বিরাম যদিও ভেবে নিশ্চিন্ত আছে চেনা লোকেরা ওদের দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু চেনা লোকদের ওই যা বললাম-দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে।
কাজেই সেদিন ওই ঢাকুরিয়া না গড়িয়া কোথা থেকে যেন ফেরার সময় দুজনে যখন পাশাপাশি আসছে গল্প করতে করতে, আনন্দের আবীর মুখে মেখে, তখন বিরামের এক ভায়রাভাই দূর থেকে দেখতে পেল। দেখে চমকে উঠল না অবশ্য। শুধু বিরক্তিতে ভুরুটা কোঁচকালো। কিছুই হত না যদি হঠাৎ বিরামের চোখে ওই ভ্রুকুঞ্চিত মুখটি না পড়ত। কিন্তু পড়ল।
আর বিরাম ভাবল বুঝি এই প্রথম ও ধরা পড়ল লোকচক্ষে। তাও আবার সে চোখ বন্ধুজাতীয়ের নয়, সংসারের সবসেরা প্রতিদ্বন্দ্বী স্ত্রীর ভগ্নিপতির। ভয়ে দিশেহারা হল বিরাম। মৃদু অথচ দ্রুত উচ্চারণে নর্মদাকে একটু দূরত্বের ব্যবধান রেখে এগিয়ে যেতে বলে, যেন নিঃসঙ্গ চলেছে এই ভাবে ভায়রাভাইয়ের কাছে সহাস্যে গিয়ে দাঁড়াল।
আর তারপরই এল সেই মারাত্মক আঘাত।
নর্মদা এগিয়ে গিয়েও শুনতে পেল বিরামের কণ্ঠনিঃসৃত সেই কটি শব্দ। যে কষ্ঠ বহু অলৌকিক মুহূর্তে, বহু অপূর্ব ক্ষণে নর্মদার কানে স্বর্গের সুরঝঙ্কার বয়ে এনেছে, সেই কণ্ঠ নিয়ে এল একটি অগ্নিগর্ভ বাজ। নর্মদা শুনল, বোধ করি ভায়রাভাইয়ের কোনও তীক্ষ্ণ মন্তব্যে বিদ্ধ বিরাম কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর এনে উচ্চারণ করছে, আর বলল না ভাই। মেয়েটা আমার জীবন একেবারে মহানিশা করে তুলেছে। অ্যাভয়েড় করতেও পারা যায় না, এমন নাছোড়
একেবারে কুমীরের কামড়? কেমন? ভদ্রলোক শ্লেষের সুরে বলেন।
আর তার উত্তরে এবার বিরামের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যা বলেছ ভাই। প্রায় তাই। অথচ ভদ্রতার দায়ে না করতেও পারা যায় না। উনি কবিত্ব করতে বাংলা দেশের পল্লীশোভা দেখে বেড়াবেন, আর আমার প্রাণান্ত।
না, বিরামের কোন লাভ হয় নি ওই বোকাটে কৈফিয়টুকু দিয়ে, কারণ দুনিয়াটা বোকা নয়। সেখানে ভাতই খায় সবাই, ঘাসের বীচি নয়। বিরামের কৈফিয়তে ভদ্রলোক একটু বাঁকা হাসি হেসে শুধু বলেছিলেন, মহিলাটি বেছে বেছে তোমার স্কন্ধেই ভর করলেন, এটা অবশ্য একটা আশ্চর্য রহস্য। কাজেই লাভ কিছু হল না বিরামের। কিন্তু যে বিরাট একটা লোকসান ঘটে গেল আর এক জায়গায়, তার আর তুলনা হয় না।
বিরাম আর কোন উত্তর দিয়েছিল কি না সে কথা জানে না নর্মদা। ওর শুধু মনে আছে, চোখটা অবিরত ঝাপসা হয়ে আসার দরুন বাড়ি ফিরে আসতে সেদিন ভারী অসুবিধে হয়েছিল।
ভায়রাভাইয়ের কবলমুক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর রকম দ্রুত চলে এসেও বিরাম নর্মদাকে দেখতে পায় নি। শুধু ফুটপাথের একধারে কমুঠো বুনো ফুল আর গোছা কতক নতুন ধানের শীষ দেখে বুকটা হিম হিম হয়ে গিয়েছিল তার!
সেই হিম হিম বুক নিয়েই তখুনি নর্মদাদের বাড়ি গেল বিরাম, কিন্তু দোতলা থেকে কাকা বজ্রকণ্ঠে বললেন, ফেরেনি এখনো।
.
পরদিন আবার গেল অসময়ে। চাকরকে বলল, দিদিমণিকে ডেকে দিতে। চাকর মুখটা কালিপনা করে চলে গেল। আর তারপর দোতলা থেকে যিনি নেমে এলেন, তিনি নর্মদা নয়, তার কাকী।
কাকী গম্ভীর মুখে মৃদু কণ্ঠে বললেন, আপনিই বোধকরি বিরাম বক্সী?
বিরাম থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমিও আন্দাজ করছিলাম। যাক আপনার জানা দরকার তাই জানাচ্ছি, নর্মদা কাল রাত্রে মারা গেছে।
বিরাম কেঁদে উঠল না, চেঁচিয়ে উঠল না, শুধু অবোধ্য বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, কী বলছেন!
বাংলা ভাষাটা ঠিকমত জানা নেই বুঝি? মারা যাওয়া কথার মানে জানেন না? ইংরিজি বললে বুঝতে পারবেন বোধহয়। কাল রাত্রে সে সুইসাইড করেছে। এবার বুঝতে পেরেছেন? আপনি এবার আসতে পারেন।
এবার বিরাম বক্সী রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠেছিল, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না।
কাকী মুখ আরও ভীষণ করে বলেছিলেন, বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে। আমার জানানোর কথা জানিয়ে দিলাম। তবে এটুকু মনে রাখবেন, এ বয়সের মেয়েরা আত্মহত্যা করে বসলে পুলিশ কারণ আবিষ্কার করতে আগে তাদের প্রণয়ীকে সন্দেহ করে।
এ হেন কুলিশকঠোর স্পষ্ট কথার পর আর কে দাঁড়াতে পারে তার সামনা সামনি?
বিরামও পারেনি। চলে এসেছিল।
অবিশ্বাস্য কথাটা বিশ্বাস অবশ্য করেনি সে, তবু বুকটা কাঁপছিল বৈকি। কী জানি যদি সত্যি হয়, যা আবেগপ্রবণ মেয়ে!
অথচ কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারে না বিরাম। গত সন্ধ্যায় নর্মদাকে সেই একা এগিয়ে যেতে বলাটাই কি তাহলে এত অভিমানের কারণ হল? এমন কি অপরাধ সেটা?
.
কাকী ফের দোতলায় উঠে আসতেই নর্মদা রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি বলল?
বলবে আবার কি? মুখটা পেঁচার মত করে চলে গেল।
বিশ্বাস করল?
বিশ্বাস যে করেনি, সেটুকু বোঝবার মত বুদ্ধি কাকীর আছে, কিন্তু তিনি একটু প্যাঁচ খেললেন। বললেন, প্রথমে অবিশ্বাস দেখিয়েছিল, তারপর বলার গুণে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লাম।
তাহলে করল বিশ্বাস?
করল বৈকি।
চেঁচিয়ে উঠল না, কাঁদল না, কিছু করল না?
কাকী মুখখানি অমায়িক করে বললেন, সে হয়ত বাড়ি গিয়ে কাঁদবে, চেঁচাবে! ভদ্রলোকের বাড়িতে তাই কি পারে?
না না, বাড়ি গিয়েও কিছু করবে না। চেঁচিয়ে উঠল নর্মদা নিজেই। বলল, বাড়ি গিয়ে ও ওর সেই ঘটির মতন বৌয়ের কাছে হেসে হেসে গল্প করবে, একটা দামী মেয়ে কী ভাবে তার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।
কাকী আরও অমায়িক কণ্ঠে বললেন, তা বলা যায় না, হতেও পারে। পুরুষ মানুষ বৈ তো নয়।
পুরুষ মানুষদের দ্বারা যে সব রকম অমানুষিকতাই সম্ভব, এই তথ্যটাই পরিবেশিত হল কাকীর কণ্ঠস্বরে।
তুমি এখন এ ঘর থেকে যাও, নর্মদা বলল, আর কাকাকে বলগে, ওঁর সেই কে কোথায় একটা লক্ষ্মীছাড়া পাত্তর ছিল, তার সঙ্গে কথার ঠিক করে ফেলতে।
কাকী গিয়ে তৎক্ষণাই বললেন।
কিন্তু কাকা উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এমন লক্ষ্মীছাড়া কেউ কোথাও নেই যে ওই ধিঙ্গী অবতারের জন্যে পিত্যেস করে বসে থাকবে। তার বিয়ে হয়ে গেছে।
কাকী চুপ চুপ করে থামালেন। বললেন, যদি বা মেজাজ একটু বদলেছে, তুমি আর বিগড়ে দিও না। এই মোহাড়ায় বিয়েটা যে করে তোক দিয়ে ফেল, নইলে ও মেয়ে আবার কেলেঙ্কারী করে বেড়াবে।
ও মেয়ে বিয়ে হলেও তাই করে বেড়াবে।
কাকী মুচকে হেসে বললেন, তখন তো আর আমরা ভুগতে যাব না। কি করবে, বিধাতা পুরুষ তোমার ভাইঝির ভিতরে প্রেমটা একটু অধিক পরিমাণে দিয়ে ফেলেছেন, ওর দোষ কি?
কাকা জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলেন।
কাকী অবশ্য ভয় পেলেন না এতে, বললেন, তা সেদিন যে বলছিলে, তোমাদের কোম্পানির কোন্ ডিরেক্টর নাকি বিয়ে করবে–বিদূষী সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে বলে রব উঠেছে? আমাদের সঙ্গে জাতে মিলবে না?
কাকা অবাক হয়ে বললেন, মিস্টার পালিতের কথা বলছ?
পালিত বুঝি? তা অত জানতাম না। তাহলে তো জাতে আটকাচ্ছে না। দেখ না চেষ্টা করে, নমির মত সুন্দর মেয়ে তো আর ঘরে ঘরে নেই।
পাগল না কি? পালিত সাহেবের বয়েস কমসে কম পঁয়তাল্লিশ। বরং ওদিকে তো এদিকে নয়। উন্নতি উন্নতি করে সারা বয়েসটা শুধু কাজের পিছনেই ছুটেছে লোকটা, বিয়ের ফুরসৎ পায়নি। এখন টনক নড়েছে। কে দেবে সুন্দরী বিদূষী মেয়ে ওই বুড়োকে?
কে না দেবে শুনি? তুমি আর ন্যাকামী করো না। মাসিক আয় কত লোকটার?
সে বলে আর তোমার দুঃখ বাড়াই কেন? শুনে তুমি হয়তো নিঃশ্বাস ফেলে ভাববে, হায় হায়, ওই অফিসের কেরানীর বৌ না হয়ে, ডিরেক্টরের বৌ হলাম না কেন?
সে তো অহরহই ভাবি। যেখানে যত বড়লোকের বৌ আছে তাদের সকলকে দেখেই নিঃশ্বাস ফেলি আমি। সে যাক, বয়েস নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবে?
চমৎকার!
বেশ তো, আমি না হয় চমৎকারিণী। জিগ্যেস করে দেখ তোমার ভাইঝিকে। কি তার পছন্দ। নিঃস্ব যুবক, না ধনী প্রৌঢ়। আমি হলে তো শেষেরটাই পছন্দ করতাম। তবে জানি না, তোমার প্রেমিকা ভাইঝি কি বলবেন।
তা ভাইঝি যে কারণেই তোক কাকীর পছন্দেই একাত্ম হল। বলল, মন্দ কি?
দেখতে অবশ্য খুব বুড়োটে নয়
হলেও আপত্তি ছিল না।
কাকী এঘরে এসে বললেন, দেখলে?
কাকা গম্ভীরমুখে বললেন, দেখলাম।
ডিরেক্টর শুনেই সব আপত্তি খণ্ডন হয়ে গেছে।
আমার তো সে কথা মনে হয় না। মনে হচ্ছে–এখন একটা ঝোঁকের বশে
থামো না, বকছ কেন? মেয়েমানুষ এটুকু বোঝে, সংসার করতে পয়সাই মূলাধার।
কাকা তিক্ত মুখে বললেন, একথা আগে জানা থাকলে বুঝে কাজ করতাম।
তাই করাই উচিত ছিল।
.
সে তো হল। কিন্তু আপাতত, কাকা তার ভাইঝির সমর্থনে যা করতে উদ্যত হলেন, সে কাজকেও আত্মীয়জন উচিত কাজ বলে অভিহিত করল না।
পালিত সাহেবের আয় পদমর্যাদা ইত্যাদি আত্মীয়ের চোখ টাটাবার এবং বুক ফাটাবার পক্ষে যথেষ্ট! অতএব যেটুকু নিয়ে ধিক্কার দেওয়া যায়, তা কে কবে ছাড়ে?
কেউ বলল, কে বলেছে পঁয়তাল্লিশ! পঞ্চান্নর এক হপ্তা কম নয়। কেউ বলল, বাপ নেই বলে বুড়ো বরে ধরে দেওয়া, এ দৃষ্টান্ত এ যুগে বিরল। কেউ কেউ বা একেবারে শিকড়সুদ্ধ টান দিয়ে বলল, কাকার কী দোষ? আধুনিক মেয়েরা ওই রকমই। তারা যতক্ষণ না একটি শাঁসাল বর জোটাতে পারে, ততক্ষণ প্রেম করে বেড়িয়ে সাধ মিটিয়ে নেয়, তারপর জোটাতে পারলেই, সেই ব্যাঙ্কের খাতার গলায় মালাটি পরিয়ে দিব্যি তার পিছু পিছু গিয়ে সংসারে ঢোকে। ব্যাঙ্কের খাতা রঙিনই হোক আর কালোই হোক, চকচকেই হোক কি ঢিলেঢালা পুরনোই হোক এসে যায় না কিছু। টাকার অঙ্কটাই আসল।
এ সব গল্প করে করে বীথিকা তার স্বামীকে বলে, আমরা তো ওই পালিত সাহেবের বয়েস শুনে ওকে বলতে লাগলাম, গলায় দড়ি দে নর্মদা, গলায় দড়ি দে
ওর স্বামী বাধা দিয়ে বলল, কেন, তুমিই তো বল, টাকা থাকলেই হল।
আহা, সে তো এখন বলি। তখন কি আর বলতাম? তখন মায়া-কাজল পরা চোখ, উন্নাসিক মন। তাই বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমাদের বলাবলিতে কিছু হল না। নর্মদা তখন বিয়েতেই বদ্ধপরিকর। এবার সে দেখতে চায়, বিবাহের ওই বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে সত্যিই কোন শক্তি আছে কি না। দেখতে চায়, তার পিতামহী প্রপিতামহীরা খাঁটি দুধ আর খাঁটি ঘিয়ের মত খাঁটি প্রেমও ভোগ করে গেছেন কি না।
সত্যিই এ সব বলত নাকি সে?
বলত বৈ কি। ওই রকম অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তাই তো তখন ছিল তার। এখনকার ওই মিসেস পালিতকে দেখে কে বলবে, এক সময় ও এই রকম এক কল্পনাপ্রবণ স্বাপ্নিক মেয়ে ছিল। অকৃত্রিমের সন্ধান করতে করতে নিজে যে একখানি কৃত্রিমতার খনি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বোধও ওর নেই।
.
বীথিকার এ কথাটাও হয়তো নির্ভুল।
কারণ বিয়ের পর নর্মদা যখন পালিত সাহেবের ঘর করতে গেল, তখন ওকে ওর বন্ধুদের থেকেও তো বেশি দেখেছি আমরা। দেখছি ওর চেষ্টা আর হতাশা। দেখেছি আবার নতুন করে উদ্যম আর তার জন্যে নানা ছলাকলার আশ্রয় নেওয়া।
বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ও ওর পিতামহীর জীবনকে অন্বেষণ করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওর বয়েস সাতাশ, আর পালিত সাহেবের, বয়েস সাতচল্লিশ। ওর চেয়ে আরও কুড়িটি বছর পৃথিবীকে বেশী দেখেছেন সাহেব। যে পৃথিবী তার কাছে পড়া বইয়ের মত আকর্ষণহীন হয়ে গেছে, ঘসা পয়সার মত রূপহীন।
নর্মদার যে প্রত্যাশার আবেগ, তার চাহিদা মেটাবার উপকরণও নেই তার মধ্যে।
পালিত সাহেবের যৌবনের উদ্দাম আবেগ যে প্রেয়সীর পিছনে ছুটোছুটি করে তাকে করায়ত্ত করে সাফল্যের হাসি হেসেছে, সে প্রেয়সী হচ্ছে তার কোম্পানির উন্নতি। সেই তার মানস-সঙ্গিনী। বিয়ে করেছেন কতকটা একটি জীবন-সঙ্গিনীর প্রয়োজনে, কতকটা বা সাংসারিক সৌষ্ঠবের প্রয়োজনে। অবশ্য বিয়ে করার পক্ষে বয়েসটা যে তার বেড়ে গেছে, এটুকু সত্য তিনি আপন মনের কাছেও স্বীকার করেননি।
স্বাস্থ্য আর শক্তিমত্তার গর্বে স্ফীত পালিত সাহেব এদিকে সেদিকে স্বাস্থ্যহীন যুবকদের দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হেসেছেন। আর স্ত্রীকে যথেষ্ট টাকা এবং যথেচ্ছ স্বাধীনতার মর্যাদা দিয়ে ভেবেছেন, অনেক দিলাম।
অন্য যে কোন সাধারণ মেয়ে হয়তো এই পেলেই খুশি হত, সন্তুষ্ট হত। কিন্তু নর্মদা অন্য রকম। তাই সে আরও কিছু চায়।
চায় স্বামীর অনন্যমুখিতা।
পালিত সাহেব নবপরিণীতায় বিভোর থাকুন, বিমুগ্ধ থাকুন, কোম্পানির কাজ ভুলে যান, সাংসারিক কর্তব্য ভুলে যান–তা নইলে নর্মদার জীবন ব্যর্থ। যৌবন অপমানাহত।
কিন্তু পালিত সাহেব ইস্পাতের মানুষ। তবু নর্মদা চেষ্টা করে। আর এই চেষ্টাই দেখা দেয় কৃত্রিম কৌশলের মূর্তিতে।
হয়তো ঠিক পালিত সাহেবের অফিস বেরোবার মুহূর্তে হঠাৎ নর্মদার হার্টের কষ্ট শুরু হয়। কাতর নর্মদা কাঁদো কাঁদো অস্ফুট গলায় বলে, আবার মনে হচ্ছে এক্ষুনি হার্টফেল করব আমি।
পালিত সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে নেন, পারিবারিক চিকিৎসককে তন্মুহুর্তে চলে আসতে বলেন এবং ফোনেই নির্দেশ দেন–তেমন দরকার বুঝলে ডাক্তার যেন তার অফিসে ফোন করেন, কারণ তার না বেরোলেই নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশও দেন ডাক্তারকে, ডাক্তার যদি বোঝেন অন্য কোনও স্পেশালিস্টকেও কল দিতে পারেন।
সে কৌশল ব্যর্থ হয়।
তবে আবার কোন একদিন, পালিত সাহেব যখন হয়তো বাড়িতেই কোন এজেন্ট বা অ্যাটর্নি অথবা কোন পার্টনারের সঙ্গে বিশেষ আলোচনায় ব্যস্ত, চাকর গিয়ে খবর দেয়, মেমসাহেব বাথরুমে পড়ে গেছেন, কোন রকমে ঘরে এনে শোওয়ানো হয়েছে। সাহেব অবিলম্বে না গেলে
সাহেবের উপস্থিত সঙ্গীরা হাঁ হাঁ করে উঠেছেন, আলোচনা বন্ধ করে দিতে বলেছেন, এবং সাহেবও তৎপর হয়ে ভিতরে ঢুকে এসে ডাক্তারকে ফোন করতে করতে বারংবার প্রশ্ন করেছেন, হাড় ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে না তো?
এহেন সময় মাঝে মাঝে নর্মদা অজ্ঞানও হয়ে গেছে, কাজেই কথার উত্তর পাওয়া যায় নি। পালিত সাহেব নর্মদার খাস ঝিকে মুখে-চোখে জল দেবার নির্দেশ দিয়ে ফের বাইরে গিয়ে বসেছেন। ওরা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছেন, চলে এলেন আপনি? বেশী কিছু আঘাত পাননি তো!
পালিত মৃদু গম্ভীর হাস্যে বলেছেন, নেহাৎ কম আঘাত পেয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কষ্ট দেবে।
সে কি! সে কী! তাহলে এখন আলোচনা বন্ধ থাক, আপনি বরং
পালিত সাহেব অমায়িক হাস্যে বলেছেন, আমি আর থেকে কি করব? আমি তো ডাক্তার নই? ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, এসে দেখুন যদি এক্স-রে করার প্রয়োজন বোঝেন।
.
ডাক্তারের সামনেও সেই কথাই বলেছেন পালিত সাহেব, পরম ব্যগ্রতা দেখিয়ে।
এক্স-রে করার দরকার হয় তো
ডাক্তার সবিনয় হাস্যে বলেছেন, দরকার হলে আপনাকে বলতে হবে কেন, আমিই বলব।
মুখে একথা বলেছেন, আর মনে মনে বলেছেন, বুড়োবয়সে বিয়ে করে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে লোকটার। স্ত্রৈণ আর কাকে বলে! আহ্লাদী গিন্নীর আহ্বাদেপনাটুকুও বোঝবার ক্ষমতা নেই।
ক্ষমতা যে নেই, সেটাই সাড়ম্বরে প্রকাশ করেছেন পালিত সাহেব তুচ্ছ ব্যাপারে চিকিৎসায় রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে। কোনদিন অবিশ্বাসের ছায়ামাত্র উঁকি মারতে দেখা যায়নি তাঁর চোখের কোণে। বার বার সাবধানে থাকবার অনুরোধ জানিয়েছেন, নিটুট বিশ্রাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, উচিত মত সেবার জন্য দাসীর উপর আবার নার্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির দিকে চোখ ফেলে বলেছেন, আমার তো সময় হয়ে গেল, চলছি তাহলে।
এ সময় হওয়ার জন্যে শুধু অফিসের কাজই একমাত্র নয়। সন্ধ্যায় ক্লাবে যাওয়া, অন্যান্য কোম্পানীর পার্টিতে যাওয়া ইত্যাদি বহুবিধ যে কাজ আছে পালিত সাহেবের, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তার উদয়াস্ত দিনগুলো, তার কোনটাই ব্যাহত হয় না।
আচ্ছা চলছি।-বলে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী ঠিক চলে যান সাহেব। অবশ্য তেমন অবস্থায় যেখানেই যান, সেখান থেকে মাঝে একবার ফোন করে স্ত্রীর কুশলবার্তা নিতে ত্রুটি করেন না।
সর্বত্রই লোকে এই অনুমান করে, বুড়োবয়সে বিয়ে করে গোল্লায় গেছে লোকটা। লোকলজ্জাও নেই।
বন্ধুরা ঠাট্টা করেছে।
পালিত সস্নেহ হাস্যে বলেছেন, আহা, বেচারী বড্ড একলা। বাড়িতে তো আর কেউ নেই।
ফোন করলে নর্মদা কোনদিন কথা বলেছে, কোনদিন রাগ করে কথা বলেনি। নার্সকে দিয়ে বলিয়েছে, উনি ঘুমোচ্ছন।
যেদিন কথা বলেছে, তীব্র অভিমানে বলেছে, শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি এসে যেন আমার মরামুখ দেখ।
পালিত সাহেব লাইনের ওধারে হো হো করে হেসে উঠে বলেছেন, ন্যটি গার্ল!
.
এক একদিন এমন মনে হয়েছে নর্মদার, সাহেব ঠিক যে মুহূর্তে গাড়িতে উঠতে যাবেন, সেই মহা-মুহূর্তটি তাক করে সে একবার দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দেখবে, তার যাওয়া আটকায় কি না। কিন্তু অতদূর আর সাহস হয়ে ওঠেনি। কাজেই হার্টের কষ্ট, মাথার যন্ত্রণা, সারা শরীরের মধ্যে কী রকম যেন করা আর দুর্বলতায় মূৰ্ছা যাওয়া, এই কটা পরিচিত ঘরের মধ্য দিয়েই তাঁতের মাকু আনাগোনা করতে থাকে।
কিন্তু আশ্চর্য যে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না পালিত সাহেবের।
কাজেই অভিযোগ করবার কোথাও কিছু নেই।
এমনি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কিছুদিন কাটাবার পর কাবেরীর জন্মসূচনা দেখা দিল। আর নর্মদা আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তবে এইবার বুঝি দেখা দেবে মস্ত একটা ওলট পালট। স্বামীর কাছে মহামূল্যবান হয়ে উঠবে সে। কিন্তু এমনি ভাগ্য নর্মদার যে তার নিজের স্বাস্থ্যই তার সঙ্গে বাদ সাধল। যে সময় সাধারণত মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে সময় নর্মদার রূপ আর স্বাস্থ্য যেন বেড়ে গেল।
কাকী একদিন আচার আর ভাজা খাবারের সম্ভার নিয়ে দেখা করতে এসে ভবিষ্যৎবাণী করে গেলেন, নির্ঘাৎ মেয়ে হবে। রূপে বোঝায় বেটা বেটি, মেয়ের ছিরি পরিপাটি।
তারপর অবশ্য তিনি ধর্মের সাক্ষী একবার নর্মদাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাবও করলেন। বললেন, এ সময় তো মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়। মা বাপ না হয় নেই, আমরা তো আছি।
নর্মদা রাজী হল না।
ওর মনে হল এ সংসার থেকে সরে গেলে, ওর জায়গাটা বুঝি হারিয়ে যাবে।
পালিত সাহেব বললেন, ইচ্ছে হয়তো যাও না। না হয় দুদিন বেড়িয়েই এসো না।
নর্মদা ক্ষুব্ধ অভিমানে বলল, তুমি তো তাড়াতে পারলেই বাঁচো। তবু আমি যাব না। মরতে হয় এখানেই মরব।
পালিত বললেন, মরার কথা বলতে নেই।
.
নর্মদা আগে ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে সচেতন ছিল না, এখন অবিরত সেই অদৃশ্য অজানিত লোকে আবেদন পাঠাতে লাগল, যেন সেই ভয়ঙ্কর সময়ে, তার খুব ভয়ঙ্কর একটা কিছু হয়। যেন পালিত সাহেবের চৈতন্য জন্মায়।
কিন্তু কিছুই হল না।
একেবারে নেহাৎ সাধারণদের মত বিনা উদ্বেগে নির্বিঘ্নে নিরাপদে একটি হৃষ্টপুষ্ট কন্যা ভূমিষ্ট হল।
অবশ্য আড়ম্বর আয়োজনের ত্রুটি হল না, কিন্তু তাতে সুখ কোথায়? নর্মদার জন্যে যদি কেউ উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে রাতের পর রাত বিনিদ্র না কাটাল, নর্মদা বেঁচে ওঠার পর প্রাপ্তির বিহ্বল আনন্দে না বলল, উঃ কী দিনই গেছে–তবে আর কী হল নর্মদার?
অতএব জীবনের ঘোড়শোপচার আয়োজনের মধ্যেও এক বঞ্চিত দুঃখী হৃদয় নিয়ে দিন কাটাতে লাগল নর্মদা।
অনেকবার কল্পনা করল সে, সত্যিই যদি ভয়ঙ্কর একটা কিছু হত, কী এসে যেত পালিত সাহেবের?
ভেবে দেখল, কিছু না। কিছু না।
বিনিদ্র রজনীর প্রশ্ন উঠত না। উঃ কী দিনই গেছে–এ কথা কোথাও উচ্চারিত হত না।
এ দুঃখের মত দুঃখ আর কি আছে?
কিন্তু পালিত সাহেব?
সত্যিই কি লোকটা হৃদয়হীন?
না, সে দোষ তাঁকে দেওয়া যায় না। লোকটার দোষ শুধু সে প্র্যাকটিক্যাল। এসব ভাব বিলাসের মর্ম তার কাছে অস্পষ্ট।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব কিছু থাকতেও একটা মানুষ মনগড়া দুঃখ নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, এ দেখলে তার রাগ হয়, করুণা হয়।
নর্মদা যদি সেই এক অলৌকিক অমিয় মাধুরী দিয়ে গড়া বিহ্বল প্রেম না চাইত, যদি সুস্থ স্বাভাবিক একটা মেয়ে হত, পালিত সাহেব তাকে সুখী করতে পারতেন।
কিন্তু লোকটার ভাগ্যই বাদী।
তবু বুদ্ধিমান আর আত্মস্থ পুরুষ পালিত সাহেব ভাগ্যের এই পরিহাসে বিচলিত হন নি কোনদিন, খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে সকৌতুক উদারতায় সহ্য করে গেছেন।
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, নর্মদাকে কোনদিন টের পেতে দেন নি, নর্মদার এই অসুখ আর দুর্বলতা, মূৰ্ছা আর প্রাণ কেমন করার কৃত্রিমতা টের পাচ্ছেন।
বরং অহরহ সাবধান হতে বলার জন্যেই মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেত নর্মদা। আর স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীর স্বাস্থ্যের জন্য অকাতরে অর্থব্যয় দেখে ক্ষেপে যেত আত্মীয়জন, ভৃত্যজন।
বাস্তবিকই নর্মদার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ করাটা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই সময় হেনাকে এখানে এনে রেখেছিলেন পালিত সাহেব। আর হেনাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল কনক মিত্তিরের সঙ্গে নর্মদার হৃদয়গত জটিলতা।
কাবেরী তখন দোলনার শিশু।
.
কনক মিত্তিরের সঙ্গে নর্মদার প্রথম কি করে আলাপ হয় সে কথা আর এখন বোধকরি দুজনের কারোরই মনে নেই। তবু ভেবে মনে করলে মনে করা যায়, প্রায় আকস্মিক ভাবে পরিচয় হওয়ার সেই চেহারাটা এই ছিল। একদা বেশি রাত্রে কোথা থেকে যেন নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন পালিত দম্পতি, সহসা একটি প্রায় জনশূন্য এবং যানবাহন শূন্যও বটে, পথের ধার থেকে স্যুট পরা সিগারেট হাতে ধরা একটি স্মার্ট যুবক হাত তুলে গাড়ি থামানোর আবেদন করল।
গাড়িতে পালিত সাহেব নিজে এবং ড্রাইভার দুজনের রক্ষীবল, কাজেই ভয় পাবার কিছু নেই। গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন পালিত।
যুবকের আবেদন অবশ্য গাড়ি থামানোতেই থেমে থাকল না, বসতে পেলে শুতে চায় নীতিতে সে বলল, অনুগ্রহ করে তাকে যদি একটু লিফট দেওয়া হয়।
কারণ?
কারণ, সে এখানে এসেছিল কোন প্রয়োজনে, নিজের এলাকা থেকে অনেকটা পথ ব্যবধানে, কিন্তু এখন যান-বাহন পাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে তার রুগ্ন মা আছেন, ছেলে না বাড়ি ফিরলে তিনি নাকি আহার নিদ্রার কোনটাই করেন না।
এই এক মুশকিল! মৃদু হেসেছিল ছোকরা, কিছুতেই বুঝবেন না। এদিকে একখানা খালি ট্যাক্সি পাচ্ছি না।
মাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নর্মদার মন মুহূর্তে জয় করে নিল ছোকরা, পালিত সাহেবও খুব বেশি বিমুখতা বোধ করলেন না। শুধু দিব্যি পরিষ্কার গলায় একবার বললেন, নিতে আপনাকে পারি। ভাগ্যক্রমে আপনার আর আমার গন্তব্যস্থল যখন এক। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি বলি, কলকাতা শহরটিকে তো জানেন। আপনার এই সুন্দর চেহারাখানির মধ্যে কোন ভয়াবহ ব্যক্তির বাসা নেই, এ গ্যারান্টি কে দেবে? ধরুন ছোরা পকেটে নিয়ে উঠলেন আপনি।
ছোকরা হাস্যমুখে বলে, শুধু হাতে তো আর আপনাদের দু-দুটো লোককে ঘায়েল করতে পারব না? পকেট সার্চ করুন। করে দেখুন, যদি আপত্তিকর কিছু পান অবশ্যই নেবেন না।
সঙ্গে সঙ্গে নিজে নিজেই চটপট শার্টের পকেট উল্টে আর প্যান্টের পকেট থাবড়ে প্রমাণ দাখিল করল সে।
এদিকে নর্মদা স্বামীর বর্বর ব্যবহারে একেবারে স্তম্ভিত। কোন ভদ্রলোককে যে এভাবে সরাসরি এমন ভয়ানক প্রশ্ন করা যায়, এ তার ধারণার বাইরে। তাই নীচু গলায় স্বামীকে প্রায় শাসিয়ে বলে ওঠে, ছি ছি, অভদ্রতার কি একটা সীমা নেই? জানো, যে কোন সভ্য দেশে এ রকম অবস্থায় গাড়িবানেরা পথচারীদের নিজেই গাড়ি অফার করে। আর তুমি এই কথা বললে?
পালিত সাহেব মৃদু হাস্যে বলেন, পৃথিবীকে চিনতে তোমার এখনো বাকী আছে নর্মদা! কে বলতে পারে যাকে সাদরে গাড়ির বুকে আশ্রয় দেব, সে আদর ভরে আমার বুকে ছুরি বসাবে কি না।
বলেছিলেন, কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু যতই চতুর হোন পালিত সাহেব, তিনি কি এ আশঙ্কা করেছিলেন, ততক্ষণে তার ঘরণী পথচারীর জন্য তার হৃদয়-দুয়ার খুলে ধরেছে!
গাড়িতে সারাক্ষণ কথা বলল কনক মিত্তির, এবং সেই কথার মধ্যে এই কথাটাই পরিস্ফুট হল, রীতিমত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে সে, তবে সম্প্রতি বাপ হঠাৎ মারা গিয়ে বেচারা একটু অসুবিধেয় পড়েছে। কারণ তিনি যে তার ব্যাঙ্কের খাতা, ইনসিওরের কাগজপত্র, বহুবিধ কোম্পানির শেয়ার সম্পর্কিত দলিল ইত্যাদি কোথায় রেখে গেছেন, সেটা ধরা যাচ্ছে না। আসলে বড় বেশি সাবধানী ছিলেন তিনি।
অ্যাটর্নি বলছেন, সন্দেহবাতিক লোকেদের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে এই অবস্থা ঘটে। এমন কি শেষ অবধি লেপের চালি, ছাতের বরগার খাঁজ অথবা দেয়ালের গহ্বরেও হদিশ মেলে।
অন্য পক্ষে, অন্য কোনও অ্যাটর্নির সঙ্গেও যোগসাজস থাকতে পারে। অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে অ্যাটর্নি এই কথাই বলেছিলেন, ডাক্তার আর উকিল ব্যারিস্টারের কাছে কথা লুকোনোর মত। বোকামী আর কি আছে?
আপনার মাও জানতেন না?
প্রশ্ন করে বসেছিল নর্মদা, ব্যগ্রকণ্ঠে।
কনক মিত্তির সামনের সীট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, কিছু না। বাবা মাকে শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের মত স্নেহ আর মমতা দিয়ে আরামে রেখে গেছেন, কখনো চিন্তা বা পরামর্শের ভাগ দেন নি।
ঠিক আমার মত। মনে মনে বলে উঠেছিল নর্মদা।
আর উচ্চারণে বলেছিল, তা হলে এখন কি হবে আপনার?
দেখা যাক। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার আমার দূর সম্পর্কে জ্যাঠামশাই হন, মনে হয় তিনি কিছু জানেন। তাঁকেই ধরাধরি করছি। ভয় এই, জগতে কাউকে বিশ্বাস করা শক্ত।
তা যা বলেছেন। এতক্ষণে একটি কথা বলেন পালিত সাহেব।
আর এরপর থেকেই চুপ মেরে যায় কনক মিত্তির, নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গাড়ি থেকে নেমে নমস্কার করে চলে যায়।
.
বাড়ি গিয়ে ফেটে পড়ে নর্মদা।
ভদ্রলোককে ওভাবে অপদস্থ করলে কেন?
পালিত সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, সে কি, সযত্নে গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিলাম, অপদস্থ করলাম কখন?
করলে না? কি বলে বললে, পকেটে ছোরা আছে?
কী মুশকিল! আছে, এ কথা কখন বললাম? বললাম যে, থাকতে পারে।
ও একই কথা। তাছাড়া ভদ্রলোক যখন নিজের দুঃখের কথা বলছিল, একবারও একটু সহানুভূতি দেখালে না–
পালিত সাহেব হেসে উঠে বললেন, তাই নাকি, দেখাইনি বুঝি? তা, আমার ত্রুটিটা তুমি। পূরণ করে ফেললেই পারতে।
সেটা এমন কিছু শোভন হত না। কিন্তু আশ্চর্য, দরদ বস্তুটা তোমার মধ্যে এত কম!
পালিত সাহেব ফের হাসলেন। বললেন, খুবই স্বাভাবিক; কচি ডাবের মধ্যে জলের যে আধিক্য, ঝুনো নারকেলে তার অভাব। একটা লোক বিনা ভাড়ায় গাড়ি চড়তে পেয়ে যদি বিবেকের দংশনে কাতর হয়ে বেশ মজাদার কিছু গল্প শুনিয়ে দাম উসুল করতে চায়, তাতে কৌতুক অনুভব করতে পারি, দরদ জিনিসটাকে বাজে খরচ করব কেন?
তুমি তো ও জিনিসটা কোনখানেই বাজে খরচ করতে রাজী নও। কিন্তু গল্প কথাটার অর্থ কি?
গল্প কথাটার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বানানো কাহিনী।
তার মানে ভদ্রলোক যা বললেন সব মিথ্যে?
বিলকুল।
এ সন্দেহের কারণ?
হাস্যকর কথা চিরদিনই অবিশ্বাস্য। আমি তো কষ্টে হাসি চাপছিলাম, ওর ওই ব্যাঙ্কের খাতা খুঁজে না পাওয়ার গল্পের সময়।
ওটা কি এতই অসম্ভব?
আমার তো তাই মনে হল। মা পর্যন্ত জানেন না। তাজ্জব!
হঠাৎ নর্মদা বিছানায় এলিয়ে পড়া শরীরকে খাড়া করে উঠে বসে বলে, তাজ্জব! কিন্তু কেন বল তো? ধর আজ রাত্রে তুমি যদি হঠাৎ হার্টফেল কর, আমার অবস্থা তার থেকে কিছু উঁচুদরের হবে?
কথা শুরু করলে শেষ করা ছাড়া গতি থাকে না, তাই শেষ করতে হল। আর শেষ করেই নর্মদা প্রায় লজ্জায় অধোবদন হল। এমন রূঢ় কথা বলে বসবার ইচ্ছে কি ছিল তার?
পালিত সাহেব কিন্তু রাগ দুঃখ অভিমান কিছুই করলেন না। শুধু মিনিট খানেক চুপ করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, তা বটে। খুব জুৎসই কথাটা বলেছ, সত্যি। দেখ, খেয়াল নেই আমি নিজেই কত বেহুঁশ। একেই বলে প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। লোকটার সঙ্গে আর যদি দেখা হয়, আমার বিশ্বাস হবেই, মার্জনা চেয়ে নিতে হবে।
নর্মদা লজ্জা কাটাতে জোর করে হেসে উঠে বলেছিল, হা, রোজ সে তোমার গাড়িতে চড়াও হতে আসবে।
পালিত সাহেব বলেছিলেন, গাড়িতে না হোক বাড়িতে হতে পারে। গাড়িটা চলন্ত, কিন্তু বাড়িটা তো অচল।
পালিত সাহেবের এ ভবিষ্যৎবাণী অবশ্য সেদিন বিশ্বাস করে নি নর্মদা, ভেবেছিল, হ্যাঁ তাই আর কি। জীবনে আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে।
কিন্তু দিনকয়েক পরেই লজ্জায় পুলকে বিস্ময়ে আনন্দে স্বীকার করতে হল নর্মদাকে, পালিত সাহেবের সংসার-জ্ঞান নর্মদার থেকে অনেক বেশি। নর্মদা তো স্বপ্নেও আশা করে নি, ভদ্রলোক আবার একদিন কষ্ট করে বাড়ি বয়ে আসবেন পুনশ্চ ধন্যবাদ দিতে।
কিন্তু এল সে।
তার নাম জানতে পারলেন নর্মদা। আর কয়েকদিন পরে এও জানলেন, পালিত সাহেবের শুধু যে সাংসারিক জ্ঞানই প্রবল, তা নয়। মনুষ্য চরিত্রেও প্রবল জ্ঞান।
কারণ কনক মিত্তিরই একদিন নিভৃতে হৃদয় উজাড় করে ধরল নর্মদার কাছে। বলল, সেদিন যা বলেছে তার আগাগোড়াই মিথ্যা, বানানো।
ব্যাঙ্কের যে খাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। কারণ তার বাবার মৃত্যু হয়েছে অকস্মাৎ ব্যবসা ফেল হয়ে যাওয়ার দুরন্ত আঘাতে।
যেখানে যা ছিল সবকিছু নীলাম করেও পাওনাদারদের পাওনা সম্পূর্ণ মেটে নি, মায়ের গহনা বিক্রি করে পিতৃঋণ শোধ করতে হয়েছে তাকে।
তুলোর গদি থেকে একেবারে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাকরের পথে নামতে হয়েছে কনককে।
কিন্তু জগতের সামনে তার সেই নিঃস্ব চেহারা দেখাতে মাথা কাটা যায় কনকের। তাই খেয়ে না খেয়ে, ভাল পোশাক পরে বেড়ায় সে। বেড়ায় মুখে এক আভিজাত্যের খোলস এঁটে। বেড়ায় এই আশা নিয়ে যে কোন একদিন যদি সেই হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।
সকলের কাছেই তার অভিনয়, নয় শুধু নর্মদার কাছে। প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে নর্মদা তার কাছে দেখা দিয়েছে দেবীর মূর্তিতে।
বলতে বলতে চুপ করেছিল কনক মিত্তির।
নর্মদা ওর হাত চেপে ধরেছিল।
বলেছিল, আমায় যেমন তোমার বেদনার ভাগ দিলে, তেমনি ভাগ দাও তোমার অভাবের, অসুবিধের।
পাগলামি করতে নেই। বলেছিল কনক।
নর্মদা কিন্তু পাগলের জেদেই বলেছিল, কেন নেই? আমি বড়লোকের বৌ, কত টাকা আমার। হাত-খরচ করতে আলাদা কত টাকা পাই, সে টাকা যদি আমি ভালবেসে তোমায় দিই, দিয়ে ধন্য হই, কেন তাতে বাধা দেবে তুমি? তোমার পায়ে পড়ি কনক, এটুকু আমায় করতে দাও। জীবনের এতগুলো বছর যা খুঁজে বেড়িয়েছি, পাই নি, তুমি দিয়েছ তার আস্বাদ। তুমি তোমার দ্বিধাহীন মনকে মেলে ধরেছ আমার সামনে। এর মূল্যটুকুও অন্তত দিতে দাও আমায়। আর্থিক মূল্য বলে ভুল করো না। এ আমার দিয়ে ধন্য হবার সুখ, তোমাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার সুখ।
এমনি অনেক ভাল ভাল কথা বলেছিল নর্মদা আর হৃদয়কে দিয়েছিল সম্পূর্ণ বিকিয়ে।
কাবেরী তখন দোলনার শিশু।
তারপর নর্মদা আর কনকের সেই অন্তরালবর্তী প্রেম, নানান পরিবেশের দোলায় দুলতে দুলতে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল সে হিসেব কে রেখেছে।
শুধু হেনা ক্রমশ এ বাড়িতে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল।
নর্মদা কোনদিন হেনার অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে যায় নি। বরং হেনার ওই গরীবীয়ানা চালের কঠিন-কঠিন মুখ দেখলেই রাগে হাড় জ্বলে যেত তার বলে, অনুপস্থিতিটা বেশ আরামেরই মনে করত। দৈবাৎ কোনদিন হেনা এলেও অপদস্থ করবার ফিকির খুঁজত।
হয়তো এও অবচেতন মনের একটা জটিল ব্যাখ্যা। যদিও নর্মদা মনে করত জগতের কেউ কনকের প্রতি তার সুগভীর ভালবাসার খবর টের পায় না, এবং টের না পাবার জন্যে, যত পারত সহজ সহজ কথা বলত কনকের সঙ্গে, আর যত সম্ভব সহজ ব্যবহার করত। তবু কোথায় কোনখানে যেন এ সন্দেহ কাঁটার মত ফুটত, হেনা বোধহয় বুঝতে পারে। হেনাটা ভারি চতুর। হেনার দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ। হেনা যত না আসে ততই ভাল।
.
নির্বোধ নর্মদা স্বপ্নেও কি ভাবত দাসী-চাকর মহলে মেমসাহেবের আচার আচরণ একটা খোস গল্পের খোরাক, পালিত সাহেব স্ত্রীর সম্পর্কে আর কোন আশা পোষণ করেন না, আর তার সেই দোলনার শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার বন্ধুকে ভয়ঙ্কর ভালবাসতে বাসতে কোন এক অশুভ মুহূর্ত থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণা করতে শিখেছে।
স্বামীর কাছে দামী হবার জন্যে সেই হাস্যকর চেষ্টার নেশাটা নর্মদার ধীরে ধীরে কখন যে কমে এসেছিল, সেকথা নিজেই জানে না সে।
ক্রমশ আর এক নতুন নেশা জেগেছিল তার, সেটা হচ্ছে কারণে অকারণে বাড়িতে পার্টি দেওয়া। হ্যাঁ, পার্টি শব্দটাই পছন্দ করত নর্মদা। নিতান্ত দু-চারজন বন্ধুকে বাড়িতে ডাকলেও বলত পার্টি দিচ্ছি।
অবশ্য মাঝে মাঝে সমারোহও করত।
আরও একটা কাজ করত সে। সেটা হচ্ছে আক্ষেপ। স্বামী-কন্যা, চাকর-বাকর আর স্বাস্থ্য, এইগুলি হচ্ছে তার আক্ষেপের বস্তু। অনেক সময় এমনও মনে হত, এই আপেক্ষগুলি প্রকাশ করবার জন্যেই বুঝি এত লোককে বাড়িতে ডাকে সে।
হয়তো এও মনস্তত্ত্বের আর এক তত্ত্ব।
হয়তো কোথাও কোনখানে সূক্ষ্ম কোন অপরাধবোধ পীড়িত করত তাকে, হয়তো এই আশঙ্কা মনের গভীরতর স্তর থেকে ঠেলা মারত, আমাকে কেউ কিছু মনে করছে না তো?
যদি কিছু মনে করে? দি নর্মদার নাম নিয়ে হাসাহাসি করে? তার থেকে সর্বদা ওদের সবাইকে পরিপাটি ভোজে পরিতুষ্ট করো, আর নিজে সে কত দুঃখী, কত বেচারী, কত বঞ্চিত, সংসার-জ্বালায় কত জর্জরিত তার ফিরিস্তি দিয়ে দিয়ে আদায় করো সহানুভূতি আর সমবেদনা।
কিন্তু এত কথা ভেবেই কি এসব করত নর্মদা?
বোধহয় নয়। হয়তো এ শুধু অবচেতন মনের কারসাজি।
নইলে নিজেকে তো সে ভালই প্রবোধ দিয়ে রেখেছিল, আমি তো স্বামীর কাছে অবিশ্বাসিনী হচ্ছি না, আমি তো কোন পাপ করছি না।
মানুষ কী তার বন্ধুকে ভালবাসে না? ভালবাসে না দেবতাকে?
স্বামীর সংসার ভাসিয়ে দিয়ে আমি তো কোথাও চলে যাই নি? ওর কি বন্ধু-বান্ধব নেই? ও তাদের সঙ্গে গল্প করে না? আড্ডা দেয় না? তাদের জন্যে আকর্ষণ অনুভব করে না? একদিন ক্লাবে যাওয়া বন্ধ হলে ছটফট করে না?
তবে?
আমি যদি আমার কোন বন্ধুকে ভালবাসি, দোষ কোথায়?
কনক মিত্তির আর পার্টি–এই দুই নেশায় দুই-চক্ষু-অন্ধ নর্মদা ভুলে নিশ্চিন্ত ছিল যে দুনিয়াটা চক্ষুম্মান।
তবে এ সবই গোড়ার দিকের ব্যাপার।
ধীরে ধীরে নর্মদা থেকে মিসেস পালিত হয়ে উঠেছেন তিনি আর ক্রমশ বোধকরি কোনকিছু ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলেন। সবকিছুই মজ্জাগত একটা অভ্যাসের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই অভ্যাসের বশেই দৈবাৎ যদি কোন সন্ধ্যায় কনক না আসত, রাত নটায় টেলিফোনের রিসিভার হাতে তুলে নিতেন মিসেস পালিত, গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলতেন, হা, আমি মিসেস পালিত কথা বলছি। এলে না কেন আজ? কী রকম রেগে গেছি তা বুঝতে পারছ না বুঝি? আচ্ছা, কাল এসো না-বুঝিয়ে ছাড়ব।
ওদিক থেকে আলস্য-বিজড়িত কণ্ঠ ভেসে আসত, পারলাম না আজ। শরীরটা কেমন একটু–না না, তা বলে যেন সক্কালবেলাই তল্লাস নিতে ছুটে এস না। যাব, যথানির্দিষ্ট সময়ে যাব। আশ্চর্য, এই জন্য এত রাত্রে! ও হো হো, তা বটে। আচ্ছা। আচ্ছা ছাড়লাম।
কনকের তাহলে নিজের টেলিফোন আছে! আসলে কনক কি তাহলে অবস্থাপন্ন?
নিজের সম্পর্কে যা কিছু সে বলেছে, তার কোনটাই খাঁটি নয়? তাই তার কথায় আর কাজে সামঞ্জস্যের অভাব?
না, তা নয়। ওর অবস্থা গড়ে দিয়েছেন মিসেস পালিতই। একদা ও যখন এসে বলেছিল ওর সেই রুগ্ন মা মারা গেছেন, আর বন্ধক দেওয়া বাড়িখানাও বিক্রি করতে হচ্ছে মায়ের শ্রাদ্ধ করতে তখন ব্যাকুল হয়ে ওর বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত, যদি কোনরকমে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হয়, তাই দেখতে। বলেছিলেন, আমরাও তো কিনে নিতে পারি কনক, একটা প্রপার্টি হিসেবে। তারপর না হয় তোমাকেই ভাড়াটে রাখব।
ভাড়াটে কথাটা বলে অবশ্য হেসেছিলেন।
কিন্তু কনক কিছুতেই নর্মদাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজী হয় নি। বলেছিল, না, ওসব পুরোনো স্মৃতি ধুয়ে মুছে শেষ হোক। মার জন্যেই বাড়িটা ছাড়তে পারতাম না। এখন আর কি। মুক্ত জীবন। না না, তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারব না, সেই আমার দুঃখের মধ্যে, দৈন্যের মধ্যে।
কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই তো ভালবাসার আসন কনক।
না না। ওটা আমার থিওরি নয়। আমি বুঝি, নেহাৎ গরীব লোকও যখন বিগ্রহের সেবা করে, আয়োজন করে যোড়শোপচারে।
অতএব কনকের বাড়ি মিসেস পালিতের আর দেখা হয় নি, প্রপার্টি হিসেবে কিনে রক্ষা করাও হয়নি। মাতৃ-শ্রাদ্ধের হাঙ্গামা মিটে যাবার পর মুক্তপুরুষ কনক মিত্তিরকে তিনি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন শহরের একটি ভাল হোটেলে। সেখানেই ছিল কনক মিত্তির, অর্থাৎ তিন বছর আগের সেই দিনটি পর্যন্ত ছিল।
কাজেই টেলিফোনও তার করায়ত্ত ছিল।
কিও এত টাকা কি শুধু নিজের খরচের টাকা থেকে জোগানো সম্ভব হত মিসেস পালিতের? কারণ সর্ব তোমার–এভাবে তো কখনো সবকিছু উজাড় করে দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না পালিত সাহেব। তিনি স্ত্রীকে সংসার খরচ দিতেন, মোটা অঙ্কে হাত খরচ দিতেন, আর মাঝে মাঝে বাড়তি খরচ দিতেন, স্ত্রীর পার্টির সাধ বাবদ। সর্বস্ব তুলে দিতেন না। তার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে অতটা পর্যন্ত হয় না।
অতএব মিসেস পালিতকে মাঝে মাঝেই লুকিয়ে বেচতে হত সোনার গহনা, রূপোর বাসন, এটা-ওটা-সেটা।
বড়লোকের স্ত্রীরা এমন অনেক করে থাকেন, কাজেই যেসব দোকানে এ ব্যাপার সংঘটিত হত, সেখানে খুব বেশি আশ্চর্য কেউ হত না, এবং ব্যাপারটা গোপন রাখার ব্যাপারে সততা রক্ষা করেই চলত।
এসব সময় ড্রাইভারকেও সাক্ষী রাখতে চাইতেন না মিসেস পালিত। নিজে শখের ভান করে একা ড্রাইভ করে বেড়াতে বেরোতেন।
না, কনককেও কোনদিন জানতে দেন নি এ টাকার উৎস কোথায়।
তবে ইদানীং একটু মুশকিল হয়েছিল এই পালিত সাহেব নানা উপলক্ষে স্ত্রীকে যে সব অলঙ্কার দিচ্ছিলেন সেগুলো আর সোনার হচ্ছিল না। সবই জড়োয়া। ফ্যাসান আর চাল বেড়ে গিয়েছিল পালিত সাহেবের। বলতেন, সোনা? সোনা সভ্যসমাজে অচল। সোনার গহনা পরবে কেরানীর স্ত্রী। তোমার প্রেস্টিজের জন্যে হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্না এসব দরকার।
কিন্তু নর্মদার দরকার যে তাতে মেটে না। ওসব জিনিস ট করে বিক্রি করা যায় না। বিক্রি করতে নিয়ে যেতে সাহসও হয় না!
কাজেই ইদানীং স্বামীকে বাজারদরের অগ্নিমূল্য আর চাকরবাকরের পুকুরচুরির গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়তি টাকা আদায় করতে হত মিসেস পালিতকে।
কনক মিত্তিরের নৈবেদ্য ঠিকই বজায় থাকত, যে নৈবেদ্য গ্রাস করে দিব্যি এক অদ্ভুত জীবন যাপন করত কনক মিত্তির। না, বিয়ের চিন্তা সে কোনদিন করে নি, নিজের কোন সংসার পাতবার স্বপ্নও দেখে নি। আরামে জীবন কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উচ্চতর কোন লক্ষ্যও দেখা যেত না তার মধ্যে। সে পালিত সাহেবের টাকায় আমীরি চালে থাকত, পালিত সাহেবের চাইতেও দামী পোশাক পরত, আর পালিত সাহেবকেই নস্যাৎ করার ভঙ্গীতে ব্যঙ্গহাসির তীক্ষ্ণ ছুরি ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে তারই বাড়িতে এসে বসে থাকত কায়দা করে।
মিসেস পালিতের অতিথি অভ্যাগতেরা কনক মিত্তিরকে ভিতরে ভিতরে যে দৃষ্টিতে দেখুক, সামনে পরম সমীহের দৃষ্টিতে দেখত।
আর কনক মিত্তির ওদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত, যেন হে ঈশ্বর, কী গতি হবে এদের, এই সব বোকা মুখ গ্রাম্যদের! হ্যাঁ, দৃষ্টিতে এমনি একটি বিশেষ ভঙ্গীই কনক মিত্তিরের আত্মরক্ষার বর্ম ছিল।
মিসেস পালিত মোহিত হতেন ওই দৃষ্টিতে। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ওই দৃষ্টির দিকে। কারণ ওই বিশ্বনস্যাৎ দৃষ্টিটার মধ্য দিয়েই যেন কনক মিত্তিরের চেহারার জৌলুস বাড়ত, আকর্ষণ বাড়ত।
এইভাবেই চলছিল। চলে আসছিল।
যেন চন্দ্র সূর্যের অমোঘ নিয়মের মত! এর আর ব্যতিক্রম নেই। একটা দোলনার শিশু যে আস্তে আস্তে কিশোরী হয়ে উঠল, একটি তন্বী তরুণী যে তন্বীত্ব হারিয়ে ভার-ভারিক্কি মহিলা হয়ে উঠল, এসব ঘটনা এই নিয়মের উপর ছায়াপাত করল না। দীর্ঘ বারো তেরোটি বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল যেন।
তারপর এল সেই সন্ধ্যা।
কাবেরীর ত্রয়োদশ জন্মদিনের সেই সন্ধ্যা।
যে সন্ধ্যার কিছুদিন আগে থেকেই কনক মিত্তির বিদায় রাগিণী গাইতে শুরু করেছিল।
অনবরত নিভৃতে জানাচ্ছিল সে মিসেস পালিতের কাছে, এমন করে আর পারছে না সে। ধিক্কার এসেছে এ জীবনে।
এতদিন ধরে ভেবে এসেছিল আবার বাপের মত বিজনেস করে হৃত-গৌরব ফিরিয়ে আনবে, এই গ্লানির ভার থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু এখন ক্রমশ বুঝছে সে ক্ষমতা তার নেই।
এই অক্ষমতার সত্য ধরা পড়ে গেছে তার নিজের কাছে।
অতএব সাধারণ একটা চাকরী-বাকরী জোগাড় করে চলে যেতে চায় সে। কলকাতা থেকে দূরে, পরিচিত জগৎ থেকে দূরে।
সেখানে একেবারে সহজ সরল মধ্যবিত্তের জীবনে থাকবে কনক মিত্তির, তার ধার করা পরিচয় ছেড়ে।
মিসেস পালিত ছল ছল চোখ তুলে বলতেন, পারবে?
পারতেই হবে।
আমি কি করে থাকব, তা ভাববে না?
ভাবতে গেলে পারব না। নিতান্ত প্রিয়জনও তো মারা যায় লোকের, এই ভেবে তোমাকে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেব।
এত করবে, আর কলকাতায় থেকেই ভাগ্যকে ফেরানো যায় কি না সে চেষ্টা করবে না?
জানি ওটা হবে না।
মিসেস পালিত বলতেন, সারাদিন কি তুমি কর তুমিই জানো। কিন্তু তেমন করে চেষ্টা কোনদিন করলে না।
তখন কনক মিত্তির হেসে উঠত।
বলত, তেমন চেষ্টা করতে যেমন মূলধনের দরকার, সে আর তোমার ওই পকেট-মানিতে কুলোবে না মিসেস।
কে বলেছে?
সাধারণ বুদ্ধিই বলছে। তবে যদি, হেসে উঠত কনক, পালিত সাহেবকে বলল, তোমার ভাঁড়ারের সেরা রত্নটিই তো মিত্তিরকে দান করে বসে আছ, এবার ব্যাঙ্কের পাশ বইটাও তাকে দান করে ফেলল, তাহলে হয়তো
মিসেস পালিত বলতেন, তা বলে আমার ভাড়ার এখনো অত দুঃস্থ হয়ে যায়নি যে ওর ভাঁড়ারের দরজায় ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
হ্যাঁ, এই কথাই সেদিন বলেছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু কোন সাহসেই যে বলেছিলেন!
অবিরাম গতিতে আর অবিরল ধারে অর্থোৎসর্গ করতে করতে ভিতরে ভিতরে যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, এ কি জানতেন না? না বুঝতে পারতেন না?
শেষ সম্বল ছিল তো শুধু ওই জুয়েলারীগুলো!
তা সেই সম্বল ভেঙেই শেষরক্ষা করতে গিয়েছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
.
সেই শেষ সম্বলের নৈবেদ্য সহজভাবে গ্রহণ করে, পরদিন আবার সহজভাবে এ বাড়িতে এসে উদয় হল না কনক মিত্তির, সেই তার ব্যঙ্গ হাসির বর্মটি পরে।
ভয় পেয়ে উধাও হয়ে গেল।
একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল।
একদিন আধদিন নয়, দীর্ঘ তিনটি বছর।
সমস্ত পরিকল্পনা ফেঁসে গেল মিসেস পালিতের। কী বললেন? কনক? কনক একাজ করেছে? নিজের চোখে দেখেছেন আপনি? হতে পারে না। বলে দৃঢ় প্রতিবাদে কনক মিত্তিরের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার আর কোন উপায় তার হাতে রইল না।
মিসেস পালিতের অন্তর-জীবনের কথা থাক, বহির্জীবনেও দীর্ঘ একটা কলঙ্কের রেখা টেনে দিয়ে যে লোকটা বিদায় নিল, সে বেঁচে রইল কি মারা গেল তাও জানতে পারলেন না তিনি।
আশ্চর্য মানুষের মন!
যাকে একদিন মাত্র না দেখে থাকতে পারতেন না মিসেস পালিত, হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে তার মৃত্যু-সংবাদ কামনা করতে থাকলেন তিনি। অনেক দিন যাবৎ এ সংবাদ কামনা করেছেন মিসেস পালিত। খবর আসুক, নয়তো খবরের কাগজে খবর উঠুক–কনক মিত্তির নামক এক ব্যক্তি অমুক দিন ট্রেনের তলায় অথবা অজ্ঞাত ব্যক্তির দুর্ঘটনায় মৃত্যু! অমুক দিন অমুক সময়। তাহার সঙ্গের কাগজ-পত্রে জানা যায় লোকটির নাম–
প্রেমাস্পদের মৃত্যুর মূল্যে প্রেমাস্পদের সুনাম রক্ষা করতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত।
তা হল না।
কিন্তু যে লোক এতবড় একটা কলঙ্কের ছাপ মেখে বিদায় নিল, তার জন্য শোক করা যায়, অধীর হওয়া যায় না, ভেঙে পড়া চলে না।
মিসেস পালিতকে তার নিজের পরিচয়ে অটুট থাকতে হবে। এ এক ভয়ঙ্কর দায়।
এই দায়ের দায়েই তিল তিল করে নিঃস্ব হয়েছেন মিসেস পালিত, নিশ্চিন্ততার সহস্র উপকরণ মজুত থাকতেও দুঃসহ চিন্তার যন্ত্রণায় দিনে দিনে ক্ষয়িত হয়েছেন, অনবরত মিথ্যার জাল বুনে বুনে এক মিথ্যাময়ী হয়ে উঠেছেন, তবু পারেন নি এ দায় মুক্ত হয়ে পালিয়ে যেতে, অন্য নতুন পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে সার্থক করে তুলতে।
সেই কিশোর কাল থেকে একখানি নির্ভেজাল খাঁটি ভালবাসার প্রাণ খুঁজতে খুঁজতে নিজেই তিনি বিলকুল ভেজাল হয়ে গেছেন, এ বোধ যে আসেনি মিসেস পালিতের নিজের মধ্যে তার একমাত্র কারণ ওই বাইরের পরিচয়ের ঠাট।
এ ঠাট বজায় রাখা চাই।
সেই ঠাট বজায় রাখতে কনক নামটাকে এ বাড়ি থেকে মুছে ফেলে নতুন করে হৈ হৈ-তে মেতে উঠলেন মিসেস পালিত। পার্টি দেওয়ায় কমতি হল না, এবং বিষণ্ণ বেদনার কোন ছায়াকে মুখের ধারে কাছে আসতে দিলেন না।
আর কিছুদিন পর থেকেই কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মাতলেন। তার সঙ্গে নিত্য গান শুনতে যাওয়া, অকারণ গল্প।
না, কেউ যেন না বোঝে কনক তার কেউ ছিল।
কনককে মিসেস পালিত কলকাতা ছেড়ে যেতে পায়ে ধরে নিষেধ করেছিলেন, কলকাতায় থাকার রসদ জোগাতে ধরে দিয়েছিলেন রত্নাভরণের সম্ভার, তবু সত্যিই কি ভেবেছিলেন তিনি, কনক নিশ্চয় ফিরে আসবে?
কনকের পশ্চাৎপট কি সে আশ্বাস দিয়েছিল মিসেস পালিতকে?
মূৰ্ছার অবকাশে অতীতের সমস্ত কথা ভেবে নিলেন মিসেস পালিত।
.
কিন্তু অনির্দিষ্ট কাল ধরে মূছাহত হয়ে পড়ে থাকা যায় না। চোখ মেলতে হল মিসেস পালিতকে।
বলতে হল, জল খাব।
বীথিকা তার স্বামীর কাছে সেই সুরের নকল করে হেসে উঠল। বলল, স্রেফ নাটকের নায়িকার মূৰ্ছাভঙ্গ। সোজা কথা নয়, সাতদিক থেকে সাত গ্লাস জল এল, তিনি এক চুমুক জল খেয়ে ক্ষীণভাবে বললেন, কনক, তোমাকে কে ডেকেছে?
কেউ না। আমি নিজেই এসেছি। বলল কনক মিত্তির।
নর্মদা বলল, এতদিন কোথায় ছিলে? খোঁজ নেই, খবর নেই, জানো তোমার এই হঠাৎ নিরুদ্দেশের ব্যাপার দেখে যে খুশি তোমার নামে রটিয়েছে। কেউ বলেছে চোর, কেউ বলেছে ডাকাত-গুণ্ডা-খুনে
যাক, আমার সম্বন্ধে লোকের ধারণাটা নির্ভুল দেখে খুশিই হচ্ছি। বলে হাসল কনক মিত্তির।
ভাবতে পারো? বীথিকা বলল, আরও হেসে আরও কি বলল জানো? না, সে তুমি স্বপ্নেও ধারণা করতে পারবে না।
বীথিকার স্বামী বিকাশ বলল, অনেক সত্যি কথাই আমাদের ধারণার অতীত। কি বলল তোমাদের হারানো মানিক?
যা বলল, সে শুনে আমাদের হাত-পা এলিয়ে এল। উঃ, ভাবা যায় না, এত নির্লজ্জ মানুষ হয়।
তোমার কথায় গৌরচন্দ্রিকাটা বেশি, বলল বিকাশ।
বীথিকা বলে উঠল, গৌর থাকলেই চন্দ্রিকা থাকবে। কী বলল শুনবে? বলল, তোমাকে বেঁধে রেখে তোমার জুয়েলারিগুলো যখন নিয়ে গেলাম, ভাবিনি যে আবার ফিরে আসব। কিন্তু
কথা শেষ হল না, ওর ওই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্যের ঢেউ বয়ে গেল।
পালিত সাহেবের ভাইপো অশোক দাঁড়িয়ে উঠে লোকটার জামার কলার চেপে ধরতে যায় আর কি।
আশ্চর্য, একটু বিচলিত হল না লোকটা। বরং একটু হেসে বলল, থাক মাস্টার পালিত, নিজেই যখন ঘাড়টা নিয়ে হাজির হয়েছি তখন ওতে কোপ বসাবার জন্যে আপনাকে জামার কলার চেপে ধরতে হবে না।
পুলিশে দেওয়া হবে আপনাকে।
ফোড়ন কেটে উঠলেন মিস্টার রাহা : এতদিন পরে, রসদ ফুরিয়ে গেছে বলে আবার বুঝি এ বাড়িতে মাথা গলাতে চান নির্দোষী দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে! মিস্টার পালিত, আপনি এখনো কি করে নিশ্চেষ্ট হয়ে রয়েছেন? আশ্চর্য! এখনো একে পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করাতে ইতস্তত করছেন? ধন্য আপনার ভদ্রতা আর ধৈর্য।
আমরা অবশ্য ভাবলাম, বীথিকা বলে, মিস্টার রাহার এত ফড়ফড়ানির দরকার কি? কিন্তু এও না ভেবে পারিনি, সত্যি, ধন্য মিস্টার পালিতের ধৈর্য আর ভদ্রতা। লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তো বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে ওর টুটি চেপে ধরা উচিত ছিল। আশ্চর্য যে, এর পরেও সে ধৈর্য তাঁর অটুট রইল। আর কনক মিত্তিরকে অগ্রাহ্য করে তখন গিন্নীকে সাবধান করতে লাগলেন, এসব বিশ্রী গোলমালের মধ্য থেকে সরে গিয়ে ওঘরে বিশ্রাম নিতে পারলেই তোমার ভাল হত নর্মদা। নানা কথার চাপে আবার হয়তো ফেন্ট হয়ে পড়বে তুমি।
কিন্তু নর্মদা মুখপুড়ি এত আদরের মর্যাদা উড়িয়ে দিয়ে সেই চোরটার দিকেই তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে এলে কেন আবার? যাও, চলে যাও, আমি বলছি এখনই চলে যাও।
যাব, এখনই চলে যাব, শুধু
বলতে না বলতে মিস্টার রাহা আবার সর্দারী করে বলে উঠলেন, মাপ করবেন আমাকে মিস্টার মিত্তির, পালাবার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বেন।
কনক মিত্তির কেমন যেন বিষণ্ণ হেসে বলল, আপনি তো দেখছি বড্ড রগচটা, পালাবার মতলব থাকলে আসব কেন? তবে আপনি বৃথা ব্যস্ত হচ্ছেন, মিস্টার পালিত পুলিশ ডাকবেন না।
ডাকবেন না! অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বেজে উঠল।
কনক মিত্তির তেমনি হেসে বলল, না ডাকবেন না। সে ইচ্ছে থাকলে উনি তখনই ওয়ারেন্ট বার করে ধরে এনে ফাঁসি দিতেন আমায়। কী বলেন মিস্টার পালিত, তাই না? এই তিন তিন বছর অপেক্ষা করে বসে থাকতেন কি, আসামী কবে নিজে বামালসুদ্ধ এসে ধরা দেবে এই আশায়?
এই সময় নর্মদা হঠাৎ ঠিকরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ঠিক আছে, আমিই তোমায় পুলিশে দেব। এতই যখন সাহস তোমার।
বিকাশ হেসে উঠে বলে, বাঃ, এ যে সত্যই রীতিমত একখানি নাটকের দৃশ্য।
হ্যাঁ, একেবারে ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু এখনই শেষ হয়নি, আরও বাকি আছে। নর্মদা যেই টেলিফোনের কাছে যেতে গেছে, কাবেরীটা কোথা থেকে ছুটে এসে ওর সেই আহ্লাদে গলা ত্যাগ করে ভীষণ স্বরে বলে উঠল, বেশি বাড়াবাড়ি করো না মা। পুলিশ ডাকলে সত্যি কথা প্রকাশ পেয়ে যেতে দেরি হবে না তা মনে রেখো। আমিই দেব তাহলে সাক্ষী। আমি সব জানি। আমি সব দেখেছি।
নর্মদা পাঙাস মুখে বলল, সত্যি কথা? কী সত্যি কথা প্রকাশ হবে শুনি? কী তুই দেখেছিস? কী তুই জানিস?
বিকাশ হেসে উঠে বলে, আশ্চর্য বটে বীথিকা, এত সব হচ্ছে আর তোমরা সবাই চুপচাপ . বসে আছ?
তা থাকব না তো কী? বীথিকা বলে, আমরা তো চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ রঙ্গমঞ্চের অভিনয় দেখছি।
.
তা বীথিকা কথাটায় বিশেষ কিছু রং চড়ায়নি।
বাস্তবিকই তখন পালিত সাহেবের সেই ড্রয়িংরুমে প্রায় সকলেই চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ বসেছিল এক রঙ্গমঞ্চের সামনে।
মেয়ের এই অতর্কিত আক্রমণে মিসেস পালিত যখন পাঙাস মুখে বললেন, কী সত্যিকথা প্রকাশ হয়ে পড়বে? তখনও পালিত সাহেব একটা অগ্নিগর্ভ দৃষ্টি মেলে বসে রইলেন নির্বাক নিষ্কম্প। কথা কইলেন না। বোধকরি কথা থেকে কথা সৃষ্টি এই ভেবেই নীরবতা শ্রেয় মনে করলেন তিনি।
আর উপস্থিত সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে কনক মিত্তির রীতিমত হেসে উঠে বলে উঠল, বাঃ, এই কবছরে কাবেরী তো মস্ত লায়েক হয়ে উঠেছ দেখছি? অনেক কথা শিখেছ। কিন্তু কোন্ সত্যিটা প্রকাশ হয়ে পড়বার ভয়ে তুমি পুলিশ আসা আটকাচ্ছ বল তো? তোমার জানা সেদিনের সেই সত্যি কথাটা ছাড়া, আর একটা ভয়ঙ্কর সত্যি কথাও যে এই জুয়েলারিগুলোর মধ্যে গাঁথা আছে কাবেরী, সেটা জান না কি? বড় দুঃখিত নর্মদা সে সেই ভয়ঙ্কর সত্যিকথা এই ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। বিশ্বাস করো, ঠিক এ ইচ্ছে আমার ছিল না। ভেবেছিলাম তোমার জিনিস তোমাকে ফেরৎ দিয়ে, শুধু নেবার অক্ষমতা জানিয়ে ফিরে যাব। আর এও জানতাম নির্বিঘ্নেই যেতে পারব। কারণ পালিত সাহেব এত বুদ্ধিহীন নন যে এ নিয়ে হৈ-চৈ করবেন। কিন্তু
হঠাৎ এতক্ষণের স্তব্ধতা ভেঙে পালিত সাহেব গর্জন করে ওঠেন, চুপ।
কনক হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে সেই পুরনো ব্যঙ্গের হাসি টেনে বলে, চুপ এখুনি আপনি আমায় করিয়ে দিতে পারেন পালিত সাহেব, চিরদিনের মতই কণ্ঠরোধ করে দিতে পারেন, কারণ পুলিশের কণ্ঠরোধ করে ফেলবার মত পয়সা আপনার আছে। জানি, তবু জানি, এ সবের কিছুই করবেন না আপনি। সাহস থাকলে অনেকদিন আগেই পারতেন আমার কণ্ঠরোধ করে ফেলতে। কিন্তু সে সাহস আপনার নেই। থাকে না আপনাদের মত বড়লোকদের। সমাজে মাথা উঁচু করে দশের একজন হয়ে থাকবার মোহে আপনারা না করতে পারেন এমন নীচ কাজ নেই। আপনার জন্যে, আপনাদের মত এই হতভাগ্যদের জন্যে আমার ভারি দুঃখ হয় মিস্টার পালিত, যারা সামাজিক সুনামে কালি পড়বার ভয়ে স্ত্রীর প্রেমিকের আধিপত্য সহ্য করে চলে, তাকে খাইয়ে পরিয়ে গোকুলে বাড়তে দেয়। কিন্তু আজ আর অস্বীকার করব না, আপনার স্ত্রী এতদিন আমায় যা ভেবে এসেছেন, আমি তা নই। প্রেমটা আমার ছল। আমি একজন পাকা জুয়াচোর, আমার নাম, আমার পরিচয় সবই ভূয়ো। হ্যাঁ, এই দীর্ঘদিন ধরে তোমায় আমি ঠকিয়ে এসেছি নর্মদা, তোমাকে ঠকিয়ে খেয়েই আমার জীবনের অনেকগুলো দিন আরামে কেটেছে। ওই আমার পেশা। অবিশ্যি এমন আরামের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা আর কখনো জোটেনি।
কিন্তু ঠকাতে ঠকাতে কখন যে পালা বদল হতে শুরু করেছিল টের পাইনি। টের পেলাম তোমার এই অলঙ্কারের মধ্যেকার করুণ প্রহসন দেখে। দেখে পর্যন্ত অদ্ভুত এক মমতায় মনটা গলে যেতে লাগল। নিজের উপর ধিক্কার এসে গেল। ভাবলাম, ছি ছি, এত দিন ধরে আমি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে এসেছি! এই যে কাবেরী, চলে যেও না, সেই দ্বিতীয় সত্যটি দেখে যাও বলেই হাতের সেই রংচটা অ্যাটাচিটা হাতের চাপে খুলে ধরে কনক মিত্তির।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে হাঁ হয়ে যায় সবাই।
সীলিং জোড়া আলোয় ভর্তি ঘরে বাক্সভর্তি গহনাগুলো যেন ঝকমকিয়ে ঝলসে ওঠে।
খুব ঝকমক করছে, না? কনক মিত্তির বিষণ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হাসে। এগুলো হচ্ছে ঠিক তোমার বাবার সামাজিক প্রতিষ্ঠার মত। মূল্য নেই, শুধু চকমকানি আছে। আপনার নির্বোধ স্ত্রীকে ঝুটো কাঁচের গহনাগুলো দিয়ে ভোলাতে পেরেছিলেন পালিত সাহেব, কিন্তু জহুরীদের চোখকে ভোলানো গেল না।
ঝুটো! আবার অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে ধ্বনিত হয়।
হয়তো সে ধ্বনির মধ্যে বিস্ময় ছাড়াও রাগ ক্ষোভ অপমানের জ্বালাও আছে। প্রতারিত হয়েছে কি শুধু পালিত সাহেবের নির্বোধ স্ত্রী? তারা প্রতারিত হয়নি? কোনও উপলক্ষে যখন মিসেস পালিতের অঙ্গে এই চোখ ঝলসানো গহনাগুলো দেখেছে তারা, তখন কি অভিভূত বিস্ময়ে পালিত সাহেবের টাকার অঙ্ক পরিমাপ করতে বসেনি? আর সেই অঙ্কের হিসেবেই এযাবৎ মিসেস পালিতকে মান্য সমীহ খোসামোদ তোয়াজ করে আসেনি?
ঝুটো কাচ! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে পালিত সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। উঠে বললেন, যাক মিত্তির সাহেব, আপনি একবিষয়ে খুব খাঁটি। আত্মপরিচয়টা যা দিয়েছেন, একেবারে কারেক্ট। আমাকেও প্রায় ঘাবড়ে দিয়েছিলেন। ভেবে আঁৎকে উঠছিলাম, শহরের সেরা জুয়েলার মার্চেন্টরা কি শেষ পর্যন্ত আমায় ঠকাল? যাক, ভয়টা কাটল। নর্মদা, দেখ তো পরীক্ষা করে, গহনাগুলো তোমার সেই হারানো জিনিস কি না।
নর্মদা একবার ঘরের চারিদিকে তাকাল। তাকাল সকলের মুখের দিকে। তারপর ভুরু কুঁচকে ওই ঝকঝকে জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে হেসে উঠে বলল, ফোঃ। এইগুলো আমার? কনক, তুমি বোধকরি সেগুলোর উপসত্বে এই বছর তিনেক চালিয়ে, উদ্বৃত্ত টাকায় গোটাকতক কাঁচের টুকরো কিনে একটা নতুন গল্প নিয়ে এলে নতুন কায়দায় আসর জমাতে? সে আশা ছাড়ো। কে আছিস, গেট বন্ধ করে দে।
পালিত সাহেব হাসলেন।
সেটা তোমার আদেশের অপেক্ষায় পড়ে নেই। মানুষের ধৃষ্টতার বহর কতদূর পর্যন্ত হতে পারে, সেটা দেখার জন্যই এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম আমি।
তারপর? চাঙ্গা হয়ে উঠে বসে প্রশ্ন করে বিকাশ।
বীথিকা বলে, তারপর আর কি! পালিত সাহেব পুলিশে ফোন করলেন। লোকটাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। আমাদের আবার সাক্ষী দিতে হবে এই এক বিপদ।
সাক্ষী দিতে হবে?
তা হবে বৈকি। ছিলাম যখন। কী বলবে?
বলব আর কি। বীথিকা মৃদু হেসে বলে, গল্প বানাতে হবে। অবশ্য সে গল্প তখুনি তৈরী হয়ে গেছে। বলা হবে, আগে চুরি করে পালিয়েছিল, আবার চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে।
এই বলবে?
তা গুছিয়ে একটা কিছু না বললে—
কিন্তু তোমার কি মনে হল? কার কথাটা সত্যি?
শোন কথা। পালিত সাহেবের মত গণ্যমান্য লোকটার কথা সত্যি হবে না তো কি ওই জোচ্চোরটার কথা সত্যি হবে?
আর পালিত সাহেবের মেয়ের ওই কথাটা?
ও ছেড়ে দাও। ও তো রাগের কথা। ওকেও তালিম দেওয়া হচ্ছে। আর সত্যি, মেয়েমানুষ তো! এত বোকা হবে না যে কোনও খাঁটি সত্যি কথা প্রকাশ করে বসে নিজের মান মর্যাদা ঘোচাবে।
চোর ধরা পড়ায় তোমার বান্ধবী তাহলে খুব প্রফুল্ল?
বীথিকা ঠোঁট উল্টে বলে, ওর কথা বাদ দাও। একের নম্বর ঢঙি। ইচ্ছে করে ধরিয়ে দেওয়া হল, আবার এমন ছল ছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল। ভাবটা যেন মনে বড় দাগ লেগেছে। আরে বাবা, মেয়েমানুষের ঢং বুঝতে আমাদের দেরী হয় না। বিকাশ হেসে উঠে বলে, তা সত্যি, তোমরা হলে পাকা জহুরী।