কিন্তু পালিত সাহেব ইস্পাতের মানুষ। তবু নর্মদা চেষ্টা করে। আর এই চেষ্টাই দেখা দেয় কৃত্রিম কৌশলের মূর্তিতে।
হয়তো ঠিক পালিত সাহেবের অফিস বেরোবার মুহূর্তে হঠাৎ নর্মদার হার্টের কষ্ট শুরু হয়। কাতর নর্মদা কাঁদো কাঁদো অস্ফুট গলায় বলে, আবার মনে হচ্ছে এক্ষুনি হার্টফেল করব আমি।
পালিত সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে নেন, পারিবারিক চিকিৎসককে তন্মুহুর্তে চলে আসতে বলেন এবং ফোনেই নির্দেশ দেন–তেমন দরকার বুঝলে ডাক্তার যেন তার অফিসে ফোন করেন, কারণ তার না বেরোলেই নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশও দেন ডাক্তারকে, ডাক্তার যদি বোঝেন অন্য কোনও স্পেশালিস্টকেও কল দিতে পারেন।
সে কৌশল ব্যর্থ হয়।
তবে আবার কোন একদিন, পালিত সাহেব যখন হয়তো বাড়িতেই কোন এজেন্ট বা অ্যাটর্নি অথবা কোন পার্টনারের সঙ্গে বিশেষ আলোচনায় ব্যস্ত, চাকর গিয়ে খবর দেয়, মেমসাহেব বাথরুমে পড়ে গেছেন, কোন রকমে ঘরে এনে শোওয়ানো হয়েছে। সাহেব অবিলম্বে না গেলে
সাহেবের উপস্থিত সঙ্গীরা হাঁ হাঁ করে উঠেছেন, আলোচনা বন্ধ করে দিতে বলেছেন, এবং সাহেবও তৎপর হয়ে ভিতরে ঢুকে এসে ডাক্তারকে ফোন করতে করতে বারংবার প্রশ্ন করেছেন, হাড় ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে না তো?
এহেন সময় মাঝে মাঝে নর্মদা অজ্ঞানও হয়ে গেছে, কাজেই কথার উত্তর পাওয়া যায় নি। পালিত সাহেব নর্মদার খাস ঝিকে মুখে-চোখে জল দেবার নির্দেশ দিয়ে ফের বাইরে গিয়ে বসেছেন। ওরা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছেন, চলে এলেন আপনি? বেশী কিছু আঘাত পাননি তো!
পালিত মৃদু গম্ভীর হাস্যে বলেছেন, নেহাৎ কম আঘাত পেয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কষ্ট দেবে।
সে কি! সে কী! তাহলে এখন আলোচনা বন্ধ থাক, আপনি বরং
পালিত সাহেব অমায়িক হাস্যে বলেছেন, আমি আর থেকে কি করব? আমি তো ডাক্তার নই? ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, এসে দেখুন যদি এক্স-রে করার প্রয়োজন বোঝেন।
.
ডাক্তারের সামনেও সেই কথাই বলেছেন পালিত সাহেব, পরম ব্যগ্রতা দেখিয়ে।
এক্স-রে করার দরকার হয় তো
ডাক্তার সবিনয় হাস্যে বলেছেন, দরকার হলে আপনাকে বলতে হবে কেন, আমিই বলব।
মুখে একথা বলেছেন, আর মনে মনে বলেছেন, বুড়োবয়সে বিয়ে করে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে লোকটার। স্ত্রৈণ আর কাকে বলে! আহ্লাদী গিন্নীর আহ্বাদেপনাটুকুও বোঝবার ক্ষমতা নেই।
ক্ষমতা যে নেই, সেটাই সাড়ম্বরে প্রকাশ করেছেন পালিত সাহেব তুচ্ছ ব্যাপারে চিকিৎসায় রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে। কোনদিন অবিশ্বাসের ছায়ামাত্র উঁকি মারতে দেখা যায়নি তাঁর চোখের কোণে। বার বার সাবধানে থাকবার অনুরোধ জানিয়েছেন, নিটুট বিশ্রাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, উচিত মত সেবার জন্য দাসীর উপর আবার নার্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির দিকে চোখ ফেলে বলেছেন, আমার তো সময় হয়ে গেল, চলছি তাহলে।
এ সময় হওয়ার জন্যে শুধু অফিসের কাজই একমাত্র নয়। সন্ধ্যায় ক্লাবে যাওয়া, অন্যান্য কোম্পানীর পার্টিতে যাওয়া ইত্যাদি বহুবিধ যে কাজ আছে পালিত সাহেবের, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তার উদয়াস্ত দিনগুলো, তার কোনটাই ব্যাহত হয় না।
আচ্ছা চলছি।-বলে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী ঠিক চলে যান সাহেব। অবশ্য তেমন অবস্থায় যেখানেই যান, সেখান থেকে মাঝে একবার ফোন করে স্ত্রীর কুশলবার্তা নিতে ত্রুটি করেন না।
সর্বত্রই লোকে এই অনুমান করে, বুড়োবয়সে বিয়ে করে গোল্লায় গেছে লোকটা। লোকলজ্জাও নেই।
বন্ধুরা ঠাট্টা করেছে।
পালিত সস্নেহ হাস্যে বলেছেন, আহা, বেচারী বড্ড একলা। বাড়িতে তো আর কেউ নেই।
ফোন করলে নর্মদা কোনদিন কথা বলেছে, কোনদিন রাগ করে কথা বলেনি। নার্সকে দিয়ে বলিয়েছে, উনি ঘুমোচ্ছন।
যেদিন কথা বলেছে, তীব্র অভিমানে বলেছে, শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি এসে যেন আমার মরামুখ দেখ।
পালিত সাহেব লাইনের ওধারে হো হো করে হেসে উঠে বলেছেন, ন্যটি গার্ল!
.
এক একদিন এমন মনে হয়েছে নর্মদার, সাহেব ঠিক যে মুহূর্তে গাড়িতে উঠতে যাবেন, সেই মহা-মুহূর্তটি তাক করে সে একবার দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দেখবে, তার যাওয়া আটকায় কি না। কিন্তু অতদূর আর সাহস হয়ে ওঠেনি। কাজেই হার্টের কষ্ট, মাথার যন্ত্রণা, সারা শরীরের মধ্যে কী রকম যেন করা আর দুর্বলতায় মূৰ্ছা যাওয়া, এই কটা পরিচিত ঘরের মধ্য দিয়েই তাঁতের মাকু আনাগোনা করতে থাকে।
কিন্তু আশ্চর্য যে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না পালিত সাহেবের।
কাজেই অভিযোগ করবার কোথাও কিছু নেই।
এমনি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কিছুদিন কাটাবার পর কাবেরীর জন্মসূচনা দেখা দিল। আর নর্মদা আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তবে এইবার বুঝি দেখা দেবে মস্ত একটা ওলট পালট। স্বামীর কাছে মহামূল্যবান হয়ে উঠবে সে। কিন্তু এমনি ভাগ্য নর্মদার যে তার নিজের স্বাস্থ্যই তার সঙ্গে বাদ সাধল। যে সময় সাধারণত মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে সময় নর্মদার রূপ আর স্বাস্থ্য যেন বেড়ে গেল।
কাকী একদিন আচার আর ভাজা খাবারের সম্ভার নিয়ে দেখা করতে এসে ভবিষ্যৎবাণী করে গেলেন, নির্ঘাৎ মেয়ে হবে। রূপে বোঝায় বেটা বেটি, মেয়ের ছিরি পরিপাটি।