আসল কথা মুখস্থ শব্দটা ভুল। বলা উচিত, অন্তরস্থ। অন্তরস্থ করতে না পারলে মুখস্থ থাকে না।
তা যে শব্দের যে অর্থই হোক, বাবা আমায় রাশি রাশি কবিতা মুখস্থ করাতেন, এবং সন্ধেবেলায় বসে বসে সেই সব আবৃত্তি শুনতেন। শুনতেন আর বাহবা দিতেন। বলতেন, আশ্চয্যি, কমা-সেমিকোলনটি পর্যন্ত এদিক-ওদিক হয় না।
তাই গুরু-উপদেশবাণীও আমার একবার শুনেই নিখুঁত মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
মা কিন্তু ভয়ঙ্করভাবে ভয় পেয়ে গেলেন। মা ভাবলেন সত্যিই বুঝি মা-র এই আদুরে মেয়েটার উপর ভগবতীর ভর হল। সংসারী মানুষের ভূত আর ভগবান দুইয়ের উপরই সমান ভয়। তাই মুখে যতই বলুক ভগবানে ভক্তি হোক, সত্যি ভক্তির পরিচয় পেলে আতঙ্কিত হয়। ভাবে ওই বুঝি ছাড়ল সংসার।
মা-র এই আতঙ্কে আরও কৌতুক লাগল, বললাম, হয়তো পূর্বজন্মে আমি একটু কাজ এগিয়ে রেখেছিলাম, তাই এ জন্মে চট করে হয়ে গেল যোগাযোগ। নইলে শানুকে তো–
০৬-১০. শঙ্কর মহারাজ
না, শানুকে দীক্ষা দেননি শঙ্কর মহারাজ। বলেছিলেন, এর এখনও সময় আসেনি।
বউদি কদিন ঘোরাঘুরি করল, তারপর আশ্রমে আমার আদর আর আধিপত্য দেখে বিতৃষ্ণ হয়ে ছেড়ে দিল। রাগ করে বোনকে তার মাসের শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ক্রমশ ক্লান্তও হয়ে উঠেছিল বোঝা যাচ্ছিল। রাত্রে স্বামীসান্নিধ্য ত্যাগ করে বোনকে নিয়ে পড়ে থাকা, কতদিন চলতে পারে?
এ একটা ছুতো হল।
মাকে আর আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, মহারাজ ওভাবে ফিরিয়ে দেওয়ায় বড্ড মন-ভাঙা হয়ে পড়েছ, যাক, দুদিন ঘুরে আসুক।
আমি সেদিন আর-একবার ওর বিয়ের কথাটা তুলোম। দাদার উপস্থিতিতে। বললাম, ভাঙা মন জোড়া লাগাতে ওকে নিয়ে যা-তা না করে আর একবার বিয়েরই চেষ্টা কর না বাপু!
দাদা ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে?
মানে তো কিছু শক্ত নয় দাদা! বেচারা তো বলতে গেলে কুমারীই। নিজের বোনের জন্যে তো পাত্র খুঁজছিলে, সেই খাটুনিটা না হয়ে বউয়ের বোনের জন্য খাটলে।
থাক, তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না, বেঁজে উঠল বউদি, তুমি ঊর্ধ্বলোকের জীব, এসব তুচ্ছ চিন্তায় না-থাকাই ভালো।
তখন বলেছিল।
তখন ওরা অভিভূত হয়নি।
দাদা বলেছিল, নিজের বোনের জন্যে খোঁজাটা ছেড়েই দিতে হবে তাহলে?
নিশ্চয়।
দেবী মা হয়েই থাকবে ঠিক করেছ?
দেখা যাক না বলে হাসলাম মনে মনে। মনে ভাবলাম, আমার দিন আসুক, আসুক দুরন্ত অমিতাভ আফ্রিকার অরণ্য থেকে সোনার তাল কুড়িয়ে নিয়ে। তখন জানাব কেন তোমায় মুক্তি দিচ্ছি বোনের বর খোঁজার দায় থেকে।
.
০৭.
হ্যাঁ, দুরন্তই ওর আসল নাম, ডাক-নাম। অমিতাভটা পোশাকী নাম। বলতাম, পোশাকী নামটা তোমার সম্পর্কে স্রেফ অচল। এই এইটেই হচ্ছে ঠিক। দুরন্ত!
ও বলত, ঠিক তো? তাহলে আমার দোষ নেই, নামের উপযুক্ত কাজই করছি।
আমি ছিটকে সরে আসতাম, বলতাম, রক্ষে কর, ক্ষ্যামা দাও। শ্রীযুক্ত অমিতাভবাবুই হও।
নাঃ। দুবার দুরকম নির্দেশ চলবে না।
বলতাম, তাহলে আমারও থাকা চলবে না। বলতাম, তবু বসে থাকতাম। কে যেন পেরেক দিয়ে পুঁতে রাখত আমায় সে-ঘরের মাটির সঙ্গে। যদিও সেই ঘরটায় দুরন্তর কোনো অধিকার ছিল না। দুরন্ত হচ্ছে রমেশবাবুদের আশ্রিত। যে রমেশবাবুর কাছে আমি পড়তে যেতাম। রমেশবাবু আমাদের স্কুলের ইংলিশের টিচার।
এমন কিছু বড়োলোক নয় রমেশবাবু, তবু একটা ছেলেকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন, তার লেখাপড়ার ভার নিয়েছিলেন। বিনা স্বার্থেই নিয়েছিলেন।
কিন্তু রমেশবাবুর গিন্নি এটা বরদাস্ত করতে পারতেন না। তিনির মনোভাব—বেশ, আছে থাক, কিন্তু কিছুটা উসুল হোক।
সেই উসুলটা করতেন তিনি চাকর তুলে দিয়ে।
ঝি না এলে বাসনও ধুইয়েছেন দুরন্তকে দিয়ে। নিজের অসুখ করলে ভাতও রাঁধিয়েছেন।
আমি রেগে যেতাম, বলতাম, এসব তুমি সহ্য কর কি করে?
ও হেসে বলত, কী হয়েছে? গ্রামের বাড়িতে মায়ের অসুখ করলে তো কতদিন রান্না করেছি, কাপড় কেচেছি, বাসনও মেজেছি।
সেটা আর এটা এক নয়।
এক ভাবলেই এক।
এই বলিষ্ঠতা ছিল ওর চরিত্রে।
আশ্রিতের কর্তব্যবোধ ছিল, আশ্রিতের ক্ষোভ-অভিযোগ ছিল না। ছিল না চিত্তদৈন্য, ছিল না অভিমান বা অপমান জ্ঞান। যেন নিজের বাড়িতেই আছে। ও যেমন স্বচ্ছন্দে স্নানের ঘর থেকে হাঁক পাড়তে পারত, কাকিমা, শীগগির! শীগগির! ভাতটা রেডি করে ফেলুন। তেমনি স্বচ্ছন্দেই বলতে পারত, ঠ্যাংটা বাড়ান তো একটু, মালিশটা করে দিয়ে যাই। নিজে তো আর করবেন না। মালিশের ওষুধ টেবিলে পড়ে থাকলেই কি বাত সারবে?
এই সহজ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ছিল বলেই বোধহয় ও প্রথম দিনেই আমায় তুমি বলেছিল।
ও তখন রমেশবাবুর জুতোটা নিয়ে পালিশ করছিল, বলল, কাকাকে খুঁজছ, কাকা তো বাড়ি নেই। বসতে চাও তো বসবার ঘরে বস।
আমি জানতাম না যে, রমেশবাবুর বাড়িতে এমন কোনো ছেলে আছে। ভাবলাম চাকর। আর ভাবলাম এতই গাঁইয়া যে, তুমি আপনির ভেদ জানে না। কিন্তু দেখলে কে বলবে চাকর!
সেদিন চলে এলাম।
পরদিন আর একটু দেরিতে গেছি, দেখি দিব্যি ফর্সা কাপড়-জামা পরে বেরোচ্ছে, হাতে বইয়ের গোছা। বললাম, স্যার বাড়ি আছেন?
আছেন।
বই নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?
কলেজে, আর কোথায়?
কলেজে? তুমি কি কলেজে পড় নাকি?
তা নইলে গ্রাম থেকে এলাম কি করতে?
তুমি বলা হয়ে গেছে আর আপনি চলে না, তাই বললাম, মাস্টারমশাইয়ের কোনো আত্মীয় হও বুঝি?