.
০৪.
প্রথম দিকে আমি একদিন বলে ফেলেছিলাম, অন্যমনস্ক রাখতে এত রকম উপায় আবিষ্কার না করে শানুর আর একবার বিয়ে দাও না বাবা! জীবনের কী-ই বা হয়েছে ওর!
বউদি ভাবলেন, এটা বোধহয় ওঁর শোকে ভেঙে-না-পড়া বোনকে ব্যঙ্গ করা হল, তাই রুক্ষ গলায় বলে উঠলেন, কুমারী মেয়েরই একটা বর জোটে না এদেশে, তার আবার বিধবার।
এই কুমারী কন্যাটার উল্লেখ অবশ্য আমার উপরই কটাক্ষপাত, তাই মৃদু হেসে চুপ করে গেলাম।
যাই হোক, সেদিন বউদি যখন সাধুর মঠ থেকে ফিরে এল, মুখটা আরও থমথমে। সিনেমা দেখে ফিরে আসার থেকেও অনেক বেশি। আর ঘরে ঢুকে আদৌ বেরোলই না।
খাবার জন্যে ডাকতে গিয়ে মা প্রায় অপমানিত হয়েই ফিরে এলেন।
মা ভয়ে ভয়ে বললেন, ওখানে কি প্রসাদ পেয়েছ?
বউদি ঘর থেকে ছুঁড়ে মরালেন, অভাগারা প্রসাদ পায় না মা!
এ প্রসাদ অবশ্যই অন্য অর্থবাহী।
মাকে ডেকে বললাম, ইচ্ছে করে অপমান হতে যাও কেন?
কি করে জানব বল? খেতে ডাকতে হবে তো? না-খেয়ে থাকবে?
একদিন না-খেলে মানুষ মরে না।
একদিন কেন, নিত্যই তো খায় না। বোনের জন্যে নিজের দেহটা পাত করছে–
বড়ো করুণা হল মায়ের উপর।
ভাবলাম কী অবোধ, কী অবোধ!
কিন্তু এই অবোধের শান্তিটুকু নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। তা ছাড়া যদি মাকে বলে বসতাম অত ভয় করবার হেতু নেই মা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আসে, দুই বোনে তার সদ্ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে মা জীবনে আর কোনোদিন শানুকে শ্রদ্ধার বা স্নেহের চক্ষে দেখতে পারতেন না। কারণ সেটা হত মা-র চিরায়ত সংস্কারের ওপর প্রকাণ্ড হাতুড়ির ঘা।
সেটা আমি চাই না।
শানুকে আমি ভালোবাসি। বয়সে আমার সমান-বয়সী হলেও, ওকে আমার অনেক বালিকা মনে হয়। ও অন্যের ইচ্ছের পুতুল হতে পারে। ওর স্বামী থাকলে সেই ইচ্ছের পুতুলটিকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারত। কিন্তু সেটা ভাগ্যে নেই লোকটার। তাই ফটু করে মরেই গেল।
এখন তাই শানু তার দিদির ইচ্ছের পুতুল হয়ে কোনোদিন দক্ষিণেশ্বরে যাচ্ছে, কোনোদিন সিনেমা যাচ্ছে। কখনও আশ্রমে দীক্ষা নিতে ছুটেছে, কখনও লুকিয়ে হোটেলের চপ-কাটলেট খাচ্ছে।
জানি, বউদি এটা মমতার বশেই করে। ওই ছোট্ট বোনটাকে, যে নাকি মাছ-মাংস ব্যতীত এক গ্রাস খেতে পারত না, তাকে শাকপাতা খাইয়ে রাখতে প্রাণ ফেটে যেত তার, তাই এই লুকোচুরি। সে লুকোচুরিটাকে ঘৃণা করে করুণা করতাম আমি। আর বউদি ভাবত বুদ্ধির কৌশলে ও আমাদের চোখে ধুলো দিতে পারছে।
শানুকে ভালো না বাসলে হয়তো কোনদিন বউদির এই গোপনতাকে ধিক্কার দিয়ে বসতাম, কিন্তু আগেই বলেছি, শানুকে আমি ভালোবাসি। দাদার বিয়ে হয়ে ইস্তক তো দেখছি। ভারী নিরীহ
আর ভীতু ভীতু মেয়েটা। ঠিক তার দিদির বিপরীত।
কিন্তু সেদিন আমার হঠাৎ কেমন রোখ চেপে গেল, ওই মেয়েটার প্রতিপক্ষ হয়ে বসলাম।
অথবা ওই মেয়েটায়ও নয়, ওর দিদির। কিন্তু বহির্দশ্যে ওই মেয়েটারই প্রতিপক্ষ হলাম।
ওকে ডিঙিয়ে আমি শঙ্কর মহারাজের কৃপা অর্জন করে ফেলব।
আর আমি সংকল্প করলাম,—ওদের নাকের সামনেই দীক্ষা নিয়ে আসব। আর দেখিয়ে দেব কৃচ্ছ্বসাধন কাকে বলে।
এই একটা দিক। তাছাড়া, আরও একটা দিক আছে। আর সে কথা তো আগেই বলেছি। এই সুযোগে একটা ছদ্মবেশ নিয়ে আমি আমার মা-র হাত থেকে রক্ষা করব আমাকে।
তাই পরদিন মা-র শত আপত্তি এড়িয়ে সেই শঙ্কর মহারাজের মঠে গিয়ে হাজির হলাম, দীক্ষা নিয়ে এলাম।
প্রাণ ধরে আমায় একা ছাড়তে পারেননি মা, সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি মা-র তোয়াক্কা রাখিনি। সোজা মহারাজের সামনে গিয়ে বলেছিলাম, দীক্ষা নিতে কি কি লাগবে বলুন।
আমার এই প্রায়-দুর্বিনীত উক্তিতে মহারাজের চেলা-চামুণ্ডারা বোধকরি চমকে উঠেছিল, কিন্তু মহারাজের চক্ষে বরাভয়।
কিন্তু শুধুই কি বরাভয়?
কেমন একটা পুলক-চাঞ্চল্যেরও আভাস ছিল না কি? কিসের সেই পুলক? বিজয়-গৌরবের? বোধহয় তাই। বোধহয় ভেবে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিলেন আমি তার মহিমায় অভিভূত হয়ে ছুটে গিয়েছি। অতএব পরীক্ষা হয়ে গেল, অন্তর্যামী নয়।
.
০৫.
সেই শুরু।
মা আমার সঙ্গে ফিরলেন চোখের জল মুছতে মুছতে।
আমি জোরে জোরে হেসে বললাম, কী হল? কান্নার কী হল?
মা ডুকরে উঠলেন, কোথায় তুই বিয়ে হয়ে বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবি, তা নয় সন্নিসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে এলি!
বাঃ, তাতে খারাপটা কি?
খারাপ নয়?
আমি তো কিছু খারাপ দেখছি না। কোনো বন্ডে তো সই করিনি যে, জীবনে কখনও সংসার করব না, অর্থাৎ বিয়ে করব না।
সই করার বাকিই বা কি? বললেন তো, আমিষ খাদ্য খাওয়া চলবে না, নিত্য হাজার জপ করতে হবে–
জপ করতে হবে না তো আমি হেসে উঠে বললাম, জপের খাতা তৈরি করে তাতে হাজার বার ইষ্টনাম লিখতে হবে।
সে একই।
উঁহু, এক নয়। চোখ বুজে জপ করার থেকে অনেক সহজ। বললেন শুনলে না, কলিতে সাধনার পদ্ধতি সহজ।
কিন্তু এই বয়সে এসব তুই করতে যাবি কেন?
আমি মা-র জ্বালা দেখে খুব আমোদ পেলাম। আর কারও জ্বালাতে সেইমাত্র শুনে আসা পরমার্থিক বাক্যি কিছু বর্ষণ করে ফেললাম, সাধনার কি বয়েস আছে মা? বয়েস তো এই দেহটার, আত্মার বয়েস তুমি জান? জান কি কত কোটি কোটি বছর তার আসা-যাওয়া চলছে?
মুখস্থ করার বিদ্যেটা চিরদিনই আমার প্রবল। বাবা আমার এ বিদ্যেটায় ভারী খুশি ছিলেন। বলতেন, আমার আর তিনটে ছেলেমেয়ে রাবিশ। একটা লাইন মুখস্থ রাখতে পারে না। আজ শিখলে কাল ভোলে। বেবিই শুধু–