আচ্ছা, কাল থেকেই কি তবে সেই হাততালিটা দিতে আরম্ভ করব আমি? সকালে উঠে সবাইকে দেখাব এই চিঠিটা? তারপর বলব—
.
৩১.
নাঃ, বলিনি সকালে উঠে।
আগে আসুক ও।
কে বলতে পারে হঠাৎ ওই ছুটিটা না-মঞ্জুর হয়ে যাবে কি না।
যেমন চলছে তেমনিই চলুক তবে।
এই আমাদের পুজো-জপ-ভোগ-আরতি কীর্তনের ফুল দিয়ে মালা গাঁথা।
হাঁ, এক-একটি দিনকে এক-একগাছি ফুলের মালার মতোই লাগে আমার।
যোগ হতে থাকে মালার সঙ্গে মালার, যেমন যোগ হয় জপের সঙ্গে জপের।
তার সঙ্গে দিন গুনছি কবে ওর ছবি আসবে।
কিন্তু ছবি এল না।
ছবির আগে নিজেই চলে এল।
ও সমুদ্রের ভেসে এল না, আকাশে উড়ে উড়ে এল।
.
৩২.
তখন কনে দেখা আলো ঝিকমিক করছে, আমি স্নান সেরে কপালে চন্দনসাজ করে নিরাভরণ নির্মল দেহে আমার সেই দুধ-সাদা মিহি শাড়ি-ব্লাউজ পরে অপেক্ষা করছি হরিচরণের গাড়ির শব্দের হঠাৎ দাদা এসে ঘরে ঢুকল।
একটু যেন উত্তেজিত, একটু যেন বিস্মিত। ।
দেবী, দেখো তো কে একজন এসে দেখা করতে চাইছে তোমার সঙ্গে–
দাদা কোনো নাম করেনি, তবু আমি বুঝতে পারলাম, আমার সমস্ত শরীর হঠাৎ হিম হয়ে গেল। আমি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু তাকিয়ে রইলাম দাদার দিকে।
দাদা নিজেকে একটু সামলে নিল, বলল, খুব সম্ভব তোমার কোনো গুরুভাই-টাই হবে। বলছে পশ্চিম আফ্রিকায় ছিল অনেক দিন। তুমি নাকি জানো আসবে। জাহাজে আসার কথা ছিল, হঠাৎ প্লেনে সিট পেয়ে–
দাদা নিজেকে সামলাল, আমি বেসামাল হলাম। আমি থরথরিয়ে উঠলাম। তাই কী বলব বুঝতে পেরেই বুঝি উত্তেজিত গলায় বলে উঠলাম, পাগল নাকি!
কী? তুমি চেনো না?
কক্ষনো না।
কী আশ্চর্য! তবে কি কোনো বদলোক দাদা বলল, কিন্তু দেখলে তো–
আমি স্থির গলায় বললাম, হয়তো বাড়ি ভুল করেছে।
কিন্তু তোমার নাম-টাম বলল—একবার দেখবে নাকি?
কোনো মানে হয় না দেখা করবার।
বললাম আমি স্পষ্ট স্থির গলায়।
কোনো মানে হয় না দেখা করবার।
কারণ আমি তখনই সেটা স্পষ্ট টের পেলাম, কোনো মানে হয় না দেখা করবার। দাদা আরও কি বলতে যাচ্ছিল, হরিচরণের গাড়ির আওয়াজ পেলাম। পরিচিত হন।
আমি বললাম, আমি যাচ্ছি। বাড়ি ভুল করেছে সেটাই বুঝিয়ে দাও গে।
হয়তো সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দাদার পক্ষে শক্ত হত, হয়তো ও কিছুতেই বুঝতে চাইত না। কিন্তু ওর ভাগ্যই ওকে বুঝিয়ে দিল, নিঃশব্দে সহজে, যে ভাগ্য ওকে বসবার ঘরে বসিয়ে না রেখে ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
হয়তো গাড়িটাকে আসতে দেখেই ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, হয়তো শুধু শুধুই। স্থির থাকতে পারছি না বলে।
আমি ওর সামনে দিয়ে এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। আমার কানে এক টুকরো গরম সীসে এসে ঢুকল। কিন্তু সেটা আমি কানে রাখব কেন? ও তো দেবীবলল না, বলল বেবি।
যে নাম সবাই ভুলে গেছে, আমি নিজেও ভুলে গেছি।
আমি দেবী। দেবী মা। মঠ থেকে নিয়মিত আমার জন্যে গাড়ি আসে, কারণ আমি সুরে সুর না মেলালে কীর্তনে প্রাণসঞ্চার হয় না। এর বেশি আর কি চাইবার থাকতে পারে জীবনে?
.
৩৩.
আজ আর দেরি হয়নি।
হরিচরণ আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি নিজেকে ছেড়ে দিয়ে আরামদায়ক সিটে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি। আর আমার ভয় নেই, কারণ আমি কুমিরের হাঁ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি।
এখন আমি শান্ত আর আত্মস্থ মহিমায় মঠের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে মালঞ্চ আর তুলসীবনের মাঝখানের কেয়ারি-করা পথটি ধরে নাট-মন্দিরের বাঁধানো চত্বরের পাশ দিয়ে অভ্যস্ত অধিকারের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাব বিগ্রহেব ঘরের পিছনে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাব বারান্দায়, মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে দাঁড়াব বিগ্রহের সামনে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আর এক জীবন্ত বিগ্রহ। যার পরনে গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া রঙের দুধে-গরদের ধুতি-চাদর, যে চাদর খসে খসে পড়ে বার বার উদ্ভাসিত করে তোলে দীঘোন্নত সুগঠিত দেহদ্যুতি। কপালে তাঁর চন্দনলেখা, গলায় আজানুলম্বিত গোড়েমালা, মুখে অলৌকিক করুণার হাসি!
এ আশ্রয় ছেড়ে কোথায় যাব আমি? এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কি আছে?