সে আসামীকে কুচি কুচি করে কাটলেও রাগ মিটবে না।
বলতাম ঠাট্টা করে।
কিন্তু ক্রমশই যেন ওর সম্পর্কে একটা আক্রোশ ভাবের সৃষ্টি হচ্ছিল। মনে হত যেন ওর তেমন গরজ নেই। নইলে এমন ধীর মাথায় ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা করছে? বসে বসে পরের অন্ন খাচ্ছে, আর কলেজ যাচ্ছে বাড়ি আসছে?
আর তার মাঝখানে আমায় নিয়ে খেলা করছে।
আমি অতএব ক্রমশ দুমুখ হলাম, মুখরা হলাম, রোজগার রোজগার করে ওকে উৎখাত করতে শুরু করলাম।
অথচ সত্যি কীই বা বয়েস ছিল তখন ওর। কী-ই বা বয়েস ছিল আমার। বুঝতে পারি, শুধু যে আমার দুর্দাম বাসনাই এই জ্বালাতন করাত আমায় দিয়ে তা নয়, ওর ওই অন্নদাসত্বও অসহ্য হচ্ছিল আমার।
আমার প্রেমাস্পদ তুচ্ছ একটু অন্নঋণ শোধ করতে সকালবেলা উঠে থলি হাতে বাজারে ছুটবে, পাতানো কাকার জুতো পালিশ করবে, পাতানো কাকিকে ঘুমের সুযোগ দিতে চা বানাবে, ডাল চড়াবে, এ অসহ্য! ভাবলেই আমার আপাদমস্তক রি-রি করে উঠত।
কিন্তু ওর যেন কোনো বিকার নেই।
বলত, ছোটো কাজ? কাজের আবার ছোটো-বড়ো কি? আমার কাছে ছোটো কাজের সংজ্ঞা আলাদা। তা ছাড়া কষ্টই বা কি? তুমি কর না এসব কাজ?
আমি করি নিজের বাড়িতে।
নিজের বাড়ি!—ও হেসে ফেলত, তা বটে। তবে দুদিন বাদে বাড়িটিও পরের বাড়ি হয়ে যাবে, এই যা।
কক্ষনো না। মা আমায় কী দারুণ ভালোবাসে জানো? পর করে দেবে ভেবেছ?
বেশ, ওখানে হারলাম। কিন্তু তোমার বউদি? ওই সব ছোটো কাজ করেন না কখনও? তার তো পরের বাড়ি।
আহা কী বুদ্ধির ছিরি! বরের বাড়িটা বুঝি পরের বাড়ি?
তাও নয়? তাহলে সম্পূর্ণ হারলাম। আপন-পর জ্ঞানটা ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পারিনি।
রেগে বলতাম, মহাপুরুষগিরি রাখো, এই অন্নদাসত্বর পালা শেষ কর। কাগজে কত কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখি, দরখাস্ত করে যাও চোখ বুজে। একটা না একটা লেগেই যাবে।
ও একটু চুপ করে থেকে বলে, ভেব না করছি না। তাও করছি। হবে, হয়ে যাবে।
ও আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, ধর যদি অনেক দূর চলে যেতে হয়?
আমি মহোৎসাহে বললাম, সে তো আরও ভালো। অজানা সাগরে পাড়ি দেব মোরা দুজনে। কেটে যাবে দিন শুধু গানে আর কুজনে।
ও বলল, স্বপ্নটা বেশ গোলাপী দেখছি। নেশা টেশা করলে শুনেছি এ-ধরনের গোলাপী স্বপ্ন দেখে।
নেশা তো করেইছি— বলে হেসে উঠলাম।
হঠাৎ ওর চোখে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠল। বলল, নেশা একলা করতে নেই। দেখি, পানপাত্রটা আমার হাতে দাও তো একবার।
এই ওর স্বভাব।
কখনও স্থির, কখনও অস্থির।
কখনও বিজ্ঞ, কখনও বেপরোয়া।
কারণ ওর বুদ্ধিটা তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডা হলেও ওর প্রকৃতি উদ্দাম, ওর বাসনায় বন্যতা। ক্রমশই ওর মধ্যে দুটো সত্তা সমান প্রবল হয়ে উঠছে।
আমার কিন্তু ইচ্ছে হয় এই দুই বিভিন্ন সত্তার সমন্বয় দেখি ওর মধ্যে। কিন্তু তা হয় না, ও কখনও উদাসীন হয়ে বসে থাকে, কখনও দুরন্ত মূর্তিতে প্রকাশিত হয়।
একদিন হঠাৎ এসে বলল, ভেবে দেখলাম প্রফেসরি করে কিচ্ছু হবে না। টাকা চাই, অনেক টাকা। অতীত জীবনের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলবার মতো টাকা, ভবিষ্যতের সোনার প্রাসাদ গড়বার মতো টাকা। আচ্ছা, কি করলে বেশ রাশি রাশি টাকা পাওয়া যায় বলতে পারো?
বোধহয় চুরি করলে।
খবরদার ঠাট্টা কোরো না এখন। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।
হল কি? কিছু না বলে ও মাথার লম্বা লম্বা চুলগুলো মুঠোয় চেপে টানতে লাগল।
.
১০.
কি ওর হয়েছিল সেদিন জানি না, কিন্তু সেই দিন থেকে ওর যে একটা পরিবর্তন ঘটেছিল তাতে সন্দেহ নেই। ওর ভিতরকার সেই মানসিক প্রশান্তি—যা দেখে এক এক সময় আমার রাগে গা জ্বালা করত, তা যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ও বেশিক্ষণ কথা বলতে পারত না, আমি দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে চঞ্চল হয়ে ওঠবার আগেই বলত, আচ্ছা, আজ চলি।
আর কোনো কোনোদিন বলত, আকাশ থেকে একবোঝা টাকা পড়তে পারে না? উল্কাপিণ্ডের মতো?
একদিন বললাম, এত টাকার তোমার দরকার কি? যা তোক একটা কাজকর্ম করলেই তো বেশ চলে যাবে আমাদের।
ও অস্থির গলায় বলল, না, সেভাবে খুঁড়িয়ে চলায় আমার সুখ নেই, আমি রথে চড়ে রাজপথে চলতে চাই।
কেন জানি না হঠাৎ চোখে জল এল।
মনে হল, সেটা কি শুধু তুমি একলাই চাও? কে না চায়? কিন্তু চাইলেই তো পাওয়া যায় না! আর সেটা পাওয়া যাবে না বলে অভিমান করে জীবনের সুন্দর দিনগুলো, কবিরা যাকে নাকি বলে থাকেন নবযৌবন, বসে বসে বিকিয়ে দেবে?
কিন্তু মনে হলেই তো ঠিক গুছিয়ে বলা যায় না। ওর মনে এ আগুন তো আমিই জ্বেলে দিয়েছি, ওর চিত্তের প্রশান্তি তো আমিই নষ্ট করে দিয়েছি। ও তো ওর ওই অন্নদাসের জীবনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুঠো মুঠো মাটি দিয়ে পথ তৈরি করতেই চেয়েছিল। ওর গলাতেই তো একদা শুনেছি, পৃথিবীর এককোণে রহিব আপন মনে, ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা।
১১-১৫. আমার বিরুদ্ধে গুঞ্জন উঠছে
এদিকে বাড়িতে আমার বিরুদ্ধে গুঞ্জন উঠছে।
রোজ রোজ বান্ধবীর সঙ্গে এত কি দরকার?
তুমি রোজ যাও, সে তো কই একদিনও আসে না?
তার মানে তুমি হ্যাংলা, সে মানিনী।
না, এতক্ষণ আড্ডা দিতে যাওয়া চলবে না। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
মা বলতেন, দাদা বলত।
আর বউদি টিপে টিপে হেসে বলত, কে জানে বান্ধবী না বান্ধব।
মা তখন আড়ালে রেগে রেগে বলতেন, কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।