- বইয়ের নামঃ একটি সন্ধ্যা একটি সকাল
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. ছুরিটা এসে বিধলো
একটি সন্ধ্যা একটি সকাল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
০১.
ছুরিটা এসে প্রথম বিধলো ডান দিকের রগে।
তীক্ষ্ণ চকচকে ধারালো।
মাথাটা একটু সরিয়ে নিলো শশাঙ্ক। তবু কানের গোড়াটায় বিধতেই লাগল। এবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলল প্রায় টেবিলের কাছবরাবর। হাতের বইটার থেকে আধ ফুট মাত্র ব্যবধান থাকল।
পড়ার একটু অসুবিধে হচ্ছে, তা হোক, তবু নড়েচড়ে উঠে গিয়ে আক্রমণের পথটা বন্ধ করার কথা মনে আনছে না শশাঙ্ক।
কিন্তু মাথা হেঁট করেই কি সব সময় নিস্তার পাওয়া যায়? এ ক্ষেত্রে অন্তত যাচ্ছে না, ছুরিটা এবার এসে শশাঙ্কর হাতের বইয়ের পাতাটাই বিধছে। সমস্ত অক্ষরগুলো আলোয় আঁ আঁ করে উঠলে পড়া চলে না।
শশাঙ্কর মনে হল পশ্চিমের জানলা দিয়ে আসা পড়ন্ত বেলার ওই রোদের ছুরিটা ঠিক যেন একটা জ্বালাতুনে মানুষের মত ব্যবহার করছে। একটু নিশ্চিন্ত শান্তিতে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে দেবে না। শশাঙ্কর এই নিরুপায়তাটা হাস্যকর অর্থহীন।
ইচ্ছে করলেই এখুনি উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। উঠতে ইচ্ছে না করলে চাকরদের কাউকে ডেকে বন্ধ করে দেবার হুকুম দেওয়া যায়। চেয়ারটাকে খানিকটা টেনে নিয়ে সরে বসা যায়।
কিন্তু সে-সবের কিছুই না করে শশাঙ্ক বই থেকে চোখ তুলে ওই পশ্চিমের জানলাটার দিকেই রুক্ষ দৃষ্টি হেনে বসে বসে ভাবতে লাগল।
জীবনে সে এর বেশি কিছুই চায় নি। একটি নিরুপদ্রব কোণ, আর নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ একটু অবসরের শান্তি। শুধু এইটুকু পেলেই সারা জীবন কেটে যেতে পারত আনন্দরসের সমুদ্রে তলিয়ে থেকে!
পৃথিবীতে কত বই!
কত ভালো ভালো বই! একটা জীবনে পড়ে ফুরোবার নয়। বইগুলো আয়ত্ত করতে যদি নতুন নতুন ভাষার চাবি হস্তগত করতে হয়, তাতে তো আরও আনন্দ, আরও রোমাঞ্চ!
কিন্তু কোথায় সেই দুর্লভ অবকাশ! কোথায় সেই নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্ত!
এই পড়ন্ত রোদটা যেমন রগে কপালে কানে বইয়ের পাতায় পর্যন্ত এসে বিধে উত্ত্যক্ত করছে, সারা জীবনই কে যেন এমনি করে উত্ত্যক্ত করছে শশাঙ্ককে।
.
ছেলেবেলায়?
তখন তীব্র আকর্ষণ ছিল গল্পের বইয়ে।
কিন্তু তাতে কী তীব্র বিরোধিতা ছিল বাবার! ছেলের হাতে অথবা তার টেবিলে শেলফে বালিশের তলায় গল্পের বই দেখেছেন কি হুঙ্কার দিয়ে কেড়ে নিয়েছেন। হয়তো বা শুধু কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হন নি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, পরের বই বলে মানেন নি।
শশাঙ্কর মা এ নিয়ে মৃদু প্রতিবাদ করলে সদর্পে বলেছেন, এই ঠিক করলাম, জন্মের শোধ শিক্ষা হয়ে যাবে। একে কতকগুলো রাবিশ গেলার বদভ্যাস, তার ওপর আবার পরের কাছে চেয়ে ভিক্ষে করে আনার বদভ্যাস! দুটোই সমান খারাপ, এই রকম জব্দ হলেই তবে ওই অভ্যেস ছাড়বে।
কিন্তু না। বাবার শত চেষ্টাতেও সে অভ্যাসটা ছাড়ে নি শশাঙ্ককে। উত্তরোত্তর গ্রাসই করেছে তাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যতালিকার গতি বদলেছে, কিন্তু মনের গতি বদলায় নি। অধ্যাপনা তার পেশা, কিন্তু অধ্যয়ন তার শুধু নেশাই নয়, আরও অনেক কিছু।
এইটাই টের পেয়ে ফেলেছে বলেই বুঝি সোনালীরও শশাঙ্কর এই গ্রন্থজগার ওপর এত আক্রোশ! কিন্তু সোনালীর আক্রোশ শশাঙ্কর বাবার মত তীব্র বিরোধিতার বেশে দেখা দেয় না, দেখা দেয় ব্যঙ্গ আর অবজ্ঞার মূর্তিতে।
শশাঙ্ককে সে বইপোকা বলে সম্বোধন করে। কৌতুকের হাসি দিয়ে নয়, তিক্ত রসাস্বাদিত ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে।
এমনিতেই সোনালীর ঠোঁটের গড়নটাই যেন ঈষৎ বাঁকারেখায় রহস্যময়, তার উপর
আঃ, রোদটা ভেবেছে কী! যাবার আগে মরণকামড় দিয়ে যেতে চাইছে বুঝি! নইলে আবার কোন কোণাচে পথ দিয়ে ফের এসে বা রগটায় বিধছে!
আশ্চর্য! এই এতক্ষণের মধ্যে বাড়ির কারুর কি একবার এ ঘরে আসতে নেই? একটা চাকরবাকর কিংবা…না, সোনালীর কথা ভাবছে না শশাঙ্ক, ভাববার প্রশ্ন ওঠে না। সোনালী এতক্ষণে তার টেনিস র্যাকেট ঘোরাতে ঘোরাতে কখন নেমে গেছে, কখন চলে গেছে নিজে হাতে ড্রাইভ করে।
হ্যাঁ, বিকেলে খেলতে যাবার সময় কি বেড়াতে যাবার সময় নিজেই ড্রাইভ করে সোনালী। বলে, এ সময় ড্রাইভারের উপস্থিতিটাই তার কাছে বিরক্তিকর। অনেকক্ষণ ধরে চোখের সামনে একটা বুড়ো শিখের ঘাড় পিঠ আর পাগড়ী দেখতে রাজী নয় সে।
পশ্চিমের ওই জানলাটা দিয়েই সোনালীর গতিবিধিটা দেখতে পাওয়া যায়। ওই দিকটাই বাড়ির গেট।
কে জানে কখন চলে গেছে সোনালী। হয়তো পশ্চিম আকাশটা লালচে হয়ে ওঠবার অনেক আগেই। কিন্তু একটাও চাকরবাকর কেন আসছে না এ ঘরে? * শশাঙ্কর কি একবার তেষ্টা পেতেও পারে না? চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হল শশাঙ্কর। যেমন করে সোনালী ডাকে অনন্তকে, বীরসিংকে, আছ কোথায় তোমরা? কাল হয়ে বসে আছ? সব কাজ বলে বলে তবে করাতে হবে, নিজেদের ডিউটি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই?
না, শশাঙ্কর সে সাধ্য নেই।
চেঁচিয়ে কাউকে ডাকা শশাঙ্কর সাধ্যের বাইরে। নিজের গলার শব্দ নিজেই ভালো করে চেনে না শশাঙ্ক। তবু ওর ইচ্ছে হচ্ছিল এই মুহূর্তে কেউ এ ঘরে আসুক, অনন্ত কি বীরসিং, নিদেন পক্ষে ঠাকুর। জানলা দিয়ে রোদ আসা নিয়ে তাকেই বকে উঠবে শশাঙ্ক।
কিন্তু গেটের সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে কখন? সোজাসুজি রোদের দিকে তাকিয়েই ভুরু কুঁচকে দেখল শশাঙ্ক, হ্যাঁ তারই–মানে তাদেরই গাড়ি। সোনালী তাহলে এখনো বেলোয় নি। তার মানে আর একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সোনালীকে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই তার চকচকে ঝকঝকে আঁটসাঁট শরীরটা বেরিয়ে আসবে বাড়ির মধ্যে থেকে, ছোট্ট লনটুকু মুহূর্তে পার হয়ে গাড়িটার কাছে এসে একবার দাঁড়াবে। আর একবার চোখ তুলে দোতলার জানলার দিকে তাকাবে সে।
এটা নিয়ম।
রোজই তাকায়। টেবিলের ধারে চেয়ারে বসে বসেই দেখতে পায় শশাঙ্ক। আর দেখার পর মনে হয়, বোধ হয় জানলায় কাউকে আশা করে সোনালী।
কাকে? শশাঙ্ককে?
তাছাড়া আর কে আছে বাড়িতে? অন্তত আশা করবার মতো কে আছে? কিন্তু কেন? এত বড় দিনটায় একই বাড়িতে থেকেও স্বেচ্ছায় যে একবারও শশাঙ্কর সঙ্গে চোখাচোখি হবার ক্লেশটুকু স্বীকার করতে চায় না, সে কেন এ আশা করতে যাবে? দেখা এক এক দিন সমস্ত দিন-রাতেই হয় না। দুজনের গতিবিধি আলাদা, ঘুমের সময় আলাদা। রাতের খাওয়াটা একসঙ্গে বটে, তাও সব দিন নয়।
.
আশ্চর্য অঘটন ঘটল।
সামনের ওই দূর রাস্তায় দেখা নয়, এই ঘরের মধ্যেই পিছনের দরজা দিয়ে এসে প্রবেশ করল সোনালীর প্রসাধনমার্জিত আঁটসাঁট ছিপছিপে শরীরটি।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরক্ত কণ্ঠস্বরও ছড়িয়ে পড়ল ঘরের হাওয়ায়, পড়ন্ত রোদটায় মুখ দিয়ে বসে আছো যে?
শশাঙ্ক চমকে ঘাড় ফিরিয়ে অপ্রতিভ হাসি হাসল–এমনি!
এমনি! বাঃ চমৎকার! তার মানে, উঠে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া তো দূরে থাক, একটু সরে বসবারও ক্ষমতা হয় নি, কেমন? তা বইয়ের মধ্যেও তো ডুবে ছিলে না যে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলে, রাস্তায় কি দেখছিলে হাঁ করে?
শশাঙ্ক এবার মৃদু হাসে। হেসে বলে, হাঁ করে দেখার মত জিনিসের কি অভাব আছে জগতে?
হুঁ, কথাবার্তা তো বেশ ভালোই শিখছ ক্রমশ। ব্যাপারটা কি?
আমিও তো তোমাকে ওই প্রশ্নই করব ভাবছিলাম, ব্যাপারটা কি? এ সময় বাড়িতে? আবার এ ঘরে?
সোনালী তার গাঢ় রঙে ছোপানো ভুরু দুটো কুঁচকে বলে, কেন, আমি কি কখনো আসি এ ঘরে?
ও কথা থাক। আজ কি জন্যে?
কেন, কারণ না থাকলে নিজের বরের ঘরে আসতে নেই?
শশাঙ্ক একবার মুখ তুলে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর মৃদু হেসে হাতের বইখানাতেই চোখ রাখল।
রোদের সেই ছুরির ধারটা আর নেই, লালচে হয়ে এসেছে। আকাশ কত তাড়াতাড়ি বদলায়!
শোনো, কিছু টাকা চাই!
জানতাম। আর একবার মৃদু হাসল শশাঙ্ক।
সোনালীর মুখটা একবার একটু বিবর্ণ দেখাল, একটু বা বিপন্ন, তারপরই সামলে নিলো সে। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, জানাই স্বাভাবিক। আর কোনও সম্পর্ক তো নেই দুজনের মধ্যে। কেন, বেরিয়ে পড়তে পারো না আমার সঙ্গে? খোলা আকাশের নীচে, পৃথিবীর আলোয়? যেখানে মানুষ থাকে, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ।
শশাঙ্ক বিব্রতভাবে বলে, ছুটি ফুরিয়ে আসছে, পড়াটড়া তো তেমন কিছুই হল না
তেমন কিছুই হল না! প্রশ্ন নয়, ধিক্কার নয়, বিস্ময় প্রকাশ নয়, যেন একটা যান্ত্রিক শব্দ উচ্চারিত হল, তেমন কিছুই হল না! এই দুদুটো মাস গরমের ছুটি গেল, একখানা খাতা দেখার কাজ পর্যন্ত নিলে না, একবারের জন্যে বাড়ি থেকে বেরোও না, সারাদিন এই ভ্যাপসা গুমোট ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। তবু আশ মেটে না, তবু পড়া হয় না! আশ্চর্য! যাক, আমার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। পড়ো, আরও পড়ো, পড়ে পড়ে চোখের নার্ভগুলো জখম করে ফেলল, তারপর চিরতরে পড়ার ক্ষমতা ঘুচে যাক, মন্দ কি!
শাপ দিচ্ছো?
পারলে দিতাম। কিন্তু এটা শাপ নয়, শুধু ভবিষ্যৎ পরিণতির ছবিটা চোখের সামনে তুলে ধরা। বইপোকাদের ওই অবস্থাই ঘটে। যাক এই বলে যাই, নীপার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন করেছিল তাই যাচ্ছি। গোটা পঞ্চাশ টাকা দাও, যাবার সময় একটা প্রেজেনটেশন
এতক্ষণে শশাঙ্ক কথা বলে। অথবা এতক্ষণে কথা বলার অবকাশ পায়। তাই বলে, টাকার জন্যে সব সময় অসুবিধে পাবার হেতু কি? সব টাকাকড়ি তুমিই রাখো না?
নাঃ, ঝিলিক দিয়ে ওঠে সোনালী, ও আমার ভালো লাগে না। কোথা থেকে তোমার টাকা আসছে, কখন তোমার কোন বাড়ির ভাড়াটে ভাড়া দিচ্ছে না, আর কখন কোন বাড়ির ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে, এইসব হিসেবও তো রাখতে হবে তাহলে? উঃ বাপস! তাছাড়া এই তোমার সংসারের তেল নুন লকড়ির হিসেব! রক্ষে করো। ও সবের মধ্যে আমি নেই। আমার দরকার মত পেলেই হল।
শশাঙ্ক কি কষ্টে একটা রূঢ় কথা সংবরণ করে নিলো কে জানে। তবে কথা যা বলল সেটা মোলায়েমই।
এমনও তো হতে পারে দরকারমত সময়ে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
তার মানে?
মানে অন্য কিছু নয়। জানো তো আমাদের কলুটোলার বাড়ি দুটোর যা অবস্থা হয়েছিল, এই বেলা মেরামত না করলে কর্পোরেশন থেকে কোন দিন ভেঙে দিয়ে যেত, তাই ভাড়াটে তুলিয়ে দিয়ে মেরামত করানো হচ্ছে। ওতেই তো মাসে সাড়ে চারশো করে টাকা
তোমার ওই সব দৈন্যদশার কথাগুলো আমার কাছে না বললেই বাধিত হব। ও সব। শোনবার রুচি নেই আমার। দিতে না পারো তো বলল, বাইরের কারও কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছি আপাতত
শশাঙ্ক সহসা একটু দৃঢ় হয়ে উঠল। বুঝিবা একটু রুক্ষও, এই ধরনের কথা তুমিও আমার সামনে না বললেই বাধিত হব। ধার করাকে আমি কত ঘৃণা করি সে কথা তুমি জানো না তা নয়, তবু
তবু বাধ্য হয়েই করতে হয়, উপায় কি! ধারকে ঘৃণা আমিও কম করি না! কিন্তু প্রয়োজনের সময় নিজের ঘর থেকে না পেলে–।
প্রয়োজনের পরিধি অবিরত বাড়িয়ে চললে এ রকম অভাবও তো মুহুর্মুহুই দেখা দেবে।
সহসা একটু গুম হয়ে যায় সোনালী, তারপর তিক্তকণ্ঠে বলে ওঠে, তবে তুমি কি চাও? মানুষের জীবনে প্রয়োজনের সীমা উত্তরোত্তর সংকীর্ণ হয়ে আসবে? তা তোমার মত ঘরকুনো বইপোকার উপযুক্ত কথাই বলেছ। কিন্তু আমাকে দিয়ে তা হবে না, বুঝেছ? আমি সামাজিক জীব, আমার মানসম্ভ্রম আছে, লোকসমাজে মুখ রাখবার দায় আছে, ইচ্ছে বাসনা শখ সাধ আছে—
শশাঙ্ক হাতের ইশারায় কথাটা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর হাস্যে বলে, দ্যাখো ড্রয়ারটা খুলে এত চাহিদা মেটানোর যোগ্যতা ওর আছে কিনা।
হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে একটা চাবি ঠেলে দেয় শশাঙ্ক বইয়ের স্কুপের খাঁজ থেকে।
মুহূর্তে সামনের ড্রয়ারটা খুলে ফেলে দ্রুত অসহিষ্ণু হাতে সবকিছু ওলট-পালট করে একটা একশো টাকার নোট তুলে নিয়ে ড্রয়ারটা ফের এক ধাক্কায় ঠেলে বন্ধ করে দিল সোনালী। চলতিমুখো হয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, খুচরো দেখছি না, আস্তটাই নিলাম। যাচ্ছি তাহলে।
দলীপকে নিচ্ছ না?
না।
নীপার বাড়ি তো সেই দমদমের কাছে। ফিরতে রাত হবে অবশ্যই, অত রাত্রে একা আসার চাইতে।
না, না। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ঝঙ্কার তোলে সোনালী, একা বলে দরদ দেখাবার কোনও দরকার নেই। নেমন্তন্ন নীপা আমায় একা করে নি, তোমাকেও করেছিল।
আমাকে! আমি কি কোথাও যাই?
যাও না, সেটা বাহাদুরীর কিছু নয়। যাক, এ নিয়ে অনেক দিন অনেক তর্ক হয়ে গেছে, কতকগুলো কথার সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু হয় নি।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সোনালী, আর বেরিয়ে গিয়েও সহসা আবার ফিরে এসে বলে উঠল, জানি দেরি হলেও বসে বসে ভাববে না, তবু বলে যাচ্ছি, বেশি রাত হতে পারে। অথবা একেবারে না ফিরতেও পারি।
না ফিরতেও পারো!
শশাঙ্কর কথাতেও প্রশ্নের সুর ফুটল না, না বা ফুটল বিস্ময়ের, শুধু সোনালীর বলা কথাটাই আবার উচ্চারণ করল।
হ্যাঁ। সোনালীর মুখে একটা তিক্ত ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল, তোমার কাছে তুচ্ছ হতে পারি, কিন্তু এখনো একটু কৃপাকটাক্ষে ধন্য হয়ে যায় এমন লোকেরও অভাব নেই জগতে। সেই জগতটা যাচাই করতে বেরোব ভাবছি।
গটগট করে বেরিয়ে গেল এবার সোনালী।
সত্যিই গেল।
.
০২.
গাড়িতে কেউ নেই তাই হাত তুলে চোখ মোছবার দায় নেই। কিন্তু তপ্ত একটা অশ্রুবাষ্পে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সোনালীর।
কী লজ্জা! কী অপমান!
নেমন্তন্ন বাড়িতে সবাই যাবে যুগলে, শুধু সোনালীকে যেতে হবে বিধবার মতো একাকিনী।
যখন যেখানে যাবে এই এক পদ্ধতি। সাধারণ নিয়মের ধার ধারবার দায় নেই শশাঙ্কর, তার একমাত্র যুক্তি, সবাই তো জানে আমি এই রকমই।
আমি উকট, আমি অদ্ভুত, আমি অস্বাভাবিক–এইটা কি একটা যুক্তি?
প্রথম প্রথম রেগে কেঁদে ঝগড়া করে কোথাও কোথাও সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে শশাঙ্ককে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে পাঁচজনের মাঝখানে শশাঙ্কর আড়ষ্ট আড়ষ্ট বন্ধনদশাগ্রস্ত ভাব শুধু লজ্জাই দিয়েছে সোনালীকে।
অতএব সে চেষ্টা ত্যাগ করতে হয়েছে।
সোনালীর জন্যে ভাবনার শেষ নেই বাবুর!
আচমকা একটা রাগের উত্তাপে চোখের জল শুকিয়ে উঠল। কর্তব্যের মধ্যে কি? না, রাতে একা ফেরার বিপদ কল্পনা করে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেবার অনুরোধ!
এইতেই আরও হাড় জ্বলে যায় সোনালীর। হলেও দলীপসিং বয়স্ক, লোকটার ভাবভঙ্গী ভালো লাগে না সোনালীর। চোখের চাউনিটাও যেন কেমন ধূর্ত-ধূর্ত।
হতে পারে এটা সোনালীর ভুল ধারণা, কিন্তু ভুল জেনেও কি বদ্ধমূল একটা ধারণার মূল উৎপাটন করা সহজ?
কিন্তু মনের এই ভয়কে প্রকাশ করা চলে না। সেটা খেলোমি। তাই সোনালী শশাঙ্কর কাছে অকারণ আপত্তি তুলে জানায়,–চোখের সামনে ওই বুড়ো শিখটার পাগড়ীপরা মাথাটা বেশিক্ষণ বরদাস্ত করতে পারি না।
.
গাড়ি চলছে। চলছে চিন্তার ধারা। দ্রুত উদ্দাম।
সোনালীর ভাগ্যে সুখের সমস্ত উপকরণ মজুত থাকতেও সুখ নেই।
এই তো এখুনি নিমন্ত্ৰণবাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট প্রকট হয়ে উঠবে সেই দৈন্য। যারা প্রত্যেকেই ভালো করে জানে, শশাঙ্ক ওই রকম, তারাও পরম অমায়িকমুখে হাসিচাপা সহানুভূতিতে বিগলিত হয়ে বলে উঠবে, ওমা, এল না! আজও এল না! আশ্চর্য!
সোনালীর ইচ্ছে করে সেও বলে ওঠে, আশ্চর্য, আজও তোমরা আশ্চর্য হও, কিন্তু পারে না। গলা বুজে আসে। সেই বোজ বোজা গলায় যা হোক একটা কৈফিয়ৎ দিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে বসে সে সভায়, যেখানে প্রায়শই যুগল ছবি।
বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিমন্ত্ৰণবাড়িতে আসার ফ্যাসান আর নেই, ভাইবোন মা ইত্যাদির প্রশ্ন তো ওঠেই না। নিতান্ত যে বেচারা জোড়ভাঙা, সে বাদে সকলেই জোড়ে আসেন। আর সেই হেন সভায় সোনালী তার অসামান্য রূপ, অটুট বয়েস আর অনবদ্য সাজ নিয়ে বসে বসে নিষ্ফল আক্রোশে জ্বলতে থাকে।
তবু আসেও তো!
নিজেকে নিজে অনেক সময় এ প্রশ্ন করেছে সোনালী, কেন আমি যাই? শুধু খানিকটা দাহ ছাড়া আর কিছুই তো সঞ্চয় হয় না, তবে কেন যাই লোক্সমাজে?
এর উত্তর স্পষ্ট হয় না।
প্রতিজ্ঞা করে, আর কোথাও যাবে না, কিন্তু না গিয়ে পারে না। লোকসমাজ তাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে।
.
আঃ কি বিশ্রী জায়গাতেই বাড়ি করেছে নীপা!
লোকালয় ছাড়িয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখন পথের দুধারে ঝোঁপঝাড় গাছপালা মাঠ জঙ্গলকে রেখে রেখে। মাঝখানে অনেকখানি পথ এই রকমই চলবে।
আবার ওদিকে জনবসতি। ভালো ভালো নতুন বাড়ি। যে রকম একখানি বাড়ির মালিক আজ সোনালীর বাল্যবান্ধবী নীপা।
সোনালীর শ্বশুরের অনেক বাড়ি!
তিন চারটে ভাড়া খাটে, একটাতে বাস করে সোনালীরা। সব থেকে ভালটাতেই করে তবু এক এক সময় হতাশ নিঃশ্বাস পড়ে সোনালীর। নিজের পছন্দমতন ছবির মত সুন্দর নতুন একটা বাড়ি সে এখনো করতে পারে না।
হয়তো বা তেমন একটা বাড়ি তৈরি করতে পারলে, নতুন ধাঁচে আর নতুন নতুন আসবাবে তাকে সাজাতে পারলে, শশাঙ্ককেও খানিকটা নতুন করে তুলতে পারত সোনালী! পুরানো অভ্যাসের খাঁজে খাঁজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া ওর স্তিমিত চেতনাকে নাড়া দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খানিকটা প্রাণবন্ত করে তুলতে পারত।
কিন্তু তা হবার নয়। এই বাড়িটাই শুধু দামী নয়, রাস্তাটাও কলকাতার সেরা রাস্তার একটি।
কিসের অজুহাত তবে সৃষ্টি করা যায়? অতএব এখানেই কাটাতে হবে সোনালীকে মরণাবধি।
কাটাতে হবে ওই গাঢ় গাঢ় মেহগিনীরঙা বহু বাহুল্যকারুকার্যখচিত আসবাবপত্রের মাঝখানে ওই বইপোকা মানুষটাকে নিয়ে। কত আর ছুটে ছুটে অন্যখান থেকে আহরণ করতে যাবে জীবনের রূপ রস রঙ?
সহসা একটা ধিক্কারের আলোড়নে মনটা উত্তাল হয়ে উঠল। সহসাই মনে হল, মানুষের এত নিরুপায়তা কিসে? হাত-পা-ওলা আস্ত একটা গোটা মানুষের?
আকাশে তখনও আলো। কিন্তু মাঠের ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার নেমেছে। আর একটু পরেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ভরে যাবে। অন্ধকারে ভরে যাবে আকাশটাও। টানা বড় রাস্তাটায় খানিক ব্যবধানে আলোর ব্যবস্থা।
কিন্তু বড় রাস্তা ছাড়িয়ে যেদিকে সেদিকে ইচ্ছে ওই আলভাঙা মেঠো রাস্তায় গিয়ে পড়লে?
একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া কি এতই কঠিন?
ধরিয়ে দেবে গাড়ির নম্বর? হারিয়ে যেতে দেবে না? গাড়িটাই যদি ত্যাগ করা যায়?
দুরন্ত অভিমান বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে।
দমদমের কাছে নীপার বাড়ি। সেই কাছ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর ছাড়িয়ে চলে গেলে ক্ষতি কি?
অন্তত এই উত্তপ্ত মন নিয়ে চট করে এক্ষুনি নিমন্ত্ৰণবাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া সবচেয়ে অসুবিধের ব্যাপার বটুয়ার মধ্যে সেই একশো টাকার নোটখানা অভঙ্গ অবস্থাতেই রয়ে গেছে, কিছু কিনে নেওয়া হয়নি। খেয়াল হয়নি।
এখন এই লোকালয়শূন্য জায়গায় কোথায় কি? অথচ উপহারশূন্য হাতে উৎসববাড়িতে ঢোকাও তো অসম্ভব!
জীবনে একবার বেপরোয়া হয়ে দেখলে কী হয়? গাড়ির স্পীডটা বাড়িয়ে দিলো সোনালী। বেপরোয়া বেগে।
তেল আছে, অনেক তেল!
.
০৩.
তেল নেই!
এক ফোঁটাও না।
টিনটা কাৎ করে, উপুড় করে ঝাঁকিয়ে, কোনও প্রকারেই এক ফোঁটা বার করা গেল না।
মুখখানা পেঁচার মতন করে মিনিট দুই বসে রইল অনন্ত, তার পর উঠে পড়ল দুমদুম্ করে।
ভালো এক জ্বালা হয়েছে তার! পুরনো ঠাকুরটা চলে গিয়ে পর্যন্ত তার ঘাড়ে পড়েছে ভাঁড়ারের তদারকি। নতুন ঠাকুর তো উজবুকের রাজা।
রোজ রোজ কে এত হিসেব রাখেকখন তেল ফুরোললা, আর কখন চিনি ফুরোলো!
শুধু হিসেব রাখাই তো নয়, বাবুর কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে আবার যোগান রাখা।
অনাছিষ্টি ছিষ্টিছাড়া এ সংসার! অনন্তর এত বন্ধুবান্ধব আছে, তার মনিববাড়ির মতন মনিববাড়ি কারুর নয়। বাড়ির যিনি গিন্নী তিনি যেন কুটুম্ব, যেন স্বর্গের পরী! তার পান থেকে চুনটি খসবার জো নেই, তারপর তোমাদের যা হয় তোক! ভাঁড়ারের আছে নেই বলতে গেলেই তিনি নাক কুঁচকে বলেন, ও সব কথা আমায় বলতে এসেছ কেন?
এ আবার কেমন আদিখ্যেতা, ভগবান জানেন। বাড়ির গিন্নী, উনি রাতদিন সাজবেন গুজবেন আর হাওয়া-গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবেন! ধন্যবাদ!
বাড়ির কর্তা অবিশ্যি গঙ্গাজল, কিন্তু বই-কেতাব নিয়ে বসে থাকা মানুষটার কাছে গিয়ে টাকা দাও, টাকা দাও করে উৎপাত করতে লজ্জা করে না?
টাকার হিসেব ওঁকে দিতে হয় না সত্যি, সেদিকে সুবিধে অনেক, তবু এক-এক সময় ভারি বেজার লাগে অনন্তর। কেন রে বাপু, অনন্তরই বা যত দায় কেন?
পুরনো ঠাকুর একেবারে সংসার খরচের মাসের টাকা নিয়ে নিত! তার থেকে কত গুছিয়েই নিল লোকটা! দেশে জমিজমা চাষবাস মাছের পুকুর! দুদুটো মেয়ের বিয়েও দিয়ে ফেলেছে।
অনন্তকে তোকই পুরো মাসের মাসকাবারির টাকা দিয়ে দেয় না বাবু! বিশ্বাস নেই, না অভ্যাস নেই? যা থাকে কুল-কপালে, আজ অনন্ত সেই প্রস্তাব করে বসবে। যতদিন না ঠাকুর দেশ থেকে আসছে!
এ বাড়ির না আছে বাপ, না আছে মা, না আছে ছাত, না আছে মাটি। এ সংসারে কাজ করা ঝকমারি!
.
ঠাকুরের মুখেই সব শোনা, বাবুর মা যখন বেঁচেছিলেন, তখন নাকি সোনার সংসার ছিল। মাইনে করা লোকজন ভাড়ার ঘরে ঢুকতেই পেত না। গিন্নী নিজে স্নানান্তে তসর-গরদ পরে তবে ভঁড়ারে ঢুকতেন। তা সেও ভালো ছিল, সংসারে লক্ষ্মীশ্রী ছিল।
কিন্তু এ কী! সংসার, না মেসবাড়ি! মেয়েমানুষ অলক্ষ্মী হলে কি আর সংসারের আঁটবাঁধ থাকে? আমি তো ওনাদের সোনার সংসারের আমলের নই, তবু এ ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। বামুন-ঠাকুরের মতন অনন্তর অমন শুধু পয়সা গুরু, পয়সা ইষ্ট নয়।
তাছাড়া সংসারের গিন্নী কর্তার কড়া হুসিয়ার চোখের ওপর দিয়ে দুপয়সা হাতাতে পারলে তবেই না ফুর্তি। এ কী বাবা, সমুদুর শুষলেও কেউ তাকিয়ে দেখবার নেই। দশ টাকার নোট ভাঙিয়ে তিন টাকার জিনিস কিনে বাকী সাত টাকা ফেরত না দিলেও কেউ বলবে না, সে টাকাটা কই?
এ রকম জায়গায় টাকা সরাতে যেন গা ছমছম করে। নিজেকে পাষণ্ড পাষণ্ড লাগে।
এমন সংসারে থেকে নিয়েও সুখ নেই, খেয়েও সুখ নেই।
.
তেলের টিনটা ঠক্ করে বসানোর শব্দে নতুন ঠাকুর চমকে উঠল। তারপর অনন্তকে দুমদুম্ করে দোতলায় উঠে যেতে দেখে ব্যাপার বুঝে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল, অনন্তটা আছে ভালো। আহা, অনন্ত যদি একবার দেশে যেত!
উজবুকের রাজা হলেও পয়সা সরানোর ব্যাপারটা বোঝে না এমন নয়!
অনন্ত এসে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিতেই চমকে উঠলো শশাঙ্ক!
কী আশ্চর্য, এতক্ষণ সে অন্ধকারে বসেছিল? হাতের বইটা হাতেই ধরে?
কিন্তু কতক্ষণ? কই, মনে তো পড়ছে না কী ভাবছে এতক্ষণ ধরে? কোনও কিছুই কি ভেবেছে?
বাবুর কি মাথা ধরেছে?
অনন্তর অপ্রতিভ কণ্ঠের প্রশ্নে আর একবার চমকালো শশাঙ্ক, কেন, মাথা ধরবে কেন? কে বলেছে মাথা ধরেছে?
আজ্ঞে, অন্ধকারে রয়েছিলেন তাই।
ও তাই। তা তুই আর লোকের বাড়ি ঘরমোছা বাজার করার চাকরি করছিস কেন, যা না ডাক্তারী করগে না, পশার হবে।
ডাক্তারী।
না তো কি। এত সহজে যখন রোগলক্ষণ বুঝে ফেলিস। কিন্তু এখন আগমনের হেতু?
আজ্ঞে বাবু কি বলছেন?
বলছি–কি চাই?
অনন্ত মাথা নীচু করে ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, আজ্ঞে তেল ফুরিয়েছে, তাই
তেল ফুরিয়েছে।
কী বিশ্রী, কী কদর্য, কী কটু? শব্দজগতে এর চাইতে কুৎসিত শব্দ আর আছে?
শশাঙ্কর মনে হয়, এর চাইতে কদর্য শব্দও আর নেই, আর শশাঙ্কর মতো হতভাগাও বুঝি জগতে আর নেই! সত্যি, এমন কোনো বিবাহিত হতভাগা আছে, যাকে জটিলতম কোনও দার্শনিক চিন্তার মাঝখানে সহসা শুনতে হয় তেল ফুরিয়েছে!
সংসারে অবিরত তেল ফুরোয়, চিনি ফুরোয়, আটা ফুরোয়, ময়দা ফুরোয়, হলুদ পাঁচফোড়ন লঙ্কা সর্ষে ফুরোয়, শুধু ফুরোয় না মানুষের সংসার করার বাসনা।
নিজের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয় শশাঙ্কর। কেন সে মার একটু চোখের জল একটু আক্ষেপোক্তিতে ভুলে এই অলাতচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছিল!
শুধু সে একা থাকলে একরাশ টাকা ওই বামুন-চাকরগুলোর হাতে ধরে দিয়ে বলতে পারত, যা, যা খুশি করগে যা। শুধু আমায় দুবেলা দুটি খেতে দিবি এই শর্তে, ব্যস। জ্বালাতন করতে আসবি তো পিটুনি খাবি।
কিন্তু তা হল না।
এখন বারবার আয়ব্যয়ের হিসেব দেখতে হয়। নইলে সোনালীর সব চাহিদা মিটিয়ে ওঠা শক্ত হয়ে ওঠে।
এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়ে গেছে সোনালীর সঙ্গে। সে সাফ জবাব দেয়, আমারও ওসব ভালো লাগে না। আমারও অসহ্য ওই হলুদ পাঁচফোড়ন আলু মাছ। তোমার যাতে বিরক্তি আসে, আমারই বা তাতে আনন্দে আসবে ভাবছ কেন? আমি পারব না, আমার দায় কিসের?
গৃহের গৃহিণী যদি বলে, আমায় দায় কিসের? কতক্ষণই বা তর্ক চালানো যায় তার সঙ্গে?
অথচ মাঝে মাঝেই সে হেসে হেসে বলে, তোমার সংসারের ম্যানেজারী করে করে তোমার বামুন-ঠাকুর তো দেশে জমিদারী করে ফেলল!
সেটাই স্বাভাবিক। বলে শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে।
সোনালী নাক বেঁকিয়ে বলে, তা বটে। শুধু আমি টাকার কথা বললেই মুখ শুকিয়ে যায়। ঠাকুরের কত দেশভাই বারোমাস এখানে এসে রামরাজত্বে থাকে, সন্ধান রাখো?
ওটা আমার সন্ধান রাখার কথা নয়।
কথায় কথা বেড়ে উঠেছে, শেষ পর্যন্ত শশাঙ্ককে থেমে যেতে হয়েছে।
.
নোটে টাকায় খুচরোয় মুঠো ভর্তি করে অনন্তর দিকে বাড়িয়ে ধরে শশাঙ্ক, এই নাও, হবে এতে?
অনন্ত হাত বাড়ায় না, ভারী মুখে বলে, আমার ওপর রাগ করছেন কেন বাবু? আমার কি দোষ?
রাগ? তোর ওপর রাগ করছি? হেসে উঠল শশাঙ্ক, রাগ জিনিসটা কি এতই সস্তা রে অনন্ত?
এ সব ঝামেলা আমার ভালো লাগে না বাবু!
কিসের ঝামেলা রে?
এই এটা নেই ওটা নেই, আনতে হবে, পয়সা চাইতে হবে। মা কিছু দেখবেন না।
আর টাকার দরকার আছে তোমার?
অনন্ত সহসা এই গম্ভীরকণ্ঠের ব্যঙ্গে থতমত খেয়ে টাকাগুলো নিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
.
চমৎকার সংসার করছি আমি! মনে মনে বলল শশাঙ্ক। তারপর ভাবল আর সব লোকেদের মতন হতে পারি না আমি? সোনালী যেমন চায়? সোনালীর জামাইবাবুর মতন রোজ সকালে বাজারে গিয়ে বেছে বেছে মাছ তরকারি
.
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
বাঁচা গেল, ওই বিদঘুটে কল্পনাটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল আপাতত।
উঃ, কী করে যে মানুষ ইচ্ছে-সুখে বাজার যায়! কে?
আমি নীপা কথা বলছি। সোনালী এত দেরি করছে কেন? চলে আসুক তাড়াতাড়ি..কী বললেন, বেরিয়ে পড়েছে? কখন?…পাঁচটা নাগাদ?..সে কী? পথে আর কোথাও যাবার কথা আছে?…নেই? তাহলে? এত দেরি হবার তো কথা নয়।..কি বললেন, প্রেজেনটেশান কিনতে?… আঃ কী মুশকিল, এ সব নিয়ে আবার দেরি করা কেন, শুভেচ্ছাই তো যথেষ্ট। যাক, এসে পড়বে বোধহয় এখুনি। আচ্ছা, ছাড়লাম!
.
কিন্তু সেই ছাড়া রিসিভারই যে আবার ঘণ্টাখানেক পরে তুলে নিয়ে ডাকাডাকি করতে হবে নীপাকে, এ কথা কি নীপাই ভেবেছিল না শশাঙ্কই ভেবেছিল।
এখনো পৌঁছোয় নি সোনালী–এই সংবাদটাই পরিবেশন করতে হচ্ছে নীপাকে।
এখনো পৌঁছোয় নি। স্তব্ধ বিস্ময়ে মুহূর্ত কয়েক কাটে, তারপর প্রশ্নাঘাত শশাঙ্কর দিক থেকেই, কী বলছেন! আমি কি ভেবে নিশ্চিত হতে পারি না, আপনার বান্ধবী আপনাকে দিয়ে আমার সঙ্গে খানিকটা কৌতুক করছেন?
কৌতুক! আপনি বলছেন কি মিস্টার সেন? এটা কি একটা কৌতুকের বিষয়? আপনার ড্রাইভার কি–কী বললেন? ড্রাইভার ছিল না? সোনালী নিজেই ড্রাইভ করে? ব্যস, আর কিছু ভাববার নেই, নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট কেস। আশ্চর্য, আপনি এই একা আসাটা অ্যালাউ করলেন কি করে? জানেন তো ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবে। এতটা রাস্তা! উঃ, আমার তো ভেবে হাত পা আসছে না। ইস্, কেন যে আমি নেমন্তন্ন করতে গেলুম! ইমিডিয়েটলি থানায় হসপিটালে খবর নিন, আমিও নিচ্ছি এদিক থেকে। কোনখানে যে কি হল! উঃ, এ কী কাণ্ড!
এবার না বলেই ছেড়ে দিল নীপা!
গলার স্বর কাঁপছিল তার, উদ্ভ্রান্ত সুর। এ কখনো কৌতুক হতে পারে না। যেটা একটু আগেও আশা করছিল শশাঙ্ক। শশাঙ্ককে জব্দ করতে সোনালী বান্ধবীকে দিয়ে এই উদ্বেগের চাল চেলেছে।
কিন্তু আর সে কথা মনে করা চলছে না। এ খবর ঠিক। এ বিধাতার অমোঘ দণ্ড।
.
এবার তবে উঠে পড়ো শশাঙ্ক! খেসারৎ দাও তোমার জড়ত্বের, তোমার অলসতার, তোমার অপৌরুষের।
কিন্তু থানায় হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করলে কি হবে?
সত্যিৎ কি এ্যাকসিডেন্ট?
.
বিদ্যুৎচমকের মতো সোনালীর শেষ কথাটা মনে পড়ল।
.
০৪.
দুরন্ত অভিমানে উত্তপ্ত মস্তিষ্ক অনেকক্ষণ ধরে খোলা হাওয়া পেয়ে যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এল, এল বিচার-বুদ্ধির কোঠায়, তখন কতটা যে রাত হয়েছে বুঝতে পারল না সোনালী।
অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে হাতে বাঁধা ঘড়িটা। যথাসময়ে দম দিতে ভুলে গিয়েছিল কি ঘড়িটাতে?
ভুলের কথা মনে করবার উপায় নেই, তবু ঘড়িটার এই অদ্ভুত অসময়ে এমন নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হয়ে যাওয়াটা যেন পরিকল্পিত হিংস্রতার মত লাগল সোনালীর।
সবে ছটা বেজে থেমে আছে কাঁটা দুটো, অথচ এখন বেশ রাত মনে হচ্ছে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আশেপাশে বসতির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
হয়তো দিনের বেলা হলে দেখতে পাওয়া যেতো ওই ঝোঁপজঙ্গলের মাঝখান দিয়েই এখানে সেখানে বিধবার সিঁথির মত সাদা সরু একটু পায়ে চলা পথ, যে পথ চলে গেছে লোকবসতির মাঝখানে।
দেখা যেত দূরে দূরে ঘর-বাড়ির আভাস, যেগুলো সারা দিনের ছিটকে পড়ে থাকা মানুষগুলোর দিনান্তের আশ্রয়। যেখানে নিতান্ত দীনদুঃখী মানুষটার জন্যেও প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে উষ্ণ শয্যা, উষ্ণ অন্ন আর প্রেপোষ্ণ হৃদয়।
কিন্তু এখন চারিদিকে নিঃসীম অন্ধকার। এখন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কলকাতার এত কাছাকাছি এত অন্ধকার আছে? আছে এমন জঙ্গল?
রাত্রে ভয়াবহতা বেশিই লাগছে। গাড়ির হেলাইট জ্বালিয়ে আসছিল, চারিদিকে খেয়াল করে নি, একটিমাত্র খেয়াল মাথার মধ্যে কাজ করছিল–শশাঙ্ককে বুঝিয়ে ছাড়া যে সোনালী : একটা অবহেলার বস্তু নয়। তার মূল্য আছে।
কিন্তু কী সেই পথ?
গল্পে উপন্যাসে যেমন মাঝে মাঝে পড়া যায়, অন্যের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের ভান করে স্বামীর অথবা প্রেমাস্পদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, তেমনি একটা কিছু করে দেখা যায় না? ঈর্ষাই শশাঙ্ককে তার ঔদাসীন্যের দুর্গ থেকে বার করে আনবে তাহলে।
কিন্তু সোনালীর এই অভিনয়ের পার্টনার কে হবে?
সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনায় কখন যে এতটা সময় কেটে গেছে। এখন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার বাসনা দূর হয়ে গিয়ে জেগে উঠলো একটা ভয়ের ব্যাকুলতা।
.
ছি-ছি-ছি, এ কী করে বসেছে সে! বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছিল নাকি?
কে জানে এসে পড়েছে কোথায়, কে জানে কত রাত হয়ে গেছে? কে জানে কী বলছে তাকে নীপা?
উৎসবকক্ষের সকলেই যে আজ সোনালীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে তাতে আর সন্দেহ কি?
আচ্ছা, নীপা কি খবর নেবে না, তার সবচেয়ে প্রিয়বান্ধবী এল না কেন? কারণে অকারণে ফোন তো প্রায় একটা ব্যাধি তার। সোনালীর যেতে দেরি দেখলে অবশ্যই শশাঙ্ককে ফোন করবে সে।
হঠাৎ একটা প্রতিশোধের উল্লাস অনুভব করে সোনালী। নিশ্চয় ফোন করেছে নীপা, আর? ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে শশাঙ্কর।
খুঁজুক, সারারাত ছুটোছুটি করে বেড়াক সে। সোনালী এবার গিয়ে নীপার বাড়িতে আত্মগোপন করে বসে থাকবে, জানতে দেবে না সে এসেছে।
দেখা যাক, শশাঙ্ক কতটা কর্মক্ষমতা দেখায় নিরুদ্দিষ্টা স্ত্রীর সন্ধান করতে।
কিন্তু তাই কি হবে?
হয়তো শশাঙ্ক তার বইরাজ্যের মধ্যে মশগুল অবস্থাতেই ফোনটা ধরে বলবে, যায় নি ওখানে? কেন? বাড়ি থেকে তো বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। তা আর কোথাও গেছে বোধহয়। বলে স্বামী-কর্তব্য সমাপনান্তে আবার ফিরে যাবে নিজের রাজ্যে।
সহসা চোখে এক ঝলক জল এসে যায়।
আজ যদি সোনালী মোটর অ্যাকসিডেন্ট করে মারা পড়ে যেতে পারত! বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোথাও কোনও এক অপরিচিত অখ্যাত গ্রামের ধারে পথের একপাশে পড়ে থাকত সেই মৃতদেহ।
শশাঙ্ক এসে দেখত। দেখতো নিজের কীর্তি!
তা নিজের কীর্তি ছাড়া আর কি!
সোনালী কি মরতে উৎসুক? তার কত সাধ, কত বাসনা।
হঠাৎ বুকটা হু হু করে উঠল সোনালীর। এই অজানা গ্রামের ধারে পথের প্রান্তে মারা গিয়ে পড়ে থাকবার চিন্তাটা যেন ভয়ঙ্কর একটা শোকের মত হাহাকার এনে দিল।
না না, জীবনের এমন ভয়ানক পরিণতি চায় না সোনালী।
তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সোনালী আবার ফেলে আসা পথ পাড়ি দিতে।
আর মাত্র কয়েক গজ গিয়েইহা, কয়েক গজ মাত্র গিয়েই–গাড়িটাও ঘড়ির মতই একটা অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল।
হঠাৎ অচল হয়ে গেল!
বনের মধ্যে ঝিঁঝি পোকারা একতানে বেজে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন সুরে।
কিন্তু বাজছে শুধুই কি বনের মধ্যে?
.
০৫.
নীপা পাখাটার স্পীড শেষ সীমায় ঠেলে দিয়ে বসে পড়ে হতাশ স্বরে বলল, এই কথা বলেছিল সে?
শশাঙ্কও বসেছে হেঁটমুণ্ডে। মরীয়া হয়ে বলে ফেলেছে সে, সোনালীর চলে গিয়েও ফিরে এসে বলে যাওয়া শেষ কথাটা।
তবু এতর মধ্যেও কাণ্ডজ্ঞানটি একেবারে হারায় নি। সবটা বলে নি।
শুধু নীপার বারবার প্রশ্নে এক সময় জানিয়ে ফেলেছিল, যাবার সময় বলে গেল, হয়তো না ফিরতেও পারি।
এই কথা বললে, আর আপনি–নীপা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কেন স্টেপ নিলেন না? একলা চলে যেতে দিলেন?
ওটাকে আমি একটা কথা বলেই ধরি নি।
ধরেন নি! আশ্চর্য!
অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটাই নীপার বাড়াবাড়ি। দৈবাৎ একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল বলেই না ওই কথার কথাটায় গুরুত্ব আসছে!
শশাঙ্কদের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে নীপাদের দমদমের বাড়ি পর্যন্ত সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব রাস্তাগুলো গাড়ি ছুটিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে কোথাও কোন মোটর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কি না।
গাড়ির নাম্বার জানিয়ে থানায় থানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। খোঁজ নেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য হাসপাতালগুলিতে।
আপাতত আর কি করবার আছে?
কে আর ভাবতে বসবে নীপার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সোনালী নীপার বাড়ি ছাড়িয়ে অনেক অনেকটা দূরে।
.
ইচ্ছাকৃত নিরুদ্দেশ! বললেন নীপা-পতি মিস্টার দাশগুপ্ত, দেখাই যাচ্ছে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া। পুলিশ কেসে তো পড়তেই হবে মিস্টার সেন, এখন ঠিক করুন কি কি বলবেন।
কি বলব মানে?
আহা, আনুপূর্বিক বলতে তো হবেই? কোনও রকম কথা কাটাকাটি কলহ অথবা মনোমালিন্য হয়েছিল কি না, আর কারও সঙ্গে বিশেষ কোনও মেলামেশা ছিল কি না–
আঃ, থামো তো তুমি। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে নীপা, সবাইয়ের সব কিছুই তোমার আদালতের নথিপত্তর নয়। কথা বলার সময় একটু বুঝেসুঝে বলতে হয়।
কী আশ্চর্য, আমি কি মন্দ ভেবে কিছু বলেছি, মিস্টার দাশগুপ্ত হতাশভাবে মাথা নাড়েন, ব্যাপারটা গোলমেলে এটা তো ঠিক?
অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতেই পারছি না, বলে শশাঙ্ক।
কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবেই এই সঙ্কল্প নিয়ে সে কি উত্তরপথের বদলে দক্ষিণপথ বেছে নিয়েছিল? অথবা পূর্ব-পশ্চিম যে কোনও পথ? তাহলে অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, আমাদের অনুসন্ধানটা নিতান্তই আংশিক ব্যাপার হয়েছে। আমরা সম্ভাব্যটুকুই দেখেছি। দিকে দিকে খোঁজ করতে হলে–।
আঃ, থামো তুমি, সব সময় আর সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করা তোমার একটা রোগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলল নীপা।
উৎসবশেষের বাড়িটা যেন ভাঙা মেলার মত দেখাচ্ছে।
অতিথি অভ্যাগত সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছেন সহানুভূতি আর উদ্বেগ জানিয়ে। অনেকেই আশ্বাস দিয়ে গেছেন সকালবেলাই ফোনে খবর নেবেন।
এবং প্রত্যেকেই ঘরে ফিরে এই নিরুদ্দেশ পর্বটিকে একটি রোমান্সের রঙে ছুপিয়ে নিয়ে বহুবিধ রসালো আলোচনায় মুখর হচ্ছেন।
সোনালীর সঙ্গে যে তার স্বামীর সম্পর্কটা খুব একটা আদর্শ নয় কে না জানে?
নীপাই কি জানে না? তাই না নীপার মনের মধ্যেও ভয়ের কাপন! কে জানে সর্বনাশী পোড়ারমুখী কি করে বসল!
কিন্তু নীপা তার একান্ত বান্ধবী, আবাল্যের বান্ধবী, নীপা কিছু টের পেল না?
এই তো আজ সকালেও টেলিফোনে কত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে–বাবলীর জন্মদিন নিয়ে। দমদমে বাড়ি করা পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ দূরবর্তী হয়ে গেছে, এইসব নিয়ে করেছে আক্ষেপ। ইতিমধ্যে এমন কি ঘটা সম্ভব?
আর শশাঙ্ক লোকটা আর যাই হোক, হঠাৎ ভয়ানক রকম একটা কিছু ঝগড়াঝগড়ি করে বসবার লোক নয়।
নীপা তো বরং মনে করে ওই রকম শান্তশিষ্ট স্বল্পবাক স্বামীই সংসারযাত্রার পক্ষে সুবিধেজনক।
কিন্তু সে যাক, এখন করণীয় কি?
করণীয় আর কি! দাশগুপ্ত বলেন, গাড়ির নাম্বারটাই এখন প্রধান ভরসা। সন্ধান নিতে হবে ওই সময়ের মধ্যে ওই রকম একটা গাড়ি শহরতলীর কোনও পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিয়েছে কিনা, নিয়ে থাকে তো কোন দিকে গেছে?
কেউ যদি ইচ্ছা করে হারিয়ে যায়, তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায়? অদ্ভুত সুরে বলে শশাঙ্ক।
আর সঙ্গে সঙ্গে ধমকে ওঠে নীপা, থামুন আপনি! রাখুন মেয়েলি কাদুনী। আশ্চর্য দায়িত্বহীনতা আপনার, না বলে পারছি না এ কথা–
বান্ধবীর স্বামী বে-পোট অবস্থায় পড়লে যতটা রসনা সঞ্চালন করা চলে তাতে ত্রুটি করে না নীপা।
২. শশাঙ্কর অবস্থা
০৬.
কিন্তু শশাঙ্কর অবস্থা আর এমন কি? কতটুকুই বা জব্দ হল সে?
ঝিঁঝি পোকা আর শেয়ালডাকা গ্রামের ধারে অন্ধকার আকাশের নীচে অচল গাড়ির মধ্যে বিমূঢ় সোনালী এই কথাই ভাবল, ওর আর কতটুকু কি হল? কি আর এমন জব্দ হল ও? সোনালী নিজেই যে–
আচ্ছা, এইভাবে সারাটা রাত কাটিয়ে দেওয়া কি খুব শক্ত? কি আর হবে চারিদিকে কাঁচ তুলে নিঃশব্দে বসে থাকলে? সকাল হলে যা হয় একটা ব্যবস্থা হবেই।
তাছাড়া উপায়ই বা কি? নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে বসে থাকাই যাক।
কিন্তু এ কল্পনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
চারিদিক থেকে শেয়ালের ঐক্যতান শরীরের সমস্ত রক্ত ঝিমঝিমিয়ে তুলল।
হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যেন একটা হিমপ্রবাহ বইতে সুরু করেছে, অথচ হাত পা কপাল উঠেছে ঘেমে।
জগতের সমস্ত বাঘ, সমস্ত সাপ, আর সমস্ত চোর-ডাকাত খুনেগুণ্ডা বুঝি সোনালীর গাড়িখানা ঘিরে তাণ্ডবনৃত্য করছে, শুধু একবার ঝাঁপিয়ে পড়বার ওয়াস্তা।
যা থাকে কপালে বলে আর বসে থাকা অসম্ভব! সহসা একটা কাজ করল সোনালী। গাড়ির হেলাইটটা ফের জ্বালিয়ে তীব্র শব্দে হর্ণটা বাজাতে শুরু করল। মুহুর্মুহু নয়, অনবরত।
অবিচ্ছেদ্য সেই তীক্ষ্ণ তীব্র চীৎকারটা যেন খণ্ড বিখণ্ড করতে চাইছে গ্রামের নিশ্চিন্ত শান্তি।
কিন্তু সোনালীরও যেন নেশা লেগেছে। যেন বাজিয়ে যাবেই শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ ওই যন্ত্রটার ক্ষমতা থাকবে আর্তনাদ করবার। অথবা ওই শব্দটার মধ্যেই বুঝি ভরসা খুঁজছে সে।
সামনের পথটা গাড়ির আলোয় চোখধাঁধানো, কিন্তু পাশের অন্ধকার অনাহত।
.
হঠাৎ যেন বিদীর্ণ হল সেই নিচ্ছিদ্র প্রাচীর। সরু একটি আলোকরেখা কোথায় যেন চিকচিকিয়ে উঠল।
সত্যি? না কল্পনা?
কিসের ওই আলোকরেখা, দুলছে কাঁপছে, মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে? কিসের আলো ওটা?
চিরশহরবাসিনী সোনালী গল্পে কাহিনীতে পড়া ধারণাটাকে ছুটিয়ে দেয় কল্পনার ঘোড়ায় চড়িয়ে।
ওই বোধহয় আলেয়া।
ওই যে মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওই আলেয়াটাই কি সোনালীকে পথভ্রান্ত করে দেবে?
কিন্তু কি করে? সোনালী তো গা থেকে নামছে না। ওর পিছনে ছুটতেও যাচ্ছে না।
কিন্তু কিসের পিছনে ছুটে এতদূর এল সে?
আর যদিই বা উগ্ৰ অভিমানের বশে এসে থাকে, প্রধান রাস্তাটা ছেড়ে এমন অজানা অন্ধকার কাঁচা রাস্তায় চলে এল কেন?
যশোর রোড দিয়ে অনবরত মালবাহী লরি আসা যাওয়া করে। সোনালীর অচল গাড়িখানা সেখানে পথ জুড়ে পড়ে থাকলে নিশ্চয় তাদের দৃষ্টিতে পড়ত, এবং এতক্ষণে নীপার বাড়ি বসে সমারোহ করে নিজের খামখেয়ালের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প করতে পারত সোনালী।
কিন্তু তা হল না। পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলে এসেছে সোনালী।
হয়তো বা শুধু এইটুকু চলে আসার জন্যেই জীবনের পাকা রাস্তাটাকে হারালো সোনালী। চিরকালের মত কাঁচা রাস্তায় পড়ল।
না, ওটা আলেয়া নয়, লণ্ঠনের আলো। কেউ বুঝি এগিয়ে আসছে আলোটা হাতে ঝুলিয়ে।
ছেলেবেলায় শোনা যত সব ডাকাতের গল্প মনে জেগে উঠছে। আলো হাতে করে কাছে আসে তারা, কড়া গলায় বলে, গায়ে কী গহনা আছে খুলে দাও চটপট।
কিন্তু শুধু গহনা পেলেই কি সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাবে?
তাই কি যায়? যদি আরও কিছু উপরি পাওনার আশা থাকে? হায় হায়, কেন এ বোকামী করতে গেল সোনালী? কেন শব্দের সঙ্কেত দিয়ে অনিশ্চিত বিপদকে নিশ্চিত করে তুলল? কেন আলোর নিশানা দিয়ে জানিয়ে দিল কোনখানটায় পড়ে আছে সে অরক্ষিত একটা গাড়ির মধ্যে?
আলোটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
আর বোঝা না বোঝার দ্বন্দ্ব নেই। দুটো লোক আসছে গাড়ির দিকে। একজনের হাতে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন। মেঠো লোক, গায়ে জামার বালাই নেই, কেঁচার খুঁটটা একটু গায়ে দেওয়া।
দুজন এসেছে, অর্থাৎ গুছিয়েই এসেছে। কে জানে হাতের ফাঁকে লুকোনো আছে কিনা কোনও ধারালো অস্ত্র।
বাইরে থেকে ভরসার যখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, ভয় বস্তুটা একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র জন্তুর মত দন্ত মেলে উদ্যত হয়ে ওঠে, তখনই বুঝি অন্তর্জগতে একটা ওলটপালট ঘটে যায়। চিরদিনের ভীতু মানুষটা সহসা সাহসী হয়ে ওঠে, চিরদিনের দুর্বল মানুষটা পায় অমিত বল। মন যেন তার আঁকড়ে ধরে থাকা কোনোখানে লুকিয়ে রাখা শেষ ব্রহ্মাস্ত্রখানা প্রয়োজন বুঝে বার করে।
.
ওরা গাড়ির কাছে এসে পড়েছে।
হাতের কাছে কোনও ভারী জিনিস থাকলে, ঈশ্বর জানেন সেইটা ছুঁড়ে মেরে বসত কিনা সোনালী। কিন্তু কিছুই নেই। একখানা ভারী বই পর্যন্ত না।
অতএব চীৎকার নয়, অদৃশ্য কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা নয়, শুধু সমস্ত মানসিকশক্তি একত্র করে বসে বসে প্রতিক্ষা করা মৃত্যুর জন্যে, ধ্বংসের জন্যে।
.
কিন্তু কই, ওরা তো এসেই গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বসল না। জানালার কাঁচগুলো শাবলের ধাক্কায় ভেঙে সাতটুকরো করল না! ওরা শুধু হাতের আলোটা তুলে ধরে কিছু একটা প্রশ্ন করল।
কাঁচের ওপিঠ থেকে গলার আওয়াজ ঠিক বোঝা গেল না, তবে ভঙ্গীটা বোঝা গেল– প্রশ্নের ভঙ্গী।
আশ্চর্য, একটা ভদ্রলোক জুটল না সোনালীর ভাগ্যে?
তবু দরজাটা খুলল সোনালী।
আর তীব্র তীক্ষ্ণকণ্ঠে এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন ওরা কাঠগড়ার আসামী, আর নিজে সে অপর পক্ষের উকিল।
জায়গাটার নাম কি?
হ্যারিকেনধারী চুপচাপ সেটা উঁচু করে তুলেই রইল। অপর ব্যক্তি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, এই পাড়াটাকে জামতলা বলা হয়। টাউন বনগাঁ।
বনগাঁ! কী সর্বনাশ! বনগাঁ পর্যন্ত চলে এসেছে সোনালী? কিন্তু আসা তো নয়, এ যে এসে পড়া!
কে জানে এই এসে পড়তে কতক্ষণ লেগেছে?
কিন্তু না, এদের সামনে বিচলিত ভাব দেখালে চলবে না, ভুরু দুটো আরও কুঁচকে বলে ওঠে, বেজেছে কটা?
এই খালি-গা চাষা দুটোকে আপনি বলতেও ইচ্ছে করছে না, আবার ঠিক তুমিটাও মুখে আসছে না। একটা লোক যেন ঠিক চাষার মতও নয়। যদিও বেশভূষায় উভয়েই প্রায় অভিন্ন, তবু কোথায় যেন মস্ত একটা পার্থক্য রয়েছে চোখে, চুলে, মুখের রেখায়। হ্যারিকেনের আলোটা ওর মুখেই বারেবারে আলোছায়ার আলপনা কাটছে।
কিন্তু ও উত্তর দেবার আগেই আলোধারী বলে ওঠে, ঘড়ি তো আজ্ঞে আপনার হাতেই বাঁধা রয়েছে দিদিমণি!
অপর ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গেই তেমনি মৃদুস্বরে বলে, তুই থাম ফণী।
কিন্তু এ বিনয় নরম করতে পারে না সোনালীকে। যেন সমস্ত ঘটনাটার জন্যে এরাই দায়ী এই ভাবে রুক্ষস্বরে বলে, সেটা আমার জানা আছে। ঘড়ি বন্ধ হয়েছে বলেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
ফণী অবশ্য আর কথা কয় না, অপর জন বলে, পৌনে নটা মতন হবে।
পৌনে নটা! মাত্র পৌনে নটা।
সোনালীর যে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল এইভাবে বসে আছে সে!
সোনালীর এই বিস্ময় প্রকাশে লোকটা মৃদু হাসে, পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার তো! সন্ধ্যেবেলাই শেয়াল ডাকে। কিন্তু কি হয়েছে বলুন তো? গাড়ি বিগড়েছে?
লোকটার কথা বলার ধরনটা নেহাৎ চাষাড়ে নয় বটে, কিন্তু ওই দিদিমণি বলা লোকটার সঙ্গী বই তো নয়, ওকে আপনি বলে হাস্যাস্পদ হতে পারবে না সোনালী। তাই সবলে দ্বিধা দূর করে বেশ মনের জোরের সঙ্গে বলে, তাই মনে হচ্ছে। কাছাকাছি কোনো মোটর মেকানিকের সন্ধান জানা আছে তোমার?
আলোধারী যেন একটু চমকে উঠল। তুমি শুনেই কি?
কিন্তু অপর জন অবিচলিত মুখে বলল, কাছাকাছির মধ্যে কই? আছে টাউনে।
তবে তো সবই হল, সোনালীর স্বরে অসহিষ্ণুতা, সেটা এখান থেকে কত দূর?
মাইল তিনেক হবে।
ডেকে নিয়ে আসতে পারবে না? বখশিশ পাবে।
আলোধারীর কণ্ঠ থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ উঠল। আর অবিচলিত ব্যক্তির মুখে ফুটে উঠল একটা মৃদু হাসি।
আমি যেতে পারলেও সে আসতে রাজী হবে না।
হবে না মানে? চালাকি নাকি? একজন ভদ্রমহিলা এইরকম বিপদে পড়েছেন জেনেও আসতে রাজী হবে না?
মুশকিল কি জানেন, আবার হাসে সে, ওসব লোক এ সময় যে অবস্থায় থাকে, সে অবস্থায় স্বয়ং বৈকুণ্ঠের নারায়ণ এসে আবেদন জানালেও তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে।
এবার সোনালী যেন থতমত খায়, হোঁচট খায়, তার মানে?
মানে নেশায় আচ্ছন্ন। তায় আবার শনিবার, লরিওয়ালারা আলাদা বখশিশ দেয়।
চমৎকার! রেল স্টেশন এখান থেকে কত দূর?
ওই তো বললাম মাইল তিনেক। স্টেশনের ওপারেই বাজার, সেখানেই যত লরির আচ্ছা। মোটর মেকানিকও–
তোমাদের এখানে ট্যাক্সি মিলবে?
এখানে? পাগল হয়েছেন! দস্তুরমত হেসে ওঠে লোকটা।
উঃ, আচ্ছা বিপদেই পড়া গেছে। বলি আর কোনও যানবাহন, মানে আর কিছু গাড়ি-টাড়ি আছে?
আছে কয়েকখানা সাইকেল রিকশা, কিন্তু সন্ধ্যার পর বেরোয় না।
সন্ধ্যার পর বেরোয় না! অপূর্ব! ডবল মজুরি দিতে চাইলেও না?
সেটা ঠিক বলতে পারি না, কারণ আমার অন্তত জানা নেই কেউ কোনো দিন ওদের ডবল মজুরী দিতে চেয়েছে কিনা!
সোনালী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আর একবার লোকটার আপাদমস্তক দেখে নেয়।
মনে হচ্ছে যেন সোনালীকে ব্যঙ্গ করছে। সোনালীর বিপদগ্রস্ত অবস্থায় মজা পেয়েছে যেন। নিশ্চয় কু-মতলবী বদলোক। এইভাবে সোনালীকে আটকে ফেলতে চাইছে।
মোটে রাত্তির পৌনে নটা, এক্ষুনি অমনি গাড়ি ঘোড়া সব ঘুমিয়ে পড়ল, আর মেকানিক নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রইল!
সব মিথ্যে কথা! খুব সম্ভব দলের আরও লোকজনের আসার অপেক্ষায় কথা কয়ে সময় ক্ষেপণ করছে।
হায় ভগবান, গাড়ি বিগড়ে দেবার আর সময় পেলে না তুমি
আর কিছু না, এ হচ্ছে শশাঙ্কের শাপের ফল। নির্ঘাৎ সোনালী যখন চলে এসেছে, অভিশাপ দিয়েছে সে!
কিন্তু এখন কি করা যায়! মুখের জোর হারালে চলবে না। হাত পা ঠাণ্ডাই হয়ে আসুক আর বুকের মধ্যে সমুদ্রকল্লোলই উঠুক, মুখের জোর বজায় রাখতেই হবে।
কোথায় থাকে রিকশাওয়ালারা? নিয়ে এসো দিকি একজনকে।
তারা তো সবই গ্রামের মধ্যে। কিন্তু চেষ্টা করে তাদের কাউকে ডেকে এনে রাজী করিয়ে রওনা দিলেও ফল কিছুই হবে বলে মনে হয় না, ততক্ষণে লাস্ট ট্রেন চলে যাবে।
লাস্ট ট্রেন চলে যাবে? সোনালীর তীক্ষ্ণস্বর আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, লাস্ট ট্রেন কটায়?
সাড়ে দশটা।
ওঃ, সে তো অনেক দেরি। সাইকেল রিকশায় এই তিন মাইল রাস্তা যেতে এতক্ষণ লাগবে?
ওদের বাড়িতে গিয়ে রাজী করিয়ে ডেকে নিয়ে আসার সময়টাও যোগ করুন ওর সঙ্গে।
আবার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।
আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে সোনালীর। ছেলেবেলায় শোনা ওর মার একটা কথা মনে পড়ে যায়, হাতী যখন হাবড়ে পড়ে, ব্যাঙে ধরে লাথি মারে।
এ যে প্রায় তাই।
নইলে কোথায় সোনালী, আর কোথায় ওই খালি গা, খাটো কাপড়-পরা গাঁইয়া ভূতটা, ওর সাহস হয় সোনালীকে ব্যঙ্গ করতে!
এবার রক্তমূর্তি হওয়া দরকার।
তাই গলা চড়িয়ে বলে ওঠে সোনালী, আমার মনে হচ্ছে তোমার সমস্ত কথাই মিথ্যে। নিশ্চয় তোমার মতলব খারাপ। ভালো চাও তো হয় একটা মোটর মেকানিক, নয় একটা রিকশাওলা ডেকে আনো বলছি।
দাদাবাবু! ফণী সহসা হাতের আলোটা ঠক করে মাটিতে বসিয়ে বলে ওঠে, আপনি ফিরবেন?
আঃ, দাঁড়া না!
না দাদাবাবু, ফণীর আর দাঁড়াবার ক্ষ্যামতা নেই।
কেন রে, কি আবার হল তোর?
ও কথা শুধোবার আর দরকার নেই দাদাবাবু। আপনি দেবতা হতে পারো, ফণী রক্তমাংসর মানুষ! উঃ, ধন্যি বলি আপনাকে দিদিমণি! সাধে কি আর শহুরে মানুষদের দূরে থেকে গড় করি আমরা। বলি আপনি যে এই একা মেয়েছেলে শখ করে রাতদুপুরে গাড়ি চালিয়ে এসে, মাঠের মাঝখানে গাড়ি ভেঙে বেপোটে পড়েছ, এ দোষ কি আমাদের দাদাবাবুর?
ফণী! বিরক্ত গম্ভীর কণ্ঠ ভৎর্সনা করে ওঠে, তুমি যদি চুপ করে না থাকতে পারো আলোটা রেখে চলে যাও।
তা জানি। আপনার কাছে তো নেয্য কথা কইবার জো নেই।
ফণীর দাদাবাবু সম্বোধনটা সোনালীকে একটু যে নার্ভাস করে না আনে তা নয়। বোঝা যাচ্ছে আর যাই হোক, এ লোকটা ফণীর পর্যায়ভুক্ত নয়। কিন্তু এখন আর কি-ই বা করা যায়। বড় জোর সুরটা একটু নরম করা। কিন্তু তাতেও তো মানের হানি। ও যা হচ্ছে তোক।
অতএব সুরের গরমটা একটু কমলো কি না কমলো, নরম আদৌ নয়।
আচ্ছা মানছি, আমারই সব দোষ। কিন্তু কি করে জানব যে পৃথিবীতে এখনও এ রকম হতচ্ছাড়া জায়গা আছে।
পৃথিবীতে যে এখনও আরও কত হতচ্ছাড়া জায়গা আছে সে আপনাদের কল্পনার শুধু বাইরেই নয়, তার থেকে সমুদ্রপ্রমাণ দূরে।
.
০৭.
গম্ভীর মৃদু ক্ষুব্ধ এই স্বরটা যেন শুধু সোনালীকেই নয়, সমস্ত সভ্যতাকেই ধিক্কার দিয়ে উঠল।
সোনালী যদি আজকের বিকেল থেকে এই রাত অবধি সমস্ত ঘটনাটা জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারত!
আবার দেখা দিচ্ছে আপনি তুমির দ্বন্দ্ব। লোকটার কথাবার্তা বারে বারেই ধাক্কা দিচ্ছে সোনালীকে।
বিমূঢ়র মত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সোনালী বলে, তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে–এখন আমার সারারাত এই অবস্থায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করবার নেই! বাঘেই খাক আর ডাকাতেই ধরুক।
অত দূর পর্যন্ত নয়! একটু কষ্ট করে খানিকটা হেঁটে গ্রামের মধ্যে চলুন, আপনাকে বসিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
গ্রামের মধ্যে কোথায় আমি বসতে যাব? উদ্বিগ্ন স্বর সোনালীর।
এই হতচ্ছাড়া গ্রামের কোনও এক হতভাগ্যের ঘরে।
তারপর? ব্যবস্থাটা কি হবে?
দেখি যদি স্টেশন থেকে ফোন–ফোন আছে অবশ্যই আপনার বাড়িতে?
ফোন! সোনালী যেন অথৈ সমুদ্রের কূল পায়। কী আশ্চর্য, এতক্ষণ এই সহজ কথাটা মনে আসছিল না কেন তার?
ফোন আছে বইকি! এখানে ফোন আছে কারুর বাড়ি?
এখানে? লোকটা কেবলই বুঝি হাসির খোরাক পাচ্ছে, এখানে নয়। স্টেশন থেকেই যদি সম্ভব হয়। তাও নিশ্চয় করে বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা দেখতে হবে তো। বাড়িতে অবশ্যই সবাই ভাবছেন।
আমার জন্যে ভাববার কেউ নেই। সহসা বলে ওঠে সোনালী।
লোকটার কি একটু বিস্ময় বোধ হয় না? একটু বা কৌতূহল?
মনে হয় না ভদ্রমহিলা কি রাগ করে বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলেন না কি?
কিন্তু কৌতূহল প্রকাশটা অশোভন। তাই একেবারে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় সে, তাহলে নেমে এসে হাঁটুন একটু কষ্ট করে। ফণী, তুই আলোটা নিয়ে আগে আগে চল্।
নেমে পড়বার ইচ্ছে অনেকক্ষণ থেকেই করছিল সোনালীর, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছিল না। গাড়ির মধ্যে আছে তবু নিজের কোটে আছে।
আহা, গাড়িটা যদি সহসা বিশ্বাসঘাতকতা পরিহার করে! যদি স্টার্ট দিতেই স্টার্ট নিয়ে ছুটতে শুরু করে। তাহলে ওদের নাকের সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় সোনালী ধুলোর ঝড় উড়িয়ে।
কিন্তু যেত কি?
সত্যি বলতে কি, খুব ভয়ঙ্কর ভয় আর করছে না!
আর এই মুহূর্তে সমস্ত নাটকটার উপর যবনিকাপাত করে ঠিক যে চলেই যেতে ইচ্ছে করছে তাও নয়।
নিজেকে সাংঘাতিক বিপদগ্রস্ত আর মনে হচ্ছে না, বরং অনেকটা যেন উপন্যাসের নায়িকার মত মনে হচ্ছে নিজেকে।
এই জায়গাটাকে কি যেন বললে?
জামতলা।
এইখানে থাকো তোমরা?
হ্যাঁ।
কেন, টাউনে থাকতে পারো না? এখানে এত অসুবিধে
ফণী হেসে ওঠে, গাঁয়ের মানুষদের অসুবিধেয় অত কাতর হলে চলে না। হয়ও না।
খাও কি? এখানে নিশ্চয়ই বাজার নেই!
সবই আছে।
কথা কইবার জন্যেই কথা কইছে সোনালী। নিঃশব্দে নিয়তির নির্দেশে এগিয়ে চলার মত লোক দুটোর পিছন পিছন এগিয়ে যেতে ভালো লাগছে না।
কথা কওয়া ভালো, কথার মধ্যে আশ্রয় আছে। তবু গেল খানিকক্ষণ।
ফণীর হাতের আলোর রেখাটুকু ধরে নীরবে এগিয়ে চলেছে দুটো মানুষ।
প্রথমজন সোনালী, দ্বিতীয়জন এখনও অজ্ঞাতনামা।
তা সোনালীর নামটাই কি ও জেনেছে?
.
আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে সেই কোনো একজন যেন হতভাগ্যের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোবার জন্যে?
এ লোকটার সঙ্গে নেহাৎ ফণীর মত করে কথা না বললেও চলবে এটুকু বোঝা গেছে এতক্ষণে।
উদ্দিষ্টব্যক্তি হেসে ওঠে।
এই যে প্রায় এসে গেছি।
তোমারই বাড়ি বোধহয়? নাকি তোমার মনিববাড়ি?
নাঃ, ফণীর সহ্যের উপর বড্ড বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে, আর পারছে না সে। দাদাবাবুর এই অতাত ভাবে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।
কোথা থেকে এক উড়ো আপদ এসে জুটে কী গেরো করছে।
বেশ বাবা, একা মেয়েছেলে বেরিয়ে পড়ে পথে বিপদে পড়েছিস, মায়া দয়া করা মানুষের কাজ। আর দাদাবাবুর তো ওই পেশা, লোকের উপকার করে বেড়ানো, লোককে মায়া দয়া করে।
করো ভালো কথা, কিন্তু ওই বেসহবৎ মেয়েটা যে তোমায় চাকরবাকরের মত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে, এটা বরদাস্ত করবার দরকার কি?
অথচ এটা ফণীর বিলক্ষণ জানা, ফণী যদি মেয়েটাকে দাদাবাবুর মহিমা সমঝে দিতে যায়, জন্মে আর ফণীর মুখ দেখবে না দাদাবাবু।
রাগের চোখে শুধু হাতের আলোটাকে সজোরে আন্দোলিত করতে থাকে সে চলতে চলতে।
ফণী, আলোটা নিভে যাবে, আস্তে। …হ্যাঁ কি বললেন, বাড়িটা আমার মনিববাড়ি কিনা? তা প্রায় ঠিকই ধরেছেন। ওটাই আমার কর্মস্থল।
হুঁ।
কোনো এক রহস্য আবিষ্কারের আশায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে সোনালীর।
কি কাজ করতে হয়?
যখন যা পড়ে। যখন যা এসে যায়। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।
আর এই ফণী?
ও? ও আমার সহকারী।
বাড়িতে আছে কে?
আজ্ঞে গেলেই দেখতে পাবেন।
আর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না ফণী, বলে ওঠে, এই তো এসে গেলাম।
এসে গেলাম বলে যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে–আলোটা উঁচু করে তুলে ধরে ফণী, সে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় সোনালী।
অন্ধকারে সম্যক ধারণা না হলেও বাড়িটা যে অনেকখানি জমি জুড়ে আর অনেকটা উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা গেল। এই ঝোঁপজঙ্গলের মাঝখানে হঠাৎ এতবড় একটা বাড়ি দেখতে পাবে সে কল্পনাই করে নি। মনের মধ্যে বারে বারে কল্পনার ছায়া ফেলেছিল একখানি মাটির ঘর। একটু বা গোবর লেপা উঠোন। একটা তুলসীমঞ্চ।
প্রকাণ্ড বাড়ি।
তবে আর একবার ভালো করে চেয়ে দেখে টের পায় সোনালী, নেহাৎই ভগ্নদশাগ্রস্ত। একদিকের খানিকটা ভেঙে পড়ে স্কুপের সৃষ্টি করেছে। দেখে গা ছমছম করে।
মাকে খবর দিয়ে আয় তো ফণী! বললো অন্য ব্যক্তি।
মা!
শব্দটা যেন কানে মধুবর্ষণ করল সোনালীর।
আশা হচ্ছে তাহলে কোনো একটি নারীচরিত্রের আবির্ভাব ঘটবে।
কিন্তু মা বলতে কি বোঝায়? সত্যিকার মা, না মনিবগিন্নী?
তাই সম্ভব। তবে এ লোকটা যে নেহাৎ চাকর বাকর শ্রেণীর নয়, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিছু কিঞ্চিৎ লেখাপড়াও জানে সন্দেহ নেই। খুব সম্ভব ধনী বিধবার বিষয়আশয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয়। তার চাইতে উঁচুদরের হলে গায়ে একটা জামা অন্তত থাকত।
কিন্তু কথাবার্তায় ভব্যতা আছে। কথায় একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।
.
০৮.
আলোটা নামিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকে মুহূর্তে অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়ে গেল ফণী।
সোনালী ওর সেই পরিত্যক্ত আলোটা তুলে ধরে দেখতে থাকলবাড়ির আকৃতি আয়তন।
বাড়ির মালিক বাড়ি সারান না কেন?
মালিক বলে ঠিক কেউ নেই।
তার মানে? থাকে কে?
দুএকজন কর্মচারী।
মা বললে কাকে?
তিনি? তিনি এখানের অধিষ্ঠিত দেবী। এ অঞ্চলটারই।
নাঃ, আর একবার না ধমকে পারে না সোনালী!
আচ্ছা গোলমেলে কথা তো তোমার! এ সব কথার অর্থ কি? এ কোথায় এনে তুলেছ আমায়?
কী আশ্চর্য! এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?
হব না? বলো কি তুমি! কী মতলবে এই একটা ভাঙা বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলে আমাকে? আমি ঢুকব না এ বাড়িতে।
না ঢোকেন জোর নেই। অভিযুক্ত আসামী মৃদুহাস্যে বলে, তবে বাইরে সাপখোপ
ওঃ, আবার ভয় দেখানো হচ্ছে- সোনালীর আস্ফালনের মধ্যেও উৎকণ্ঠার স্বর গোপন থাকে না, এ সময় সাপ বেরোয়?
বেরোবেই এমন কথা বলছি না, তবে বেরোনো অসম্ভব নয়।
এই ভাঙা বাড়ির খাঁজে-খোপেই যে সাপ নেই তার প্রমাণ?
প্রমাণ দেওয়া শক্ত। প্রমাণের মধ্যে আমরা–যারা এখানে বাস করি, তারা এখনও দিব্যি টিকে আছি, এই।
হু! তোমরা কে কে থাকো?
স্থিরতা কিছু নেই, কখনো তিনজন, কখনো বিশজন।
সোনালীর বুকটা ক্রমশ যেন হিম হয়ে আসছে। বেশ বুঝতে পারছে লোকটা গোলমেলে, জায়গাটা গোলমেলে, আর মতলব ওর খারাপ নিশ্চয়ই।
একটা আস্তানায় কখনো তিনজন, কখনো বিশজন, এর মানে? ডাকাতের আচ্ছা নাকি!
না এর গহ্বরে কিছুতেই ঢুকবে না সোনালী, বরং খোলা মাঠ ভালো। সাপে খায় খাক।
সহসা রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমি ভেতরে ঢুকব না।
বেশ!
বেশ বলে এভাবে চুপ করে রইলে যে? আমাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো।
চলুন।
তুমি কি ভেবেছ কি? তীক্ষ্ণ চীৎকারে অন্ধকার পরিবেশটাকে যেন খান খান করে ফেলে সোনালী, যেন মজা দেখছ এই ভাবে কথা বলছ! ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা কইতে জানো না?
আসামী হেসে ফেলে বলে, আপনি বড্ড বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছেন, এখন আপনাকে কোনো কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা।
তাই নাকি? তুমি তো দেখছি অনেক রকম কথা জানো। কিন্তু মনে জেনো আমার সঙ্গে কোনো রকম দুর্ব্যবহার করতে এলে সহজে রেহাই পাবে না তুমি। তোমার দলসুষ্ঠু সবাইকে পুলিশে
সহসা অন্ধকারের গুহা থেকে বেরিয়ে আসে ফণী। পিছনে খানিকটা ধপধপে সাদা।
সেই শ্বেতবস্ত্রাবৃতার কণ্ঠ থেকে কোমল মধুর একটি ঝঙ্কার ওঠে, ছিঃ মা, ও কথা কি মনে করতে আছে? দুর্ব্যবহার করবে কেন? কত ভাগ্য যে এই ভাঙা বাড়িতে আজ তোমার মত অতিথির পায়ের ধুলো পড়ল!
থতমত খেয়ে যায় সোনালী। ঠিক এ রকমটা আশা করে নি সে।
কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকে কোনটাই বা তার আশানুরূপ ঘটছে?
এসো। আলোটা তুলে ধরেন মহিলাটি।
তুলে এগোতে থাকেন, আর মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মত সোনালী তার পিছন পিছন এগোয়।
বাইরেটা যেমন ভূতুড়ে ভিতরটা তেমন নয়। ভিতরে চলনপথ পার হয়ে দালানে পা দিতেই স্পষ্ট পরিষ্কার আলোর আশীর্বাদ।
সীলিং থেকে দুপাশে দুটো গোল চিমনি ঢাকা বড় বড় কেরোসিন আলো ঝুলছে। সেই আলোয় সমস্ত দৃশ্যটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল সোনালী।
দালানের একপাশে একহারা একটা চৌকীতে পরিষ্কার চাদর ঢাকা সরু একটি বিছানা। তার মাথার কাছে বয়সে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি পাথরের ত্রিপদী। তার উপর দুএকখানা বই, একখানা চশমার খাপ, একটা চকচকে তামার ঘটিতে কয়েকটি ফুল। দেওয়ালের ধারে ধারে সারিগাঁথা বুক-সেলফ।
জিনিসগুলো পুরনো সন্দেহ নেই, পালিশ খসে যাওয়া রংজ্বলা কিন্তু মজবুত সন্দেহ নেই।
পুরনো আমলের ফার্ণিচার। কিন্তু আগাগোড়া বইয়ে ঠাসা।
এ কি। এত গ্রন্থ-সংগ্রহ।
এ কোথায় এসে পড়েছে সোনালী? কোনো রাজনৈতিক দলের গুপ্ত আড্ডায়?
এ বইয়ের মালিক কে?
কে পড়ে এত বই? ওই মহিলাটি?
ওই লোকটা নয় তো? ছদ্মবেশী কোনো দলনেতা হতে পারে,–বিশ্বাস কি?
বোসো মা।
মহিলাটির কণ্ঠস্বরে দালানের এ পাশটায় লক্ষ্য পড়লো। এ পাশে দেয়াল জুড়ে সরু টানা একটা চৌকী, আশেপাশে কয়েকটি বেতের মোড়া। এই দিকে সোনালীকে বসতে অনুরোধ করছে মহিলাটি।
চৌকীতে বসল সোনালী।
দেখলো তার ওপর বিছানো চাদরটা ছাপা খদ্দরের। সামনের বিছানার চাদরটাও বোধকরি তাই। এতক্ষণে নজর পড়ল মহিলাটি এবং পুরুষ দুটি তিনজনেই খদ্দরমণ্ডিত।
ওঃ, বোঝা গেছে।
এতক্ষণে যেন কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয় সোনালী। রাজনৈতিক দল হতে পারে। কিন্তু ভয়ঙ্কর কোনো দল নয়।
মহিলাটি যে রীতিমত অভিজাত ঘরের তাতে আর সন্দেহ নেই, চলনে বলনে ধরনে চেহারায় বনেদী আভিজাত্যের ছাপ।
আর এই লোকটা?
স্পষ্ট আলোয় ধরা পড়ছে এবার মহিলাটির সঙ্গে একান্ত সাদৃশ্য। তার মানে লোকটা ওঁর আপন কেউ। অর্থাৎ ভদ্রলোক।
কিন্তু কী ভয়ঙ্কর লোক! এ ভাবে ছোটলোকের ছদ্মবেশে
নিরু, তুই তাহলে চেষ্টা দেখ এঁর জন্যে কি করতে পারিস। অভিজাতের মসৃণ কণ্ঠ ধ্বনিত হয়ে ওঠে, আমি ততক্ষণ এঁকে-হাতমুখ ধোবে মা?
সোনালী বিচলিত ভাবে বলে, না না, ওসব কিছু দরকার নেই।
মহিলাটি তাকিয়ে দেখেন।
তা সত্যি, দরকার নেই সত্যিই। এনামেলমণ্ডিত উগ্র আধুনিক সাজের এনামেলটা এত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, এত ঘাম গরম সব কিছুর মধ্যেও যথেষ্ট বজায় রয়েছে। অতিরঞ্জিত ঠোঁটটাই যা আপাতত ঈষৎ ম্লান।
তাহলে থাক। কিন্তু খেতে তো হবে একটু।
না না, আমার কিছু খাবার ইচ্ছে নেই এখন।
তা বললে কি ছাড়ব মা, এখন ছাড়া তোমাকে আর পাচ্ছি কোথায়? সকাল হলে আর কি তুমি আমার ঘরে
সকাল হলে! সোনালী চমকে বলে, রাত্তিরে এখানেই থাকতে হবে নাকি?
মহিলাটি ওর চমকানিতে হেসে ফেললেন, তা এই রাতে আর এই ঝোপজঙ্গলের পথে কোথায় যাবে মা? কি করেই বা যাবে?
কেন, আপনি যে বললেন উনি কি যেন ব্যবস্থা করবেন।
নিরু নামক ব্যক্তিটিকে এবার উনি সম্বোধনে সম্ভ্রম দেখায় সোনালী।
ভেবেচিন্তে নয়, অজ্ঞাতসারে।
মহিলাটি নিরুর দিকে একবার তাকিয়ে আর একটু হেসে বলেন, এই রাতে তোমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা আর কি করে হবে মা? কলকাতা থেকে কত দূরে এসে পড়েছ। এখন কলকাতা থেকে গাড়ি আনিয়ে আবার সেখানে ফিরে যেতেও তো রাত ভোরই হয়ে যাবে। ব্যবস্থা করতে বলছি–তোমার বাড়িতে খবর দেবার। বাড়িতে সবাই ভাবছেন তো
সবাই ভাবছেন তো, এইটুকু বলেই থেমে গেলেন ভদ্রমহিলা।
সোনালী কোথায় যাচ্ছিল, কেন যাচ্ছিল এতদূর পথে রাতে অমন একবস্ত্রে, একলাই বা যাচ্ছিল কেন, এ সব অশিষ্ট প্রশ্নের দিক দিয়েও গেলেন না।
এমন কি নারীর সহজাত কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে দেখলেন না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
এই যে সোনালী বললে হাত মুখ ধোবার দরকার নেই, তৎক্ষণাৎ সেই অপ্রয়োজনের ইচ্ছাটাকেই মেনে নিলেন, তার ওপর জোর করলেন না অনুরোধে ভেঙে পড়ে।
সোনালী যদি খেতে না চায়, যদি বলে দরকার নেই, নিশ্চয় মেনে নেবেন সে কথা। খাও খাও করে পীড়ন করবেন না।
আতিশয্য কিছুতেই নেই।
এমন কি চাকরটা পর্যন্ত এত শিক্ষিত যে, মনের বিরক্তি স্পষ্ট প্রকাশ করে নি। তবে চটেছে যে বিলক্ষণ তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু মনিবের মান রেখে চলতে চুপ করে আছে।
নাঃ, এদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই সোনালীর।
যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হয় সোনালী।
না, সত্যিই ভদ্র রুচির মানুষ।
মা, আমি বেরুচ্ছি তাহলে– বলে নিরু (খুব সম্ভব নিরঞ্জন) দালানের মধ্যেকার একটা দরজা দিয়ে কোন ভিতরে চলে যায় এবং মিনিট খানেক পরেই গায়ে একটা মোটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে বেরিয়ে আসে।
একটু সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলে, জানি না আমার অভিযান সফল হবে কিনা, না হবার আশঙ্কাই পনেরো আনা, বাকী এক আনার উপর নির্ভর। তবু চেষ্টা করব। দয়া করে আপনার ফোন নাম্বারটা—
.
০৯.
ফোন নাম্বার!
মুহূর্তে সোনালী অনেকগুলো মাইল অতিক্রম করে পৌঁছে যায় একটা পরিচিত বাড়ির দোতলার একটা ঘরে।
যেখানে টেবিলল্যাম্পের সামনে টেবিলের উপর ঝুঁকে বসে এক জ্ঞানতপস্বী।
সেই টেবিলের ধারে উঁচু টুলের উপর বসানো আছে টেলিফোন রিসিভারটা।
টেলিফোনের কল লোকটার সমাধির মধ্যে সহজে সাড়া জাগাতে পারে না। বার বার চেঁচাতে চেঁচাতে তবে সমর্থ হয় তার ধ্যানভঙ্গ করতে।
সোনালী দেখতে পায় অলস হাতে রিসিভারটা তুলে নিয়েছে সে। তারপর এ পক্ষের বক্তব্য শুনে অবাক-অবাক গলায় বলছে, তাই নাকি? এতক্ষণ ফেরেন নি উনি? জানতাম না তো! আচ্ছা ঠিক আছে, আছেন তো কোথাও এক জায়গায়।…কী বললেন? ব্যাপারটা হয়েছে গাড়ি বিগড়ে? ওঃ। আচ্ছা কাল সকালে যা হয় হবে। ধন্যবাদ, ছাড়লাম।
এ ছাড়া আবার কি! আর কিছু নয়।
এই এরা, এরা মনে মনে কত হাসবে! ভাববে, ওঃ মহিলাটির তো এ দিকে এত অহংকার, অথচ দেখছি ঘরে ওঁর কোনো মূল্যই নেই।
হঠাৎ অকারণ একটা রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে সোনালীর। থাক দরকার নেই খবর দেবার। কী কাজ, যার উদ্বেগ নেই তার উদ্বেগ মোচনের চেষ্টায়।
চেয়ে দেখে সামনের ব্যক্তিটির দিকে।
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে চেহারায় এসে গেছে ভদ্র ছাপ। সন্দেহ নেই ও এতক্ষণ ধরে প্রতারণা করেছে সোনালীর সঙ্গে।
ওই ফণীটার সঙ্গে এক শ্রেণীভুক্ত করে ওকে তুমি বলেছে সোনালী, বকেছে ধমকেছে, কোনো প্রতিবাদ করে নি ও।
ওর ওপরেও রাগে আপাদমস্তক জ্বলে যায় সোনালীর।
আর ঠিক এই মুহূর্তেই বিধবা মহিলাটি আর একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন, আচ্ছা মা, তুমি একটু বোসো, আসছি আমি।.ফণী, তুই আর একটা আলো নিয়ে যা দাদাবাবুর সঙ্গে।
অর্থাৎ তিনি যাচ্ছেন অতিথি সৎকারের চেষ্টায়।
ফণী বোধকরি এই বেহায়া মেয়েটার সংস্পর্শ যতটা পরিহার করা যায় এই ভেবে নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই আলোটা হাতে তুলে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় দাদাবাবুর বেরোবার আশায়।
.
নিরু পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে বলে, কই বলুন!
বলব! কী বলব?
আপনার ফোন নাম্বারটা। টুকে নিয়ে যাওয়াই ভালো। স্মৃতিশক্তির ওপর বেশি চাপ না পড়ানোই উচিত।
ফোন নাম্বার নেবার দরকার নেই।
দরকার নেই! দরকার নেই কথাটা এত সহজে উচ্চারণ করে ফেলছেন কেন? দুনিয়াটা এমনই জায়গা, একবার যদি উচ্চারণ করেন দরকার নেই, তো আর সে দেবে না।
দুনিয়ার কাছে আমার কিছু চাইবার নেই।
এই সেরেছে। আপনি যে দেখছি মহাপুরুষের পর্যায়ে গিয়ে পড়ছেন।..কিন্তু বাড়ির লোকের উদ্বেগের কথা চিন্তা করুন একবার!..
আমার বাড়ির কথা আমি ভাবব, নিতান্ত রূঢ়স্বরে বলে ওঠে সোনালী, আপনাকে আর ভাবতে হবে না।
কি হল, আবার আপনি কেন? বেশ তত সহজ ডাকটি ধরেছিলেন।
.
আপনি–আপনি বলে সম্বোধন করে ফেলেছে বুঝি সোনালী! তাই ফেলেছে বোধহয়। অজ্ঞাতসারেই।
কিন্তু অপ্রতিভ সে হবে না। তাই বলে ওঠে, ভেবেছিলাম মানুষটাও সরল।
সে ধারণা ভঙ্গ হবার হঠাৎ কি হল?
জানি না। আমার যখন যা খুশি, তাই বলব।
আশ্চর্য, কিছুতেই আহত হয় না লোকটা। এই অকারণ ঔদ্ধত্যেও নয়।
তাই বলবেন। তুই বললেও আপত্তি নেই। শুধু নাম্বারটা–অন্তত বাড়ির ঠিকানাটা
না না না। বলছি আমার বাড়িতে খবর দেবার দরকার নেই!
কী আশ্চর্য, এতক্ষণ তাহলে ব্যস্ত হচ্ছিলেন কেন? নিরু হতাশভাবে প্রশ্ন করে।
সোনালী সমান উদ্ধতভাবেই বলে, ব্যস্ত হচ্ছিলাম ফিরে যাবার জন্যে। বলেছি তো আমার জন্যে কেউ ভাববার নেই।
খুব মৃদু একটি হাসির রেখা ফুটে ওঠে নিরুর মুখে, যেখানে আপনার অনুপস্থিতিতে উদ্বেগের আশঙ্কা নেই, সেখানে ফিরে যাবার জন্যে এত অস্থিরতা কেন? যাবেন কাল ধীরে সুস্থে গাড়ি ঠিক করে। এসেই যখন পড়েছেন, না হয় একটু দেখে যাবেন আমাদের গ্রামটা।
সোনালী অবজ্ঞার সুরে বলে, দেখবার কিছু আছে নাকি?
আছে বইকি। নিরঞ্জন গম্ভীর হয়ে যায়, মানুষ কত হতভাগা আর তার পরিবেশ কত হতচ্ছাড়া হতে পারে সেটাও তো দেখবার জিনিস!
দেখে কি হবে? কিছু প্রতিকার করতে পারব?
অন্তত গ্রামের জন্যে কিছু ভাবতেও তো পারবেন।
তার জন্যে তো আপনারাই রয়েছেন। খুব সম্ভব গ্রামোন্নয়ন নিয়েই পড়ে আছেন এখানে?
এটা আমার দেশ, এখানেই বড় হয়েছি, দুদশ বছর ছাড়া বরাবরই এখানে আছি, পড়ে থাকা মনে হয় না।
দুদশ বছর ছাড়া কেন? পড়াশোনার জন্যে?
ওই যা হয় কিছু।
হু। এ বাড়িতে যদি বাস করেন, এমন পোড়ো বাড়ি করে রেখেছেন কেন?
এত বড় বাড়ি সারাই অত পয়সা কোথায়?
চমৎকার। বাড়ির ছাতটা মাথায় নেমে আসুক তাও ভালো, কেমন? এই আমাদের দেশ! হতচ্ছাড়া কি অমনি হয়? কেন, এত বড় বাড়ি রাখারই বা দরকার কি? বেচে দিন না।
কিনবে কে? যারা আছে সবাই যে হতভাগা। তা ছাড়া
কি? কি তা ছাড়া?
এই পোড়ো বাড়িটায় কিছু পোড় ছেলের জটলা হয় দুপুরবেলা।
ও, ইস্কুল! খুব সম্ভব অবৈতনিক? আর সেটা আপনিই পড়ান? বিদ্রুপে ভুরুটা কুঁচকে আসে সোনালীর!
আশ্চর্য অনুমানশক্তি তো আপনার! আমি কিন্তু আপনার সম্বন্ধে কিছুতেই কিছু অনুমান করতে পারছি না!
আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিশ্চয়?
আপ্রাণ না হলেও, করছি।
আপনার মার কিন্তু এত কৌতূহল নেই।
বাঃ, উনি আমার মা একথা তো বলি নি আপনাকে?
ভগবান কাউকে কাউকে সহজাত কিছু ক্ষমতা দেন যাতে সে অনেক কিছুই নিজে বুঝে নিতে পারে।
নিরু হেসে উঠে বলে, সব সময় পারে না।
ও-সেটা অপরের ছদ্মবেশের মহিমা।
ছদ্মবেশ!
তাছাড়া আবার কি?
বিশ্বাস করুন, ওইটাই আমার সত্যিকারের বেশ, সচরাচরের বেশ!
কেন? কৃচ্ছ্বসাধন?
ওসব বড়সড় কিছু না, প্রয়োজনের অতিরিক্তে আমার অস্বস্তি।
অথচ একজন ভদ্রমহিলার সামনে খালিগায়ে দাঁড়াতে আপনার অস্বস্তি নেই। কথাটা বলেই সোনালী স্তব্ধ হয়ে যায়।
এ কী! এ কথা কেন বলল সে? এ ধরনের রূঢ় কথা বলবার ইচ্ছে তো তার ছিল না!
কিন্তু বেশি অবাক হবার কিছু নেই। ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করে মানুষ। গভীর স্তরের কোনও অদৃশ্য ইচ্ছে গোপনে বসে ধাক্কা মারে, সেই ধাক্কায় বাইরের ইচ্ছের কাঠামোটা ভেঙেচুরে বদলে যায়।
ধৈর্য হারাব না ভাবলেও ধৈর্য বশ মানে না। রূঢ় হব না ভাবলেও আত্মস্থতার অভাব ঘটে। নিরাসক্ত নিস্পৃহের ভূমিকা নেব ভাবলেও নেওয়া হয় না।
.
১০.
নিরঞ্জন কিন্তু এবার অপ্রতিভ হয়।
কুণ্ঠিতস্বরে বলে, দেখুন বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করে এটা করি নি। খালি-খালি হর্ন শুনে মনে হল নিশ্চয় কেউ কোনো রকম অসুবিধেয় পড়েছে, তাই যেমন ছিলাম তেমনিই ছুটে চলে গেছি। ধারণাই করতে পারি নি, আপনার মত একজন ভদ্রমহিলাকে ওখানে এভাবে–।
হুঁ থাক। কই, এত যে পরোপকারের শখ, তা জিজ্ঞেস করলেন না তো যাচ্ছিলাম কোথায়।
সাহস হয় নি। হেসে ওঠে নিরঞ্জন, যাচ্ছিলেন কোথাও অবশ্যই। অন্তত এই হতচ্ছাড়া দেশের কোনো এক হতভাগার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোন নি সেটা তো ঠিক!
সোনালী সহসা ওর চোখের উপর অদ্ভুত একটা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মৃদুকণ্ঠে বলে, কে বলতে পারে সেটাই ঠিক?
অসম্ভব কথা কেউ বলে না!
মাথা নীচু করে বলে নিরঞ্জন ওই চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
সামান্য ক্ষণ গভীর একটা স্তব্ধতা!
.
দাদাবাবু!
ফণীর অসহিষ্ণু কণ্ঠ এসে ধাক্কা মারে এই স্তব্ধতার উপর, আসবেন, না আসবেন না?
দেখুন আমি যাই, একবার ঘুরে আসি। চেষ্টা করতে দোষ কি?
দোষ আছে। আমার দিক থেকে। আমার জন্যে আমি আপনাকে অনর্থক এত খাটাতে রাজী নই।
অনর্থক বলছেন কেন, আর আমার জন্যে ভেবেই বা কুণ্ঠিত হচ্ছেন কেন? যে কেউ এভাবে অসুবিধেয় পড়লেই
তার জন্যে এ উপকার করতেন আপনি, এই তো?তীব্র অসহিষ্ণু স্বরে বলে ওঠে সোনালী, কিন্তু আমার জন্যে করতে দেব না।
রূঢ়তা রুক্ষতা তীব্রতা আর অসহিষ্ণুতা সোনালীর একেবারে মজ্জাগত হয়ে গেছে বলেই হয়তো মুহূর্তে মুহূর্তে কারণে অকারণে সেটা প্রকট হয়ে উঠছে।
কিন্তু এ-পক্ষের বুঝি মৃদুতাই মজ্জাগত, তাই সে মৃদু হেসে বলে ফেলে, আপনার মেজাজ দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে পড়েছেন আপনি। কিন্তু ছেলেমানুষী করবেন না, দিন দয়া করে আপনার ফোন নাম্বারটা।
বিদ্যুতের মত একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে যায় সোনালীর মুখে। তাই তো, এতেই তো ওকে বেশ জব্দ করা যায়। ছেলেমানুষের মতোই মাথা নেড়ে বলে, উঁহু, কিছুতেই না। দেখি, আপনি কিন্তু পরোপকার করেন।
নাঃ, হার মানছি। কিন্তু আপনি টাই চালিয়ে যাচ্ছেন দেখছি। শুনে মনে হচ্ছে, কি যেন একটা লোকসান হচ্ছে আমার।
কি বলত সোনালী কে জানে, ঠিক এই সময় আবার মা এলেন হাতে একটা ছোট রেকাবী নিয়ে। আর সেটা যথাস্থানে দিতে ভুলে অবাক হয়ে বলেন, একি, তুই যাস নি?
কই আর গেলাম! ইনি যে আসল জিনিসটাই দিতে চাইছেন না।
আসল জিনিসটা! আবার অবাক হন মা।
ওঁর ফোন নাম্বারটা।
দিচ্ছেন না? ফোন আছে বাড়িতে?
আছে তো বলেছেন।
তবে? সোনালীর দিকেই তাকান এবার তিনি।
দ্বিধা ত্যাগ করে মুখ তোলে সোনালী, দেখুন, ভেবে দেখলাম পনেরো আনাই যখন অনিশ্চিত তখন বাকী এক আনার ওপর ভরসা করে বৃথা এত চেষ্টা করাটা অর্থহীন। স্টেশন তো শুনছি এখান থেকে অনেক দূর। তাছাড়া ওই জঙ্গল অন্ধকার
মহিলা হাসেন, জঙ্গল অন্ধকার, এখানের লোকের অভ্যাস আছে মা।
তা হোক, সোনালী দৃঢ়কণ্ঠে বলে, একজনের দোষে আর একজন কষ্ট পাবে কেন? আমি এতক্ষণ ধরে নিষেধ করছিলাম ওঁকে।
দোষ আর কি। দৈবের কথা। গাড়ি-ঘোড়ায় এমন বিপদ তো ঘটেই। শুধু ভগবান রক্ষে করেছেন যে কোনো অ্যাকসিডেন্ট কি ওই রকম কিছু হয় নি। কিন্তু বাড়িতে তো সবাই নিশ্চয় সেই আশঙ্কায় অস্থির হচ্ছেন, যদি কোনো রকমে খবরটা–।
থাক না, হেসে ওঠে সোনালী, হোক না অস্থির, দাম বাড়ক আমার।
তোমার মতো এমন একটি মেয়ের কি আর দাম বাড়বার অপেক্ষা বাছা? মা হেসে ওঠেন, সেরা দামের জিনিস।
নিরু হেসে বলে, আমার সন্দেহ হচ্ছে মা উনি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলেন।
রাখ তোর সন্দেহ। যাক, যদি স্টেশনে না যাবি তো খাওয়া দাওয়া কর। তুমি মা কিন্তু কী ভুল দ্যাখো, তোমার নামটা যে এখনো জিজ্ঞেস করি নি। ভুলটা শোধরাই। বলল শুনি।
নাম! আমার নাম সোনালী।
সোনালী!
হ্যাঁ, সোনালী সেন।
চমৎকার নামটি। উপযুক্ত নাম। আমার এই বাউণ্ডুলে ছেলেটার নাম হচ্ছে নিরঞ্জন। তবে নিরু নামেই বিখ্যাত। কিন্তু ফণী কোথায় গেল? সে কি একাই বাইরের দিকে তাকান তিনি।
আজ্ঞে বড়মা, ফণী ঘরের মধ্যে এসে উঁকি মারে, একা চলে যাবার হুকুম পেলে এতক্ষণ পৌঁছে যেতাম।
আচ্ছা থাক, যেতে আর হবে না তোকে, আয় দিকি, আমায় একটু সাহায্য করে দিবি।
আর যাই হোক, অতিথির প্রতি মন প্রসন্ন নেই ফণীর, তাই ভারী মুখে বলে, আবার এখন রান্না চাপাবে তো?
চাপাব। বড়মা ধমকে ওঠেন তাকে, এখন দুসের চালের ভাত চাপাব। আমার জন্যে ভেবে সারা একেবারে।
সোনালী ক্ষুব্ধস্বরে বলে, দেখুন দিকি আমার জন্যে কী অসুবিধেয় পড়া আপনার। ছি ছি। কিন্তু শুনুন, বৃথা আমার জন্যে কোনো আয়োজন করবেন না, খাবার মত অবস্থা নেই আমার।
কিছু করব না, নির্ভয়ে থাকো তুমি বাছা। এখন এই মিষ্টিটুকু খাও দিকি বলে রেকাবীটা এগিয়ে দিলেন তিনি।
মিষ্টি বললে মিষ্টি। একটু টাটকা ছানা আর চিনি।
সোনালী আর একবার আপত্তি প্রকাশ করে, না, সত্যি না।
তবে থাক-বলে চলে যান ভদ্রমহিলা।
নিরঞ্জন বলে, খেলে পারতেন। বাড়ির গরুর দুধের! খুব সম্ভব এইমাত্র কাটানো হয়েছে।
কি আর করা, জীবনের অনেক জিনিসই মিস করতে হয়, এটাও না হয় করলাম। এই বইয়ের কালেকশান কার? উঠে গিয়ে দেখতে দেখতে বলে সোনালী।
কিছু আমার, কিছু আমার বাবার।
ও। সুনেত্রা দেবী কার নাম?
আমার মার।
মার? আপনার মার নাম? আশ্চর্য তো
কেন, আশ্চর্যের কি আছে? খুব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চোখ না থাকলে বুঝি আর তাকে সুনেত্রা বলা চলে না?
ধেৎ, কি যে বলেন! নামটা বেশ আধুনিক-আধুনিক তাই বলছি। বই একটু দেখতে পারি?
নিশ্চয়। আপনিও কি যে বলেন!
সেলফের মাঝখান থেকে এক একখানা বই টানে সোনালী, উল্টোয় আবার রেখে দেয়।
তারপর বসে পড়ে হেসে বলে, পড়তে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু বিদ্যুতের আলোয় ঝলসানো চোখ অক্ষমতা প্রকাশ করছে!
অভ্যাসের দোষ।
সোনালী আবার ফিরে এসে বসে পড়ে বলে, আপনি আমাকে যে তখন কি ভাবলেন! মনে করে ভীষণ লজ্জা করছে।
লজ্জার কি আছে? চাষাভূষোর মত চেহারা নিয়ে দাঁড়ালে লোকে আর কি ভাববে তাকে? আমার তো মজাই লাগছিল।
মজা! আমি হলে কিন্তু রেগে আগুন হতাম।
সেটা অনুমান করছি।
অনুমান করছেন? কি করে?
সব বিষয়ে অগ্নিশিখার সাদৃশ্য দেখে।
চমকে মুখ তুলে তাকায় সোনালী, তারপর তীক্ষ্ণস্বরে বলে, এ ভাবে প্রশস্তি গাওয়াটা বুঝি আপনার অভ্যস্ত বিদ্যা?
না, কোনো দিন না। নিরঞ্জন গাঢ়স্বরে বলে, এইমাত্র দেখছি বিদ্যাটা আপনিই এসে যাচ্ছে।
কেন?
কি জানি। খুব বেশি অভাবনীয় একটা কিছু ঘটল বলে বোধ হয়। সত্যি স্বপ্নের মধ্যেও এতটা অভাবনীয়তা কল্পনা করা যায় না। আপনার আজকের এই দুর্বিপাক আমার কাছে
কি আপনার কাছে?
কিছু না এমনি।
সহসা দুজনেই কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়।
কে জানে কতক্ষণ ছিল দুজনে পরস্পরের দিকে না তাকিয়ে, অথচ কাছাকাছি বসে।
ফণী এসে ডাক দিল, দাদাবাবু, দিদিমণি, মা ডাকছেন।
চলুন।
চলুন!
সহসা অনুভব করে সোনালী, খিদেও পেয়েছে বটে।
ভিতর বাড়িতে নিয়ে যায় ফণী আলো ধরে ধরে।
দেয়াল ভাঙা ভাঙা, কিন্তু মেজেটা পরিষ্কার। নিকানো মাজা মাজা উঠোন, ধারে ধারে ফুলগাছের সারি, ঝিরঝিরে বাতাস, জানা-অজানা নানা ফুলের গন্ধে সে বাতাস অলস আবেশময়।
এই বাতাসে সমস্ত চপলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, সমস্ত বাঁচালতা মূক হয়ে যায়। বাড়িটা নতুন চকচকে হলেই বুঝি এই ছন্দে ছন্দপতন হতো।
.
কোথায় যেন চলে এসেছে সোনালী। কোনো পূর্বজন্মের অতীতে। কি যেন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ধরা-অধরার লুকোচুরি খেলায় উতলা করে তুলছে তাকে। সোনালী কি কিছু হারিয়ে ফেলেছে? সোনালী কি হঠাৎ কিছু পেয়েছে?
৩. শোবার ঘরে
১১.
খাওয়ার পর সুনেত্রা দেবী নিয়ে এলেন সোনালীকে শোবার ঘরে।
দালানের সংলগ্ন ছোট্ট একটি ঘর, দালানের যেদিকে সুনেত্রার নিজের চৌকী পাতা সেদিকে। হাত বাড়ালে দরজায় হাত ঠেকে।
বলতে গেলে একই ঘর, বললেন সুনেত্রা, নির্ভয়ে শোও তুমি, এই পর্দাটা টানা রইল, ইচ্ছে করলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারো। ওদিকে আর একটা দরজা আছে, সেদিকটা ভাঙা–সে দরজা খোলা যায় না। এই পাখা রইল, এই খাবার জল, শুয়ে পড়ো।
.
সুনেত্রা চলে আসতেই দরজাটা সোনালী বন্ধ করেই দিল। নিভিয়ে দিল টেবিলে বসানো বাতিদানের জ্বলন্ত বাতিটা। খুলে দিল সমস্ত জানলা।
ছোট্ট ঘর হলে হবে কিসব দেওয়ালে দেওয়ালজোড়া জানলা, সবগুলো খুলে দিতেই জ্যোৎস্নায় ভরে গেল ঘরখানা।
এখানেও একহারা একখানা চৌকীতে পরিপাটি একটি বিছানা। মাথার কাছে টেবিল। টেবিলে বাতিদান, ফুলদানী।
পোড়ামাটির গায়েয় ছাঁচের কাজ করা সুন্দর ফুলদানী। তাতে কয়েকটি চাঁপা ফুল।
রুচি আছে এদের। মনে মনে বলল সোনালী।
বলল কেমন যেন আবিষ্টের মত ভোলা জানলার দিকে তাকিয়ে বসে।
আজ সন্ধ্যা থেকে যা কিছু ঘটছে তা পর্যালোচনা করতে পারলে হয় তো সোনালী মনস্তত্ত্বের নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত।
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এ সব কি সত্য? এই ঘর, এই বিছানা, ওই জানলা আর জানলার বাইরের ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকার, এ সব কি বাস্তব, না স্বপ্ন?
আর সোনালী নিজে?
সব কেমন ঝাপসা লাগছে।
এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কবে কজনের ভাগ্যে ঘটে?
এই একটু আগে সেই ফুলের গন্ধে উতলা বাতাসে ভোলা বোয়াকে পিঁড়ি পেতে বসে খেয়ে এল যে মানুষটা, সে কে?
যখন খেয়েছিল তখন কি প্রকৃতিস্থ ছিল? ছিল আত্মস্থ?
তবে কেন কিছুই মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে না কি খেয়েছিল, কি বা কথা বলেছিল।
অথচ এটা মনে পড়ছে বলেছিল কথা, হয়তো খেয়েও ছিল সবই, যা কিছু পরিবেশন করেছিলেন সুনেত্রা।
নেশাচ্ছন্নের মত সমস্ত চৈতন্য যেন কুয়াসাটাকা। অথচ ঘুমও আসছে না। পরের বাড়িতে অচেনা বিছানায় ঘুম কি আসে?
এ ঘরটা কার শোবার ঘর?
চারিদিক তাকিয়ে দেখল সোনালী মোমবাতির মৃদু আলোয়। বিছানা আর টেবিল বাদে আর বিশেষ কিছুই নেই। কেমন যেন রিক্ত রিক্ত চেহারা। কোনো মানুষের স্থায়ী উপস্থিতির চিহ্ন বহন করছে না।
বোধকরি এ ঘর কারুরই শোবার ঘর নয়। অতিথির জন্যে প্রস্তুত থাকে। থাকে সরু খাটে বিছানা পাতা।
.
কৃষ্ণপক্ষের রাত।
যত রাত গম্ভীর হচ্ছে চাঁদ ততই উজ্জ্বল হচ্ছে। জানলার বাইরের ঝোঁপজঙ্গলগুলো এখন আর জমাট অন্ধকারের চাপ বলে মনে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া ভাবে দেখা যাচ্ছে।
জানলার ধারে এসে দাঁড়াল সোনালী।
ঠাণ্ডা একটা বাতাসের শিহরণ।
কিন্তু ও কি?
ঠাণ্ডা বাতাসের শিহরণের চাইতে অনেক তীব্র বিদ্যুতের মত একটা শিহরণ খেলে গেল সর্বাঙ্গে।
ওখানে, ওই মাঠের মাঝখানে এত রাত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে?
কী দরকার ওর এমন করে ঘুরে বেড়াবার খালিগায়ে জ্যোৎস্নার প্রলেপ মেখে!
বিশ্বাস করুন, ছদ্মবেশ নয়, ওটাই আমার স্বাভাবিক বেশ, সচরাচরের বেশ।
হ্যাঁ, বিশ্বাস করেছে সোনালী।
বিশ্বাস করে মুগ্ধ হয়ে বলেছে, এমন বলিষ্ঠ পুরুষদেহের এই বেশই স্বাভাবিক হওয়া উচিত।
কিন্তু ও জেগে কেন?
ও ঘর ছেড়ে বাইরে কেন?
.
আস্তে আস্তে তখনকার কিছু কিছু কথা মনে পড়ছে।
সুনেত্রা তার ছেলের গুণের কথা গল্প করছিলেন তখন।
একরাশ পাশ করে, দেশ-বিদেশ থেকে বিদ্যে আহরণ করে ছেলে ওঁর এখন গ্রাম সেবা নিয়ে মেতে আছে, এই কথাটাই বোঝাচ্ছিলেন তিনি।
বলেছিলেন, তাই কি গভর্নমেন্টের সাহায্য নেবে?
নেবে না।
নিজের চেষ্টায় আর গ্রামের লোকের সহযোগিতায় যা পারবে করবে।
বাপ-ঠাকুরদার ভিটেটা ছিল তাই চলছে অনেক কিছু। স্কুল, তাঁতশালা, পোলট্রি।
গোড়ায় কি কম বেগ পেতে হয়েছিল? গ্রামের লোক বিশ্বাসই করতে চায় না। তাছাড়া শ্রমদানের মূল্য তো দূরের কথা, মানেই বোঝে না কেউ।
ছাড়া ছাড়া ছিটে ছিটে ভাবে মনে পড়ছে কথাগুলো।
.
খাওয়ার পর আবার সেই দালানে এসে বসেছিল খানিকক্ষণ। দেখছিল সুনেত্রার টেবিলের বই দুখানা উল্টে। না, গীতা নয়, ভাগবত নয়, যোগবাশিষ্ট রামায়ণও নয়, আধুনিক দুজন লেখকের দুখানা অতি আধুনিক উপন্যাস।
.
দেখে একটা সুস্থ হাওয়ায় হাঁপ ফেলে বেঁচেছিল সোনালী।
মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো লোকটার কি প্রাণে সাপের ভয়ও নেই?
ওই বিশ্রী জায়গায় সাপ বেরোতে পারে না রাত্রে?
এত বেপরোয়া কেন!
আশ্চর্য, কেউ তো ওকে বারণও করছে না।
কিন্তু কে করবে?
মা? মা কি সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে জেগে থাকতে পারেন?
আচ্ছা, সোনালী তো দেখছে। সোনালীর কি উচিত নয় ওকে সাবধান করে দেওয়া?
অনেকক্ষণ ধরে উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব চলল, তারপর তাকিয়ে দেখল দরজার দিকে। ও দরজাটায় নিষেধ, এ দরজাটা সুনেত্রার মাথার কাছে।
কোনটাই সহজ নয়।
কিন্তু সহজ হলেই কি সহজ হত?
অতএব এই জানলাই রইল শেষকথা। জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সোনালী।
কোনো এক সময় যেন নিশাচর মানুষটা কাঁটাবন ডিঙিয়ে জানলার কাছবরাবর এল, দাঁড়াল, চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, আবার চলে গেল।
জানলার নীচে দিয়ে চলে গেল। কথা বললে বলা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু সাপের ভয়ের জন্যে সাবধান করা হল না।
অথচ যেত। একটু চেঁচিয়ে বললে অনায়াসেই শুনতে পেত লোকটা।
আরও কতক্ষণ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সোনালী।
তারপর কখন ঘুমে শরীর ভেঙে এল। কখন যেন শুয়ে পড়ল।
পরের বাড়িতে অচেনা জায়গায় ঘুম?
তা আসে বইকি। শ্বাসপ্রশ্বাসের গভীর শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে সোনালী ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
১২.
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়।
সুনেত্রার ডাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে মৃদু ডাক দিচ্ছেন তিনি।
কী আশ্চর্য, আপনি! না না, ছি ছি, আমায় একটু আগে ডেকে দিলেন না কেন? আমি তৈরি করতাম চা।
সুনেত্রা হেসে উঠলেন, আমাদের চা-টা কোরো তৈরি, এখন খেয়ে নাও। তোমরা বাছা শহরের মানুষ, নিশ্চয় বেড-টি খাওয়া অভ্যেস।
না না, ওসব কিছু না। লজ্জিতভাবে বলে সোনালী।
তা আজ একদিনই নয় খাও। সুনেত্রা সামনে একটা টুলে বসে বলেন, এ শহুরে অভ্যেসটুকু আমারও আগে ছিল, কিন্তু গ্রামে বাস করতে করতে কখন যে সে অভ্যেস ঝরে পড়ল টেরও পেলাম না। কত অভ্যেসই এমন ঝরলো।
আগে বুঝি কলকাতায় থাকতেন? সোৎসুকে প্রশ্ন করে সোনালী।
না কলকাতায় নয়, ওদিকে। সুনেত্রা বুঝি একটা নিঃশ্বাস চেপে নিয়ে বলেন, নিরুর বাবার কাজ ছিল দিল্লী সিমলে, মানমর্যাদা বজায় রাখবার জন্যে ক্লেশ কত! হাসলেন সুনেত্রা, নিজের হাতে নিজের সংসারের কাজকর্ম করব তার জো নেই। হামেহাল নাকের সামনে চাকর খাড়া। কি আর করবে তারা, বারকতক চা-ই খাওয়াতো সেধে সেধে ডেকে ডেকে।
স্তব্ধ হয়ে যায় সোনালী। এই সহজ কথাটুকুর মধ্যেকার প্রচ্ছন্ন ইতিহাসখানি অনুভব করে।
আর যখন চেতনা হয়, তখন সমস্ত অন্তরাত্মা আর একবার ছি-ছি করে ওঠে নিজের গত সন্ধ্যার আচরণ স্মরণ করে।
আপনাদের চা খাওয়া হয় নি?
বোধকরি নীরবতা ভঙ্গ করতেই এই বাহুল্য প্রশ্ন।
না, নিরু তো সেই কোন ভোরে বেরিয়ে গেছে। ফণীও গোয়ালের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নিরু আসুক।
কোথায় গেছেন?
যেন কোনো ঔৎসুক্য নেই, নেই কোনো আগ্রহ, শুধু একটু সাধারণ কথা।
সুনেত্রা বলেন, ওই যে সেই মোটর মেকানিকের সন্ধানে। সাড়ে সাতটা থেকে যত সব বাস লরি ছাড়তে থাকবে, মিস্ত্রিগুলো তখন কাজে আটকা পড়ে যায়, তার আগেই যাতে–
আমার জন্যে আপনাদের কত বিব্রত হতে হল!
এর আবার বিব্রত কি মা? সুনেত্রা প্রসন্নমুখে বলেন, আমার ক্ষ্যাপা ছেলে এটুকুতে বিব্রত বোধ করে না। ওই করতেই তো আছে। কারুর একটু কাজে লাগতে পারলে–তা ছাড়া যদি বিব্রতই বলল, হাসেন সুনেত্রা, তার বদলে কতখানি লাভ হল আমাদের বলো তো?
লাভ!
লাভ বইকি! তোমার মত এমন একটি মেয়ে পাওয়া কি কম লাভ মা?
হয়তো জীবনে আর আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
যেমন গভীর স্বরে জীবনে কোনো দিন বলে নি সোনালী, হয়তো যে গভীরতর স্তরের সন্ধানও জানত না কোনো দিন, সেই গভীর স্বরে কথা বলে সোনালী। সেই গভীরতর স্তর থেকে উঠে আসে একটি ভারী নিঃশ্বাস।
সুনেত্রা বৃথা হইহই করেন না, না না সে কি, আবার দেখা হবে বইকি, বলে স্তোক না দিয়ে শুধু তিনিও গভীর স্বরে বলেন, হয়তো হবে না। তবু এই পাওয়ার জমাটুকু তো রইল। আমার ঘরে এমন মেয়ে তো জীবনে কখনো আসবে না।
এই আক্ষেপটুকুর মধ্যে রইল অনেকটা কথা। অনুক্তর মধ্যে উক্ত হল বাংলা মাতৃমনের আশা আর হতাশা।
আদর্শবাদী সন্তানের মা হওয়া গৌরবের নিশ্চয়, কিন্তু গৌরবের মধ্যে তো লুকিয়ে থাকে দুঃখ।
সাধারণ হতে না পারার দুঃখ, সহজ হতে না পারার দুঃখ।
.
সকালের আলোয় সুনেত্রার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখল সোনালী-সুনেত্রার ক্ষেতখামার, ফুলবাগান, নিরঞ্জনের স্কুল, তাঁতশালা।
তারপর এল নিরঞ্জন।
ঠিক হয়ে গেছে আপনার গাড়ি।
ঠিক হয়ে গেছে! কথাটা হাতুড়ির ঘায়ের মত বুকের মধ্যে এমন করে বাজতে থাকে কেন?
সোনালী কি আশা করছিল ঠিক হবে না! এত সহজে ঠিক হবে না!
থেকে যেতে পারে সোনালী আরও কিছুক্ষণ। গ্রাম্য প্রকৃতি কি তার সরল সৌন্দর্যের ডালি হাতে নিয়ে দুর্নিবার আকর্ষণে টানছে সোনালীকে?
ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
এত শীগগির?
বিশেষ কিছুই হয় নি। তবে তেলটা ফুরিয়েছিল।
আবার আশায় স্পন্দিত হয় বুক।
তবে? এখানে তেল জোগাড় করা তো খুব যেন চিন্তায় পড়েছে সোনালী।
না, ওটা একেবারে সংগ্রহ করেই আনলাম।
সংগ্রহ করেই আনলাম!
তার মানে যত শীগগির সম্ভব সোনালীকে বিতাড়ন করা!
হঠাৎ ভয়ানক একটা রাগ হয় সোনালীর। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে, এ সবের জন্যে টাকা বলে একটা জিনিসের তো দরকার হয়, যাবার সময় বলে গেলে পারতেন!
সুনেত্রা একটু অবাক হয়ে তাকান। এতক্ষণের সেই উজ্জ্বল উচ্ছল প্রাণচঞ্চল মেয়ের সহসা এমন রুদ্ররূপ কেন? ওই মুখের দিকে একবার তাকান সুনেত্রা দেবী, একবার নিজের ছেলের মুখের দিকে।
একটু স্তব্ধ হয়ে যান, তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
কিন্তু ওই নিঃশব্দ প্রস্থান বুঝি এদের নজরে পড়ে না। ওরা শুধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েকটি মুহূর্ত।
তারপর নিরঞ্জন বলে, টাকা নেব বৈকি, শুধু টাকা কেন, আনা পাই সবই নিখুঁত হিসেব করে নিয়ে নেব।
তা তো নেবেনই। পাছে আর একটা বেলা আপনাদের অতিথি হতে চাই, তাই তাড়াবার জন্যে ব্যস্ততার সীমা নেই। মানুষ তো অতিথিকে একবার অফারও করে,–এ বেলাটা থেকে যান, এক মুঠো ভাত খেয়ে যান।
হয়তো করে। যে অতিথি সহজপ্রাপ্য, তাকে হয়তো করে। দুর্লভ অতিথির জন্যে কি সাধারণ ব্যবস্থা চলে?
ছাই দুর্লভ। কাল থেকে খালি জ্বালাতন করলাম।
দোহাই আপনার, ওই সাধারণ কথাগুলো থাক।
তবে কি বলব বলুন? সোনালী যেন হতাশ সুরে বলে, অসাধারণ কথার স্টক কোথায়?
নাই বা কথা হল। কথা সকলের মুখে মানায় না। নীরবতা অনেক বেশি অর্থবহ। কি কাজ কতকগুলো অর্থহীন কথায়, কি বলেন?
হেসে ওঠে নিরঞ্জন, চলুন। উঠবেন চলুন আপনার রথে। তারপর এই হতচ্ছাড়া দেশের হতভাগাদের চোখে ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে যান তাদের নাকের ওপর দিয়ে।
সোনালী অদ্ভুত এক রকম হেসে বলে, ধরুন যদি না যাই?
আহা। অপূর্ব!
ঠাট্টা করছেন? কিন্তু আপনাদের গ্রাম দেখে ইচ্ছে হচ্ছে থেকে যাই।
ওটা শহরবাসীদের প্রচলিত কথা। আবার স্বস্থানে ফিরে গেলেই মনে হবে, ই, অমন হতচ্ছাড়া দেশে মানুষ থাকে কি করে!
ওঃ, ওই কথাটা আর ভুলতে পারছেন না দেখছি।
নিরঞ্জনও বুঝি সোনালীর দেখাদেখি অদ্ভুত হাসি হাসতে শিখেছে। তাই সে হাসির সঙ্গে একটি বদ্ধ গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, সব কথা কি ভোলা যায়?
.
১৩.
না, সব কথা ভোলা যায় না।
সোনালী কি জীবনে কখনো ভুলতে পারবে এই জামতলা গ্রামকে?
শূন্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ছুটে চলেছে সোনালী নতুন মেরামত করা নতুন তেল ভরা গাড়ি করে। গাড়িটার গতিতে উদ্দাম প্রাণের আবেগ।
যন্ত্র জিনিসটা সহসা বিকল হয়ে থেমে গেলেও ভয় নেই, আবার মেরামত করা যায়। আবার চালানো যায় তাকে সহজ পথে, নির্ভুল পথে।
সেই নির্ভুল পথ ধরে চলেছে সোনালী। যে পথে কাল সন্ধ্যায় যাবার কথা ছিল।
শুধু যে জিনিসটাকে সহজ পথে নির্ভুল পথে চালান নিজের হাতের বাইরে, সে চলেছে আপন খেয়ালে।
তাই বান্ধবী নীপার বাড়ি যাবার পথে সোনালীর আর মনে হচ্ছে না উপহারের জিনিস নেই তার হাতে।
একশো টাকার সেই নোটখানা ভাঙিয়ে গাড়ির তেলের দাম দিয়েছে সোনালী, দিয়েছে। মোটর মেকানিকের মজুরি, বাকী ফেরতটা নিয়েছে হাত পেতে নির্ভুল হিসেবে, তবু বারে বারে হিসেবের গরমিল হয়ে যাচ্ছে যেন।
আচ্ছা, আসার সময় সুনেত্রার কাছে কি তেমন করে বিদায় নেওয়া হয়েছিল? নাকি ত্রুটি থেকে গেল?
একটুখানি ব্যঙ্গহাসি ফুটে উঠবে না তো তার মুখে মেয়েটা কি অকৃতজ্ঞ ভেবে?
আর নিরঞ্জন? সুনেত্রার নেত্রের নিধি?
সে কী ভাবল সোনালীকে? বাঁচাল? বেহায়া? বেশি গায়ে-পড়া?
সোনালী বলেছিল, চলুন না আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। কত ট্রেন আছে ফেরবার।
কই আর কথা রাখল সে!
মৃদু হেসে বলল, কেন, এই তো বেশ দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করে ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া।
.
না, কেউ বলে নি আবার আসবেন। বলে নি যাবেন ওখানে।
নীপা মিনিটখানেক স্তব্ধ থেকে ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলে, তুমি না তোমার প্রেতাত্মা?
যা বলিস।
চেহারাটি তো দেখছি একেবারে তাজা ঝকঝকে। চুলে একটু বিশৃঙ্খলা নেই, শাড়িতে নেই একবিন্দু ধুলো, মনে হচ্ছে সকালবেলা সাবান ঘষে মানও করে এসেছিস।
ধারণা ভুল নয়।
ভুল নয়?
না।
গিয়েছিলি কোথায়?
কোথাও না।
ন্যাকামি রাখ! অ্যাকসিডেন্ট যে ঘটে নি তা তো দেখা যাচ্ছে, গাড়ি আস্ত, তুই আস্ত, ব্যাপারটা কি?
ব্যাপার কিছুই না। কাল তোর নেমন্তন্নে এসে উঠতে পারি নি, আজ বাসি খেতে এলাম।
কোথায় গিয়েছিলি বলবি না?
কোথাও তো যাই নি, তা বলব কি?
আমার সঙ্গেও এ রকম চালাকি খেলবি? বেশ। কিন্তু গৃহকলহ যদি হয়েই থাকে, আমার সঙ্গে কি? আমার কাছে এলি না কেন?
গৃহকলহ? এ কথা কে বলল?
ভয় নেই, গৃহস্বামী নয়। আহা, বেচারার কি অবস্থা কাল থেকে! বোস, সব কথা শুনব পরে, আগে ওনাকে একটা খবর দিয়ে দিই। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এক করে বেড়াচ্ছেন ভদ্রলোক।
বড্ড বেশি অত্যুক্তি হয়ে যাচ্ছে না নীপা?
অত্যুক্তি?
তা ছাড়া আর কি? যার যা অসাধ্য, সে তা—
অসাধ্যসাধন করিয়ে ছেড়েছ তুমি বলে টেলিফোন তুলে নেয় নীপা।
কে? ও তুমি। বাবু বাড়ি নেই?…কতক্ষণ বেরিয়েছেন?…ভোরবেলা? আচ্ছা, এলেই বলে দিও মা এসেছেন…হা হা, এখানেই আছেন।…হা ভালো আছেন।..ও সে কথা পরে শুনো। বাবুকে বলবে বাড়ি ফিরেই যেন সোজা এখানে চলে আসেন। হা হা, আমার এখানে। বুঝতে পেরেছ তো আমি কে? পেরেছ? ঠিক আছে। তোমাদের বাবু আজ এখানেই খাবেন বলে দিও সে কথা। এসেই চলে আসেন যেন।
সরে এসে বলে নীপা, এত করে অনুরোধ করবার কথা নয়, হারানিধি পাওয়া গিয়েছে শুনে উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসবার কথা, কিন্তু যা উদোমাদা মানুষ হয়তো ভাববেন, যাক, এসেছে, ভালো আছে, আর চিন্তার কি!
তা সত্যিই তো–আর চিন্তার কি?
বটে! প্রাণ থেকে বলছিস?
প্রাণ মন আত্মা সব থেকে বলছি।
তবে বৃথাই লোকটা কাল থেকে অস্থির হয়ে বেড়াল?
একেবারে বৃথা।
দেখ সোনালী, তোর রকম-সকম রীতিমত সন্দেহজনক, বল পোড়ারমুখি কোথায় গিয়েছিলি?
এ জোর নীপা করতে পারে বটে। নীপা সোনালীর আবাল্যের সখী। নীপার কাছে কোনও দিন কোনও কথা গোপন করে নি সোনালী। এমন কি শশাঙ্কর ঔদাসীন্য অবহেলার কথাও।
নীপা অবশ্য বলে, অবহেলা নয়, ওকে বলে অন্যমনস্কতা, কিন্তু সোনালী তা বলে না।
কই, বললি না?
সোনালী ওর উগ্র কৌতূহলেভরা উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলে, পৃথিবীর বাইরে।
ভুরু কুঁচকে ওঠে নীপার।
তুই ভেবেছিস কি? কাল থেকে কি ঘোড়দৌড়টা করিয়েছিস আমাদের, তার ধারণা আছে? নিশ্চিন্ত ভেবে বসে আছি কোন চুলোয় কোন খানাখন্দরের ধারে হাত পা ভেঙে পড়ে আছিস, চোরে গায়ের গহনাগুলো খুলে নিয়ে গেছে
আহাহা, বলে যা বলে যা। শেয়ালে কুকুরে চোখনাকগুলো খুবলে খাচ্ছে! সত্যি, এত ভালবাসিস আমাকে যে কিছুতেই ভাবতে ইচ্ছে হল না, আমি বেশ আছি, খাসা আছি, নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছি, কেমন? ভালবাসার দাপটে আমার হাতভাঙা রক্তাক্ত কলেবর ছাড়া আর কিছুই তোর চোখে ভাসল না!
কথা দিয়ে কথা ঢাকিসনে সোনালী, এবার সত্যিই ভাবনা হচ্ছে আমার, কোথায় কী একটা করে এসেছিস তুই!
আমার ওপর তো তোর অগাধ আস্থা দেখছি।
আস্থা ছিল, সত্যিই ছিল। কিন্তু আর থাকছে না। মনে হচ্ছে পোড়ারমুখী তুই নিশ্চয় শশাঙ্কবাবুকে বোকা বুঝিয়ে নেমন্তন্নে যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে অভিসারে গিয়েছিলি।
যাক এতক্ষণে রহস্য উদঘাটন করলি তাহলে?
আচ্ছা, এ রকম করছিস কেন বল তো? নীপা করুণ সুরে বলে, আমাকে না বলে পারবি তুই?
দেখি না চেষ্টা করে পারি কিনা।
কিন্তু তাতে তোর লাভ? বলতে বাধা কি? চেহারাখানি দেখে তো মনে হচ্ছে না বাপু অসহায়া রমণী কোনো দুৰ্বত্তের কবলে পড়েছিল, অথবা ডাকাতের কবলে। সাপ বাঘ নেকড়ে শেয়াল ধারে কাছেও আসে নি, অ্যাকসিডেন্ট তো নয়ই, তবে এই আঙুল গুনে সময় হিসেব করে বলে নীপা, আঠারোটি ঘণ্টা ছিলে কোথায়, করলে কি, তার হিসেব দিতে হবে না?
দিতেই হবে? সোনালী একটি দুর্ভেদ্য হাসি হেসে বলে, এত বড় এই জীবনটা থেকে মাত্র আঠারো ঘণ্টা সময় চুরি করে সরিয়ে রাখা যায় না?
নীপা এবার গম্ভীর হয়ে যায়, সোনালীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে, নাঃ এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেস সিরিয়াস! অভিসারটা আর ঠাট্টার কথায় থাকছে না। কিন্তু আমার অগোচরে তলে তলে কবে কি করলি?
ভাবো বসে বসে। নিষ্কর্মা মাথা তবু খানিক কাজ পাবে।
উচ্ছন্নে যাও তুমি, গোল্লায় যাও। বলে রাগ করে উঠে যায় নীপা। যায় রান্নার তদারকে।
শুধু সোনালী নয়, আপ্যায়িত করতে হবে শশাঙ্ককেও। সহজে যাকে ধরে এনে খাওয়ানো দাওয়ানো যায় না। আজ বড় প্যাঁচে পড়েছেন বাছাধন, নীপা ভাবে, গিন্নিটিকে আটকেছি, ছুটে আসতেই হবে।
.
১৪.
কিন্তু আশ্চর্য, কিছুতেই কেন কোনো কথা বলছে না সোনালী! রহস্যকে জইয়ে রাখবারও তো একটা সীমা আছে। তবে কি শশাঙ্ককেই প্রথম বলতে চায়? নিশ্চয় এই নেমন্তন্নে আসা নিয়ে শশাঙ্কর সঙ্গে কিছু একটা ঘটেছিল, তাই রাগ করে কোথাও গিয়ে বসেছিল।
কিন্তু কোথায়?
সম্ভব অসম্ভব কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িই তো কাল থেকে খবর নেওয়া বাকী থাকে নি। আর নীপা বা শশাঙ্কর অজ্ঞাত কোথায় এমন আত্মীয় বন্ধু
.
চিন্তায় ছেদ পড়ল নীপার।
ফোন এসেছে।
করছে শশাঙ্ক। সবিনয়ে জানাচ্ছে মধ্যাহ্নভোেজনের নেমন্তন্ন নেবার সময় নেই তার। কিছু যেন মনে করে না সে আর সোনালী। ওই নেমন্তন্ন জিনিসটা ধাতে সয়ও না তার। সোনালী এসেছে, ভালো আছে, কোনো রকম বিপদ আপদ হয় নি, এটা যখন জেনেই যাওয়া গেল তখন আর শশাঙ্কর ব্যস্ততা কি? দুই সখী সারাদিন প্রেমালাপ চলুক। সন্ধ্যায় তো আসছে সোনালী নিজের বাড়ি।
নীপা বসে পড়ে। রেগে বলে, এই লোককে খোঁড়াই কেয়ার করে অভিসারেই যাওয়া উচিত তোর! ছি ছি, একটু ইয়ে নেই? কাল তো একেবারে মুখ-চোখ বসে শুকনো আমসি হয়ে উঠেছিল। আর যেই শুনলেন নিরাপদে ফিরেছে, হয়ে গেল সব উদ্বেগ ঠাণ্ডা? এই মুহূর্তে ছুটে আসতে ইচ্ছে হল না দেখবার জন্যে?
সোনালী শান্ত হাসি হেসে বলে, অবাক হবার কি আছে? ও তো ওই রকমই।
জানি না বাবা, রাগে ঝলসে ওঠে নীপা, এত সব রাঁধতে দিলাম ঘটা করে—
ভালোই তো। আমরা বেশি করে খাব।
হেসে ওঠে সোনালী।
রাগ হচ্ছে না তোর?
সোনালী তেমনি শান্ত হাসি হেসে বলে, কই, টের পাচ্ছি না তো?
.
না, সত্যিই টের পাচ্ছে না সোনালী।
অনুভব করতে পারছে না কোথাও কোনোখানে কোনো ক্ষোভ আছে কিনা তার। বুঝতে পারছে না কোথায় হারিয়ে গেল তার সেই সদাবিক্ষুব্ধ হৃদয়ের উত্তাল অভিযোগ, যে উত্তাল অভিযোগের উত্তাপ গতকালও তাকে রাগে অন্ধ করে তুলেছে, ছুটিয়ে নিয়ে গেছে দিশাহীন বেপরোয়া পথে।
কোন মন্ত্রে সহসা বদলে গেল মনের সেই অন্ধকার রং? সহসা সমগ্র পৃথিবীটা সোনালীর করায়ত্ত হয়ে গেল কি করে?
তাই সোনালীর আর অভাব নেই অভিযোগ নেই ক্ষোভ নেই। তাই কিছুই এসে যাবে না তার আগ্রহে কি ওদাসীন্যে।
যে জিনিসটা প্রতিমুহূর্তে যন্ত্রণা দিয়েছে সোনালীকে, করে তুলেছে উগ্ৰ অসহিষ্ণু হিংস্র, সে জিনিসটা সহসা এত তুচ্ছ এত মূল্যহীন হয়ে গেল কি করে ভেবে পায় না সোনালী।
অথচ ভাবেও না! শুধু অপূর্ব এক পূর্ণতার প্রশান্তিতে ভরে থাকে মন, যেন বাকী সমস্তটা জীবনে রয়ে যাবে এই পূর্ণতার স্পর্শ। অবোধ শশাঙ্কর কোনও ত্রুটিই সেখানে বিদারণরেখা আঁকতে পারবে না।