তবে এ সবই গোড়ার দিকের ব্যাপার।
ধীরে ধীরে নর্মদা থেকে মিসেস পালিত হয়ে উঠেছেন তিনি আর ক্রমশ বোধকরি কোনকিছু ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলেন। সবকিছুই মজ্জাগত একটা অভ্যাসের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই অভ্যাসের বশেই দৈবাৎ যদি কোন সন্ধ্যায় কনক না আসত, রাত নটায় টেলিফোনের রিসিভার হাতে তুলে নিতেন মিসেস পালিত, গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলতেন, হা, আমি মিসেস পালিত কথা বলছি। এলে না কেন আজ? কী রকম রেগে গেছি তা বুঝতে পারছ না বুঝি? আচ্ছা, কাল এসো না-বুঝিয়ে ছাড়ব।
ওদিক থেকে আলস্য-বিজড়িত কণ্ঠ ভেসে আসত, পারলাম না আজ। শরীরটা কেমন একটু–না না, তা বলে যেন সক্কালবেলাই তল্লাস নিতে ছুটে এস না। যাব, যথানির্দিষ্ট সময়ে যাব। আশ্চর্য, এই জন্য এত রাত্রে! ও হো হো, তা বটে। আচ্ছা। আচ্ছা ছাড়লাম।
কনকের তাহলে নিজের টেলিফোন আছে! আসলে কনক কি তাহলে অবস্থাপন্ন?
নিজের সম্পর্কে যা কিছু সে বলেছে, তার কোনটাই খাঁটি নয়? তাই তার কথায় আর কাজে সামঞ্জস্যের অভাব?
না, তা নয়। ওর অবস্থা গড়ে দিয়েছেন মিসেস পালিতই। একদা ও যখন এসে বলেছিল ওর সেই রুগ্ন মা মারা গেছেন, আর বন্ধক দেওয়া বাড়িখানাও বিক্রি করতে হচ্ছে মায়ের শ্রাদ্ধ করতে তখন ব্যাকুল হয়ে ওর বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত, যদি কোনরকমে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হয়, তাই দেখতে। বলেছিলেন, আমরাও তো কিনে নিতে পারি কনক, একটা প্রপার্টি হিসেবে। তারপর না হয় তোমাকেই ভাড়াটে রাখব।
ভাড়াটে কথাটা বলে অবশ্য হেসেছিলেন।
কিন্তু কনক কিছুতেই নর্মদাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজী হয় নি। বলেছিল, না, ওসব পুরোনো স্মৃতি ধুয়ে মুছে শেষ হোক। মার জন্যেই বাড়িটা ছাড়তে পারতাম না। এখন আর কি। মুক্ত জীবন। না না, তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারব না, সেই আমার দুঃখের মধ্যে, দৈন্যের মধ্যে।
কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই তো ভালবাসার আসন কনক।
না না। ওটা আমার থিওরি নয়। আমি বুঝি, নেহাৎ গরীব লোকও যখন বিগ্রহের সেবা করে, আয়োজন করে যোড়শোপচারে।
অতএব কনকের বাড়ি মিসেস পালিতের আর দেখা হয় নি, প্রপার্টি হিসেবে কিনে রক্ষা করাও হয়নি। মাতৃ-শ্রাদ্ধের হাঙ্গামা মিটে যাবার পর মুক্তপুরুষ কনক মিত্তিরকে তিনি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন শহরের একটি ভাল হোটেলে। সেখানেই ছিল কনক মিত্তির, অর্থাৎ তিন বছর আগের সেই দিনটি পর্যন্ত ছিল।
কাজেই টেলিফোনও তার করায়ত্ত ছিল।
কিও এত টাকা কি শুধু নিজের খরচের টাকা থেকে জোগানো সম্ভব হত মিসেস পালিতের? কারণ সর্ব তোমার–এভাবে তো কখনো সবকিছু উজাড় করে দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না পালিত সাহেব। তিনি স্ত্রীকে সংসার খরচ দিতেন, মোটা অঙ্কে হাত খরচ দিতেন, আর মাঝে মাঝে বাড়তি খরচ দিতেন, স্ত্রীর পার্টির সাধ বাবদ। সর্বস্ব তুলে দিতেন না। তার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে অতটা পর্যন্ত হয় না।
অতএব মিসেস পালিতকে মাঝে মাঝেই লুকিয়ে বেচতে হত সোনার গহনা, রূপোর বাসন, এটা-ওটা-সেটা।
বড়লোকের স্ত্রীরা এমন অনেক করে থাকেন, কাজেই যেসব দোকানে এ ব্যাপার সংঘটিত হত, সেখানে খুব বেশি আশ্চর্য কেউ হত না, এবং ব্যাপারটা গোপন রাখার ব্যাপারে সততা রক্ষা করেই চলত।
এসব সময় ড্রাইভারকেও সাক্ষী রাখতে চাইতেন না মিসেস পালিত। নিজে শখের ভান করে একা ড্রাইভ করে বেড়াতে বেরোতেন।
না, কনককেও কোনদিন জানতে দেন নি এ টাকার উৎস কোথায়।
তবে ইদানীং একটু মুশকিল হয়েছিল এই পালিত সাহেব নানা উপলক্ষে স্ত্রীকে যে সব অলঙ্কার দিচ্ছিলেন সেগুলো আর সোনার হচ্ছিল না। সবই জড়োয়া। ফ্যাসান আর চাল বেড়ে গিয়েছিল পালিত সাহেবের। বলতেন, সোনা? সোনা সভ্যসমাজে অচল। সোনার গহনা পরবে কেরানীর স্ত্রী। তোমার প্রেস্টিজের জন্যে হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্না এসব দরকার।
কিন্তু নর্মদার দরকার যে তাতে মেটে না। ওসব জিনিস ট করে বিক্রি করা যায় না। বিক্রি করতে নিয়ে যেতে সাহসও হয় না!
কাজেই ইদানীং স্বামীকে বাজারদরের অগ্নিমূল্য আর চাকরবাকরের পুকুরচুরির গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়তি টাকা আদায় করতে হত মিসেস পালিতকে।
কনক মিত্তিরের নৈবেদ্য ঠিকই বজায় থাকত, যে নৈবেদ্য গ্রাস করে দিব্যি এক অদ্ভুত জীবন যাপন করত কনক মিত্তির। না, বিয়ের চিন্তা সে কোনদিন করে নি, নিজের কোন সংসার পাতবার স্বপ্নও দেখে নি। আরামে জীবন কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উচ্চতর কোন লক্ষ্যও দেখা যেত না তার মধ্যে। সে পালিত সাহেবের টাকায় আমীরি চালে থাকত, পালিত সাহেবের চাইতেও দামী পোশাক পরত, আর পালিত সাহেবকেই নস্যাৎ করার ভঙ্গীতে ব্যঙ্গহাসির তীক্ষ্ণ ছুরি ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে তারই বাড়িতে এসে বসে থাকত কায়দা করে।
মিসেস পালিতের অতিথি অভ্যাগতেরা কনক মিত্তিরকে ভিতরে ভিতরে যে দৃষ্টিতে দেখুক, সামনে পরম সমীহের দৃষ্টিতে দেখত।
আর কনক মিত্তির ওদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত, যেন হে ঈশ্বর, কী গতি হবে এদের, এই সব বোকা মুখ গ্রাম্যদের! হ্যাঁ, দৃষ্টিতে এমনি একটি বিশেষ ভঙ্গীই কনক মিত্তিরের আত্মরক্ষার বর্ম ছিল।
মিসেস পালিত মোহিত হতেন ওই দৃষ্টিতে। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ওই দৃষ্টির দিকে। কারণ ওই বিশ্বনস্যাৎ দৃষ্টিটার মধ্য দিয়েই যেন কনক মিত্তিরের চেহারার জৌলুস বাড়ত, আকর্ষণ বাড়ত।