আমি বুঝতে পারতাম, বউদির উপস্থিতিই আমার পথ কিছুটা সুগম করে দিয়েছে। মা বউদিকে অগ্রাহ্য করবার জন্যেই আমার গতিবিধির এদিক-ওদিককে অগ্রাহ্য করছেন। ভাবটা যেন—তুমি যা খুশি করতে পারো, বোনের বাড়ি যেতে পারো, দোকানে যেতে পারো, আর ও বেরোলেই দোষ? বেশ করবে ও বেড়াত যাবে।
সোচ্চারে না হলেও এই নিরুচ্চার বাক্যই আমার পৃষ্ঠবল ছিল। না হলে বউদির সঙ্গে এই টেক্কা দেওয়াদিয়ি না হলে মা কবেই হয়তো আমার ওপর পাহারা বসাতেন।
.
১২.
বসাননি পাহারা, তাই আমি যথারীতি ওর সঙ্গে দেখা করছিলাম। কোনদিন ও প্রতীক্ষা করত, কোনোদিন আমি।
একদিন ও আলো-জ্বলা মুখে এসে বলল, বছর সাতেকের জন্যে ছেড়ে দিতে পারবে আমায়?
বছর সাতেক!
ছেড়ে দেওয়া! দু
টো শব্দই অবোধ্য।
বললাম, ধরলাম কবে যে ছেড়ে দেব?
ধরনি? উঃ! আষ্টেপৃষ্ঠে নাগপাশে বেঁধে রেখেছ। যাক শোনো, একটা চাকরি পাচ্ছি দুবছরের ট্রেনিং, পাঁচ বছরের কনট্রাক্ট সার্ভিস। ট্রেনিংয়ের দুবছর চোদ্দ-শো করে দেবে, সার্ভিসে সাড়ে তিন হাজার।
মনে মনে হিসেব করে নিয়ে উৎসাহের গলাতেই বলি, তা মন্দ কি? কোথায়? কোন কোম্পানি? ওদের বুঝি বাৎসরিক হিসেবে মাইনে?
দুরন্ত আমার কথা শুনে প্রবলভাবে হেসে উঠল হা-হা করে।
হাসি আর থামতে চায় না।
তারপর বলল, বাৎসরিক মানে? মাসিক। বুঝলে? মান্থলি সাড়ে তিন হাজার।
আমিও অতএব হেসে ফেললাম।
বুঝলাম ঠাট্টা।
বললাম, শুধুই মাইনে? তার সঙ্গে একটি সুন্দরী রাজকন্যা নয়?
কী ভাবছ, ঠাট্টা? তাহলে এই দেখো।
ও পকেট থেকে কতকগুলো ছাপানো কাগজপত্র বার করল। ফরম, প্রসপেক্টাস, আরও কি যেন। তারপর আমায় ধরে বসিয়ে বোঝাতে বসল।
সত্যিই ওই রকম অবিশ্বাস্য হারের মাইনে।
কিন্তু কাজটা যে কি তার উল্লেখ নেই। ট্রেনিং নিতে হবে এই উল্লেখ আছে।
আর উল্লেখ আছে শর্তের।
ওই সাত বছরের মধ্যে দুবছর কোনো ছুটি পাবে না। চাকরির পাঁচ বছরের মধ্যে অবশ্য ছুটি পাবে, বছরে তিন সপ্তাহ, তার মধ্যে, দেশে আসতে পারো, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের ব্যবস্থাপনায়, ও বিষয়ে কোম্পানি তোমাকে কোনো সাহায্য করত অসমর্থ।
কিন্তু ছুটিতে তুমি তোমার দেশে আসবে তাতে সাহায্যের প্রয়োজনই বা কি?
তা আছে প্রয়োজন।
চাকরিটি যে পশ্চিম আফ্রিকায়।
আফ্রিকার মানচিত্রের কোণে ছোট্ট একটি নাম। কে জানে সেখানে অরণ্য উপড়ে উপনিবেশ স্থাপনের আয়োজন চলছে, না উপনিবেশ গড়ে ফেলে কাজ করবার মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না, তাই সারা পৃথিবীতে প্রলোভনের জাল ফেলেছে। একদল ছেলে চাই তাদের। স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ।
পড়বে কেউ না কেউ সে জালে।
হয়তো বা দলে দলেই পড়বে।
পৃথিবীতে বেকারের সংখ্যা তো কম নয়। যারা বেকারিত্বের জ্বালায় বাঘের মুখে যেতেও প্রস্তুত। কুমীরের হাঁয়ের মধ্যে হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।
তাই বলে তুমি? বললাম, পাগল নাকি?
ও বলল, কেন পাগল কিসে? টাকার দরকার কি আমার কম?
এত কি দরকার?
ও দৃঢ় গলায় বলল, আছে দরকার।
আমার ওপর রাগ করে বলছ?
না বেবি, তোমার ওপর নয়, হয়তো নিজেরই ওপর। শুধু একটা কথাই বলব—আমাদের দুজনের মধ্যে এই ভালোবাসা আমার অন্নদাতাদের চোখ এড়ায়নি, আর এই সূত্রেই তারা আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীটা শুধু নেমকহারামের বাসভূমি। সে ধারণাটা যে ভুল সেটাই প্রমাণ করতে হবে আমায়।
এই প্রথম ও কাকাবাবু কাকিমা না বলে অন্নদাতা বলল।
কিন্তু আমাদের ভালোবাসার সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক কি?
আছে বৈকি।
কে না জানে রমেশবাবুর ছেলে নেই, কে না জানে রমেশবাবুকে এবার অবসর গ্রহণ করতে হবে। আর এটাই বা কে না জানে, একটা লোক যদি বিয়ে-থাওয়া করে সংসারী হয়ে বসে, তার আর পুরনো ঋণ শোধ দেবার ক্ষমতা থাকে না, গরজ থাকে না।
এই সব কথাগুলোই হয়তো জানা ছিল অমিতাভর, শুধু এইটা জানা ছিল না-দেবতার মুখ থেকেও এই জানা কথাগুলো বেরোতে পার।
রমেশবাবুকে অমিতাভ দেবতার প্রাপ্য আসনে বসিয়ে রেখেছিল।
হয়তো দেবতার মনেও হঠাৎ ক্ষোভ জন্মাতে পারে, হয়তো দেবতাও হঠাৎ বিচলিত হতে পারে। হয়তো সেটা নিতান্তই সাময়িক। কিন্তু ওই বিশ্বস্তহৃদয় ছেলেটার সে বিচারের ক্ষমতা থাকবার কথা নয়। তাই তার দেবতা আসনভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তার হাতের পুস্পাঞ্জলি স্খলিত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সেই ক্ষোভে সে পাহাড়ের চূড়া থেকে খাদে ঝাঁপ দেবে?
ও বলল, একথা বলছ কেন? মানুষ তো শুধু ভ্রমণের পিপাসাতেও পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে গিয়ে হাজির হয়। ইতিহাসের সাক্ষী হয় সেই সব পর্যটকদের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত।
সে আলাদা। সেটা স্বেচ্ছাধীন।
ওটা ভুল। কোনো সময়েই মানুষ স্বেচ্ছাধীন নয়। প্রতিমুহূর্তেই তাকে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
তবু অনেক কথা বললাম।
অনেক নিষেধ-বাণী, অনেক প্রতিবাদ, অনেক অভিমান, অনেক যুক্তি খরচ করলাম। কিন্তু ও অটল। ও বলছে, কষ্ট হবার ভয় করলে উন্নতির আশা কোথায়?
.
১৩.
ও কোনো কথাই শুনল না, চলে গেল। আমাকে বলল, সাতটা বছর অপেক্ষা করতে পারবে না। আমার জন্যে?
আমাকে উৎপীড়িত হতে হবে।
সইবে আমার জন্যে।
আমি অভিমানে চুপ করে রইলাম।
ও বলল, উপায় থাকলে রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলে যেতাম। কিন্তু আইনের চোখে যে তুমি এখনও নাবালিকা। আশ্চর্য, এখনও এত কম বয়েস তোমার!