কারণ শুনেছিলাম বটে, খেতে বসেন নি হঠাৎ শরীরটা অসুস্থ বোধ হচ্ছিল বলে। কিন্তু কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কি না তা ভেবেছি অনেকবার। মহোৎসাহে যিনি অতক্ষণ অত হৈ-চৈ করে বেড়াচ্ছিলেন! মানে, হেনা ঠিক সেদিন না দেখুক, আরও অনেক দিন তো দেখেছে। দেখেছে পার্টি দেওয়ায় মামীর কী অগাধ উৎসাহ। হেনাকে অবশ্য সাহায্য করতে ডাকেন না কখনও, তবে হেনা নিজে থেকে এগিয়ে এসে কিছু করলে খুব অমায়িক গলায় বলেন, এটা করে ফেলেছ? ভালই হল, একা হাতে এত ব্যবস্থা, মারা যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ কী, কি করে এমন মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে হেনা? এ যে একেবারে অচল। সত্যি হেনা, বুদ্ধিসুদ্ধি আর তোমার হবে না কোনদিন। তা, তোমারই বা দোষ কি দেব বল? ভাল পার্টি তো আর দেখছ না হামেসা। আমার এখানে এলেই যা।
মিসেস পালিতের সেই মারাত্মক ভুলটা হয়তো ফুলদানিটার একটু স্থানচ্যুতি, কি নুন আর মশলাডোর পাত্রগুলোর জায়গায় একটু হেরফের। হৈ চৈ করে সব কিছু ফের নিজে গোছাতে শুরু করেন মিসেস পালিত। যাঁর নিজস্ব নাম নাকি নর্মদা দেবী।
.
হেনা যখন নির্লিপ্তের মত উদাসীন মুখে বসে বসে এত কথা ভাবছিল, তখন মিস্টার পালিতও ভাবছিলেন, নর্মদা এতটা বোকামী না করলেও পারত। আজ এত লোকের মাঝখানে কী দরকার ছিল ওই হতভাগা লোকটাকে ডাকবার? কেলেঙ্কারী যা হবার তার তো চূড়ান্ত হয়েছে, তবু যা হোক পাঁচ জনে আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছিল সব কিছু, আর নর্মদাও নূতন উৎসাহে কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মেতে কিছুটা ভুলে ছিল। হঠাৎ আবার নিভে যাওয়া ছাইকে খুঁচিয়ে আগুন বার করতে গেল কোন্ বুদ্ধিতে? আশ্চর্য! মেয়েগুলো কি এত নির্বোধও হয়! অথচ নিজেদেরকে কী বুদ্ধিমানই না ভাবে।
নাঃ, নর্মদার বুদ্ধিকে কিছুতেই প্রশংসা করা চলে না।
কিন্তু আরও আশ্চর্যজনক লোকটার নির্লজ্জ ধৃষ্টতা। এল কি বলে! এসে সভার মধ্যে বসল কি বলে! হাতেই বা এনেছে কি? পচা ওই অ্যাটাচিটায় কী থাকা সম্ভব? কাবেরীর জন্যে কোনও উপহার? তাই সম্ভব। মানুষের ধৃষ্টতার তো সীমা থাকে না।
এখন বোঝা যাচ্ছে, নর্মদা এ-যাবৎ ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এসেছে, নইলে হঠাৎ ঠিকানা পাবে কি করে নিরুদ্দিষ্ট লোকটার। তবু মনে মনে মৃদু একটু হাসলেন মিস্টার পালিত, লোকটার ওপর আমার করুণাই হচ্ছে। আগেও অবশ্য হত, অসার এক ভালবাসার পাত্রীর মোহে অমন একটা বিদ্বান বুদ্ধিমান ছেলে কিভাবে নিজের কেরিয়ারটা নষ্ট করছে, আর মনে ভাবছে খুব জিতছি, এটা আমায় যেমন হাসাত তেমনিই করুণাও জাগাত। ওর বাবুয়ানার খরচা, ওর বাহারে সাজ-পোশাক কোথা থেকে আসে সে কথা যে আমার অজানা নয়, এটা ওর অজানা–এ দেখেও কৌতুকের শেষ ছিল না আমার। কিন্তু সেদিন? তিন বছর আগের সেই দিনটায় বরং একটু দুঃখই হয়েছিল ওর জন্যে। ওর এত ভালবাসা যদি সত্যিকার সারালো একটা মেয়ের ওপর পড়ত।
সত্যিকার সারালো! ভাবলেন মিস্টার পালিত, ধারে কাছে কোথায় বা পাবে দুর্লভ সেই বস্তু। হেনাকে একটু শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু হেনা নিজের দারিদ্রের অহঙ্কার আর দারিদ্রের কুণ্ঠায় দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আমি মামা–আমার সাহায্য নে না তুই, মা-বাপ মরা মেয়ে। তা নেবেন না। অথচ এই সব পার্টিতে আসতে সাজসজ্জায় যে প্রাচুর্য থাকা দরকার তার অভাব বলে সে সব জায়গায় আসতেই চান না বাবু। হ্যাঁ, বুকের পাটা থাকে তো পাঁচ টাকার শাড়ি পরে চলে আয় রাজসভায়। এ-ও নয়, ও-ও নয়। মেয়েটা আমাকে হতাশ করেছে।
আর, আমার ওই মেয়েটা!
আজ নাকি ষোল বছর পূর্ণ হল ওর।
লোকে বলে, এত সরল যে দশ বছরের বাচ্চা বলে মনে হয়। আমার কিন্তু মনে হয় না। আমি ওকে বুঝতে পারি না।
হ্যাঁ, আমার ওই ষোল বছরের মেয়েটাকে আমি বুঝতে পারি না।
আচ্ছা, কনক মিত্তিরকে গিয়ে কি আমি সরাসরি প্রশ্ন করব, কি খবর? এতদিন ছিলেন কোথায়? না কি মৃদু হেসে বলব, জাত গিয়ে পেট না ভরাটা ভারি লোকসান, না হে মিত্তির? না নর্মদাকেই একটু ভয় পাওয়াব?
.
কনক মিত্তির কি অনন্তকাল ধরে বসেছিল?
আর ঘরের সবাই অনন্তকাল ধরে তার কথা নিয়ে মনকে তোলপাড় করছিল? তা অবশ্য নয়। কিন্তু বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী যে কে, তার উত্তর তো দ্বাপরে স্বয়ং যুধিষ্ঠির দিয়ে গেছেন।
সময় খুব বেশি কাটেনি।
এতগুলো লোকের এত চিন্তা দৌড়চ্ছিল বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
.
অন্য ঘরে বেশ কয়েকটি কিশোর-কিশোরী কাবেরীকে ঘিরে হৈ-হুল্লোড় করছিল। উপহারে পাওয়া কি একটা নতুন ধরনের খেলার সরঞ্জাম খুলে বসেছিল কাবেরী, ওরা খেলছিল। মাঝে মাঝে ওদের উল্লাসধ্বনি ভেসে আসছিল এ-ঘরে। ওরা আসেনি একবারও।
তবু কাবেরী জানে।
কাবেরী কখন কোন কাজে একবার এসেছিল এ ঘরে, কে জানে। কাবেরী অবাক হয়নি। কাবেরী কোন কিছুতেই অবাক হয় না। ও অদ্ভুত রকমের সরল। যা দেখে শুধু দেখেই চুপ হয়ে থাকে, স্থির হয়ে থাকে।
আজও চুপ হয়ে গিয়েছিল। নতুন খেলনাটা মেলে দিয়েছিল বন্ধুদের সামনে, আর সেই অবসরে ভাবছিল। কাবেরী নিজে কিছু ভাবে, ভাবতে পারে–একথা কেউ ভাবে না। সবাই জানে, মা যা ভাবায় তাই সে ভাবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক কথা? কাবেরী ভাবে বৈ কি। এই তো আজ ভাবছে। ভাবছে, আমার মন বলছে আজও একটা কিছু ঘটবে। সেদিনও আমার মন একথা বলেছিল। সেদিন উৎসব-আয়োজনের তলায় তলায় আর একটা কিসের যেন আয়োজন চলছিল।