এইভাবেই চলছিল। চলে আসছিল।
যেন চন্দ্র সূর্যের অমোঘ নিয়মের মত! এর আর ব্যতিক্রম নেই। একটা দোলনার শিশু যে আস্তে আস্তে কিশোরী হয়ে উঠল, একটি তন্বী তরুণী যে তন্বীত্ব হারিয়ে ভার-ভারিক্কি মহিলা হয়ে উঠল, এসব ঘটনা এই নিয়মের উপর ছায়াপাত করল না। দীর্ঘ বারো তেরোটি বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল যেন।
তারপর এল সেই সন্ধ্যা।
কাবেরীর ত্রয়োদশ জন্মদিনের সেই সন্ধ্যা।
যে সন্ধ্যার কিছুদিন আগে থেকেই কনক মিত্তির বিদায় রাগিণী গাইতে শুরু করেছিল।
অনবরত নিভৃতে জানাচ্ছিল সে মিসেস পালিতের কাছে, এমন করে আর পারছে না সে। ধিক্কার এসেছে এ জীবনে।
এতদিন ধরে ভেবে এসেছিল আবার বাপের মত বিজনেস করে হৃত-গৌরব ফিরিয়ে আনবে, এই গ্লানির ভার থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু এখন ক্রমশ বুঝছে সে ক্ষমতা তার নেই।
এই অক্ষমতার সত্য ধরা পড়ে গেছে তার নিজের কাছে।
অতএব সাধারণ একটা চাকরী-বাকরী জোগাড় করে চলে যেতে চায় সে। কলকাতা থেকে দূরে, পরিচিত জগৎ থেকে দূরে।
সেখানে একেবারে সহজ সরল মধ্যবিত্তের জীবনে থাকবে কনক মিত্তির, তার ধার করা পরিচয় ছেড়ে।
মিসেস পালিত ছল ছল চোখ তুলে বলতেন, পারবে?
পারতেই হবে।
আমি কি করে থাকব, তা ভাববে না?
ভাবতে গেলে পারব না। নিতান্ত প্রিয়জনও তো মারা যায় লোকের, এই ভেবে তোমাকে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেব।
এত করবে, আর কলকাতায় থেকেই ভাগ্যকে ফেরানো যায় কি না সে চেষ্টা করবে না?
জানি ওটা হবে না।
মিসেস পালিত বলতেন, সারাদিন কি তুমি কর তুমিই জানো। কিন্তু তেমন করে চেষ্টা কোনদিন করলে না।
তখন কনক মিত্তির হেসে উঠত।
বলত, তেমন চেষ্টা করতে যেমন মূলধনের দরকার, সে আর তোমার ওই পকেট-মানিতে কুলোবে না মিসেস।
কে বলেছে?
সাধারণ বুদ্ধিই বলছে। তবে যদি, হেসে উঠত কনক, পালিত সাহেবকে বলল, তোমার ভাঁড়ারের সেরা রত্নটিই তো মিত্তিরকে দান করে বসে আছ, এবার ব্যাঙ্কের পাশ বইটাও তাকে দান করে ফেলল, তাহলে হয়তো
মিসেস পালিত বলতেন, তা বলে আমার ভাড়ার এখনো অত দুঃস্থ হয়ে যায়নি যে ওর ভাঁড়ারের দরজায় ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
হ্যাঁ, এই কথাই সেদিন বলেছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু কোন সাহসেই যে বলেছিলেন!
অবিরাম গতিতে আর অবিরল ধারে অর্থোৎসর্গ করতে করতে ভিতরে ভিতরে যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, এ কি জানতেন না? না বুঝতে পারতেন না?
শেষ সম্বল ছিল তো শুধু ওই জুয়েলারীগুলো!
তা সেই সম্বল ভেঙেই শেষরক্ষা করতে গিয়েছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
.
সেই শেষ সম্বলের নৈবেদ্য সহজভাবে গ্রহণ করে, পরদিন আবার সহজভাবে এ বাড়িতে এসে উদয় হল না কনক মিত্তির, সেই তার ব্যঙ্গ হাসির বর্মটি পরে।
ভয় পেয়ে উধাও হয়ে গেল।
একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল।
একদিন আধদিন নয়, দীর্ঘ তিনটি বছর।
সমস্ত পরিকল্পনা ফেঁসে গেল মিসেস পালিতের। কী বললেন? কনক? কনক একাজ করেছে? নিজের চোখে দেখেছেন আপনি? হতে পারে না। বলে দৃঢ় প্রতিবাদে কনক মিত্তিরের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার আর কোন উপায় তার হাতে রইল না।
মিসেস পালিতের অন্তর-জীবনের কথা থাক, বহির্জীবনেও দীর্ঘ একটা কলঙ্কের রেখা টেনে দিয়ে যে লোকটা বিদায় নিল, সে বেঁচে রইল কি মারা গেল তাও জানতে পারলেন না তিনি।
আশ্চর্য মানুষের মন!
যাকে একদিন মাত্র না দেখে থাকতে পারতেন না মিসেস পালিত, হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে তার মৃত্যু-সংবাদ কামনা করতে থাকলেন তিনি। অনেক দিন যাবৎ এ সংবাদ কামনা করেছেন মিসেস পালিত। খবর আসুক, নয়তো খবরের কাগজে খবর উঠুক–কনক মিত্তির নামক এক ব্যক্তি অমুক দিন ট্রেনের তলায় অথবা অজ্ঞাত ব্যক্তির দুর্ঘটনায় মৃত্যু! অমুক দিন অমুক সময়। তাহার সঙ্গের কাগজ-পত্রে জানা যায় লোকটির নাম–
প্রেমাস্পদের মৃত্যুর মূল্যে প্রেমাস্পদের সুনাম রক্ষা করতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত।
তা হল না।
কিন্তু যে লোক এতবড় একটা কলঙ্কের ছাপ মেখে বিদায় নিল, তার জন্য শোক করা যায়, অধীর হওয়া যায় না, ভেঙে পড়া চলে না।
মিসেস পালিতকে তার নিজের পরিচয়ে অটুট থাকতে হবে। এ এক ভয়ঙ্কর দায়।
এই দায়ের দায়েই তিল তিল করে নিঃস্ব হয়েছেন মিসেস পালিত, নিশ্চিন্ততার সহস্র উপকরণ মজুত থাকতেও দুঃসহ চিন্তার যন্ত্রণায় দিনে দিনে ক্ষয়িত হয়েছেন, অনবরত মিথ্যার জাল বুনে বুনে এক মিথ্যাময়ী হয়ে উঠেছেন, তবু পারেন নি এ দায় মুক্ত হয়ে পালিয়ে যেতে, অন্য নতুন পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে সার্থক করে তুলতে।
সেই কিশোর কাল থেকে একখানি নির্ভেজাল খাঁটি ভালবাসার প্রাণ খুঁজতে খুঁজতে নিজেই তিনি বিলকুল ভেজাল হয়ে গেছেন, এ বোধ যে আসেনি মিসেস পালিতের নিজের মধ্যে তার একমাত্র কারণ ওই বাইরের পরিচয়ের ঠাট।
এ ঠাট বজায় রাখা চাই।
সেই ঠাট বজায় রাখতে কনক নামটাকে এ বাড়ি থেকে মুছে ফেলে নতুন করে হৈ হৈ-তে মেতে উঠলেন মিসেস পালিত। পার্টি দেওয়ায় কমতি হল না, এবং বিষণ্ণ বেদনার কোন ছায়াকে মুখের ধারে কাছে আসতে দিলেন না।
আর কিছুদিন পর থেকেই কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মাতলেন। তার সঙ্গে নিত্য গান শুনতে যাওয়া, অকারণ গল্প।
না, কেউ যেন না বোঝে কনক তার কেউ ছিল।