বন্ধু-বান্ধবের কাছে নর্মদা তার নিজস্ব চিন্তাধারা আর অভিজ্ঞতার গল্প করে বেড়াত, এই ছিল তার একটা পাগলামী। হয়তো সে মানুষকে শ্রদ্ধা করত, তাই মানুষকে অবজ্ঞা করে যা খুশি করতে না চেয়ে, তাদের বোঝাতে চাইত। চাইত তাদের সহানুভূতি, সমর্থন।
কিন্তু জগতে কে এই বিশ্বস্ততার মূল্য দেয়?
কে বুঝতে চায় সরল চিত্তের সৃষ্টিছাড়া মতবাদ?
কাজেই কেউ বা তাকে ন্যাকা বিশেষণে বিভূষিত করত, কেউ বলত পাকা শয়তান, ইচ্ছে করে ন্যাকামি করে। যে মেয়ে লেখাপড়ায় প্রথম সারিতে থাকে, গানে বাজনায় খেলায়-ধূলায় রীতিমত চটপটে চৌকস, সে যে যেখানে সেখানে কেবল তার হৃদয়তথ্য উদ্ঘাটন করে বেড়ায়, এটা ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি ছাড়া আর কি?
নর্মদা যে বন্ধুদের বিশ্বাস করতে চাইত, একথা কেউ বিশ্বাস করত না।
বন্ধুরা বলত, সে লোকটাকেও বলিহারী দিই। বিবাহিতা স্ত্রী থাকতে–এ তো দস্তুরমত চরিত্রহীনতা।
নর্মদা বলত, সেই বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে যদি মনের মিল না হয়, তার সঙ্গে কেবলমাত্র দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে ঘর-সংসার চালিয়ে যাওয়াটাই কি মহৎ চরিত্রের স্বাক্ষর? আমি তো বলি, সেও একরকমের চরিত্রহীনতা।
এরা বলত, ওসব কথা বস্তাপচা। ঢের শুনেছে লোকে। তুমি এমন কিছু নতুন থিওরি আমদানী করছ না। সোজা কথা হচ্ছে, সমাজের মুখ চাইতে হবে, আইনের দায় মানতে হবে।
নর্মদা বলত, তা বটে! শুধু চাইতে হবে না মানুষের মুখ, মানতে হবে না হৃদয়-সত্যের দায়!
লেখাপড়া শিখেছিল, বই পড়ত দেদার, ভাল ভাল কথা বলতে পারত সহজেই।
শুধু বুঝতে পারত না, হৃদয়-সত্যের দায় পোহানোর ঝক্কি কতখানি।
বুঝতে পারত না সবাইয়ের সাধ্য নেই সে ঝক্কি সামলাবার। সাধ্য নেই, তাই মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, হৃদয়-দ্বন্দ্ব আর সমাজ-দ্বন্দ্ব সব কিছুকে লোকচক্ষু নামক পাকযন্ত্রে চড়িয়ে একটা পাঁচন তৈরি করে করে গিলে জীবন-জ্বরের শান্তি খোঁজে।
২. পাকা জহুরী
হয়তো সেই লাইব্রেরিয়ান বিরাম বক্সী নর্মদার অকপট হৃদয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করেছিল, হয়তো বুদ্ধি আর সরলতা এই দুটো বিপরীত বস্তুর একত্র সমাবেশ দেখে সে কিছুটা অভিভূত হয়েছিল, হয়তো বা তার মূল্যহীন একঘেয়ে জীবনের মাঝখানে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে-এসে-পড়া এই ঐশ্বর্যের লোভ সে সামলাতে পারে নি, তাই বেশ কতকগুলো দিন সে ওই নতুন সমুদ্রের তরঙ্গে ওঠা-পড়া করেছে, মাঝে মাঝে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে গেছে তীর ছাড়িয়ে, কিন্তু একেবারে নোঙর ছাড়লে তার চলবে কেন? লোকচক্ষুর সামনে নিজেকে খাড়া রাখবার চেষ্টা না করলেই বা টিকবে কি করে?
তাই এক ছুটির দিন, সারাদিন দুজনে কোথায় না কোথায় ঘুরে, ছোট রেলে চড়ে এক অখ্যাত গ্রামে বেড়িয়ে, একরাশ বুনো ফুল মাথায় গুঁজে, হাত ভর্তি নতুন ধানের শীষ আর মন ভর্তি আনন্দের আবেগ নিয়ে ছলছলিয়ে এসে ওর সঙ্গে যখন স্টেশনে নামল নর্মদা, তখন পেল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত।
যে আঘাতে তার সোনারঙা পৃথিবী হঠাৎ যেন হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাচের বাসনের মত গুঁড়ো হয়ে গেল।
এর চাইতে কেন ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হল না তার, কেন মাথায় নেমে এল না ভারী কোন লোহার বীম। ভাবল নর্মদা, তাহলে সোনারঙা পৃথিবীর কোলে পরিপূর্ণ আনন্দের পরম প্রসাদ নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারত সে।
অথচ আঘাত যে দিল সে জানতেও পারল না আঘাত হেনেছে সে। জানতে পারল না, কারণ সে শুধু তার সামাজিক চেহারাটা লোকচক্ষে অবিকৃত রাখতে চেয়েছিল, এর বেশি আর কিছু না। ভয়ানক একটা পাষণ্ডজনোচিত কাজ কিছু করেনি। মানুষ মাত্রেই এইরকম অবস্থায় পড়লে এরকম করে থাকে।
নর্মদা আর বিরাম, এদের পাশাপাশি দেখতে দেখতে লোকের চোখ ক্ষয়ে গেছে। ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে, পায়ে হাঁটায়, কিসে নয়? আর কোথায় নয়? হাতের কাছে যতগুলো বেড়াবার ঠাই আছে, বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর, দমদম, ডায়মণ্ড হারবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বোটানিক, আর সিনেমা জলসা, এসব পুরোনো করে ওরা ছুটির দিনে পাড়াগাঁ বেড়াতে শুরু করেছে। এবং বিরাম যদিও ভেবে নিশ্চিন্ত আছে চেনা লোকেরা ওদের দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু চেনা লোকদের ওই যা বললাম-দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে।
কাজেই সেদিন ওই ঢাকুরিয়া না গড়িয়া কোথা থেকে যেন ফেরার সময় দুজনে যখন পাশাপাশি আসছে গল্প করতে করতে, আনন্দের আবীর মুখে মেখে, তখন বিরামের এক ভায়রাভাই দূর থেকে দেখতে পেল। দেখে চমকে উঠল না অবশ্য। শুধু বিরক্তিতে ভুরুটা কোঁচকালো। কিছুই হত না যদি হঠাৎ বিরামের চোখে ওই ভ্রুকুঞ্চিত মুখটি না পড়ত। কিন্তু পড়ল।
আর বিরাম ভাবল বুঝি এই প্রথম ও ধরা পড়ল লোকচক্ষে। তাও আবার সে চোখ বন্ধুজাতীয়ের নয়, সংসারের সবসেরা প্রতিদ্বন্দ্বী স্ত্রীর ভগ্নিপতির। ভয়ে দিশেহারা হল বিরাম। মৃদু অথচ দ্রুত উচ্চারণে নর্মদাকে একটু দূরত্বের ব্যবধান রেখে এগিয়ে যেতে বলে, যেন নিঃসঙ্গ চলেছে এই ভাবে ভায়রাভাইয়ের কাছে সহাস্যে গিয়ে দাঁড়াল।
আর তারপরই এল সেই মারাত্মক আঘাত।
নর্মদা এগিয়ে গিয়েও শুনতে পেল বিরামের কণ্ঠনিঃসৃত সেই কটি শব্দ। যে কষ্ঠ বহু অলৌকিক মুহূর্তে, বহু অপূর্ব ক্ষণে নর্মদার কানে স্বর্গের সুরঝঙ্কার বয়ে এনেছে, সেই কণ্ঠ নিয়ে এল একটি অগ্নিগর্ভ বাজ। নর্মদা শুনল, বোধ করি ভায়রাভাইয়ের কোনও তীক্ষ্ণ মন্তব্যে বিদ্ধ বিরাম কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর এনে উচ্চারণ করছে, আর বলল না ভাই। মেয়েটা আমার জীবন একেবারে মহানিশা করে তুলেছে। অ্যাভয়েড় করতেও পারা যায় না, এমন নাছোড়