পালিত সাহেব মৃদু হাস্যে বলেন, পৃথিবীকে চিনতে তোমার এখনো বাকী আছে নর্মদা! কে বলতে পারে যাকে সাদরে গাড়ির বুকে আশ্রয় দেব, সে আদর ভরে আমার বুকে ছুরি বসাবে কি না।
বলেছিলেন, কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু যতই চতুর হোন পালিত সাহেব, তিনি কি এ আশঙ্কা করেছিলেন, ততক্ষণে তার ঘরণী পথচারীর জন্য তার হৃদয়-দুয়ার খুলে ধরেছে!
গাড়িতে সারাক্ষণ কথা বলল কনক মিত্তির, এবং সেই কথার মধ্যে এই কথাটাই পরিস্ফুট হল, রীতিমত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে সে, তবে সম্প্রতি বাপ হঠাৎ মারা গিয়ে বেচারা একটু অসুবিধেয় পড়েছে। কারণ তিনি যে তার ব্যাঙ্কের খাতা, ইনসিওরের কাগজপত্র, বহুবিধ কোম্পানির শেয়ার সম্পর্কিত দলিল ইত্যাদি কোথায় রেখে গেছেন, সেটা ধরা যাচ্ছে না। আসলে বড় বেশি সাবধানী ছিলেন তিনি।
অ্যাটর্নি বলছেন, সন্দেহবাতিক লোকেদের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে এই অবস্থা ঘটে। এমন কি শেষ অবধি লেপের চালি, ছাতের বরগার খাঁজ অথবা দেয়ালের গহ্বরেও হদিশ মেলে।
অন্য পক্ষে, অন্য কোনও অ্যাটর্নির সঙ্গেও যোগসাজস থাকতে পারে। অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে অ্যাটর্নি এই কথাই বলেছিলেন, ডাক্তার আর উকিল ব্যারিস্টারের কাছে কথা লুকোনোর মত। বোকামী আর কি আছে?
আপনার মাও জানতেন না?
প্রশ্ন করে বসেছিল নর্মদা, ব্যগ্রকণ্ঠে।
কনক মিত্তির সামনের সীট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, কিছু না। বাবা মাকে শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের মত স্নেহ আর মমতা দিয়ে আরামে রেখে গেছেন, কখনো চিন্তা বা পরামর্শের ভাগ দেন নি।
ঠিক আমার মত। মনে মনে বলে উঠেছিল নর্মদা।
আর উচ্চারণে বলেছিল, তা হলে এখন কি হবে আপনার?
দেখা যাক। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার আমার দূর সম্পর্কে জ্যাঠামশাই হন, মনে হয় তিনি কিছু জানেন। তাঁকেই ধরাধরি করছি। ভয় এই, জগতে কাউকে বিশ্বাস করা শক্ত।
তা যা বলেছেন। এতক্ষণে একটি কথা বলেন পালিত সাহেব।
আর এরপর থেকেই চুপ মেরে যায় কনক মিত্তির, নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গাড়ি থেকে নেমে নমস্কার করে চলে যায়।
.
বাড়ি গিয়ে ফেটে পড়ে নর্মদা।
ভদ্রলোককে ওভাবে অপদস্থ করলে কেন?
পালিত সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, সে কি, সযত্নে গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিলাম, অপদস্থ করলাম কখন?
করলে না? কি বলে বললে, পকেটে ছোরা আছে?
কী মুশকিল! আছে, এ কথা কখন বললাম? বললাম যে, থাকতে পারে।
ও একই কথা। তাছাড়া ভদ্রলোক যখন নিজের দুঃখের কথা বলছিল, একবারও একটু সহানুভূতি দেখালে না–
পালিত সাহেব হেসে উঠে বললেন, তাই নাকি, দেখাইনি বুঝি? তা, আমার ত্রুটিটা তুমি। পূরণ করে ফেললেই পারতে।
সেটা এমন কিছু শোভন হত না। কিন্তু আশ্চর্য, দরদ বস্তুটা তোমার মধ্যে এত কম!
পালিত সাহেব ফের হাসলেন। বললেন, খুবই স্বাভাবিক; কচি ডাবের মধ্যে জলের যে আধিক্য, ঝুনো নারকেলে তার অভাব। একটা লোক বিনা ভাড়ায় গাড়ি চড়তে পেয়ে যদি বিবেকের দংশনে কাতর হয়ে বেশ মজাদার কিছু গল্প শুনিয়ে দাম উসুল করতে চায়, তাতে কৌতুক অনুভব করতে পারি, দরদ জিনিসটাকে বাজে খরচ করব কেন?
তুমি তো ও জিনিসটা কোনখানেই বাজে খরচ করতে রাজী নও। কিন্তু গল্প কথাটার অর্থ কি?
গল্প কথাটার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বানানো কাহিনী।
তার মানে ভদ্রলোক যা বললেন সব মিথ্যে?
বিলকুল।
এ সন্দেহের কারণ?
হাস্যকর কথা চিরদিনই অবিশ্বাস্য। আমি তো কষ্টে হাসি চাপছিলাম, ওর ওই ব্যাঙ্কের খাতা খুঁজে না পাওয়ার গল্পের সময়।
ওটা কি এতই অসম্ভব?
আমার তো তাই মনে হল। মা পর্যন্ত জানেন না। তাজ্জব!
হঠাৎ নর্মদা বিছানায় এলিয়ে পড়া শরীরকে খাড়া করে উঠে বসে বলে, তাজ্জব! কিন্তু কেন বল তো? ধর আজ রাত্রে তুমি যদি হঠাৎ হার্টফেল কর, আমার অবস্থা তার থেকে কিছু উঁচুদরের হবে?
কথা শুরু করলে শেষ করা ছাড়া গতি থাকে না, তাই শেষ করতে হল। আর শেষ করেই নর্মদা প্রায় লজ্জায় অধোবদন হল। এমন রূঢ় কথা বলে বসবার ইচ্ছে কি ছিল তার?
পালিত সাহেব কিন্তু রাগ দুঃখ অভিমান কিছুই করলেন না। শুধু মিনিট খানেক চুপ করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, তা বটে। খুব জুৎসই কথাটা বলেছ, সত্যি। দেখ, খেয়াল নেই আমি নিজেই কত বেহুঁশ। একেই বলে প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। লোকটার সঙ্গে আর যদি দেখা হয়, আমার বিশ্বাস হবেই, মার্জনা চেয়ে নিতে হবে।
নর্মদা লজ্জা কাটাতে জোর করে হেসে উঠে বলেছিল, হা, রোজ সে তোমার গাড়িতে চড়াও হতে আসবে।
পালিত সাহেব বলেছিলেন, গাড়িতে না হোক বাড়িতে হতে পারে। গাড়িটা চলন্ত, কিন্তু বাড়িটা তো অচল।
পালিত সাহেবের এ ভবিষ্যৎবাণী অবশ্য সেদিন বিশ্বাস করে নি নর্মদা, ভেবেছিল, হ্যাঁ তাই আর কি। জীবনে আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে।
কিন্তু দিনকয়েক পরেই লজ্জায় পুলকে বিস্ময়ে আনন্দে স্বীকার করতে হল নর্মদাকে, পালিত সাহেবের সংসার-জ্ঞান নর্মদার থেকে অনেক বেশি। নর্মদা তো স্বপ্নেও আশা করে নি, ভদ্রলোক আবার একদিন কষ্ট করে বাড়ি বয়ে আসবেন পুনশ্চ ধন্যবাদ দিতে।
কিন্তু এল সে।
তার নাম জানতে পারলেন নর্মদা। আর কয়েকদিন পরে এও জানলেন, পালিত সাহেবের শুধু যে সাংসারিক জ্ঞানই প্রবল, তা নয়। মনুষ্য চরিত্রেও প্রবল জ্ঞান।