বুকের বল থাকলে থাকবি না কেন শুনি? শুনবি কেন মেয়ে ছেলের কথা?
তুই আর হাসাস নে নিধু। তিন-ভুবনে যা হয়ে আসছে, আমার জন্যে তা পাল্টাবে? তবে হ্যাঁ, পরস্ত্রীর পোষা বাঁদর হওয়ার চাইতে নিজের বিয়ে করা পরিবারের কেনা গোলাম হওয়াও ভাল। আমি তো এই বুঝি!
নিধুকে আর বেশি ব্রহ্মজ্ঞানের শিক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠে না, নিধু ছুটে চলে যায় দোতলা থেকে ডাক পেয়ে।
জল চাই! জল!
মেমসাহেব মূর্ছা গেছেন।
.
তাক বুঝে মূর্ছা যেতে পারলে সংসারের অনেক অসুবিধেজনক অবস্থার হাত এড়ানো যায়। নীলাঞ্জনা বলে বীথিকাকে। হিসেব মত যে মহিলা দুটি নাকি নর্মদার বান্ধবী।
কিন্তু বান্ধবী বলে যে আড়ালে সমালোচনা করবে না, এমন ভাববার কোন হেতু নেই। মেয়েদের স্বধর্ম সমালোচনা। এতে তাদের স্বাভাবিক পটুত্ব। একমাত্র আত্মসমালোচনা বাদে আর কার না সমালোচনা করে তারা?
গুরুর করে না? ইষ্টের করে না?
বীথিকা নাক কুঁচকে বলে, তা যা বলেছিস! কিন্তু ওই পতন ও মূৰ্ছা, এ তো সেকেলে হয়ে গেছে
হুঁ! আর সেই হাত-পা মাথা বাঁচিয়ে কায়দা করে ঢলে পড়া। আমার বিশ্বাস হাতের কাছে ডানলোপিলো দেওয়া ওই ডিভানটা না থাকলে নির্ঘাৎ, ও পিছু হঠতে হঠতে, সুবিধে-মাফিক জায়গা বেছে নিয়ে তবে পড়ত।
মনে করে সবাই ওর অভিনয়ে ভোলে। নেহাৎ নাকি চুপ করে থাকা।
ওই তো মজা। তুমি ভদ্রতার দায়ে চুপ করে থাক, যারা নিজেকে ভারি বুদ্ধিমান ভাবে, তারা ভাববে তুমি বোকা।
কিন্তু আমি শুধু ভাবছি মিস্টার পালিতের সহ্যশক্তির কথা। কি করে এই অভিনয়, এই ন্যাকামী আর এই যথেচ্ছাচার সহ্য করে আসছেন।
কি করবেন, ওই ভদ্রতার দায়।
তা বাপু আকুলি-বিকুলিও তো কম না। স্ত্রীর মূৰ্ছায় ব্যস্ততার বহরটা দেখলি তো?
ওর সবটাই খাঁটি ভেবেছিস!! তিনভাগ শো, বুঝেছিস?
আরে বাবা, আমার মতে এই চর্মচক্ষে যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় সেটাই খাঁটি। হৃদয়ের গভীর গুহায় কী আছে তা কে দেখতে যাচ্ছে? আর দেখতে যাওয়াই কি বুদ্ধিমানের কাজ? সেখানে কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরোবার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু ভদ্রলোকের জীবন কী দুর্বহ!
আহা, বিগলিত হচ্ছিস যে একেবারে। জীবনটা সুবহ করে তোলার ভার নিয়ে দেখবি নাকি?
থাক, ঢের হয়েছে। চল, ভিতরে গিয়ে বসি। দেখি আরও কি তামাশা হয়!
বান্ধবীকৃত্য সমাপন করে, মহিলা দুটি বারান্দা থেকে ফের ঘরে গিয়ে বসেন।
এই নিয়ে তিনবার তাদের জায়গা বদলাবদলি।
ওরা অনেক বাজে কথা বলে, তবে মাঝে-মাঝে কিছু সত্যি কথাও বলে। তাক বুঝে মূৰ্ছা যেতে পারলে জগৎ-সংসারের অনেক ঝড়-ঝাপটার হাত এড়ানো যায় বৈকি।
এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে নর্মদাকে কে রক্ষা করত ওই মূৰ্ছা ছাড়া?
এই মূৰ্ছার অবসরে, জগৎ-সংসারের চোখের সামনে থেকে চোখটা বুজে থাকার অবসরে আকাশ-পাতাল কত কথাই ভাবতে পারছেন নর্মদা।
ভাবছেন, আর ঘরে যে কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে তাকে অজ্ঞান-অচৈতন্য ভেবে, সেগুলো শুনেছেন শ্রবণশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে।
.
ঠিক যে মুহূর্তে মূর্ছা গেলেন নর্মদা, ভয়ঙ্কর একটা হৈ-চৈ উঠল। প্রায় সেই তিন বছর আগের মতই। তবে এটা থেমে গেল তাড়াতাড়ি। সেদিনকার ঘটনা ছিল আলাদা। সেদিন মূৰ্ছাটা ছিল গৌণ। কাজেই ঘরে একটা উগ্র ওষুধ-মাখা রুমাল পড়ে থাকলেই ঘরে থাকা মানুষটার একেবারে জ্ঞান-চৈতন্য হারিয়ে অসাড় হয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। উত্তেজনার কারণ রয়েছে অন্যত্র। সেদিনের মুখ্য ব্যাপার ছিল দু-হাট করে পাল্লা-খোলা গডরেজের আলমারিটা।
মিস্টার পালিতের অনেক আদরের আর অনেক ধনবত্তার সাক্ষ্য নর্মদার জড়োয়ার গয়নাগুলি থাকত যে আলমারিতে।
চোখ বুজে সেদিনের সমস্ত ছবিটা আগাগোড়া ভাবতে লাগলেন নর্মদা, সিনেমার ফ্লাশ ব্যাকের মত।
নিমন্ত্রিতেরা খেতে বসেছে, নর্মদা উঠে গেলেন ক্ষমা চেয়ে আর দুঃখ জানিয়ে। বললেন, অসম্ভব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, একটু শুয়ে না নিলে
হ্যাঁ, একটু শুয়ে নেবার জন্যে নিজের শোবার ঘরে চলে এলেন নর্মদা। চাকর-বাকররা সকলেই ওদিকে কাজে ব্যস্ত, এ তল্লাটে কেউ নেই। এদিকটা নির্জন।
অতএব ঘরের আলো নিভিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেওয়া যায়। কমিয়ে নেওয়া যায় মাথার যন্ত্রণা। কিন্তু ঘর তো অন্ধকারই ছিল। নর্মদা ঘরে ঢুকতেই একটা মৃদুকণ্ঠ অসহিষ্ণু হয়ে বেজে উঠল, আমায় কেন আটকে রাখলে? এ ট্রেনটা বোধকরি আর ধরা হল না–
এ ট্রেন ধরতে হবে না। সামান্য ওই চাকরিটার জন্যে অতদূরে চলে যেতে তোমায় দেব না আমি। নিজের গলার সেই চাপা ফিসফিস শব্দটা যেন এখন আবার নতুন করে শুনতে পাচ্ছেন নর্মদা। তুমি কি জান না, তোমায় না দেখতে পেলে আমি মরে যাই?
কিন্তু কতদিন আর এমন করে তোমায় ভাঙিয়ে চলবে নর্মদা? নিজের উপর ঘৃণা আসছে। তোমার টাকায় পোশাক কিনে সেজে তোমার বাড়িতে বাহার দিই, তোমার দেওয়া টাকায় তোমাকে উপহার কিনে দিয়ে লোকের কাছে মুখ রাখি, এ জীবন আর ভাল লাগছে না।
জানি জানি, আমি টের পেয়েছি তোমার আর ভাল লাগছে না। কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচব কনক? দেখেছ তো আমার ঘর, আমার সংসার? কিন্তু বেশি কথা বলবার সময় আর নেই, ওরা ওঠবার আগে পালাতে হবে তোমায়। ওরা জানে তুমি চলে গেছ, এতক্ষণে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছ। এই নাও, এগুলো নিয়ে যাও। অনেক গহনা আছে এতে, সব দামী জড়োয়ার। এগুলো বিক্রী করে তুমি একটা ব্যবসা করে। ব্যবসায় পয়সা আছে। মফস্বল শহরের ওই সামান্য চাকরিতে তোমার কি হবে? কিন্তু যাও, যাও, পালাও। ধরো, এই অ্যাটাচিটায় পুরে দিয়েছি। আলমারি এমনি খোলা পড়ে থাক, চাবি ঝুলুক। এই নাও ওষুধ-মাখা রুমালটা। এটা আমার নাকের কাছে ফেলে রেখে যাও। রোসো রোসা, বরং আরও ভাল হবে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আমাকে খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে গেলে। পারবে না? কী আশ্চর্য! আমার বিপদটা বুঝছ না? আমি সজ্ঞানে জেগে বসে থাকলে তো সব প্রকাশ হয়ে পড়বে। মনে রাখো, বাইরের চোর এসে আমাকে ক্লোরোফর্ম করে বেঁধে রেখেও কনক, যা বলছি কর। দেরি করো না, দেরি করো না। দেরি করলে দুজনকে মরতে হবে। আমার মেয়েটা কোথায় আছে। দেখতে পাচ্ছি না, কে জানে কখন এসে পড়বে। ওকে আমার বিশ্বাস নেই। মনে হয় ও সব বোঝে। কনক নাও! ধর এটা। তারপর মনে আছে তো? ওখানে গিয়ে তুমি একটা চিঠি লিখবে। লিখবে চাকরি খারাপ, থাকা অসম্ভব। চলে আসছি। তারপর তোমার দূর গাঁয়ের কোন দূর সম্পর্কের দিদিমার সম্পত্তি পাবে তুমি। লুকনো টাকার গাদা। সেই দিয়ে ব্যবসা কাঁদবে তুমি। মনে রাখছ তো সব? যাও, যাও শীগগির। এই যে এইটা দিয়ে বাঁধো, আমারই আলনার এই শাড়িটা দিয়ে। ওই কে যেন আসছে। এটা নাও কনক, তোমার পায়ে পড়ি। কিন্তু না না, সত্যি অজ্ঞান করে ফেলো না আমায়, তাহলে বুঝতে পারব না কে কী বলছে। শুধু নাকের কাছে ফেলে রাখ। হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। ওই ওরা উঠে পড়েছে বোধহয়। এক্ষুনি আমায় খুঁজতে আসবে, দেখতে আসবে আমি কেমন আছি। আচ্ছা, আবার শীগগির দেখা হবে। দ্বিধা করো না কনক, তোমার কাছে তো আমি আর কিছু চাই না, চাই শুধু রোজ একবার তোমায় দেখতেতার বিনিময়ে আমার সব কিছু দিয়ে দিচ্ছি। পালিত আমায় ভালবাসা দিতে পারে না, শ্রদ্ধা-সম্মান দিতে পারে না, তাই অনেক গহনা দেয়। ভাগ্যিস দেয়। ওর বদলে আমি তোমাকে পাবো কনক। দেখ, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি আমি। এ রকম কেন হচ্ছে বল তো?