রান্নাঘরের চাকর নতুন বেহারার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, তুই তার কি জানিস! আমি এদের হাড়হদ্দ সব জানি, সব দেখেছি। আজকে তত আসি নি এ বাড়িতে! সেদিন ওই বাবুটাকে পিছনের ওই ঘুরনো লোহার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল কে? এই আমি, বুঝলি? অবাক। হয়ে হাঁ করে দেখেছি–মানুষটা ট্রেন ধরবে বলে মেমসাহেব তাড়া দিয়ে আগে-ভাগে ওর জন্যে ফ্রাই কাটলেট সব ভাজিয়ে নিয়ে গেল, অথচ এতক্ষণ ও রইল কেন? তারপর থালা থালা চপ কাটলেট-ফ্রাই ভাজলাম, সব ভস্মকীটেদের পেটে ঢুকে গেল, দুখানা রইল না আমাদের জন্য। হাঁড়ি-ভর্তি মাংস-পোলাও সব পাচার হয়ে গেল, ও কোথায় ছিল? কি করছিল? আর রইলই যদি, সামনের সিঁড়ি দিয়ে না গিয়ে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে কেন, আর হাতেই বা কি ওর? কি বলছিস? আসলে লোকটা এ বাড়ির কে? ও কথাটা জিজ্ঞেস করিস না, ওইটি বলতে পারব না। সব জানি, ওইটি জানি না। হা! কি বলছিলাম, হাঁ করে ভাবছি, স্বপ্নেও জানি না ওকে চেপে ধরে চেঁচালে ভাল হত, হঠাৎ শুনি ভেতর বাড়িতে হৈ-হৈ। পড়ি তো মরি করে ছুটে গিয়ে দেখি মেমসাহেব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে, ঘরে অজ্ঞানের ওষুধের বিটকেল-বিটকেল গন্ধ আর মেমসাহেবের লোহার আলমারির পাল্লা দুহাট করে খোলা।
বুঝতে দেরি হল না এ ঘটনার কর্তা কে। আর পালাবার সময় হাতেই বা কি ছিল ওর! আর কিছু নয়, ছোট একটা সুটকেস। তার মধ্যে করেই মেমসাহেবের যথাসর্বস্ব নিয়ে গেছে। উঃ, কম গয়না ছিল মেমসাহেবের! আর সবই হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্নার। গিন্নীর তাবন্ত জন্মদিনে, তারপর তোমার গে, নতুন বছরে, পূজোর সময় একখানা করে গয়না বরাদ্দ ছিল তো কর্তার। গিন্নী বলত, এবার আমায় সোনার গয়না দিতে হবে। কর্তা বলত, সোনা! ও কি আর ভদ্রলোকে পরে? গাঁইয়ারা পরে। জড়োয়াই আসল ভাল।
তা সত্যি, কথাটা মিথ্যে নয়।
গিন্নী যখন কোথাও যেত যা ঝকমকাত, যেন মহারাণীর মত!
সেই সমস্ত গয়না নিয়ে গেল বাবুটা?
হ্যাঁ, এতদিনের এত চেনা-জানা, এত খাওয়া-মাখা, এই তার প্রতিদান! ছোটলোকরাই নাকি ছোটলোক নেমকহারাম। হু! কি বলছিস? বলে দেওয়ার কথা কি বলছিস?
বলছি, বাবুটার কথা সবাইকে বলে দিলি না?
আরে বাবা, তখন আমার মধ্যে বুদ্ধির জিলিপি খেলে গেছে। বলি, আমি চাকর-নফর মানুষ, আমার অত বাহাদুরী দেখাবার কি দরকার? শেষকালে আমাকে নিয়েই টানাটানি করুক আর কি। যত দোষ নন্দ ঘোষ তো এই চাকর-বাকররা। ভদ্দরলোকে যত কাণ্ড করছে, সব ধামাচাপা। জাহির হতে এই ছোটলোকদের দোষ ঘটে। কাজ কি আমার সত্যিকথা প্রকাশ করায়? চোখ দেখল, মন জানল, চুকে গেল ল্যাঠা। মুখ যদি বলে ফেলল, তাহলেই তো খাল কেটে কুমীর আনা!
তা ধম্মের কল বাতাসেই নড়ল। দেখবি ত দে গিন্নীর ভগ্নিপতিই দেখল। ডাক্তার মানুষ কাজে আটকা পড়ে সময়ে আসতে পারে নি, পরে আসছিল, গেটে ঢুকতে গিয়ে দেখেছে মিত্তিরবাবু একটা ছোট সুটকেস হাতে করে চোরের মতন পালাচ্ছে। চেনা-জানা তো আছে, তবু যেন চিনতেই পারল না। সেই কথাই বলল ডাক্তার ভগ্নীপতি। তা যাই এসে পড়েছিল তাই মেমসাহেবের সময়ে অজ্ঞান ভাঙল, নইলে আরও যে কী হত!
অবিশ্যি জ্ঞান ফিরেই মেমসাহেব কেঁদে কেঁদে এই কথাই বলল, কে এমন কাজ করল টেরই পায়নি সে। মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে বলে, একটু জিরিয়ে নিতে এসেছিল, হঠাৎ পেছন থেকে ওষুধের রুমাল নাকে ঠেকিয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে কোমরে গোঁজা চাবির তোড়া খুলে নিয়ে এই কাজ করেছে।
কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, ও জামাইবাবু, আমার কতদিনের কত স্মৃতি মাখানো কতটাকার গয়না। সব গেল। কে এমন কাজ করল। চারিদিকে লোকের ভীড়, তার মধ্যে এত সাহস কার হল!
মেসোমশাই গম্ভীর মুখে বলল, কার সাহস হল তা আমি জানি। নিজের চক্ষে দেখেছি। ভীড়ের মধ্যেই তো সাহস। কার দোষ কার ঘাড়ে চাপে। বলল, অত চালিয়াৎদের এই অবস্থাই ঘটে। তারা চালবাজীর খরচ জোগাতে বাপের বাক্স ভাঙে, লক্ষ্মীর কৌটোয় হাত দেয়। তোমাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে ওই চালিয়াৎ কনক মিত্তির।
মেমসাহেব অবিশ্যি রেগে আগুন হয়ে বলেছিল, এ হতে পারে না! কিন্তু হতে যদি পারে না তো মানুষটা ফেরার হল কেন? বিদেশে চাকরি করতেই যদি গিয়ে থাকে, চিঠি তো দেবে? যাদের সঙ্গে এত ভালবাসা! পৃথিবী উল্টে গেলেও তো নিত্য দিন আসার কামাই ছিল না। আমাদের আর বলবার কি আছে? বড়লোকের বাড়ির চাকর চোখ থাকতেও কানা, স্বর থাকতেও বোবা। এই চা, এই কফি, হুকুম আসে তামিল করি, ব্যস।
কিন্তু জগৎ সংসার তো আর কানাও নয় বোবাও নয়। তারা বলল পুলিসে হুলিয়া কর। সাহেব বললেন, থাক, লোক জানাজানিতে দরকার নেই–যতই হোক এতদিনের বন্ধুলোক।
আসল কথা ঘরের কথা জানাজানির ভয়। ওরা অবিশ্যি ভাবে, কেউ কিছু জানে না, কেউ কিছু বোঝে না, বুঝলি নিধু? মনে করে চাকর বাকর ক্লাস সব নীরেট গাধা। আরে বাবা, যে যতই গবেট গাধাই হোক, আর কিছু না বুঝুক, মেয়ে-পুরুষের ভাবভালবাসার খবর ঠিক বোঝে। মরুক গে যাক। তবে একথা বলব, মিত্তিরবাবু লোকটা খুব খারাপ ছিল না। তবে নাকি মেয়েছেলের কবলে পড়লে মুনি-ঋষিরও মতিচ্ছন্ন ঘটে, তা এ তো তুচ্ছ মানুষ। ওই ধিক্কারে বিয়ে করিনি বুঝলি নিধু? বিয়ে করলে তো আর আমাতে আমি থাকব না।