- বইয়ের নামঃ জহুরী
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কাঠামো দেখলে বোঝা যায়
জহুরী – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
কাঠামো দেখলে বোঝা যায়–এক সময় লোকটার চেহারায় দীপ্তি ছিল, জৌলুস ছিল, আকর্ষণের উপাদান ছিল। এখন একটু ঢিলে, একটু বিবর্ণ, একটু বা স্তিমিত। সামনের চুল পাতলা হয়ে যাওয়ায় মাথায় টাকের আভাস, আর ঠোঁটের কোণাটা বাঁকাটে হওয়ার দরুন মুখে একটু সকৌতুক বিষণ্ণ হাসির আভাস।
আগেও ওর ঠোঁটের গড়ন এমনিই ছিল, যেন সেখানে সব সময় উঁকি দিচ্ছে একটা সূক্ষ্ম হাসির ব্যঞ্জনা। কিন্তু সে ব্যঞ্জনা ছিল তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের, এমন বিষণ্ণ কৌতুকের নয়।
বদলালো কেন?
ও কি তারপর থেকে আত্মদর্শনের চর্চা করে করে দার্শনিক হয়ে উঠেছে। প্রায় সকলেই একথা ভাবল।
আজকের উৎসব উপলক্ষে জানলার কাছে কাছে বাড়তি যে ছোট ছোট সীটগুলো আলাদাভাবে পাতা হয়েছে, তারই একটায় বসেছিল ও ঘরের সকলের দিকে সোজাসুজি চোখ চেয়ে। ওকেও তাই সকলে দেখতে পাচ্ছিল। দেখতে পাচ্ছিল ওর ভাঁজহীন ট্রাউজার আর বোতামবিহীন বুশ কোট এবং পালিশ-বিহীন চপ্পল জোড়াটার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান দামী আর শৌখিন চশমা জোড়াটা, দেখতে পাচ্ছিল ওর ঈষৎ শীর্ণ ফর্সা ফর্সা আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখা ধার-ঘসা, কোণ-ক্ষওয়া, ছাল-চামড়া-ওঠা চামড়ার অ্যাটাচি কেসটা, যেটা নাকি মিসেস পালিতের এই শৌখিন ভোজ-সভায় প্রায় বিদ্রোহের মত।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে সকলেই তাই দেখছিল ওকে, আর ভাবছিল, এর মানে কী! ও এখানে কেন! কে নেমন্তন্ন করেছে ওকে? আর যদি বা কেউ করেছে, ও এসেছে কি বলে!
ঘর থেকে উঠে গেল নীলাঞ্জনা আর বীথিকা। বারান্দার একান্তে এসে বলল, ব্যাপার কি বল তো?
বোঝা অসম্ভব! আমি তো ঘরে ঢুকেই দেখে একেবারে পাথর বনে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা, নেমন্তন্নটা করল কে? মিস্টার না মিসেস?
মিস্টার পালিত নেমন্তন্ন করবেন ওকে? মাথা খারাপ নাকি তোর?
কিন্তু মিসেসই বা কী করে? জানিস তো সবই।
জানি, কিন্তু আজ স্রেফ গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি।
আচ্ছা, ঠিক কতদিন হয়ে গেল বল দিকি?
ঠিক? খুব সঠিক বলতে না পারলেও বলি এক হাজার চুরানব্বই দিন সাড়ে বাইশ ঘণ্টা
থাম। দিন মাস বচ্ছর গুনতিস নাকি?
আহা, ওর আর কি, ঘটনাটা তো ঘটেছিল ঠিক তিন বছর আগে মিসেস পালিতের ওই আহ্লাদী মেয়ের এই জন্মদিনের উৎসবেই। সেদিনও ঠিক এই এই লোকগুলোই উপস্থিত ছিল, বাড়তির মধ্যে পালিত-গিন্নীর ন্যাকা মেয়ের ওই নতুন গানের মাস্টারটি, আর অশোকের বৌ। তখন অশোকের বিয়ে হয়নি।
আর ওই রোগা কালো মেয়েটা? ওই কোণের দিকে যে বসে আছে? ওকে তো কোনদিন এ বাড়িতে দেখিনি।
কী আশ্চর্য! ও তো মিস্টার পালিতের ভাগ্নী হেনা। ওকে দেখিসনি তুই?
কি জানি, মনে পড়ছে না। ও এ বাড়িতে আসে?
মাঝে মাঝে। গরীব বলে দেখতে পারেন না মিসেস পালিত, তবে নেহাৎ নাকি মামার বাড়ি।
আর পালিত একটু স্নেহ করেন। সেদিন অবশ্য আসেনি। তিন বছর আগের সেই ঘটনার দিন। আমি যেন চোখের ওপর সেদিনের সব দেখতে পাচ্ছি। ডানদিকের ওই দেয়ালটার ধারে যেখানে আজ অশোক আর সুকান্ত বসে রয়েছে ওই দুটোতে বসেছিলেন মিস্টার রাহা আর তার ওই সুটকি মেয়ে, এদিকে মিসেস রাহা জমিয়ে বসেছিলেন সুকান্তর সঙ্গে, সামনে ওই যেখানে মিসেস ক্ষেত্রী বসে রয়েছেন, ওখানে বসেছিল সোনালী চাকলাদার। অদ্ভুত ধরনের একটা জমকালো শাড়ি পরে এসেছিল, আর কানে দুটো লম্বা রূপোর ঝুমকো, হাতে
ঈস! এত ডিটেল মনে রাখতে পারিস তুই! আমার বাবা এত সব মনে থাকে না।
বাঃ, সেদিনের দিনটা ভাব। ছবির মত সবটা যেন
তা বটে। কিন্তু আমি ভাবছি ওই নির্লজ্জ আর দুঃসাহসী লোকটার বেপরোয়া সাহসের কথা। কতখানি বুকের বল থাকলে আবার এ বাড়িতে মাথা গলাতে পারা সম্ভব হতে পারে সেদিনের সেই ঘটনার নায়কের পক্ষে!
তা সাহস না থাকলে সে ঘটনাটাই বা ঘটল কি করে? কিন্তু আমি ঘুরে ফিরে শুধু ভাবছি ওকে এ বাড়িতে ডাকল কে?
এই তো! আমিও তো দেখে অবধি ভেবে কূল পাচ্ছি না।
.
ভেবে কূল পাচ্ছে না এ ঘরের প্রত্যেকটি লোক।
সোনালী চাকলাদার। যে আজও অদ্ভুত ধরনের জমকালো একটা শাড়ি পরে এসেছে, আর কানে প্রকাণ্ড দুটো চাকার মত রিং পরেছে, সে সেই অবধি তীক্ষ্ণদৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, এই তিন বছরে লোকটার চেহারার বেশ একটু পরিবর্তন হয়েছে। প্রকৃতিরও। ভাবা যায় না যে কনক মিত্তির এ রকম ঢিলেঢালা আধময়লা পোশাক পরে মিসেস পালিতের পার্টিতে এসেছে। পটপ সাজসজ্জায় যে লোকটা ভয়ঙ্কর রকম খ্যাতিমান ছিল।
সোনালী চাকলাদার ভাবতে থাকে, সেদিন কনক মিত্তির একটা মাখন-রঙা ডেক্রনের স্যুট পরেছিল। ভয়ানক রকমের ভাল দেখাচ্ছিল ওকে। মেয়েদের রীতিমত মুগ্ধ করবার মত। কিন্তু কেবলমাত্র একটি মেয়েমানুষকে মুগ্ধ করেই ও যেন জীবনের সব পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল, তাই আর কারও দিকেই তেমন করে তাকাত না। শুধু ওর ওই ঈষৎ বঙ্কিম ঠোঁটের রেখায় একটু বিদ্রুপের হাসির ছিটে মাখিয়ে অলসভাবে তাকাত সকলের দিকে একইভাবে।
কাজেই সোনালী চাকলাদার বেশীক্ষণ আর মুগ্ধভাব বজায় রাখতে পারে নি। নিজের সুর্মাটানা চোখ দুটোয় বিলোল বিহ্বলতার ভঙ্গী এনে অনেকক্ষণ ধরে চোখাচোখি হবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিরক্ত চিত্তে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিল। তারপর–ঠিক খাওয়া দাওয়ার শেষের দিকে সেই গোলমালটা উঠল।