বুঝতে পারি মা ক্ষুণ্ণ হন, গভীরভাবে একটা নিশ্বাস ফেলেন, স্বগতোক্তি করেন, বাবাঃ, এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়লি? এই তো কথা বলছিলি।
আমাকে জেগে ঘুমিয়ে কাঠ হয়ে পড়ে থাকতে হয়, নড়বার উপায় থাকে না।
.
০২.
কিন্তু ওসব তো বর্তমান নয়, অতীত।
এখন তো আমি বারান্দার পাশের ওই ছোট্ট ঘরটায় আস্তানা গেড়েছি। যে ঘরটায় আমার বাবা যত রাজ্যের পুরনো পত্রিকা জমিয়ে রাখতেন, জমিয়ে রাখতেন ফুটপাত থেকে কেনা পুরনো বই। পত্রিকাগুলোকেও বাবা বই বলতেন, তাই একফালি ঘরটাকে বলতেন লাইব্রেরি।
আমরা হাসতাম বাবার ঘরের ওই নামের বাহার শুনে, কিন্তু এখন বুঝতে পারি ওই বলাটুকুর মধ্যে দিয়েই প্রাণের আকাঙ্ক্ষা মেটাতেন বাবা। হয়তো এমন কতজনের জীবনেই হয়, অন্যজনের কৌতুকহাসির কারণ হয়েও সাধ মেটায়। লোকে সেই দুধের সাধ ঘোলে মেটানো দেখে আহা না বলে বলে, আহারে!
কিন্তু সে যাক। বাবার লাইব্রেরির সেই অমূল্য গ্রন্থরাজী ভাড়ারঘরের তাকে, চিলেকোঠার ঘরে চালান করে দিয়ে আমি নিজের জায়গা করে নিলাম। খাট-পালঙ্ক নয়, মাটিতে সতরঞ্চি পেতে সামান্য বিছানার সম্বলে শোয়া শুরু করলাম। বললাম, একা না শুলে আমরা ধ্যান-ধারণার সুবিধে হচ্ছে না।
ধ্যান-ধারণাই তো বলতে হবে, কারণ আমি তো তখন ছদ্মবেশের খোলসে ঢুকেছি। শঙ্কর মহারাজ আমার নামকরণ করেছেন দেবী মা।
প্রথম দর্শনের দিন থেকেই আমার উপর তার অহেতুক অগাধ কৃপা। যেচে বললেন, কাল আমি একে দীক্ষা দেব।
শুনে তো মা-র মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। মা থতমত গলায় বললেন, ও এমনি বেড়াতে এসেছে বাবা, ওর এখনও বে-থা হয়নি–
মহারাজ বললেন, সবাই কি সংসার করতে আসে? আপনার এই মেয়ে ভগবতীর অংশ। একে উচ্চমার্গের পথে এগিয়ে দেওয়া আপনার কর্তব্য। জননীই প্রকৃত হিতকারিণী!
এই হেঁদো ঘেঁদো কথা শুনে মনে মনে ভারী হাসি পেয়েছিল, বুঝলাম এইভাবেই ওঁরা শিষ্য নম্বর পাঁচশো পঞ্চান্ন বা নশো নিরানব্বই করে থাকেন।
কিন্তু মা ওই ঘেঁদো কথায় ভয় পেলেন, মা তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা বাবা, বাড়ি গিয়ে মেয়ের মন বুঝি—
মা একরকম পালিয়েই এলেন আমাকে নিয়ে। বউদি বসে রইলেন তার সদ্যবিধবা ছোটো বোনকে নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে তার জন্যেই আসা। নচেৎ দাদা-বউদি কোনো মঠে এসে কোনো বাবা মহারাজের সামনে জোড়হস্তে বসে আছেন, এ দৃশ্যের মতো অকল্পনীয় দৃশ্য আর কি ছিল?
কিন্তু আশ্চর্য, সেই সদ্যবিধবা তরুণীর বিষাদাচ্ছন্ন মুখের দিকে নাকি দৃষ্টিপাতও করেননি মহারাজ। বউদি যখন কাঁদো-কঁদো গলায় তার অবস্থা জানিয়েছিল, তখন শুকনো দুটো উপদেশবাণী দিয়েছিলেন, অদৃষ্ট, নিয়তি, প্রাক্তন কর্মফল ইত্যাদি শব্দ-সংবলিত।
কিন্তু আমাকে কেন?
পরে বাড়ি ফিরে ভেবে দেখেছি—আমার মুখে-চোখে অবিশ্বাসের যে কৌতুকচ্ছটা খেলা করছিল, ওঁর ওই অহেতুক কৃপা তার বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ।
অনমনীয়কে আয়ত্তে আনতে পারাই তো শক্তির পরীক্ষা। বিরুদ্ধবাদীকে স্বমতে আনতে পারার মধ্যেই তো আত্মচরিতার্থতা। আমি যে ওঁর কথাগুলোকে ছেদো ভাবছি, এটা ধরে ফেলে উনি রণক্ষেত্রে
অবতরণ করলেন তূণে তীর ভরে। তাই আমার মধ্যে উনি ভগবতীর অংশ আবিষ্কার করলেন।
সেটাও বুঝে ফেলে আরও কৌতুকবোধ করলাম আমি, কিন্তু মা প্রমাদ গুনলেন। মা বাড়ি ফিরে এসে বললেন, তোর আর তোর ওই বউদির সঙ্গে মঠে-ফটে যাবার দরকার নেই।
এটাও কৌতুককর।
বাস্তবিক পক্ষে আমাদের এই জীবনের কোন ঘটনাই বা কৌতুককর নয়। মঠটা বউদির আবিষ্কৃত বটে, কিন্তু মা-রই আকুলতা ছিল বেশি। বউদিরই বরং ইচ্ছা ছিল না তার নিজস্ব আবিষ্কৃত ভূমিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বিনীর প্রবেশাধিকার ঘটুক। কিন্তু সাধু-সন্ত দেব-দেবী তো কারও কেনা জিনিস নয়, কাজেই মাকে আর আমাকেও সঙ্গে নিতে হয়েছিল বউদি বেচারাকে।
তা তখন তাকে আমার বেচারাই মনে হয়েছিল। কারণ বউদি বেশ কয়েকবার বলেছিল, শানু লজ্জা পাবে।
শানু অর্থাৎ শান্তি, বউদির সদ্যবিধবা বোন।
মা কিন্তু বউদির সে অনিচ্ছাকে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, সেকি জয়ন্তী, আমরা কি শানুর পর? বেবির সঙ্গে এক বয়সী, কতদিনের ভাব ওদের!
হ্যাঁ, তখনও আমার নাম ছিল বেবি।
শঙ্কর মহারাজ না শুনে হেসে বলেছিলেন, নামের একটি অক্ষর আমি বদলে দেব। ধ্বনিটা ঠিক থাকবে, ছন্দটাও। শুধু একটি অক্ষর—বেবির বদলে দেবী। দেবী মা।
শুনে তখনই বউদির মুখটা ভারী হয়ে উঠেছিল। তবে তাতে আমি দোষও দেখিনি। সেটাই স্বাভাবিক। ওর অবস্থাটা হয়েছিল যেন যে এল চষে, সে রইল বসে।
বউদিকে ব্যাজার করে আর আমাকে তোয়াজ করে তবে সেদিনকার অভিযান মা-র। হ্যাঁ, তোয়াজ করতে হয়েছিল। আমি রেগে রেগে বলেছিলাম, তোমরা যাচ্ছ যাও না, আবার আমাকে টানা কেন? ও সব আমার ভালো লাগে না।
মা বললেন, একদিন গেলেই বা তোর কী এত লোকসান? শানু যাচ্ছে, তোর সময়বয়সী।
জানি এটা মা-র একটা ট্রি। এই সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কথা বলা। শানু বিধবা হয়েছে, শানু দুঃখী, অতএব শানুকে করুণা করা তোমার কর্তব্য, তাকে সঙ্গ দেওয়া তোমার মানবিকতা বোধের পরিচায়ক। এই আর কি।
কিন্তু আসলে মা-র উদ্দেশ্য ছিল অন্য তা বুঝেছিলাম। মা সেই মহারাজের কাছে জানতে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েটির কবে বিয়ের ফুল ফুটবে। সে ফুল যে অনেকদিন আগেই ফুটিয়ে বসিয়ে রেখেছে তার মেয়ে, সে কথাটি তো জানা ছিল না মা-র!