না, তবু সেদিন সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাননি নর্মদা। অসম্ভব স্নায়বিক উত্তেজনা, অন্ধকার ঘর আর খোলা মেজেয় পড়ে থাকা, এই তিন মিলিয়ে নর্মদাকে যেন এই পরিচিত জগৎ থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল। তবু সব টের পাচ্ছিলেন তিনি। টের পাচ্ছিলেন রাতদিনের ঝি কানন কি যেন বকবক করতে করতে ঘরে এল, এসেই ফট করে ঘরের আলোটা জ্বালল, তারপর হাঁকপাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল।
তারপর হুড়মুড় করে ও-ঘর থেকে এসে পড়ল আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাদের উত্তেজিত কলকোলাহল বোধকরি একটা মরা মানুষকেও সাড়া এনে দিতে পারত, কিন্তু নর্মদা অসাড় হয়েই পড়ে থাকলেন, যতক্ষণ না মুখে জল পড়ল, বাতাস পড়ল, ওষুধ পড়ল। আর জ্ঞান হতেই গহনার শোকে কাঁদতে হল নর্মদাকে। তার জন্মদিনে আর বিবাহবার্ষিকীর দিনে স্বামীর কাছে পাওয়া ভালবাসার উপহারগুলি এমন করে চুরি হয়ে যাওয়ার শোকে এত বেশী ব্যাকুল কাতর হয়ে উঠলেন তিনি যে, পালিতসাহেবকে বলতে হল, সামান্য গহনার জন্যে এত ভাববার কি আছে? জুয়েলারীর দোকানগুলো তো আর রাতারাতি উঠে যাচ্ছে না? আমিও কিছু দেউলে হয়ে যাচ্ছি। না। তোমার প্রাণটা যে বেঁচেছে এই ঢের। ভাব দেখি, যদি তোমায় মেরেকেটে এ কাজ করত?
তারপর অবশ্য আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। ডা
ক্তার ভগ্নিপতি বললেন, তিনি দেখেছেন চোরকে। পরিচিত চোর।
নর্মদা বললেন, অসম্ভব।
কিন্তু নর্মদার আর সে জোর বজায় রইল কই?
আচ্ছা, নর্মদা কি সত্যিই আশা করেছিলেন সে জোর তার বজায় থাকবে? সত্যিই তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ হতে থাকবে? বিদেশ থেকে চিঠি আসবে চলে আসছে কনক, চলে এসে দূর সম্পর্কের দিদিমার টাকা পাবে সে, আর সেই টাকায় ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে কলকাতাতেই চিরস্থায়ী বসবাস করবে নিত্য একবার নর্মদাকে দেখা দেবার জন্যে। এমন অদ্ভুত কথা ভাববেন, সত্যিই কি আর এমন বোকা নর্মদা?
না, এখন অন্তত সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিলেন নর্মদা। ভাবছিলেন, এতদিন পরে ও আবার এল কেন? আমি তো ধারণা করিনি ও আবার আসবে। আসবে না ভেবেই তো নতুন করে নিজের বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর এখন ওকে দেখার কী আছে আমার? কিন্তু ও আবার এসেছে। ঈশ্বর জানেন কী মতলবে।
ভাবছিলেন, কতক্ষণই বা মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়ে থাকা চলে? আর একটু পরেই তো আস্তে আস্তে কাঁপাতে হবে চোখের পাতা, কাঁপাতে হবে লালরঙে ছোপানো ঠোঁট দুখানি, তারপর মুদিত কমল-কলির মত খুলতে হবে চোখের সেই কাঁপা-কাঁপা পাতা দুটি। ক্ষীণকণ্ঠে বলতে হবে, আমার কী হয়েছে?
কিন্তু তারপর?
তারপর ও যদি সব প্রকাশ করে দেয়? এই এত লোকের মাঝখানে যদি উদঘাটিত হয়ে যায় সব সত্য, সব বানানো গল্প।
যদি ধরা পড়ে যায়, চোর আর কেউ নয় স্বয়ং নর্মদা নিজে?
কী বলবে এরা? চোর চোর চোর! এই তো।
আশ্চর্য, এ সংসারে নিজের জিনিসও নিজে নেওয়া যায় না। ব্যবহার করার বাইরে আর কিছু করতে গেলেই, চুরি করে নিতে হয়। নিজের জিনিস কথাটার অর্থ কী তাহলে?
না, সত্যকার অর্থ কিছু নেই।
কনক মিত্তির যদি সেদিনের কথা সব প্রকাশ করে দেয়, এরা সকলেই বলবে, ছি ছি, মিসেস পালিত এই।
মূছার অবসরে তাই মনকে দৃঢ় করতে থাকেন নর্মদা। ভাবতে থাকেন কেমন করে সরাসরি অস্বীকার করবেন কনকের সেই অভিযোগ। কেমন চড়া আর কড়াগলায় বলবেন, অনেক ঘাটের জল খেয়ে এসে বুঝি খুব চালাক হয়ে উঠেছ তুমি? চমৎকার একটি গল্প বানিয়ে ফেলার মত চালাক?
কিন্তু না বোধহয়। ও বোধহয় কিছু প্রকাশ করবে না।
চোখ বুজে আর শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ করে শুয়ে থাকা মানুষটা শুনতে পায় পরিষ্কার ঘসা-মাজা একটি গলা, নমস্কার মিস্টার পালিত, আমি বলছিলাম কি, আমি তাহলে এবার উঠি। মনে হচ্ছে ওঁর চৈতন্য ফিরতে একটু দেরীই হবে। আমি আর ততক্ষণ না বসলাম। চৈতন্য ফিরলে ওঁকে এটা দিয়ে দেবেন।
দিয়ে দেবেন!
কী দিয়ে দেবেন? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? বুকের ভিতরটা আকুলি-বিকুলি করে ওঠে নর্মদার। কী করে দেখা যাবে? চোখটা একটু খুলবেন? না কি সহসা ধড়মড়িয়ে উঠে বসবেন?
ভেবে ঠিক করার আগে পালিতসাহেবের ভারী গলার উত্তরটা শোনা গেল, চৈতন্য ফেরার কথা বলা বড় শক্ত মিস্টার মিত্র। ও যে কখন ফেরে আর কখন না ফেরে। কিন্তু এখুনি চলে যাবেন কি বলছেন? যে ভদ্রমহিলা এত যত্ন করে আপনাকে তার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন। করলেন, তার সঙ্গে দেখা করুন, নেমন্তন্ন খান, তবে তো?
নেমন্তন্ন আমাকে কেউ করে নি, মৃদু হাসির সঙ্গে বলে কনক, মেয়ের জন্মদিন সেটাও আমার স্মরণ ছিল না। যদিও স্মরণ থাকা উচিত ছিল। তা উচিত কাজ আর কটাই বা হয়ে ওঠে? স্মরণ ছিল না, এসে দেখলাম বাড়িতে উৎসব। ঠিক যে রকম উৎসবের দিন লাস্ট দেখা হয়েছিল আপনাদের সঙ্গে।
হ্যাঁ, ঠিক যেদিন থেকে আপনি ফেরার হলেন।
জোর গলায় হেসে ওঠেন পালিতসাহেব।
আর কত পারা যায় চোখ বুজে পড়ে থাকতে?
সেই অসতর্কতার অবসরে ওই দস্যু নিশ্চয় সব বলে দেবে। সেই খাতেই আলোচনাকে এনে ফেলছে।
নর্মদা চোখ খুললেন। মুদিত কমল-কলির ধীর প্রস্ফুটনের মত নয়, খুললেন আচমকা ঘুম ভাঙার মত।
বলে উঠলেন, জল খাব।
.
তারপরের কথা ভাবতে পার তুমি?
বীথিকার স্বামী সভায় আসে নি, তাই বাড়ি ফিরে স্বামীর কাছে বিশদ বর্ণনায় মুখর হয়ে ওঠে বীথিকা। তারপর, জল খাবার পর, ওঃ নর্মদাটা যে এমন হতে পারে কে কবে ভেবেছে? স্কুলে কলেজে অনেকগুলো বছর তো কাটিয়েছি ওর সঙ্গে? বলেওছি তোমায়, লেখাপড়ায় কত ভাল ছিল, চাল-চলন সভ্য, কথাবার্তা মার্জিত, গান জানত সুন্দর। এক কথায় রীতিমত একটি বিশিষ্ট মেয়ে। সে কি না জীবনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠল একটি অভিনেত্রী! ওই মূৰ্ছা, ও কি সত্যি মূৰ্ছা? মূৰ্ছার অভিনয় করে পুরুষকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মেয়েদের যায় না। মেয়েদের চোখ বড় তীক্ষ্ণ।