টেবিল ছেড়ে ওঠেনি তখনও কেউ। আর সোনালী ভাবছিল প্রত্যেক পার্টিতেই পুডিং এত কম কম করে কেন! অথচ সোনালী ওটা কী পছন্দই যে করে! ওর তো মনে হয় টেবিলে যতটা রাখা থাকে, সবটাই ও একা খেয়ে নিতে পারে। তাই আর সবাই যখন পুডিংয়ে চামচ বসায়, বুকের মধ্যে কী একরকম যেন যন্ত্রণা হতে থাকে সোনালীর।
ইচ্ছে করলেই তো এই চমৎকার সুখাদ্যটা একটু বেশি বেশি মজুত রাখা যায়। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তখন ভাবছিল সোনালী, বেশ মনে আছে। আর মনের অগোচর পাপ নেই, কাজেই এটুকুও মনে আছে, ওই গোলমালটা শুনে সকলে যখন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে শব্দ লক্ষ্য করে মিসেস পালিতের শোবার ঘরের দিকে ছুটেছিল, তখন সোনালী একটু দেরি করেছিল। উগ্র কৌতূহল চেপেও শেষ লোকটি পর্যন্ত ঘর থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করেছিল। কারণ, পুডিংয়ের পাত্রটার ভিতরে তখনও খানিকটা লেগেছিল, যেটা চামচে করে তোলা যায় নি।
তবু ওই লোকটা, ওই কনক মিত্তির নামক দুঃসাহসী লোকটা সেদিন কোথায় যেন ট্রেন ধরতে যাবে বলে আগে আগে খেয়ে নিয়েছিল, তাই একটু স্বস্তি করে খেতে পেরেছিল সোনালী। নইলে কনক মিত্তির থাকলেই একটু ইয়ে করে খেতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কী রকম যে ব্যঙ্গ হাসি মাখা মুখে ঠিক সোনালীর খাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে লোকটা।
.
কনক মিত্তির এ বাড়ির কে, সে কথা সোনালী জানে না। ওর মনে আছে প্রথম যখন কাউকে জিজ্ঞেস করেছে সোনালী, মিসেস রাহাকে কি তার পুঁটকি মেয়েকে, নীলাঞ্জনা কি বীথিকাকে, কেমন করে যেন মুচকে হেসেছে ওরা, আর বলেছে–কে কার কে হয়, সে হিসেব দেওয়া কি সোজা!
অথচ, কনক মিত্তিরের সামনে ওরা মুখের চেহারায় বিনয় আর সমীহের আলপনা কেটে তবে কথা বলেছে। বরং কনক মিত্তিরই সকলের দিকে তাকিয়ে থাকত-সোনালীর তো মনে হয় বিশেষ করে তার দিকেই, ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে। নাকি, দৃষ্টিতে নয়, যা কিছু ভঙ্গী ওর ওই বাঁকানো ঠোঁটের কোণাতেই। যে কোণাটায় আজ সকৌতুক বিষণ্ণতার আভাস।
কিন্তু এই তিন বছর সুখে ছিল না লোকটা, ভাবল সোনালী। সুখে থাকলৈ চেহারায় এমন বয়সের ছাপ পড়ে না।
.
ঠিক এই কথাই ভাবছিলেন মিসেস রাহাও।
যিনি নাকি এতক্ষণ ফিসফিস করে সুকান্তর রীত-চরিত্তিরের নিন্দে করছিলেন মিসেস ক্ষেত্রীর কাছে। বলছিলেন, মানুষকে বিশ্বাস করবেন না মিসেস ক্ষেত্ৰী। বরং বিশ্বাস করবেন সাপকে, বাঘকে, বিছেকে। ওই সুকান্ত সিদ্ধান্তর সত্যিকার চেহারা যদি আপনার কাছে খুলে ধরি, ঠিক আপনি সেন্সলেস হয়ে যাবেন। অথচ দেখুন বাইরে কী সুন্দর অমায়িক মার্জিত সভ্য। কিন্তু রুচি? থাক সে কথা। কি বলছেন? আমি আগে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতাম? মিশতাম বৈকি। আমার সরল মন, সহজ ভাবেই সকলকে বন্ধু বলে গ্রহণ করি। আর লোকের স্বরূপ চিনে ফেলি তাতেই ঘনিষ্ঠ ভাবে না মিশলে কী করে টের পেতাম বলুন মিস্টার সিদ্ধান্তর প্রকৃতি কি?
মিসেস ক্ষেত্রী প্রতিবাদে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় সামনের জানলার ওই নীচেটায় লোকটা এসে বসল। যার ভাঁজহীন ট্রাউজার, বোতামবিহীন বুশ কোট, পালিশছাড়া চপ্পল আর হাতে ধরা ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার এটাচি কেসটা ঘরের সমস্ত শৌখিন পরিবেশকে যেন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।
তারপর পরিবেশ সমেত সমস্ত মানুষগুলো পাথর বনে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে।
কনক মিত্তির না?…ওকে কে ডাকল?
…এতদিন ছিল কোথায়?
তারপর থেকেই ভাবছেন মিসেস রাহা, সুখে ছিল না। সুখে থাকতে পারে না। সুখে থাকলে কখনও এই দু-তিন বছরে বুড়িয়ে যায় মানুষ? ভাবছেন–তবু উঁটটি বজায় আছে ষোল আনা। তাকিয়ে আছে দেখ, যেন কোন্ স্বর্গলোক থেকে তুচ্ছ এই মর্ত্যলোককে করুণাকটাক্ষ বিতরণ করছে!
মুশকিল! কাকে জিজ্ঞেস করা যায়, কার নেমন্তন্নে এখানে এসে মাথা গলিয়েছে ও। সেদিনের কথা এক্ষুনি ভুলে গেল কে!
.
মিস্টার রাহা ভাবছিলেন অন্যকথা।
ভাবছিলেন, সত্যিই কি লোকটা সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়ক? ওর মুখ দেখে কি সে কথা বিশ্বাস হয়? অবশ্য ভয়ঙ্কর কাণ্ডের নায়করা প্রায়শই পাকা অভিনেতা হয়, সমস্ত বিদেশী নভেলে তো এই কথাই বলে। তবু ওই বিষণ্ণ কৌতুকমণ্ডিত মুখটায় যেন এমন একটা কিছু রয়েছে, যাতে বিশ্বাস করা শক্ত–লোকটা অপরাধী।
তাছাড়া অপরাধী হলে কোন সাহসের বশে ও আজ এই ভোজসভায় এত লোকের সামনে এসে হাজির হয়েছে? আশ্চর্য, পুলিসের ভয়ও কি নেই লোকটার? কিন্তু নেই-ই বা বলা যায় কি করে? না থাকলে এই তিন বছর নিরুদ্দেশ হয়েছিল কেন? অনুতাপে দগ্ধ হয়ে হয়ে আত্মসমর্পণ করতে এল নাকি আজ?
দেখা যাক শেষ পর্যন্ত।
মনে হচ্ছে আজ মজাটা জমবে ভাল।
.
অশোকের নতুন বৌ এক সময় ইশারায় বরকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, বল কি? সত্যি? এই সেই লোক? কিন্তু আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মুখ দেখে
মুখ দেখে চরিত্র-নির্ণয়ের ক্ষমতা রাখ বুঝি? অশোক হেসে বলে, আমিই যে কোন সাংঘাতিক ঘটনার নায়ক নই, কে বলতে পারে?
নও একথা অন্তত আমি বলি না, বৌ-ও হাসে, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ডাকাতি করে মেয়ে-চুরির নজীর আমার জানা। কিন্তু বল দিকি, ওই কনক মিত্তির না কি ওর সত্যি ব্যাপারটা কি?
আহা, সে তো বলেইছি তোমায়। নতুন আর কি বলব। নতুনের মধ্যে আজ ওঁর আবির্ভাব।