পুরুষদের তীক্ষ্ণ নয়, একথা তোমাকে কে বলেছে? হেসে ওঠে বীথিকার বর বিকাশ।
পুরুষরা ভদ্রতার বশে অবোধ সেজে থাকে। জীবনের ক্ষেত্রে মেয়ে-পুরুষ সবাই আমরা অভিনয় করে চলেছি।
ওঃ, তাই নাকি? তাহলে আমারও ভরসা করবার কিছু নেই?
কিছু না।
বকো না, থাম। যার কথা হচ্ছে, তার কথাই হোক। সত্যি বলতে কি, আসলে মেয়েটা ভালই কিন্তু কাল করল ওকে ওর ওই প্রেম।
প্রেম তো চিরকালই কাল করে এসেছে। ও আর নতুন কি। সেই শ্রীরাধিকার আমল থেকে
আহা মশাই, সে নয়। প্রেমে পড়া নয়, প্রেম খোঁজা।
প্রেম খোঁজা! বিকাশ হেসে উঠে বলে, গরু খোঁজা বলে একটা কথা আছে শুনেছি। কিন্তু
নাঃ, তোমার সঙ্গে সিরিয়াস কথা কইবার জো নেই। ওর বাসনা কি ছিল জান? একখানি নির্ভেজাল খাঁটি প্রেম। সেই বস্তু খুঁজে বেড়াত ও। ছেলেবেলা থেকে। বন্ধুদের মধ্যে, সখীদের মধ্যে–
আর বড় হয়ে বোধ করি সখাদের মধ্যে?
হা মশাই, তাই। কিন্তু সবাই ওকে হতাশ করত। তবু ও আবার নতুন অন্বেষণের পথে পা বাড়াত। বলত কি জান? জীবনের শেষদিন পর্যন্তও যদি খুঁজতে হয়, তবু খুঁজে নেব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।
তোমার বান্ধবীর বুঝি ঠাকুমা ছিলেন না?
ঠাকুমা! ঠাকুমা মানে? বীথিকা অবাক হয়ে বলে, মা বাপ ছিলেন না, ছেলেবেলায় মারা গিয়েছিলেন তাই জানি। ঠাকুমার প্রশ্ন ওঠে নি কোনদিন। হঠাৎ ঠাকুমা প্রসঙ্গ কেন বল তো?
না, মানে, আমার ঠাকুমা বলতেন কি না ঘরে নেই যা, ছেলে চায় তা। ওর ঠাকুমা বোধহয় ওকে সময়ে এ সুশিক্ষা দেন নি। মনের মানুষ! বাপস!
হুঁ, বুঝছি, সব বুঝছি, তুমি কি চীজ একখানি। তা ঠাকুমা না থাক আমরাই ওকে জ্ঞান দান করতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, ও সব বাজে পাগলামী ছাড়, এবেলা ওবেলা প্রেম-পাত্র বদলে বদলে আর নির্ভেজাল প্রেম খুঁজে বেড়াস নে বাবা, দেখে-শুনে ভালমত একটা বিয়ে কর। দেখবি প্রেম-বাই পৃথিবী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না।
তা তোমাদের নিজেদের তখনই এতটা জ্ঞান জন্মেছিল?
বীথিকা সগর্বে বলে, নিশ্চয়! জ্ঞান নিয়েই জন্মেছি, বুঝলে? কিন্তু ও আমাদের কথায় শুধু আমাদের প্রতি করুণার কটাক্ষ নিক্ষেপ করত। ভাবটা যেন আমরা কোথায় আর ও কোথায়। তারপর নিত্যি নানা রকম। একবার এক প্রফেসরের সঙ্গে প্রেম এমন জমে উঠল, আমরা ভাবলাম, যাক বাবা, এতদিনে হল সুরাহা। এবার খুব একটা নেমন্তন্ন। ওমা, কদিন পরে হঠাৎ দেখি একা একা ঘুরছে নর্মদা। চুল রুক্ষু, মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?
না, ধিক্কার হয়ে গেছে।
বললাম, কেন, কী করল প্রফেসর?
ও বলছে, বিয়েতে ওর মা টাকা চান।
অ্যাঁ! বল কি? বিকাশ চোখ কপালে তোলে।
তাই তো বললে। ও নাকি বলেছিল, আমার বাবা নেই, টাকা দেবার লোক নেই, এ কথাটাই আসল কথা নয়। বিয়ের কর্তা কাকা হয়তো গতানুগতিক নিয়মে টাকা দিতে প্রস্তুত হতেও পারেন, কিন্তু ঘুষ নিয়ে তুমি আমায় গ্রহণ করবে?
প্রফেসর বলেছিল, ঘুষের কথা কি আছে? এ তো সাধারণ একটা প্রথা মাত্র। মা সেকেলে লোক, প্রথাটাই বোঝেন। মাকে অসন্তুষ্ট করে আমি কি করে
নর্মদা বলল, ঠিক আছে।
তারপর কিছুদিন কাটল একা একা, আবার দেখি ক্লাসের একটা ছেলের সঙ্গে খুব মাতামাতি জুড়েছে। হাঁদা নাম্বার ওয়ান ছেলেটা কৃতার্থন্মন্যের মত ওর পায়ে পায়ে ঘোরে, নর্মদা তাতেই বিভোর।
আমরা বলি, কি রে, এতদিনে পেলি খুঁজে?
নর্মদা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। ঢলঢলে চোখে বলে, সত্যি ভাই, ছেলেটা যথার্থ খাঁটি। দেখছি, একটু অবোধ একটু বোকাদের মধ্যেই সত্যি ভালবাসা থাকে। ওকে নিয়েই গড়ব আমার ঘর।
তারপর যথারীতি।
আবার নর্মদা একা ঘুরছে। এবার আর রুক্ষু চুল শুকনো মুখ বিষণ্ণ নয়, যেন ক্ষিপ্ত ক্ষুব্ধ চঞ্চল। জিগ্যেস না করতেই নিজে থেকে এসে বলল, ওই লক্ষ্মীছাড়া ছেলেটা কি করেছে জানিস? লুকিয়ে একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েকে লাভ-লেটার দিতে শুরু করেছে।
শুনে সত্যিই হাঁ হয়ে গেলাম। বললাম, বলিস কি?
ও বলল, হ্যাঁ। আবার তাকে নাকি বলেছে, নর্মদা? সে তো একটা আস্ত পাগল।
ওই হাঁদার এই কথা?
না রে বীথি, হাঁদা ও নয়, হাঁদা আমিই। বলল নর্মদা।
বলে, কিন্তু খুঁজে বেড়ানোর কামাই দেয় না।
এদিকে বাড়িতে অভিভাবক কাকা বিয়ে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, কারণ মেয়ের নিয়ে কান পাতা দায় হচ্ছে তার। অতবড় মেয়ে, তায় আবার নিজের মেয়ে নয়, ভাইয়ের মেয়ে, তাকে এঁটে ওঠা শক্ত। সে যুগ নয় যে অভিভাবকগিরির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখাতে মেরে ধরে ঘরে বন্ধ করে আটকে রাখবেন।
পড়ুয়া মেয়েকে পড়তে যেতে দিতে হয়, কিন্তু লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে যদি প্রেমেও পড়তে শুরু করে, কি করবে অভিভাবক? বড় জোর করতে পারে বিয়ের চেষ্টা।
চেষ্টা তো করতেই হবে। কারণ নর্মদার দ্বারা সে সুরাহাও তো হয় না। নিজেই সে জলে নেমে হাবুডুবু খায়, ছিপ ফেলে মাছ টেনে তুলতে পারে না একবারও।
কাকা যাহোক করে একটা সম্বন্ধ যখন প্রায় পাকা করে এনেছেন, এমন সময় নর্মদা বেঁকে বসল। বললে, এ বিয়ে হতে পারে না।
সত্যিই হতে পারে না। কারণ মুখপুড়ি তখন কলেজ লাইব্রেরির এক লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে তোলপাড় কাণ্ড শুরু করে দিয়েছে।
সবাই ছি-ছিক্কার করছে আর বলছে, কী নির্লজ্জতা! কী হ্যাংলামি!