কনককে মিসেস পালিত কলকাতা ছেড়ে যেতে পায়ে ধরে নিষেধ করেছিলেন, কলকাতায় থাকার রসদ জোগাতে ধরে দিয়েছিলেন রত্নাভরণের সম্ভার, তবু সত্যিই কি ভেবেছিলেন তিনি, কনক নিশ্চয় ফিরে আসবে?
কনকের পশ্চাৎপট কি সে আশ্বাস দিয়েছিল মিসেস পালিতকে?
মূৰ্ছার অবকাশে অতীতের সমস্ত কথা ভেবে নিলেন মিসেস পালিত।
.
কিন্তু অনির্দিষ্ট কাল ধরে মূছাহত হয়ে পড়ে থাকা যায় না। চোখ মেলতে হল মিসেস পালিতকে।
বলতে হল, জল খাব।
বীথিকা তার স্বামীর কাছে সেই সুরের নকল করে হেসে উঠল। বলল, স্রেফ নাটকের নায়িকার মূৰ্ছাভঙ্গ। সোজা কথা নয়, সাতদিক থেকে সাত গ্লাস জল এল, তিনি এক চুমুক জল খেয়ে ক্ষীণভাবে বললেন, কনক, তোমাকে কে ডেকেছে?
কেউ না। আমি নিজেই এসেছি। বলল কনক মিত্তির।
নর্মদা বলল, এতদিন কোথায় ছিলে? খোঁজ নেই, খবর নেই, জানো তোমার এই হঠাৎ নিরুদ্দেশের ব্যাপার দেখে যে খুশি তোমার নামে রটিয়েছে। কেউ বলেছে চোর, কেউ বলেছে ডাকাত-গুণ্ডা-খুনে
যাক, আমার সম্বন্ধে লোকের ধারণাটা নির্ভুল দেখে খুশিই হচ্ছি। বলে হাসল কনক মিত্তির।
ভাবতে পারো? বীথিকা বলল, আরও হেসে আরও কি বলল জানো? না, সে তুমি স্বপ্নেও ধারণা করতে পারবে না।
বীথিকার স্বামী বিকাশ বলল, অনেক সত্যি কথাই আমাদের ধারণার অতীত। কি বলল তোমাদের হারানো মানিক?
যা বলল, সে শুনে আমাদের হাত-পা এলিয়ে এল। উঃ, ভাবা যায় না, এত নির্লজ্জ মানুষ হয়।
তোমার কথায় গৌরচন্দ্রিকাটা বেশি, বলল বিকাশ।
বীথিকা বলে উঠল, গৌর থাকলেই চন্দ্রিকা থাকবে। কী বলল শুনবে? বলল, তোমাকে বেঁধে রেখে তোমার জুয়েলারিগুলো যখন নিয়ে গেলাম, ভাবিনি যে আবার ফিরে আসব। কিন্তু
কথা শেষ হল না, ওর ওই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্যের ঢেউ বয়ে গেল।
পালিত সাহেবের ভাইপো অশোক দাঁড়িয়ে উঠে লোকটার জামার কলার চেপে ধরতে যায় আর কি।
আশ্চর্য, একটু বিচলিত হল না লোকটা। বরং একটু হেসে বলল, থাক মাস্টার পালিত, নিজেই যখন ঘাড়টা নিয়ে হাজির হয়েছি তখন ওতে কোপ বসাবার জন্যে আপনাকে জামার কলার চেপে ধরতে হবে না।
পুলিশে দেওয়া হবে আপনাকে।
ফোড়ন কেটে উঠলেন মিস্টার রাহা : এতদিন পরে, রসদ ফুরিয়ে গেছে বলে আবার বুঝি এ বাড়িতে মাথা গলাতে চান নির্দোষী দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে! মিস্টার পালিত, আপনি এখনো কি করে নিশ্চেষ্ট হয়ে রয়েছেন? আশ্চর্য! এখনো একে পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করাতে ইতস্তত করছেন? ধন্য আপনার ভদ্রতা আর ধৈর্য।
আমরা অবশ্য ভাবলাম, বীথিকা বলে, মিস্টার রাহার এত ফড়ফড়ানির দরকার কি? কিন্তু এও না ভেবে পারিনি, সত্যি, ধন্য মিস্টার পালিতের ধৈর্য আর ভদ্রতা। লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তো বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে ওর টুটি চেপে ধরা উচিত ছিল। আশ্চর্য যে, এর পরেও সে ধৈর্য তাঁর অটুট রইল। আর কনক মিত্তিরকে অগ্রাহ্য করে তখন গিন্নীকে সাবধান করতে লাগলেন, এসব বিশ্রী গোলমালের মধ্য থেকে সরে গিয়ে ওঘরে বিশ্রাম নিতে পারলেই তোমার ভাল হত নর্মদা। নানা কথার চাপে আবার হয়তো ফেন্ট হয়ে পড়বে তুমি।
কিন্তু নর্মদা মুখপুড়ি এত আদরের মর্যাদা উড়িয়ে দিয়ে সেই চোরটার দিকেই তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে এলে কেন আবার? যাও, চলে যাও, আমি বলছি এখনই চলে যাও।
যাব, এখনই চলে যাব, শুধু
বলতে না বলতে মিস্টার রাহা আবার সর্দারী করে বলে উঠলেন, মাপ করবেন আমাকে মিস্টার মিত্তির, পালাবার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বেন।
কনক মিত্তির কেমন যেন বিষণ্ণ হেসে বলল, আপনি তো দেখছি বড্ড রগচটা, পালাবার মতলব থাকলে আসব কেন? তবে আপনি বৃথা ব্যস্ত হচ্ছেন, মিস্টার পালিত পুলিশ ডাকবেন না।
ডাকবেন না! অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বেজে উঠল।
কনক মিত্তির তেমনি হেসে বলল, না ডাকবেন না। সে ইচ্ছে থাকলে উনি তখনই ওয়ারেন্ট বার করে ধরে এনে ফাঁসি দিতেন আমায়। কী বলেন মিস্টার পালিত, তাই না? এই তিন তিন বছর অপেক্ষা করে বসে থাকতেন কি, আসামী কবে নিজে বামালসুদ্ধ এসে ধরা দেবে এই আশায়?
এই সময় নর্মদা হঠাৎ ঠিকরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ঠিক আছে, আমিই তোমায় পুলিশে দেব। এতই যখন সাহস তোমার।
বিকাশ হেসে উঠে বলে, বাঃ, এ যে সত্যই রীতিমত একখানি নাটকের দৃশ্য।
হ্যাঁ, একেবারে ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু এখনই শেষ হয়নি, আরও বাকি আছে। নর্মদা যেই টেলিফোনের কাছে যেতে গেছে, কাবেরীটা কোথা থেকে ছুটে এসে ওর সেই আহ্লাদে গলা ত্যাগ করে ভীষণ স্বরে বলে উঠল, বেশি বাড়াবাড়ি করো না মা। পুলিশ ডাকলে সত্যি কথা প্রকাশ পেয়ে যেতে দেরি হবে না তা মনে রেখো। আমিই দেব তাহলে সাক্ষী। আমি সব জানি। আমি সব দেখেছি।
নর্মদা পাঙাস মুখে বলল, সত্যি কথা? কী সত্যি কথা প্রকাশ হবে শুনি? কী তুই দেখেছিস? কী তুই জানিস?
বিকাশ হেসে উঠে বলে, আশ্চর্য বটে বীথিকা, এত সব হচ্ছে আর তোমরা সবাই চুপচাপ . বসে আছ?
তা থাকব না তো কী? বীথিকা বলে, আমরা তো চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ রঙ্গমঞ্চের অভিনয় দেখছি।
.
তা বীথিকা কথাটায় বিশেষ কিছু রং চড়ায়নি।
বাস্তবিকই তখন পালিত সাহেবের সেই ড্রয়িংরুমে প্রায় সকলেই চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ বসেছিল এক রঙ্গমঞ্চের সামনে।