সে সাহস কি আমার আছে?
এতগুলো লোকের চোখের সামনে হঠাৎ আমার এই বাচ্চা মেয়ের খোলশটা খুলে ফেলে স্বরূপ প্রকাশিত হবার সাহস? না না, পারব না বোধহয়। অনবরত মাকে ভয় করে করে আমার মেরুদণ্ডে জোর নেই।
সেদিনের মত আমার আজকের জন্মদিনটাও বোধহয় মাটি হবে। ওই লোকটা যেন আমার শনি।
.
সবাই এত কথা ভাবছিল, তবু সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি কাজও চলছিল। চাকর-বাকরদের কাজ চাকর-বাকররা করছিল, গিন্নীর কাজ গিন্নী। অর্থাৎ, তখনও মার্কেট চষে বেড়াচ্ছিলেন মিসেস পালিত। বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতদের ডাকলে, মহামুহূর্তে একবার মার্কেট ঘুরে আসতে যাওয়া মিসেস পালিতের চিরাচরিত রীতি। যাওয়ার কারণটা আবশ্যকীয় বা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক যাই হোক। এমনও হতে পারে ফুলদানিতে ফুল কিছু কম দেখাচ্ছে বলে চট করে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মহিলা।
ফিরবেন হাঁপাতে হাঁপাতে, অতিথিদের সামনে চেয়ারে এলিয়ে বসে পড়বেন, কিছুক্ষণ হাওয়া খাবেন, আর তিনি যেটি না দেখবেন, সেটিই যে একেবারে মার্ডার কেস হয়ে বসে থাকবে এই তথ্যটি পরিবেশন করবেন প্রায় কেঁদে, আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সবাইকে ধরে ধরে জানাবেন–তার স্বামীটি কিছু না। তারপর ভয়ঙ্কর রকম ক্লান্ত আর দুর্বলের ভূমিকা নিয়ে সহানুভূতি কুড়োবেন অতিথিদের। সকলে ওঁকে বলবে, থাক থাক, তুমি উঠো না; থাক থাক, আপনি খাটবেন না, আর উনি যেন মরে মরে, তা কি হয় বলে উঠবেন, খাটবেন।
এই এক নেশা মিসেস পালিতের। সবাই ওঁকে আহা আহা করুক।
আজও তাই খানিক আগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন তিনি। আর সময়ের স্রোত যেন . নিথর হয়ে পড়ে আছে তার প্রতীক্ষায়।
.
শুধু চারিদিকে চাপা ফিস ফিস গুনগুন। সে গুঞ্জনধ্বনি দাসীচাকর মহলেও উঠেছে।
রাতদিনের ঝি কানন মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমরা দাসী-বাঁদী, মনিবের ঘরের কথায় থাকবার দরকার নেই, তবু বলি-যে লোকটা অমন কাণ্ড করে গেল, তাকেই আবার আদর করে ডেকে আনতে প্রবৃত্তি হল! এই দু বছরেই সব বিস্মরণ!
বাসন-মাজা ঝি সুখদা বলে, তুমি তো বললে কাননদি সেকাজ ওই বাবুটাই করেছে; কিন্তু এ-ও বলি, গিন্নীর সঙ্গে যার এত আসনাই, এত দিনের এত ভালবাসা, সে কখনও তা করতে পারে?
তুই থাম, কানন ঝঙ্কার দেয়, বলে মন্দিরের পূজুরী পুরুত আজন্ম বিগ্রহসেবা করে সে বিগ্রহের গয়না চুরি করে পালায়, আর এ তো পরস্ত্রীর আসক্তি। কর্তা যে কি করে সহ্য করে তাই ভাবি।
বড়মানুষ তমন সহ্য করে থাকে। না করে গতি কি? সেকালে রাজা-জমিদারের ঘরে পরিবারদের সোয়ামীদের বেচাল সহ্য করতে হত, একালে সাহেব সুবোদের ঘরে সোয়ামীদেরই পরিবারের বেচাল সহ্য করতে হয়। সহ্য না করে চেঁচামেচি করলেই তো লোকজানাজানি। আপনার মুখে আপনিই চুনকালি মাখানো।
কিন্তু আদর-সোহাগেও তো কমতি দেখি না কিছু। একটু মাথা ধরল তো ডাক্তার এনে হাজির করল। একটু রান্নাঘরে এল তো মাথা ধরবে বলে বকাবকি। তার ওপর তোমার গে, গয়নার ওপর গয়না, শাড়ির ওপর শাড়ি।
ধন্যি কপালখানা বটে!
.
এমনি আলোচনার গুঞ্জনের মাঝখানে বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। পরিচিত শব্দ। অতএব বোঝা গেল গিন্নী ফিরলেন।
নিথর সমুদ্রে ঢিল পড়ল।
অস্ফুট একটা ধ্বনি উঠল, মিসেস পালিত এলেন।
সকলেই যেন নতুন করে নড়ে-চড়ে বসল। সেই অবাঞ্ছিত অতিথিও।
হাতের সেই অ্যাটাচি-কেসটা একটু যেন বিশেষ করে বাগিয়ে ধরল, আর একটু যেন খাড়া। হয়ে বসল।
মিসেস পালিত যথারীতি হাঁপাতে হাঁপাতে একগোছা চামচ হাতে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিলেন, হঠাৎ মিস্টার পালিত সামনে দাঁড়ালেন; গম্ভীরভাবে বললেন, ও-ঘরে নয়, এ-ঘরে।
কেন, এ-ঘরে কি? ভুরু কোচকালেন মিসেস পালিত।
দরকার আছে।
থাম। রাখ তোমার দরকার। আমি বলে এখন মরছি।
পাগল হয়েছ! অমন অমঙ্গলের কথা বলতে আছে! এখুনি মরবার কি হয়েছে? না না, ওদিকে না এদিকে।
কি আশ্চর্য! তোমার কি এখন রঙ্গ-তামাসা করবার সময় হল? অতিথিরা বসে রয়েছেন।
থাক না। বসে যখন রয়েছেন, আর কিছুক্ষণ না হয় থাকলেন। আমার কথাটা হয়ে যাক।
মিসেস পালিত বিরক্ত আর বিচলিত স্বরে বলেন, তা অত গৌরচন্দ্রিকার দরকার কি? যা বলবার বলে ফেল।
উঁহু–এখানে নয়, ওদিকে।
আশ্চর্য! এরকম ঢঙের মানে? তোমার দরকারী কথা থাক, যেতে দাও আমাকে!
যাবে যাবে। যার জন্যে এত ব্যস্ততা সে ঠিকই এসে গেছে। কিন্তু নর্মদা, ভাবছি তোমরা মেয়েরা এত বোকা হও কেন? আজ এতলোকের মাঝখানে ওকে ডাকবার হেতু কি? বেশ নিরালায় একদিন ডাকলেই তো
কি বকছ বাজে-বাজে? কাকে ডেকেছি?
ওঃ, বুঝতে পারছ না বুঝি? আমি বলছিলাম মিস্টার মিত্তিরের কথা। শ্রীকনক চন্দ্র মি—
তার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?
আহা-হা, অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? উত্তেজিত হবার কি আছে? আমি শুধু একটি নিরীহ প্রশ্ন করছিলাম। বলছিলাম, ওর সঙ্গে যে এ-যাবৎ যোগাযোগ রেখেছিলে সে খবরটা যখন এতদিন চেপে রেখেছিলে, তখন আজ হঠাৎ
তোমার এইসব অর্থহীন কথা শোনার মত প্রচুর সময় আমার নেই! বলে ঠিকরে ও-ঘরে গিয়ে পড়েন নর্মদা। আর গিয়ে পড়েই সহসা যেন পাথর হয়ে যান।
কে? কে? কে এখানে?
এই যে শ্রীমতী নর্মদা দেবী! আমন্ত্রিত অতিথিদের ফেলে এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?
কনক মিত্তির উঠে দাঁড়ায়। বিনয় নমস্কারের ভঙ্গিতে মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে।