একেবারে কুমীরের কামড়? কেমন? ভদ্রলোক শ্লেষের সুরে বলেন।
আর তার উত্তরে এবার বিরামের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যা বলেছ ভাই। প্রায় তাই। অথচ ভদ্রতার দায়ে না করতেও পারা যায় না। উনি কবিত্ব করতে বাংলা দেশের পল্লীশোভা দেখে বেড়াবেন, আর আমার প্রাণান্ত।
না, বিরামের কোন লাভ হয় নি ওই বোকাটে কৈফিয়টুকু দিয়ে, কারণ দুনিয়াটা বোকা নয়। সেখানে ভাতই খায় সবাই, ঘাসের বীচি নয়। বিরামের কৈফিয়তে ভদ্রলোক একটু বাঁকা হাসি হেসে শুধু বলেছিলেন, মহিলাটি বেছে বেছে তোমার স্কন্ধেই ভর করলেন, এটা অবশ্য একটা আশ্চর্য রহস্য। কাজেই লাভ কিছু হল না বিরামের। কিন্তু যে বিরাট একটা লোকসান ঘটে গেল আর এক জায়গায়, তার আর তুলনা হয় না।
বিরাম আর কোন উত্তর দিয়েছিল কি না সে কথা জানে না নর্মদা। ওর শুধু মনে আছে, চোখটা অবিরত ঝাপসা হয়ে আসার দরুন বাড়ি ফিরে আসতে সেদিন ভারী অসুবিধে হয়েছিল।
ভায়রাভাইয়ের কবলমুক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর রকম দ্রুত চলে এসেও বিরাম নর্মদাকে দেখতে পায় নি। শুধু ফুটপাথের একধারে কমুঠো বুনো ফুল আর গোছা কতক নতুন ধানের শীষ দেখে বুকটা হিম হিম হয়ে গিয়েছিল তার!
সেই হিম হিম বুক নিয়েই তখুনি নর্মদাদের বাড়ি গেল বিরাম, কিন্তু দোতলা থেকে কাকা বজ্রকণ্ঠে বললেন, ফেরেনি এখনো।
.
পরদিন আবার গেল অসময়ে। চাকরকে বলল, দিদিমণিকে ডেকে দিতে। চাকর মুখটা কালিপনা করে চলে গেল। আর তারপর দোতলা থেকে যিনি নেমে এলেন, তিনি নর্মদা নয়, তার কাকী।
কাকী গম্ভীর মুখে মৃদু কণ্ঠে বললেন, আপনিই বোধকরি বিরাম বক্সী?
বিরাম থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমিও আন্দাজ করছিলাম। যাক আপনার জানা দরকার তাই জানাচ্ছি, নর্মদা কাল রাত্রে মারা গেছে।
বিরাম কেঁদে উঠল না, চেঁচিয়ে উঠল না, শুধু অবোধ্য বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, কী বলছেন!
বাংলা ভাষাটা ঠিকমত জানা নেই বুঝি? মারা যাওয়া কথার মানে জানেন না? ইংরিজি বললে বুঝতে পারবেন বোধহয়। কাল রাত্রে সে সুইসাইড করেছে। এবার বুঝতে পেরেছেন? আপনি এবার আসতে পারেন।
এবার বিরাম বক্সী রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠেছিল, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না।
কাকী মুখ আরও ভীষণ করে বলেছিলেন, বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে। আমার জানানোর কথা জানিয়ে দিলাম। তবে এটুকু মনে রাখবেন, এ বয়সের মেয়েরা আত্মহত্যা করে বসলে পুলিশ কারণ আবিষ্কার করতে আগে তাদের প্রণয়ীকে সন্দেহ করে।
এ হেন কুলিশকঠোর স্পষ্ট কথার পর আর কে দাঁড়াতে পারে তার সামনা সামনি?
বিরামও পারেনি। চলে এসেছিল।
অবিশ্বাস্য কথাটা বিশ্বাস অবশ্য করেনি সে, তবু বুকটা কাঁপছিল বৈকি। কী জানি যদি সত্যি হয়, যা আবেগপ্রবণ মেয়ে!
অথচ কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারে না বিরাম। গত সন্ধ্যায় নর্মদাকে সেই একা এগিয়ে যেতে বলাটাই কি তাহলে এত অভিমানের কারণ হল? এমন কি অপরাধ সেটা?
.
কাকী ফের দোতলায় উঠে আসতেই নর্মদা রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি বলল?
বলবে আবার কি? মুখটা পেঁচার মত করে চলে গেল।
বিশ্বাস করল?
বিশ্বাস যে করেনি, সেটুকু বোঝবার মত বুদ্ধি কাকীর আছে, কিন্তু তিনি একটু প্যাঁচ খেললেন। বললেন, প্রথমে অবিশ্বাস দেখিয়েছিল, তারপর বলার গুণে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লাম।
তাহলে করল বিশ্বাস?
করল বৈকি।
চেঁচিয়ে উঠল না, কাঁদল না, কিছু করল না?
কাকী মুখখানি অমায়িক করে বললেন, সে হয়ত বাড়ি গিয়ে কাঁদবে, চেঁচাবে! ভদ্রলোকের বাড়িতে তাই কি পারে?
না না, বাড়ি গিয়েও কিছু করবে না। চেঁচিয়ে উঠল নর্মদা নিজেই। বলল, বাড়ি গিয়ে ও ওর সেই ঘটির মতন বৌয়ের কাছে হেসে হেসে গল্প করবে, একটা দামী মেয়ে কী ভাবে তার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।
কাকী আরও অমায়িক কণ্ঠে বললেন, তা বলা যায় না, হতেও পারে। পুরুষ মানুষ বৈ তো নয়।
পুরুষ মানুষদের দ্বারা যে সব রকম অমানুষিকতাই সম্ভব, এই তথ্যটাই পরিবেশিত হল কাকীর কণ্ঠস্বরে।
তুমি এখন এ ঘর থেকে যাও, নর্মদা বলল, আর কাকাকে বলগে, ওঁর সেই কে কোথায় একটা লক্ষ্মীছাড়া পাত্তর ছিল, তার সঙ্গে কথার ঠিক করে ফেলতে।
কাকী গিয়ে তৎক্ষণাই বললেন।
কিন্তু কাকা উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এমন লক্ষ্মীছাড়া কেউ কোথাও নেই যে ওই ধিঙ্গী অবতারের জন্যে পিত্যেস করে বসে থাকবে। তার বিয়ে হয়ে গেছে।
কাকী চুপ চুপ করে থামালেন। বললেন, যদি বা মেজাজ একটু বদলেছে, তুমি আর বিগড়ে দিও না। এই মোহাড়ায় বিয়েটা যে করে তোক দিয়ে ফেল, নইলে ও মেয়ে আবার কেলেঙ্কারী করে বেড়াবে।
ও মেয়ে বিয়ে হলেও তাই করে বেড়াবে।
কাকী মুচকে হেসে বললেন, তখন তো আর আমরা ভুগতে যাব না। কি করবে, বিধাতা পুরুষ তোমার ভাইঝির ভিতরে প্রেমটা একটু অধিক পরিমাণে দিয়ে ফেলেছেন, ওর দোষ কি?
কাকা জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলেন।
কাকী অবশ্য ভয় পেলেন না এতে, বললেন, তা সেদিন যে বলছিলে, তোমাদের কোম্পানির কোন্ ডিরেক্টর নাকি বিয়ে করবে–বিদূষী সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে বলে রব উঠেছে? আমাদের সঙ্গে জাতে মিলবে না?
কাকা অবাক হয়ে বললেন, মিস্টার পালিতের কথা বলছ?
পালিত বুঝি? তা অত জানতাম না। তাহলে তো জাতে আটকাচ্ছে না। দেখ না চেষ্টা করে, নমির মত সুন্দর মেয়ে তো আর ঘরে ঘরে নেই।