আত্মীয়? ও হাসল।
বলল, আমি ওঁর আত্মীয় হই না, তবে উনি আমার আত্মীয়।
চাকর যে নয়, তা বুঝে ফেলেছিলাম। আর ওর ওই ভয়ঙ্কর উজ্জ্বল চোখ দুটো যেন আমাকে তীব্রভাবে সম্মোহিত করছিল।
তাই কথার পিঠে কথা বাড়ালাম, তুমি ওঁর আত্মীয় নয়, উনি তোমার আত্মীয়? সেটা আবার কি রকম?
বুদ্ধি থাকলে বুঝতে।
রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল।
বললাম, বুদ্ধি না থাকতে পারে, তবে কথার একটা মানে থাকা দরকার।
মানেটা বুঝতে না-পারাই তো আশ্চয্যি। থাক, আর মানে বুঝতে হবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।
দেরি! ইস! কলেজে পড়ে না হাতি! বই নিয়ে কাউকে দিতে যাওয়া হচ্ছে। তা হলে তাই।
বলে হেসে চলে গেল ও।
ও যদি সতেজে প্রতিবাদ করত, তাহলে আমার অভিমানবোধ এমন ক্ষুণ্ণ হত না। আর সেই সূত্রে আরও কথা চালাতে পারতাম। অবচেতন মনে যা চাইছিলাম। কিন্তু ও অবজ্ঞা করে চলে গেল।
তখন হায়ার-সেকেন্ডারির জন্য টেস্টে অ্যালাউ হয়েছি, স্যার বলছেন খুব নাকি ভালো পড়ছি আমি, তাই মনের মধ্যে বিরাট আত্মমর্যাদাবোধ, তাই এই অবজ্ঞাটা প্রাণে লাগল। ভাবলাম, রোসো শোধ নিচ্ছি!
.
০৮.
সেই প্রথম পরিচয়।
শোধ নেবার সংকল্পে দৃঢ় হলাম।
তারপর জানলাম ও রমেশবাবুর বাল্যবন্ধুর ভাইপো, দীনহীন আশ্রিত। জানলাম ওর নাম দুরন্ত। জানলাম আশুতোষে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। জানলাম যেমনি সপ্রতিভ, তেমনি জলি।
তারপর জানলাম ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।
ও বলত—মানে পরে, যখন আমি মাকে নানা মিথ্যা কথায় ছলনা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ওর সঙ্গে লুকিয়ে বেড়াতে পালিয়ে যাচ্ছি।
কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন, সুবিধে কিছু সঞ্চয় হয়েছে। কোনোদিন বলি বান্ধবীর বাড়িতে পড়তে যাচ্ছি, কোনোদিন বলি লাইব্রেরি যাচ্ছি। কোনোদিন হয়তো—অর্থাৎ এরকম ক্ষেত্রে অন্য যে-কোনো মেয়েই যা যা বলত, যেভাবে ছলনা করত, ঠিক তাই করতাম। নতুন কিছু না।
ছলনা করে বেরিয়ে পড়ে আবার ওর সঙ্গে ছলনা করতাম। বলতাম, আর এরকম চলবে না। মা জেনে ফেলেছেন।
তখন বাবা মারা গেছেন, শুধু মা। মা-র কথাই বলতাম।
ও বলত, লুকোচুরির কি আছে? বললেই পার স্পষ্ট করে।
আহা রে! কী বলব শুনি?
কেন? বলবে, মা, মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির জুতো-ঝাড়া চাকর সেই দুরন্তটার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। তাই তাকে নিত্য একবার না-দেখলে ছটফটিয়ে মরি।
রেগে বলতাম, আমি তোমায় বলেছি কোনোদিন জুতো-ঝাড়া চাকর?
বলনি, ভেবেছ।
আহা একেবারে অন্তর্যামী! কে কি ভেবেছে–
অন্তর্যামীই তো। হেসে উঠত ও, না হলে সেই প্রথম দিনেই কী করে বুঝলাম, মেয়েটা স্কুলের বালিকা হলে কি হয়, রীতিমতো পরিপক্ক। একটা ছেলেকে দেখল আর প্রেমে পড়ল! একেবারে অগ্নিতে পতঙ্গবৎ।
ইস, অহমিকার আর শেষ নেই! দেখল আর প্রেমে পড়ল!
পড়নি তো এত ছটফটানি কিসের?
ছটফটানি আবার কি?
ও, নেই বুঝি? আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল থেকে আর আসবার দরকার নেই।
বেশ।
ও হঠাৎ দুরন্ত বেগে এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার চোখের কাজল, ঠোঁটের রং, খোঁপার বাঁধুনী, সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে বলত, এই খবরদার! অ্যাবসেন্ট হলে চলবে না। আমার দরকার আছে।
রেগে যেতাম, হাঁপিয়ে যেতাম, বলতাম, কে তোমার নামটা রেখেছিল?
কি জানি। নিশ্চয়ই কোনো দূরদ্রষ্টা ঋষি।
কক্ষণো আসব না আর।
পাগল! কালই আসবে আবার আরও সেজে-গুঁজে।
এইভাবে ঘোচাতে?
ও একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলত, এ আর কিই বা! ওর সেই চোখদুটোয় যেন আগুন জ্বলে উঠত।
আমার বুকটা কেঁপে উঠত।
পালিয়ে আসতাম।
ভাবতাম, নাঃ, সত্যিই আর নয়।
কিন্তু কদিন থাকত সে প্রতিজ্ঞা?
.
০৯.
ছেলেমানুষী মজা থেকে ক্রমশ জ্বলে ওঠে বাসনার আগুন, তীব্র থেকে তীব্রতর হয় আকর্ষণ। রাতে মা-র শয্যার একাংশে শুয়ে শুধু সেই পরম রমণীয় ক্ষণটুকুরই চিন্তা করি, যে ক্ষণটুকু অনেক চেষ্টায় আহরণ করি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আস্বাদ করি ওর কথা, ওর হাসি, ওর দুরন্ত আবেগ।
কোনো কোনোদিন মনে হয় কাল আর বাড়ি ফিরব না, বলব, চল আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।
কিন্তু দিনের আলোয় সে চিন্তার অবাস্তবতা ধরা পড়ে। ও তখনও পরাশ্রিত পড়ুয়া ছেলে, আর আমি মা-দাদার পরম বিশ্বাসস্থল একটা থার্ড ইয়ারের ছাত্রী মাত্র। পালিয়ে গিয়ে কি গাছতলায় সংসার পাব?
বলতাম, এম.এ. পড়ে তোমার কী ডানা গজাবে? এটা কিছু কর না?
করছি তো—
কী করছ?
কেন, প্রেম।
থামো অসভ্য! রোজগারপাতির চেষ্টা কর না?
তা সেটাই তো করছি। এম.এ. দিয়ে বেরোতে আর একটা বছর, তারপর দুটো বছর যাবে রিসার্চে। একটা ডক্টরেট নিয়ে
প্রফেসরি করবে, এই তো?
সেটাই আমার আপাতত লক্ষ্য। আমার বাবা শিক্ষকতা করতেন, আমিও তাই করব। মা-র তাই ইচ্ছে ছিল।
ঠিক আছে। মাস্টারিও শিক্ষকতা। যা তোমার বাবা করতেন। আমিও বি.এ. দিয়ে বেরোলেই—
নাঃ। স্কুলমাস্টারি নয়।
তা তো বটেই। আমি রেগে বলতাম, তাতে সুবিধে কি? কলেজের অধ্যাপনা, দোহাত্তা ছাত্রীদের সঙ্গে প্রেম, তবেই তো সুখ।
কী সর্বনাশ! দেখছি যে তুমিই অন্তর্যামী। এত কষ্টে মনের গোপন ইচ্ছেক লুকিয়ে রেখেছি, তাও ধরে ফেলেছ?
ফেলব না কেন? প্রকৃতিটি জেনে ফেলেছি যে।
ঘরে একটি বাঘিনী থাকতে কি সে সুযোগ হবে? হয়তো সেই অবলা হলগুলিকে কামড়েই দিয়ে আসবে।
আসবই তো। ভেবেই তো কামড়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
ও গম্ভীরভাবে বলত, তা সে ইচ্ছের কিছুটা পূরণ করতে পার। আসামীর একজন হাতের কাছে হাজির।