হ্যাংলামি ছাড়া আর কি বলবে? লোকটা যে বিবাহিত!
সহপাঠিনীরা, মানে আমরা যখন তাকে ঘেন্না দিয়ে বলছি, ছি ছি, শেষকালে কি না একটা এঁটো পাত! আর লোকটাই বা কী চরিত্র, তা ভাব।
নর্মদা একটি মধুর স্বর্গীয় হাসি হেসে, দেশের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত অধ্যাপক কবি সুধীজনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। যাঁরা জলজ্যান্ত স্ত্রী বর্তমান থাকতে, নবীনা দ্বিতীয়ার প্রেমে লোকলজ্জা আহুতি দিয়ে দিব্যি খোসমেজাজে নতুন সংসার করছেন।
আমরা বলতাম, ওটা মানুষের দুর্বলতার দৃষ্টান্ত, আদর্শের দৃষ্টান্ত নয়।
নর্মদা বলত, আদর্শ হচ্ছে ঠাকুর ঘরের জিনিস, তাকে বেদীতে স্থাপন করে ফুল চন্দনে পূজো করা চলে। জীবন সার্থক করবার জন্যে যা চাই সে হচ্ছে রক্তমাংসের মানুষ, দোষে গুণে ভুলে দুর্বলতায় সুন্দর মানুষ। ও যে বিবাহিত, সে একটা দৈবাতের ঘটনা মাত্র। ওর যে স্ত্রী আছে, সেটা বিধাতার একটা হাস্যকর কৌতুক, ওর জন্যে আমি আর আমার জন্যে ও পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। সেটাই শেষ কথা।
কিন্তু এসব উচ্চাঙ্গের শেষ কথা কে শুনছে কান পেতে? লোকে বহিদৃশ্যটাই দেখে। আর সেই দেখার ফলশ্রুতিতে কাকার কান পাতা দায় হয়।
তাই কাকা যখন শুনলেন, ভাইঝি গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করেছে–এ বিয়ে হতে পারে না, তখন কাকা সমস্ত গাম্ভীর্য ভুলে তার আদিম পিতামহের ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে আর লাফিয়ে উঠে বললেন, হতে পারে না, এ কথাটা এতদিন বলতে পারনি? আমি যে এই হন্যে হয়ে পাত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, সে খবর জানতে না তুমি?
জানবার দরকার বুঝিনি। কারণ আপনিও আমাকে জিগ্যেস করবার দরকার বোঝেননি।
ও হ্যাঁ, অফিসিয়ালি জিগ্যেস করা হয়নি বটে। কিন্তু তুমি যে আয়োজনটা টের পাচ্ছ, অথচ না করছ প্রতিরোধ, না করছ প্রতিবাদ, এটাকেই সম্মতি বলে ধরে নেওয়া কি খুব ভুল হয়েছে?
আমার ধারণায় ভুল হয়েছে।
ঠিক আছে। বাধ্য হয়েই বুঝতে হবে আমায়, তুমি আর আমার অভিভাবকত্বের অধীনে থাকতে চাও না। বেশ, সেই মত ব্যবস্থাই করব। হিসেবমত বাড়ির অর্ধাংশ তোমার, সেটা আইনসিদ্ধ করে তোমার সঙ্গে সংস্রব মুছে ফেলতে চাই।
বীথিকার বর বাধা দিয়ে বলে, ওদের ঘরের কথা তুমি জানলে কি করে?
যে করে বিশ্ব-সংসারে একে অন্যের ঘরের কথা জানে। কথা এ-কান থেকে ও-কান, পাঁচ কান থেকে দশ কান হেঁটে বেড়ায় জান না? আবার কথা শুধু কানেই হাঁটে না, বাতাসেও হাঁটে। তার উপর আবার এমন মজাদার কথা জানতে আর বাকী ছিল না কারুর।
তা, বীথিকার কথা অত্যুক্তি নয়। ওদের ধারে কাছে জানতে আর বাকী ছিল না কারুর নর্মদার সেই কাহিনী। আমরাও জেনেছিলাম।
তবে এদিকে মজা এই, আলাদা করে দেব, সম্পর্ক মুছে ফেলব-বলে কাকা যতই চোখ রাঙান, মূল কথা হচ্ছে, বাড়ির অর্ধাংশ নর্মদার নয়, সম্পূর্ণাংশই তার। কারণ বাড়িটা কাকাদের পৈত্রিক নয়, তৈরি হয়েছিল নর্মদার বাবার সম্পূর্ণ একার স্বাপার্জিত অর্থে এবং দলিল আছে নর্মদার মায়ের নামে। কিন্তু এসব রহস্য নর্মদার অজানা, কারণ মা-বাপ দুজনেই মরেছেন তার নিতান্ত বাল্যে। হিতৈষী আত্মীয়স্বজন যদি বা কখনও তার কানে তুলতে এসেছেন, নর্মদা কানে তোলেনি! বলেছে, যা বুঝবেন কাকা বুঝবেন।
তা কাকা এই বুঝলেন, রাগ করে আখের খুইয়ে কাজ নেই, কেঁচো খুঁড়তে সাপ খুঁড়ে দরকার নেই।
একখানা ঘর বাদে সারা বাড়িটাতেই তিনি, অথবা তার সংসার।
ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়েটাকে একবার বিয়ে দিয়ে ফেলতে পারলেই নিষ্কণ্টক। যথানিয়মে সে পতিগৃহে যাত্রা করবে, তিনি কম্বঋষির মত আশীর্বাদ করবেন, পতিগৃহে অচলা হও। লেখাপড়ায় যাই হোক আর অন্যদিকে বেপরোয়া হোক, এদিকে–সংসার-জ্ঞানে তো মেয়েটা সরল অবোধ, কাকার কাছ থেকে সে বাড়ির দলিল দেখতে চাইবে, এমন মনে হয় না।
কাজেই রাগের সময়ের কথা বাতাসে উড়ে গেল, কাকা অন্য পন্থা খুঁজতে লাগলেন।
কিন্তু সত্যিই কি নর্মদা এমন একটা নীচ মেয়ে, যে একজন বিবাহিত ব্যক্তিকে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়?
তা বহিদৃশ্যে তো তাই বলতে হয়।
নীচ, লোভী, হ্যাংলা, স্বার্থপর–এক্ষেত্রে এছাড়া আর কি বলে লোকে?
কিন্তু বিভিন্ন মনোজগৎবাসী বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা, চিন্তাধারা আলাদা। তাই নিজের কাজকে সমর্থন করবার যুক্তিও থাকে তাদের ভঁড়ারে মজুৎ।
নর্মদা ভাবে, লোকে তো বলবেই, বলবার জন্যেই আছে লোক। কে কার ভিতর দেখে? ওই যে মানুষটা, যার বুদ্ধি চিন্তা রুচি পছন্দ বিকশিত হবার আগেই, মা-বাপে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নিতান্ত গ্রাম্য একটা মুখ মেয়ের সঙ্গে, তার জীবনটা কি কিছুই নয়? সে জীবন অপচয়িত হলে কিছুই এসে যায় না?
সেই গ্রাম্য মেয়েটা যদি তার চিত্তের ক্ষুধা মেটাতে না পারে, যদি হতভাগ্য মানুষটার সমস্ত অন্তর পিপাসিত হয়ে থাকে একটি মার্জিত শিক্ষিত হৃদয়ের সঙ্গলাভ-আশায়, সে পিপাসা মেটাতে চাওয়া কি অপরাধ?
জগতের বহুবিধ অ্যাকসিডেন্টের মত ওই গাঁটছড়ার অ্যাকসিডেন্টটাই পরম সত্য? আর সবই মিথ্যা? এইসব যুক্তি নর্মদার।
নর্মদার সেই নতুন প্রেমাস্পদ খুব একটা রূপবান নয়, অতএব এটাকে রূপের মোহের কোঠায় ফেলা যায় না, এ একপ্রকার ভাবের মোহ।