তারপর যাবার আগে ও আমার চোখে চোখে চেয়ে বলল, ফিরে এসে তোমায় ঠিক এমনি পাব তো?
সন্দেহ হচ্ছে?
না, সন্দেহ নয়, ভয়। মনে হচ্ছে যদি বদলে যাও।
কে জানে বদলটা কার হয়!
আমি? আমি ঠিক থাকব। জলে, জঙ্গলে, অরণ্যে, সভ্যতায়, বর্বরতায়, আদিমতায়।
জোর করে কিছু বলা যায়?
মনের জোর থাকলে যায়।
আমার অভিমান ক্ষুব্ধ হল। আমিও মনের জোর দেখালাম। বললাম, তোমার বদল না হলে, আমারও বদল হবে না।
.
১৪.
বলেছিলাম।
বলেছিলাম, আমারও বদল হবে না।
কিন্তু আমার বদল হল।
আমার নাম বদল হল, আমার সাজ বদল হল, আমার আচার-আচরণের বদল হল, আমার মুখের ভাষারও বদল হল। আমি এখন কথা বলি শান্ত গম্ভীর মৃদু ছন্দে। আর সেই কথার মধ্যে দার্শনিকের ঔদাস্য থাকে, থাকে আধ্যাত্মিকতার ধোঁয়াটে রহস্য।
আমি ভাবি এগুলি আমার ভান, আমার ছলনা, কিন্তু হঠাৎ এক এক সময় মনে হয়, নাকি ওইগুলোই সত্যি হয়ে উঠেছে আমার জীবনে? ওই ছলনার খোলসের মধ্যেই আমি আমার সত্তাকে সমর্পণ করেছি?
তাই বউদির বোন শানু যখন বলেছিল, আশ্চর্য! কুমারী মেয়ে হয়েও তুমি অনায়াসে এতখানি কৃচ্ছ্বসাধন করছ। তোমাকে দেখে আমার নিজের উপর ঘৃণা আসছে বেবি!
তখন বলতে পারিনি, এ-কথা বোল না শানু! বরং ঘৃণা তুমি আমাকেই করতে পার। তুমি তো সরল, সত্যবাদী, খাঁটি। আমি কি? মেকি। ভেজাল। একটা ঝুটো মাল।
আমি শুধু মিষ্টি করে একটু হেসে শানুর গায়ে হাত রেখেছিলাম। কারণ, মনে হয়েছিল শানু যা বলছে, তা অস্বীকার করা যায় না। আমার মধ্যে আছে নিশ্চয় কিছু। নইলে শঙ্কর মহারাজ কেন ওকে অবহেলা করলেন, আর আমায় এতখানি মর্যাদা দিলেন।
অথচ যে সার্কেলের মধ্যে আমার মর্যাদা, সে সার্কেলটাকে আমি কোনোদিনই মর্যাদা দিতাম না। আমি মনে করতাম—জীবনে যারা বঞ্চিত, যারা ব্যর্থ, যারা পৃথিবীর সত্যকার আলো-বাতাসের স্বাদ পায়নি, তারাই ভগবান ভগবান করে মাথা ঠোকে, তারাই গুরুর দরজায় ভিড় বাড়ায়। অতএব তাদের অভিমতের মূল্য ছিল না আমার কাছে।
কিন্তু এখন যখন সেই গুরুর দরজায় ভিড় করা মেয়ে-পুরুষের দল আমার দিকে ঈর্ষার চোখে তাকায়, তখন আত্ম-অহমিকায় স্ফীত হই আমি।
আসল কথা, আমাদের সত্তা আমাদের পরিবেশের কাছে বিক্রিত। পরিবেশই আমাদের গড়ে ভাঙে। আর সেই পরিবেশের সমীহ দৃষ্টিই আমাদের কাছ সবচেয়ে মূল্যবান।
আগে আগে যখন কখনও কখনও তার গুরুভগিনী বা গুরুভ্রাতাদের বাড়িতে ডাকতেন, তাদের জন্যে তটস্থ হতেন, তখন মায়ের উপর কৃপা হত, আর ওদের দেখে হাসি পেত। হাসি পেত ওদের সম্বন্ধে মা-র মূল্যবোধের বহর দেখে। কিন্তু এখন আমি আমার গুরুভ্রাতা বা গুরুভগিনীদের চোখে একটু বিশেষ হয়ে উঠতে পারাকে রীতিমতো গৌরবের মনে করি। অথচ সেই একই শ্রেণীর তো এঁরাও।
.
১৫.
কিন্তু ওই আমিটা যেন সমুদ্রের উপরকার ঢেউয়ের মতো। আসল জলটা নয়, জলের ফেনা। কখনও অনেকখানি উঁচু হয়ে ওঠে বলে মনে হয় এটাই সত্য, কখনও হঠাৎ স্তিমিত হয়ে যায়। তখন নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া স্তিমিত জলটা চোখে পড়ে।
সেই রকম স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল আমার আমিটা শানুর যাবার আগের দিন। সন্ধ্যাবেলা শানু আমার কাছে এসে বসেছিল।
আলতোভাবে আমার বিশুদ্ধ শয্যার একাংশে বসে বলেছিল, সেই বাড়িটায় আবার যেতে ভয় করছে। সেই শ্বশুরবাড়ি।
আমার দেবিত্বটা তখন যেন ঝাঁপসা হয়ে গেল। বললাম, তুমি ভারী বোকা শানু, তাই তুমি এই বৈধব্যটাকেই নিজের জীবনের শেষ কথা বলে মেনে নিচ্ছ। তোমার জীবনে অফুরন্ত দিন-রাত্রি, তোমার রূপ আছে, বয়েস আছে, স্বাস্থ্য আছে। তুমি কেন আবার তোমার ভাগ্যটাকে যাচাই করে দেখবে না? ক্লাসে একবার ফেল হলে কি লোকে পড়া ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে? এত কিসের ইয়ে তোমার?
শানু আস্তে বলল, তোমার কাছে লুকোব না ভাই, জীবনের প্রতি এখনও সম্পূর্ণ লোভ আছে আমার, লোভ আছে খাওয়া-পরায়, আমোদ-প্রমোদে। তা ছাড়া আর আমায় কেউ ভালোবাসবে না, আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পাব না, একথা ভাবতে বসলে চেঁচিয়ে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয় : আমার, কিন্তু সেকথা চেঁচিয়ে বলতে লজ্জা করে।
বললাম, লজ্জার কিছু নেই শানু, তোমার এই বৈধব্যটা কৃত্রিম। সমাজের আরোপিত একটা জুলুম। এটাকে জোরের সঙ্গে অস্বীকার কর। তাছাড়া তোমাদের বাড়িটা তো বেশ প্রগতিশীল? বাপের বাড়িটার কথাই বলি।
শানু নির্বোধ, তবু শানু একটু হেসে বলে, প্রগতির পোশাক পরলেই প্রগতিশীল হওয়া যায় না বেবি! এখন আমি একটা রঙিন শাড়ি পরলে দাদা-বউদিরা তো দূরের কথা, আমার বাবা সুষ্ঠু বিরক্ত হন। বিধবা মেয়েকে তারা আহা আহা করবেন, কিন্তু তার আবার বিয়ের কথা? ভাবতেই পারবেন না।
তাহলে এবারে তোমায় নিজে হাতে ভার নিতে হবে।
শানু কেমন একরকম চোখে তাকিয়ে বলে, লজ্জা আমার সবচেয়ে বেশি বেবি তোমার কাছেই। তুমি অকারণ এইভাবে স্বেচ্ছায় জীবনকে হাত দিয়ে ঠেলে দিতে পারছ–
আমি লজ্জা পেলাম।
আমি যেন আমার ভেতরটা দেখতে পেলাম, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ভুল শানু, ওটা তোমার সম্পূর্ণ ভুল। আমার সব কিছুই ভান। এই বৈরাগ্যটা আমার ছদ্মবেশ।
ও অবাক হয়ে বলল, কিন্তু কেন? তোমার এতে দরকার কি?
এমনি মজা। খেলা।
শানু আরও অবাক হল।
বলল, মজা! খেলা! কিন্তু এই খেলাটা যখন আর ভালো লাগবে না?