তাই যখন মার ওই বন্ধু বলল, ট্রেন ধরতে হবে, খাবার সময় নেই, পালাই, আর মা ব্যস্ত হয়ে একটা প্লেটে করে সব কিছু ভাল ভাল জিনিস এনে ধরে দিল ওর হাতে, তখনই মনে। হয়েছিল আমার, এইবার সেই একটা কিছুর সূচনা দেখা দিচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ট্রেনে চড়ে ও একা পালাবে না। আরও কেউ ওর সঙ্গী হবে।
কেন এমন কথা মনে হয়েছিল, তা জানি না। তবে তার কদিন আগে থেকে মার মধ্যে যে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস টের পাচ্ছিলাম সেটাই বোধহয় আমাকে এমন কথা ভাবিয়ে তুলেছিল। সেদিন যখন দেখলাম মা অতিথিদের সঙ্গে টেবিলে বসল না, বলল মাথা ঘুরছে, বলল শরীর খারাপ লাগছে, বলল অতিথিরা যেন কিছু মনে না করেন-মা মিনিট কয়েক বিশ্রাম করে নেবে, তখনই আমার সেই ধারণা বদ্ধমূল হল। ঠিক বুঝলাম, অতিথিদের খাওয়ার অবসরে মা পালাবে।
কথাটা বুঝে ফেলেই ভয়ানক একটা যন্ত্রণায় বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যেতে থাকল আমার। আর একটু আগেই আমরা ছোটরা খেয়েছি, আমার জন্মদিনের ভোজের ভাল ভাল সব রান্না, সেগুলো যেন পেটের মধ্য থেকে উঠে আসতে চাইল সব গায়ের মধ্যে মোচড় দিয়ে দিয়ে।
মা যে আমাকে ফেলে চলে যাবে এই কষ্টটাই শুধু নয়, ভয়ানক একটা ভয়ও তার সঙ্গে এসে জুটল। মনে হল, মা চলে গেছে এই খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি অবস্থা হবে আমাদের। আমার আর বাবার ওই সব অতিথিরা তখন কেমন করে মুচকে মুচকে হাসবে, আর কেমন করে আহা করে আমাদের সহানুভূতি জানাতে আসবে–সে কথা ভেবে চেঁচিয়ে কান্না পেল আমার।
আশ্চর্য! মা-র ওই বন্ধুকে ছোটবেলায় আমি কি ভালই না বাসতাম। ও এলে যেন আহ্বাদে নেচে উঠতাম। তার কারণ ছোট ছেলেদের মন ভোলাবার অনেক সব কায়দা ও জানত। মজার মজার কত যে গল্পের স্টক ছিল ওর। আর ও এলেই এত সুন্দর হয়ে উঠত মা। ছোটবেলায় সেই সুন্দর মা, আর সেই সুন্দর হয়ে ওঠার কারণস্বরূপ মানুষটা, দুজনকেই তাই ভীষণ ভাল লাগত।
কিন্তু একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মনটা একেবারে উল্টো হয়ে গেল। মনের এই বদলে নিজেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। মা-র ওই বন্ধুকে দেখলেই রাগে সমস্ত শরীর জ্বালা করে উঠতে আরম্ভ করল, আর ওকে দেখে মা-র সেই সুন্দর হয়ে ওঠাটা বিষ লাগতে লাগল। কিন্তু এসব কিছু প্রকাশ করার উপায় ছিল না আমার। আমাকে সরল থাকতে হবে, বাচ্চা মেয়ে থাকতে হবে। আমাদের বয়সের মেয়েদের তাই নাকি নিয়ম। তাদের বুদ্ধির প্রকাশ ধরা পড়লেই সেটা নাকি নিন্দনীয় পাকামী। আমার বয়সী অন্য যে সব মেয়েরা সাধারণ, বয়সের উপযুক্ত বুদ্ধিমতী, মা তাদের দেখতে পারে না। বলে, ওরা অকালপক্ক। আমি আদর্শ বেবি। আমি অবোধ। অবিশ্যি লেখাপড়ায় দস্তুরমত বুদ্ধি সুদ্ধি থাকা চাই। সে না থাকলে আবার মা-র মুখ থাকে না।
বাধ্য হয়ে আমাকে তাই কিম্ভুতকিমাকার আদর্শ বেবি হয়ে থাকতে হয়েছে! বছর বছর স্কুলে ফাস্ট হই, নির্বিচারে দেখি-বিদেশী সাহিত্য গিলি, লুকিয়ে প্রেমের কবিতা লিখি, আর বিশ্ব সংসারের সব কিছুতে অনভিজ্ঞ আহ্লাদে খুকীর অভিনয় করে চলি। লোকে বলে, মেয়েটা একেবারে বাচ্চা!
তবু মা মাঝে মাঝে সন্দেহ করে।
মা যখন আমার গানের মাস্টারমশায়ের সঙ্গে নাচতে নাচতে জলসা শুনতে যায়, তখন আমি যদি মা-র সঙ্গে যাবার জন্যে খুকীমাফিক বায়না ধরি, তা হলে মা কেমন ঝাল ঝাল তেতো তেতো চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে, তুমি আবার কি যাবে! রাত হয়ে যাবে, ঠাণ্ডা লাগবে না?
অগত্যাই আমাকে মায়ের সন্দেহ ঘোচাবার জন্যে আরও খুকী হতে হয়। আঁ আঁ করে কেঁদে ফেলতে হয়, বারে, আমার বুঝি একা বাড়িতে খারাপ লাগে না?
অবিশ্যি একথা জানি, গানের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এত মেশামেশি মা করে, সে শুধু মনের শূন্যতার পূরণ করতে। মা-র ওই বন্ধু চলে গিয়ে পর্যন্ত মন সব সময় খাঁ খাঁ করে। বুঝতে পারি, কিন্তু ভাল লাগে না। মনে হয় ঐ খাঁ খাঁ করাটা খারাপ।
তবু মা-র ওই বন্ধুকে আমি ভক্তি করেছিলাম, ওর চলে যাওয়াটাই এই ভক্তির কারণ। ভাবতাম, ভয়ঙ্কর একটা বিপদকে যেন ও সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে। উঃ, কি বিপদই হত যদি সেদিন ও একা না যেত!
অবিশ্যি অনেক কিছু জিনিস নিয়ে গেছে ও। তা যাক্, সব নিয়ে যাক ও। শুধু আমাদের মানসম্ভ্রম যে নিয়ে যায়নি, এর জন্যেই আমি ওর উপর কৃতজ্ঞ। আবার এল কেন? কে ডাকল ওকে? নিশ্চয় মা। তাছাড়া আর কে। কিন্তু ওকি ওর ভয়ঙ্কর অপরাধটা অস্বীকার করবে? বলবে–আগে ভাগে খেয়ে ও তো ট্রেন ধরতে চলে গিয়েছিল। তার পর কি ঘটে গেছে কিছুই জানে না। এত দিন যে আসেনি তার কারণ অন্য। হয়তো সেই কারণ নিয়ে এমন গল্প ফঁদবে যে সবাই ভাববে, ছি ছি, এতদিন কী ভুল ধারণাই না করে এসেছি আমরা! বাবা ভাববে, ছি ছি, তাইতো। ভারি অন্যায় হয়ে হয়ে গেছে তো পুলিসে খবর না দিয়ে।
কিন্তু তাই কি? ওর মুখটা যেন বদলে গেছে।
মনে হচ্ছে, ও আর কোন গল্প ফাঁদবে না। এ বাড়িতে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার বাসনা আর নেই ওর।
কিন্তু যদি থাকে? তখনও কি আমি আদর্শ বেবি সেজে বসে থাকব? জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠব না না, মোটেই ও সেদিন তখুনি ট্রেন ধরতে যায়নি। বলে দেব না–আমি সব ঘটনা জানি, আমি ছাতের সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ভেন্টিলেটারে চোখ রেখে সব দেখেছিলাম? পারব কি?