সেই জন্যই কি বহু বছর বাদে অমল যখন ভুবনেশ্বরে পোস্টেড এবং আর পাঁচজন স্বল্প মেয়াদের বাঙালি বাসিন্দাদের নিয়ে ক্লাব গড়তে গেল, তার নামকরণের প্রশ্নে ৬ টা নামই মনে এল—একতা? আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেল ক্লাবের কার্যনির্বাহী ছোট দলটির সব সদস্যই অমলের মতো পশ্চিমবঙ্গীয়, তিনজন এমনকি উত্তর কলকাতা থেকে। অর্থাৎ বাংলার জাতীয় কংগ্রেসের আদি অকৃত্রিম ভোটব্যাঙ্কের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ একতা ক্লাবের প্রাণ। হয়তো তাই তার জাতীয় চরিত্রটি ঢাক পিটিয়ে জারি। যদিও শহরে তামিল তেলুগু পঞ্জাবি সংগঠন তামিল তেলুগু পাঞ্জাবী নামে যদিও একতার শতকরা নব্ব। সদস্যই বাঙালি তবুও তাকে বাঙালি প্রতিষ্ঠান আখ্যা দেওয়া হল না। রিজিওনাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির সায়েন্টিস্টদিব্যেন্দুমুখার্জির আবার একটু বাংলা বাংলা ভাব আছে। স্ত্রী কাকলি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়টায় তো। ও একটু মিনমিন করে আপত্তি তুলেছিল।
—আমরা প্রবাসী বাঙালিরাই যখন চালাচ্ছি, তখন বাঙালি ক্লাব বলতে ক্ষতি কি।
–খুব ক্ষতি। বাঙালি বাঙালি আর করো কোন মুখে। ও পরিচয়টা আর দিও না, বুঝেছ। ওড়িশা তো প্র্যাকটিক্যালি রুল বাই আই এ এস এবং বেশ কটা বাঙালিও আছে ক্যাডারে। খোদ ভুবনেশ্বরে অন্তত আধডজন। কারও প্রেজে টের পাও? খবরের কাগজে যাদের নাম বেরোয়, টিভি-তে যাদের দেখানো হয় তাদের একজনও কি এই সব প্রেসিডেন্সি কলেজের বাঙালি ভাল ছেলে? না, না ও সব বাঙালি ওড়িয়া পার্শিয়ালিটি-ফিটির কথা বোলো না। অমল বেশ গুছিয়ে বলে যায়।
-এই তো গত বছর অ্যানুয়েল ফাংশানের সুভেনিরের জন্য বিজ্ঞাপন চাইতে গেলাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ওড়িয়া চেয়ারম্যান সুধাংশু মহাজ্ঞি কাছে। দু চারটে কথায় একতার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার। একটা ডেট দিলেন ম্যাটারটা দিয়ে যেতে। সুভেনিরের কপি অফিসে পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে-হাতে চেক। সবসুদ্ধ আধঘণ্টা সময় খরচ। আর ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশনের বাঙালি চেয়ারম্যান ১৫ বি চ্যাটার্জির কাছে যেই গেলাম আধঘণ্টা ধরে ঘ্যান ঘ্যান—অ্যানুয়েল বাজেট কত আছে, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে দেখা করুন, অমুককে বলুন তমুককে ডাকুন। হাজারটা ফাঁকড়া। এই তত তোমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া বাঙালিদের ছব্বা। এই পড়া আর পরীক্ষা দেওয়াতেই ভাল। কাজেই বেলা অষ্টরম্ভা। নইলে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আজ এই অবস্থা হয়। বাঙালি আই এ এস সব এক-একটি ট্যাড়স।
অতঃপর বিরাট ব্যানারে চিনে হাজার ফুল ফুটুক ছাঁচে একটি নকশা বা লোগো ওপরে একতা একটি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা। একতার সর্বভারতীয় সদস্য হলেন জনা দুই ওড়িয়া আই এ এস, যাঁদের প্রশাসনের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা, রাজ্যের সবেধন নীলমণি ওড়িয়া শিল্পপতি, একজন অবসরপ্রাপ্ত কেরলি খ্রিস্টান আই পি এস যিনি ওড়িয়া বিয়ে করে ভুবনেশ্বরে স্থিতু।
এঁরা সব একতার উপদেষ্টা। হ্যাঁ, এ দলে দুজন সিনিয়র বাঙালি আই এ এসের নামও আছে, তবে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। সাধারণ সদস্যদের মধ্যে জনা তিনেক স্থানীয় পঞ্জাবি ব্যবসায়ী, জনা দুয়েক অসম, উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত চাকুরে। বাদবাকি সবাই নির্ভেজাল বঙ্গসন্তান, বেশিরভাগই সেই শ্রেণীর যাদের সর্বভারতীয় ডাকনাম বোং বা বং। একতা ক্লাবের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের ছকটি দ্বিমুখী। বছরে একবার সর্বভারতীয়অনুষ্ঠান, অর্থাৎ মুম্বই থেকে মোটা দক্ষিণায় আনা গাইয়েদের মুখে জনপ্রিয় হিন্দি ফিল্মের গান, সঙ্গে তাঁদের সমান মোটা দক্ষিণার অর্কেস্ট্রা। অনুষ্ঠানে প্রথমে এক আধটা ক্লাসিকাল নাচ, দক্ষিণ ভারতের কোনও শিল্পীর। তার প্রস্তুতি কয়েক মাস ধরে। খবরের কাগজে নিউজ আইটেম। রাজমহল ছক-এ বিশাল বিশাল ব্যানার, দৈনিক সানটাইমস্, সংবাদ প্রভৃতির সঙ্গে বাড়ি বাড়ি হকারের হাতে হ্যান্ডবিল বিলি। বহুল প্রচারধন্য অনুষ্ঠানটির টিকিট বিক্রি আমজনতাকে। স্থান সাধারণত রবীন্দ্র মণ্ডপ। তেমন অতি বড় মাপের অনুষ্ঠান হলে কটক ইন্ডোর স্টেডিয়াম। এই সব সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকেন মুখ্যমন্ত্রী যার ত্রাণ তহবিলে টিকিট বিক্রি ও সুভেনির প্রকাশের অর্থপ্রদান করা হয়। মঞ্চে আরও দু-চারজন মন্ত্রী। অতিথির সারিতে সপরিবারে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা। বেশ কিছু আসন পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য নির্দিষ্ট। নইলে ঝামেলার সময় কারও টিকিটি দেখা যাবেনা। ইউনিফর্ম-পরা মানুষ দেখলে তবেই আমাদের আমজনতা সভ্য হয়। এছাড়া পয়লা বৈশাখ, বিজয়া বা সরস্বতী পুজো উপলক্ষে ছোট ছোট অনুষ্ঠান। কলকাতার মাঝারি মাপের শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক। স্থান, স্টেশন স্কোয়ারে হোটেল স্বস্তির ব্যাংকোয়েট রুম বা শহিদনগরে হোটেল মেঘদূত এর কনফারেন্স হল। শুধু নিমন্ত্রিতদের জন্য। অর্থাৎ একতারসদস্য ও বন্ধুবান্ধব। একবার নববর্ষেকলকাতার একটি দল চিত্রাঙ্গদানৃত্যনাট্য করবে। স্টেজ চাই। রবীন্দ্র মণ্ডপ বাজেটে এল না, অতএব, সূচনা ভবন। প্রথমে স্থানীয় একজন সাহিত্যিক ও রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের বক্তৃতা। তারপর সাড়ে সাতটা নাগাদ নৃত্যনাট্য আরম্ভ। আটটা থেকে লোডশেডিং। এয়ারকন্ডিশন করা হলে সরকারি জেনারেটার চলে না। তবু অনুষ্ঠান হল। সেই এক অভিজ্ঞতা পরের বছর রবীন্দ্র মণ্ডপে সন্দীপ ঘোষালের নজরুল গীতি আর. ভি. কুলচারার অর্কেস্ট্রায়। কী ভাবে কত মাথা খেলিয়ে এ সব দুর্দৈব ম্যানেজ করা হয়েছে তা শুধু এই বান্দাই জানে। তবু অমলকুমার দাসের অপ্রতিরোধ্য উৎসাহে ভাটা পড়েনি। প্রত্যেকটি মেগাফাংশনের আগের দিন স্বস্তি বা নিউ কেনিলওয়ার্থ-এ প্রেস কনফারেন্স, চারিদিকে সাংবাদিক। টি ভি ক্যামেরার সামনে সবার মাঝখানে অনুষ্ঠানের আকর্ষণ মুখ্য শিল্পী আর তার পাশে অমল। যেন বিয়ের আসরে বর ও বরকর্তা। তার পরদিন মঞ্চেও তাই। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দিচ্ছে অমল, একতার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করছে অমল—হলই বা মুখস্থ করা বক্তৃতা এবং অজস্র ভুলে-ভরা। টিভি ক্যামেরায় ধরা মান্যগণ্যদের আগে পরে পাশে কে? না, অমলকুমার দাস, সভাপতি একতা। গোটা ভুবনেশ্বর দেখছে। দিন ছিল বটে।