.
২৯.
পরদিন কিন্তু ভয়ানক একটা গ্লানি নিয়ে উঠলাম। মনে হল দাদা-বউদির কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না। বাস্তবিক কী হাস্যকর কাণ্ডই করলাম কাল! কী দরকার পড়েছিল সাজবার, আর সাজ ঘোচাবার?
হঠাৎ হরিচরণের উপরও রাগ হল। ও যদি ঠিক সেই মুহূর্তে এসে হাজির না হত! আমাকে নিয়ে যেন কে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
বিকেলবেলা শিপ্রা এল।
বলল, জানতাম আসবে না।
জানতে?
তা ছাড়া কি? আমার ছেলের কি এত ভাগ্যি হবে?
এই ছিঃ, তোমার ছেলেকে দেখে আসব একদিন।
দেখা যাক কবে সাতমণ তেল পোড়ে।
কথার পালা শেষ করে ও কাজের কথায় এল। বলল, এই দেখ কাণ্ড কি এসেছে। ভাবলাম তুমি আসবে, তোমরা হাতেই দেব। তা এলেই না।
তারপর ব্যাগ থেকে চিঠি বার করল।
দুরন্তর চিঠি।
লিখেছে–
ভয়ঙ্কর একটা সুখবর দিচ্ছি নাও। কিন্তু খবরদার শুনে যেন আহ্লাদে হার্টফেল করে বোসো না। শুধু বিগলিত হও, উন্নতি হও। শোনো, আমার ওপরওলার সঙ্গে সাংঘাতিক রকম ভাব করে ফেলে একদিন আমার জীবনের সব কথা বলে বসেছিলাম, তার ফলে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার দুমাস ছুটি মঞ্জুর করেছে বিয়ে করে ফেলবার জন্যে। আবার তার সঙ্গে যাতায়াতের খরচা। ভাবতে পারো? অবশ্য এটা একা আমার।…নিকষ কালো মুখে দুষ্টু দুষ্টু হেসে বলল-ফেরার সময় তোমার খরচা আছে। বউকে নিয়ে আসবে। ওটা কিন্তু কোম্পানি দেবে না। তবে ফিরে এসে আলাদা বাড়ি পাবে।… ভারি ভালো লোক! তাছাড়া আমার কাজে এত বেশি সন্তুষ্ট যে নিয়ম ভেঙে সুযোগ দিচ্ছে। আমার দলের আর সবাই আমার সৌভাগ্যে ঈর্ষিত। এর পর আবার যখন একটি সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে ফিরব, রাগে বোধহয় আমার মুখ দেখবে না।
তারপর টাকাকড়ি, এখানের ব্যাঙ্ক ওখানের ব্যাঙ্ক, তার নিয়মকানুন, কত কি যেন লিখে শেষকালে লিখেছে, একমাস পরেই রওনা দিচ্ছি। তার আগে তোমায় আমার এখনকার একটা ফটো পাঠাব, যাতে দেখে সহজে চিনতে পার। কে জানে যদি বদলেই গিয়ে থাকি।…এই একমাস বোধহয় রাত্রে ঘুমোতে পারব না, কারণ এখন থেকেই যা রোমাঞ্চ হচ্ছে।…এখানে এসে তোমার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে প্রতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। আগে ভয় ভয় করত, এখন সাংঘাতিক ভাবে এই বন্য সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গেছি। দেখ, তোমাকেও পড়তে হবে প্রেমে।…আরে না না, তুমি শুধু আমার প্রেমে ডুবে থেকো।
ইতি
তোমার শ্রীদুরন্ত।
কতদিন ধরে কোনো অজানিত দেশে পড়ে আছে দুরন্ত, কেমন তার কাজ, কেমন সহকর্মীরা, কেমনই বা প্রভু, কী তাদের ভাষা, কী আচার-আচরণ, তবু ওর চিঠির ভাষা বদলায়নি। যে ভাষাটা ঠিক ওর মুখের ভাষারই মতো। কারণে অকারণে ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক, অদ্ভুত, অপূর্ব।
ভাষা বদলায়নি, তার মানে স্বভাব বদলায়নি।
অথচ আমি আমার নিজের কেন্দ্রে থেকেও ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাচ্ছি।
কিন্তু আমি কি আমার কেন্দ্রে আছি?
শিপ্রা ক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেল।
কারণ শিপ্রা বুঝে গেল আমার সেই বদলটা। এতদিন ধরে ও আশা করেছিল, প্রয়োজন ফুরোলেই আমি আমার এই মিথ্যাচরণ ভেঙে ফেলে প্রকাশিত হব, কারণ ওকে আমি ষড়যন্ত্রের সাক্ষী রেখেছিলাম। ও বলেছিল, তোর বিয়ের দিন আমি তোকে সাজাব। বলেছিল, শবরীর প্রতীক্ষার আর-এক ইতিহাস সৃষ্টি করছিস তুই।
কিন্তু আজ বুঝতে পেরে গেল আমার জগৎ আর ওর জগৎ ভিন্ন হয়ে গেছে। বুঝতে পারল, ভয়ঙ্কর সুখবরবাহী ওই চিঠিটা আমাকে আর এখন উল্লসিত করে তুলতে পারল না। খুব ভালো করে পড়লামও না আমি।
.
৩০.
নাঃ, সত্যিই ভালো করে পড়তে পারিনি।
ওর সুখবরটা হঠাৎ যেন আমার বুকে হাতুড়ির ঘা বসিয়ে দিয়েছিল। মনে হল যেন একখানা লোভের হাত এগিয়ে আসতে চাইছে আমার শান্তির বাসা ভেঙে দিতে।
মনে হল সে হাত অশুচি।
তবে? আমি কেন এগোতে দেব সে হাত?
আমি আমার নিভৃত শান্তি, আমার শুভ্র পবিত্রতা কলুষিত করতে দেব কেন?
কে ও?
আমার একদার মাস্টারমশায়ের আশ্রিত একটা বন্য বর্বর বাজে ছেলে। লেখাপড়া ছেড়ে টাকা টাকা করে ছুটে গিয়েছে আফ্রিকার জঙ্গলে। কে জানে কী খাচ্ছে কী না-খাচ্ছে, কী অপবিত্রতার মধ্যে জীবন যাপন করছে, ওর ওই লোভের হাতে নিজেকে সমর্পণ করব আমি?
ছিঃ! কেন?
এক সময় একটু ছেলেমানুষী ভালোবাসার খেলা খেলেছিলাম বলে? সেই দাবিতে ও আমায় টেনে নিয়ে যাবে আরও বর্বরতার মধ্যে?
না না, অসম্ভব।
ওর সঙ্গে আর আমার জীবনের ছন্দ মিলবে না।
আমার জীবনের ছন্দ শান্ত স্নিগ্ধ শুদ্ধ।
কিন্তু পুজো করতে বসে মন বসাতে পারছি না কেন?
বারে বারে ওই দেবমূর্তির জায়গায় একটা অশান্ত অস্থির-মূর্তির ছায়া পড়ছে কেন? ভয়ঙ্কর একটা যন্ত্রণা বোধ করছি কেন? এ কি অশুচি চিন্তার গ্লানির যন্ত্রণা? না খোলস ভেঙে পড়বার আকুতি?
আমি বুঝতে পারছি না।
আমার ভয় করছে।
মনে হচ্ছে ওই প্রবল হাত আমায় এই শান্তির ছন্দের মধ্যে থাকতে দেবে না। টেনে নিয়ে যাবে, লুঠ করে নেবে।
নিক তবে, সর্বস্ব নিক আমার।
নিজের তৈরি যে জালে আটকে পড়ে ছটফট করছি আমি, সে জাল থেকে উদ্ধার করুক আমায় ছিঁড়ে খুঁড়ে তচনচ্ করে।
লজ্জা করবে?
কই, শানুর তো লজ্জা করল না?
শানু তো মুছে-ফেলা সিঁথিতে আবার সিঁদুর তুলেছে। তবে আমার এই কুমারী সিঁথির শুভ্রতা রক্তিম করে তুলতে লজ্জা কি? সেই রক্তিম সিঁথি নিয়ে আমি তো হাততালি দিয়ে বলতে পারব সবাইকে-দেখ, এতদিন কেমন ঠকিয়ে এসেছি তোমাদের! এই অভিনয়টি না করলে তোমরা আমায় প্রতীক্ষার স্বস্তি নিয়ে টিকতে দিতে কি?