তাই ব্যাকুল হচ্ছিলেন।
আর উৎখাত করছিলেন দাদাকে।
তা শালী বিধবা হবার আগে পর্যন্ত দাদাও চেষ্টার ত্রুটি করেনি, উঠে পড়ে লেগে পাত্র যোগাড় করে এনে আমার সামনে ধরে দিয়েছে, আমার সঙ্গে মিশতে দিয়েছে, আমাকে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে দিয়েছে। কিন্তু দাদাকে সফল হতে দিইনি আমি, যে কটাকে এনেছে, সব কটাকেই নাকচ করে দিয়েছি।
অবিশ্যি মা যতই মেয়ের বিয়ে বিয়ে করুন, এই ধরনটা মা-র পছন্দ হত না। সেই চিরাচরিত পদ্ধতিতে মেয়ের অষ্টাঙ্গে গহনা পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে আর জানলামুখো করে বসিয়ে কনে দেখনোটাই ছিল মা-র আদর্শ। তারপর তো দেনা-পাওনার প্রশ্ন আছেই। কন্যাপক্ষ যে দেনদার, এবং বরপক্ষ পাওনাদার, এটাকে নিতান্তই স্বাভাবিক রীতি বলে মনে মনে গ্রহণ করতেন, এবং এই ভাবটাই পোষণ করতেন—ওই সব স্বাভাবিক পদ্ধতির অভাবেই বিয়েটা ঘটছে না। আর এ সন্দেহও পোষণ করতেন-টাকাকড়ি খরচা হবার ভয়েই বউদি এই ফ্যাসানটির আমদানী করেছে।
হ্যাঁ, ফ্যাসানটি বউদিরই আমদানী।
বউদির সঙ্গে দাদার ভাবের বিয়ে বলে, বউদি ঘটকে-ঘটানো বিয়েকে খুব নিম্নশ্রেণীর বলেই মনে করে।
কিন্তু এটাই বা কি?
মনে মনে একচোট হেসে নিতাম আমি।
তুমি দাদা, আমার হিতৈষী অভিভাবক, কুল-শীল মিলিয়ে কেরিয়ার বিবেচনা করে পাত্র ধরে এনে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে দিলে আমায়, অথবা দুখানা টিকিট কেটে হাতে গুঁজে দিয়ে সিনেমা হল-এ পাঠিয়ে দিলে, তার নাম পূর্বরাগ?
আমার তো এটাকে ক্যারিকেচার মনে হত।
বার কয়েক নাকচ করে, অথবা বলতে পারা যায়, নাকচ হয়ে হয়ে (অর্থাৎ আমার ব্যবহারে নাকচ করতে বাধ্য হত তারা) যখন দাদা বউদি এবং মাকে বিরক্তির সীমারেখায় এনে ফেলেছি, আর মা জোরগলায় ঘোষণা করেছেন এসব ফ্যাশানেপনায় বিয়ে হবে না–তখন শানু আমায় উদ্ধার করল। বিধবা হয়ে এসে তার দিদির গলায় পড়ে ননদের বিয়ের থেকে অনেক বেশি গুরুতর সমস্যার জালে জড়িয়ে ফেলল বউদিকে।
মা নেই বউদির, তাই বোনকে কাছে টেনে না এনে পারল না। আমি দৃশ্যপট থেকে একটু সরে গেলাম।
তবে সরে গেলে মা-র চলবে কেন?
তাই মা বউদির সঙ্গ ধরে শঙ্কর মহারাজের কাছে ছুটেছিলেন মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী শুনতে।
কিন্তু এ কী বাণী শুনলেন?
সবাই কি সংসার করতে আসে? কিছু কিছু মানুষকে অধ্যাত্ম পথের পথিক হতে হয়।
মা ভয় খেয়ে বললেন, তোকে আর মঠে-ফটে যেতে হবে না।
.
০৩.
মা-র ওই নিষেধবাণীতে আর একবার কৌতুক বোধ করলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা দুষ্টুমি খেলে গেল। ভাবলাম এই তো বেশ একটা পথ পাওয়া যাচ্ছে—মার বিয়ে বিয়ে উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাবার। কিছুদিন অন্তত এই পথে খেলানো যায় মাকে।
আর মনের অগোচর পাপ নেই, বউদির উপর টেক্কা দেবার এই একটা সুযোগ পেয়েও বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম। বউদি গেল তার বোনকে নিয়ে আকুলতা পেশ করতে, আর বিজয়িনী হয়ে ফিরে এলাম আমি, হলাম দেবী মা, হলাম ভগবতীর অংশ, এটা অহমিকা পরিতৃপ্তির একটা সুখ এনে দিল বৈকি।
তাই আমি অবহেলাভরে বললাম, কেন? যেতে ভয় কি? শঙ্কর মহারাজ কি আমাকে স্বর্গের পথে চালান করে দেবেন?
মা বললেন, থাক বাবু, ঠাট্টা-তামাসা। ওদিকে আর নয়। সাধু-সন্নিসীরা বড়ো সর্বনেশে জিনিস। ওঁদের দিকে না-মাড়ানোই ভালো।
হেসে ফেললাম।
বললাম, মা, এই ঘণ্টাকতক আগে তুমি আমায় গঞ্জনা দিয়েছ, ওদিক মাড়াতে রাজী হচ্ছিলাম বলে।
সে আলাদা, মা-র গলায় অসন্তোষ, সে এমনি একবার দর্শন করতে যাওয়ার কথা বলেছি।
আমি তো ভাবছি কাল গিয়ে দীক্ষাটা নিয়ে নেব।
বকিসনে, থাম।
বকিসনে কি মা? অত লোকের মধ্যে থেকে তোমাদের মহারাজ আমাকেই সিলেক্ট করে বসলেন, এটা কি কম মজার? আমি কাল যাচ্ছি
কুমতলব ছাড় বেবি, আমাকে জ্বালাতন করতে ওসব গোলমেলে কাণ্ড করতে বসিসনে। কে জানে বাবা ওঁরা সব অন্তর্যামী কিনা, ঠাট্টা-তামাসা না-করাই ভালো।
বেশ তো, অন্তর্যামী কিনা তার পরীক্ষাটা হয়েই যাক।
আগুন নিয়ে খেলতে চেষ্টা করিসনে বেবি!
হেসে উঠলাম।
বললাম, তুমি ভাবছ আগুন, আমি তো ভাবছি স্রেফ ফুলঝুরি।
তারপর বউদি এল, থমথমে মুখ, শানুকে নিয়ে ঝপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। তাই যায় অবশ্য। শানুকে নিয়ে বেড়াতে যায় সর্বত্র, দোকানে, সিনেমায়, অনাত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে, আর বুঝতে আটকায় না বেশ সহজভাবেই যায়, কিন্তু বাড়ি ফিরলেই দুই বোনেই মুখটা বিষণ্ণ করে ফেলে। আত্মীয়-বাড়িতে যায় না ওই জন্যে।
অবশ্য শানু এটা করতেই পারে। জানি, শোকের থেকে লজ্জটাই বড়ো হয়ে ওঠে এ বয়সে। ও যে স্বামী মরে যাওয়া সত্ত্বেও হাসছে, গল্প করছে, সিনেমা দেখছে, এটা স্বচ্ছন্দে করতে লজ্জা করত ওর।
অথচ ওর যা বয়েস, তাতে শোক নিয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া কদিনই বা বিয়ে হয়েছিল ওর? কতইবা ভালোবাসা পড়েছিল বরের উপর?
বউদি বলত, ওর মনটা অন্যমনস্ক রাখতে নিয়ে নিয়ে বেরোই। দাদাও সেই সমীহতে তটস্থ থাকে, আর শানু মুখের উপর একটা বিষণ্ণতার প্রলেপ মেখে মনকে অন্যমনস্ক রাখবার সাধনা করে চলে।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওই মহারাজ আবিষ্কার করাও বউদির আর এক চাল। যেন অন্ধস্নেহ কেবলমাত্র অসার আমোদে নিমজ্জিত রাখছে না বিধবা ছোটোবোনকে, তার উন্নতির পথের সহায়তা করছে। খুঁজে খুঁজে বার করে ফেলেছে তার মুক্তির উপায়।