কে ডেকেছে?
আর কে ডাকতে পারে বল, কাকীমা ছাড়া?
কাকাবাবু চুপ করে আছেন কেন তাহলে?
বোধ করি এত লোকের মাঝখানে আর সীন ক্রিয়েট করতে চান না।
তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস কর না সোজাসুজি।
জিজ্ঞেস করব? কাকে জিজ্ঞেস করব?
কেন, ওই ওঁকে।
ওঁকে জিজ্ঞেস করব? কি জিজ্ঞেস করব বল তো?
স্পষ্ট জানতে চাইবে, আপনাকে আজ এখানে ডাকল কে।
মাথার চিকিৎসা করা দরকার তোমার।
কেন, খুব একটা অযৌক্তিক কথা হল?
সম্পূর্ণ।
বেশ, তবে কাকীমাকেই জিজ্ঞেস কর না।
নাঃ! হেসে ওঠে অশোক, চিকিৎসায় কোন কাজ হবে বলে আশা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ডাকাতি করে আনা রত্নটিকে পাগলা গারদে উৎসর্গ করতে হবে মনে হচ্ছে।
ঈস্! কেন? এত ভয়টা কিসের শুনি? কাকীমাকে যে কেন এত ভয় কর তুমি! এক বাড়িতে থাকলে তো বোধহয় আমার জীবন মহানিশা করে তুলত। দূরে থেকেই এই! অথচ উনি তোমার থেকে এমন কিছু বড় না।
এমন কিছু বড় নয় বলেই তো! অনেকখানি বড় হলে বরং কিছুটা সাহসের প্রশ্রয় থাকে। এদিকে কাকা বেশ বড়। কিন্তু চল, ওদিকে সবাই কি ভাবছে।
যাচ্ছি। কাকীমার মেয়েটি যে একেবারে আহ্লাদী-মার্কা হাঁদা। কিছু যে জেনে নেব ওর কাছ থেকে তার উপায় নেই। যা জিজ্ঞেস করব, ঠিক বলবে, কি জানি–মা জানেন।
ওঃ, কাবেরীর কথা বলছ? ও তো ছেলেবেলা থেকেই অমনি। নিজের কোন বুদ্ধি নেই। কাকীমা যেদিকে চালান সেদিকে চলে, যা বোঝান তাই বোঝে।
উঁহু, আরও আছে। যা খাওয়ান তাই খায়, যা পরান তাই পরে। যা ভাবান তাই ভাবে, যা দেখান তাই দেখে।
ইডিয়ট আর কি।
ওই রকম বাপ-মায়ের কী করেই যে এরকম মেয়ে হয়।
বলতে গেলে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের প্রবল ইচ্ছাশক্তির দাপটে সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হতে পায় না। এমন কি স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও অনেক সময় এ দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অবিরত একজনের মতের প্রাবল্যে অপরজনের বুদ্ধিবৃত্তি আর চিন্তাশক্তি হ্রাস হতে থাকে।
এত স্বামী-স্ত্রী দেখলে কোথায়? জগতে দেখবার মধ্যে দেখেছ তো ওই কাকাকে আর কাকীমাকে।
কেন, এতগুলো বছর চোখ বুজে পৃথিবীতে বিচরণ করেছি বুঝি?
আমার তো তাই মনে হয়।
মনে হয়? সত্যি? তাহলে এ হেন রত্নটিকে কি করে চক্ষুগোচর হল?
আসলে রত্নই নয়। মুদিত চক্ষু একবার খুলেই যা দেখেছ, মোহিত হয়েছ।
হুঁ, তাই দেখছি। বড় ভুল হয়ে গেছে। আরও দেখে বেড়ানো উচিত ছিল।
ঈস, তাই বৈকি। আচ্ছা আমাদের মধ্যে প্রবল কে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যাব, এতবড় বোকা আমি নই। কিন্তু চল চল, ওঘরে চল।
আমি কিন্তু ঠিক করেছি, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করব।
পাগলামী করো না।
কেন, পাগলামী কিসের? আমি নতুন মানুষ, আগের কিছু দেখিনি, আগের কিছু জানিও না। অতএব কাছে গিয়ে সরল চোখে তাকিয়ে বলব, আচ্ছা, আগে তো কই আপনাকে দেখিনি এখানে।
তারপর?
পরের কথা পরে।
এই, ওসবের কিছু করতে যেও না। আমার মনে হচ্ছে, আজকের ব্যাপারটা খুব একটা হালকা নয়। বাতাসে কিছু একটা যেন থম্ থম্ করছে। মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ আসছে।
.
পালিতের ভাগ্নী হেনা ভাবছিল, আমি সেদিন ছিলাম না। আমাকে সেদিন ডাকা হয়নি। আমি থাকলে হয়তো সেদিনের সব রহস্য ধরে ফেলতাম। কনক মিত্তিরকে তো আমি জানতাম। লোকমুখে পরে সব শুনেছি, কিন্তু আসল রহস্যটা ঠিক বুঝতে পারিনি। আর কেউ না জানুক আমি তো জানতাম, লোকটা মামীর পেয়ারের লোক। অথচ ব্যাপারটা ঘটল অদ্ভুত। সস্তাদরের নাটকের নাটকীয়তার মত একেবারে। সেদিনের সেই উৎসবে আমি আসিনি, কিন্তু তার কদিন আগেই যে সেই একদিন এসেছিলাম, সেদিন তো দেখেছিলাম ড্রইংরুম ছেড়ে পিছনের ওই ব্যালকনিতে গিয়ে গল্প করা হচ্ছে দুজনে।
না, আড়ি পাততে আমি যাইনি। সে প্রবৃত্তিও নেই আমার। ঈশ্বর করুন, কোনদিন যেন না হয়, সে প্রবৃত্তি। তবু আমি সেদিন ওদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলাম। হঠাৎই পেয়েছিলাম। নীচে চাকরদের কাছে শুনে এলাম মেমসাহেব বাড়িতেই উপস্থিত আছেন, কিন্তু উপরে উঠে দেখতে পেলাম না কোথাও। তাই না পিছনের ওই ব্যালকনির দিকে! সত্যি বলতে অবাক হয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি ওদিককার ওই প্যাসেজটার কাছে, যেটায় নাকি তখন আলো জুলছিল না। হ্যাঁ, অন্ধকার সেই প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম কনক মিত্তিরকে কী যেন একটা ব্যাপার নিয়ে মিনতি করছেন মামী। কারণটা কি! অবাক হয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম কিছুটা দূরে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যেতে চাইছে ভদ্রলোক, কানপুর কানপুর শুনলাম মনে হল; মামী তাকে নিবৃত্ত করতে চাইছেন। যেন চাইছেন, তা অবশ্য বুঝতে বাকী রইল না আমার, আর বুঝে মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। মানি, মামার সঙ্গে ওঁর বয়সের তফাৎ অনেকটা, মনের মিল হওয়া হয়তো শক্ত, তবু
ওই তবুটা বুদ্ধি আর যুক্তির ধার ধারে না।
যাই হোক, মামীর সেই অভিমান আর অনুযোগের, মিনতি আর শাসনের মানেটা তো বুঝতে পারা শক্ত হয়নি, কিন্তু কাবেরীর জন্মদিনের ব্যাপারটা? ভয়ঙ্কর সেই ঘটনাটা? তার মানে কে বুঝবে?
আমি উপস্থিত থাকলেই কি পারতাম?
শুনে প্রথমে তো আমি বিশ্বাসই করিনি। বলেছিলাম, এটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়। বাইরের কোন লোক এসেই ওই দুঃসাহসিক কাজটা করে গেছে। তাক বুঝেই ছিল সে, জেনেছিল বাড়িতে একটা ভোজসভা আছে, বাড়ির লোক ওদিকে ব্যস্ত থাকবে, কাজেই শোবার ঘরগুলো থাকবে খালি পড়ে। দৈব যোগাযোগে ঠিক সেই সময় মামী গিয়ে পড়ায়–কিন্তু এটা আমি বুঝতে পারিনি, মামী কেন ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে খেতে বসেন নি, এটা কী করে হল?