কারণ কনক মিত্তিরই একদিন নিভৃতে হৃদয় উজাড় করে ধরল নর্মদার কাছে। বলল, সেদিন যা বলেছে তার আগাগোড়াই মিথ্যা, বানানো।
ব্যাঙ্কের যে খাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। কারণ তার বাবার মৃত্যু হয়েছে অকস্মাৎ ব্যবসা ফেল হয়ে যাওয়ার দুরন্ত আঘাতে।
যেখানে যা ছিল সবকিছু নীলাম করেও পাওনাদারদের পাওনা সম্পূর্ণ মেটে নি, মায়ের গহনা বিক্রি করে পিতৃঋণ শোধ করতে হয়েছে তাকে।
তুলোর গদি থেকে একেবারে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাকরের পথে নামতে হয়েছে কনককে।
কিন্তু জগতের সামনে তার সেই নিঃস্ব চেহারা দেখাতে মাথা কাটা যায় কনকের। তাই খেয়ে না খেয়ে, ভাল পোশাক পরে বেড়ায় সে। বেড়ায় মুখে এক আভিজাত্যের খোলস এঁটে। বেড়ায় এই আশা নিয়ে যে কোন একদিন যদি সেই হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।
সকলের কাছেই তার অভিনয়, নয় শুধু নর্মদার কাছে। প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে নর্মদা তার কাছে দেখা দিয়েছে দেবীর মূর্তিতে।
বলতে বলতে চুপ করেছিল কনক মিত্তির।
নর্মদা ওর হাত চেপে ধরেছিল।
বলেছিল, আমায় যেমন তোমার বেদনার ভাগ দিলে, তেমনি ভাগ দাও তোমার অভাবের, অসুবিধের।
পাগলামি করতে নেই। বলেছিল কনক।
নর্মদা কিন্তু পাগলের জেদেই বলেছিল, কেন নেই? আমি বড়লোকের বৌ, কত টাকা আমার। হাত-খরচ করতে আলাদা কত টাকা পাই, সে টাকা যদি আমি ভালবেসে তোমায় দিই, দিয়ে ধন্য হই, কেন তাতে বাধা দেবে তুমি? তোমার পায়ে পড়ি কনক, এটুকু আমায় করতে দাও। জীবনের এতগুলো বছর যা খুঁজে বেড়িয়েছি, পাই নি, তুমি দিয়েছ তার আস্বাদ। তুমি তোমার দ্বিধাহীন মনকে মেলে ধরেছ আমার সামনে। এর মূল্যটুকুও অন্তত দিতে দাও আমায়। আর্থিক মূল্য বলে ভুল করো না। এ আমার দিয়ে ধন্য হবার সুখ, তোমাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার সুখ।
এমনি অনেক ভাল ভাল কথা বলেছিল নর্মদা আর হৃদয়কে দিয়েছিল সম্পূর্ণ বিকিয়ে।
কাবেরী তখন দোলনার শিশু।
তারপর নর্মদা আর কনকের সেই অন্তরালবর্তী প্রেম, নানান পরিবেশের দোলায় দুলতে দুলতে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল সে হিসেব কে রেখেছে।
শুধু হেনা ক্রমশ এ বাড়িতে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল।
নর্মদা কোনদিন হেনার অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে যায় নি। বরং হেনার ওই গরীবীয়ানা চালের কঠিন-কঠিন মুখ দেখলেই রাগে হাড় জ্বলে যেত তার বলে, অনুপস্থিতিটা বেশ আরামেরই মনে করত। দৈবাৎ কোনদিন হেনা এলেও অপদস্থ করবার ফিকির খুঁজত।
হয়তো এও অবচেতন মনের একটা জটিল ব্যাখ্যা। যদিও নর্মদা মনে করত জগতের কেউ কনকের প্রতি তার সুগভীর ভালবাসার খবর টের পায় না, এবং টের না পাবার জন্যে, যত পারত সহজ সহজ কথা বলত কনকের সঙ্গে, আর যত সম্ভব সহজ ব্যবহার করত। তবু কোথায় কোনখানে যেন এ সন্দেহ কাঁটার মত ফুটত, হেনা বোধহয় বুঝতে পারে। হেনাটা ভারি চতুর। হেনার দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ। হেনা যত না আসে ততই ভাল।
.
নির্বোধ নর্মদা স্বপ্নেও কি ভাবত দাসী-চাকর মহলে মেমসাহেবের আচার আচরণ একটা খোস গল্পের খোরাক, পালিত সাহেব স্ত্রীর সম্পর্কে আর কোন আশা পোষণ করেন না, আর তার সেই দোলনার শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার বন্ধুকে ভয়ঙ্কর ভালবাসতে বাসতে কোন এক অশুভ মুহূর্ত থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণা করতে শিখেছে।
স্বামীর কাছে দামী হবার জন্যে সেই হাস্যকর চেষ্টার নেশাটা নর্মদার ধীরে ধীরে কখন যে কমে এসেছিল, সেকথা নিজেই জানে না সে।
ক্রমশ আর এক নতুন নেশা জেগেছিল তার, সেটা হচ্ছে কারণে অকারণে বাড়িতে পার্টি দেওয়া। হ্যাঁ, পার্টি শব্দটাই পছন্দ করত নর্মদা। নিতান্ত দু-চারজন বন্ধুকে বাড়িতে ডাকলেও বলত পার্টি দিচ্ছি।
অবশ্য মাঝে মাঝে সমারোহও করত।
আরও একটা কাজ করত সে। সেটা হচ্ছে আক্ষেপ। স্বামী-কন্যা, চাকর-বাকর আর স্বাস্থ্য, এইগুলি হচ্ছে তার আক্ষেপের বস্তু। অনেক সময় এমনও মনে হত, এই আপেক্ষগুলি প্রকাশ করবার জন্যেই বুঝি এত লোককে বাড়িতে ডাকে সে।
হয়তো এও মনস্তত্ত্বের আর এক তত্ত্ব।
হয়তো কোথাও কোনখানে সূক্ষ্ম কোন অপরাধবোধ পীড়িত করত তাকে, হয়তো এই আশঙ্কা মনের গভীরতর স্তর থেকে ঠেলা মারত, আমাকে কেউ কিছু মনে করছে না তো?
যদি কিছু মনে করে? দি নর্মদার নাম নিয়ে হাসাহাসি করে? তার থেকে সর্বদা ওদের সবাইকে পরিপাটি ভোজে পরিতুষ্ট করো, আর নিজে সে কত দুঃখী, কত বেচারী, কত বঞ্চিত, সংসার-জ্বালায় কত জর্জরিত তার ফিরিস্তি দিয়ে দিয়ে আদায় করো সহানুভূতি আর সমবেদনা।
কিন্তু এত কথা ভেবেই কি এসব করত নর্মদা?
বোধহয় নয়। হয়তো এ শুধু অবচেতন মনের কারসাজি।
নইলে নিজেকে তো সে ভালই প্রবোধ দিয়ে রেখেছিল, আমি তো স্বামীর কাছে অবিশ্বাসিনী হচ্ছি না, আমি তো কোন পাপ করছি না।
মানুষ কী তার বন্ধুকে ভালবাসে না? ভালবাসে না দেবতাকে?
স্বামীর সংসার ভাসিয়ে দিয়ে আমি তো কোথাও চলে যাই নি? ওর কি বন্ধু-বান্ধব নেই? ও তাদের সঙ্গে গল্প করে না? আড্ডা দেয় না? তাদের জন্যে আকর্ষণ অনুভব করে না? একদিন ক্লাবে যাওয়া বন্ধ হলে ছটফট করে না?
তবে?
আমি যদি আমার কোন বন্ধুকে ভালবাসি, দোষ কোথায়?
কনক মিত্তির আর পার্টি–এই দুই নেশায় দুই-চক্ষু-অন্ধ নর্মদা ভুলে নিশ্চিন্ত ছিল যে দুনিয়াটা চক্ষুম্মান।