তার মানে দাদা ঘরে ঢোকবার আগেই খবর শুনেছে। আর দাদার মনটা খুশি হয়েছে সে খবরে। দাদার স্নেহের সুরটাই সেই খুশির সাক্ষী।
কিন্তু আমার এ কী হল?
আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে যাওয়া এক দুর্দান্ত লজ্জার ধাক্কা যেন বিদ্যুতের শক-এর মতো ধাক্কা মেরে ছিটকে সরিয়ে দিল আমায় আয়নার কাছ থেকে। ভয়ঙ্কর রাগ হল দাদার উপর, ভয়ঙ্কর রাগ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উপর। সারা শরীরের মধ্যে ধ্বনিত হল, ছি ছি ছি! এ আমি কী করেছি!
.
২৮.
কেমন করে যে ছিটকে সে ঘরের থেকে চলে এসেছিলাম তা জানি না, কেমন করে যে সেই শাড়ি-গহনাগুলোর ভারমুক্ত হয়েছিলাম, তাও জানি না। শুধু মনে আছে খুব হাঁপাচ্ছিলাম।
এই সময় বুড়ি, গোপালের মা এসে দরজায় দাঁড়াল, দিদি, তোমার গাড়ি এয়েছে।
গাড়ি এসেছে!
কোথাকার গাড়ি?
শিপ্রার পাঠানো?
আরে না না, মঠের গাড়ি। হরিচরণ এনেছে। কনে দেখা আলো মুছে সন্ধ্যার ছায়া পড়ে গেছে যে। আরতির সময় হয়েছে।
কৃতজ্ঞতায় মনে মনে দেয়ালে মাথা কুটে বললাম, ঠাকুর, তুমি আছ, তুমি আছ। তারপর স্নানের ঘরে ঢুকে ধুয়ে ফেললাম মুখের সব রং, মুছে ফেললাম চোখের কাজল, কপালের টিপ। আলনা থেকে নিজের দুধ-সাদা শাড়ি-ব্লাউজটা পরে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেলাম, ভীষণ ভুলে গিয়েছিলাম বউদি! আজ যে মঠে একটা বিশেষ উৎসব। শিপ্রার বাড়ি থেকে কেউ নিতে এলে বলে দিও…তোমার শাড়ি-টাড়িগুলো অগোছালো করে রেখে গেলাম বাপু
বউদির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবার সঙ্কল্পটা পালন করলাম। বউদি বলে ডাকলাম, অনেকগুলো কথা বললাম।
কিন্তু বউদি কি বুঝল আমি ভালো ব্যবহার করেছি? নাকি সেও ছি ছি করে উঠে নিশ্বাস ফেলল।
জানি না কী করল।
আমি তো গাড়িতে উঠে নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।
যেমন নিশ্বাস ফেলে লোকে আততায়ীর হাত থেকে উদ্ধার হয়ে নিজের এলাকায় পৌঁছে যেতে পারলে।
কিন্তু আততায়ী কে?
তাও জানি না। ভেবে দেখবারও সময় নেই, আরতির সময় পার হয়। হরিচরণ পড়ি মরি করে গাড়ি চালাচ্ছে। মঠের ব্যাপার, ঘড়ির কাটায় চলে। মুখের রং তুলতে যেটুকু দেরি করে ফেলেছি আমি, তাতেই দেরি।
তবু দেরি হল না, ঠিক সময় এসে পা দিলাম মঠের চৌহদ্দিতে, মালঞ্চ আর তুলসীবনের কেয়ারির মাঝখানের পথ দিয়ে যখন নাটমন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন আরতির ওয়ার্নিং বেল বাজছে। ঢং ঢং ঢং।
যে যেখানে ছড়িয়ে আছে, এসে স্থির হয়ে বসবে, তাই এই জানান।
আমি নাট-মন্দিরে উঠলাম না, অভ্যস্ত নিয়মে চত্বরের পাশ দিয়ে চলে গেলাম বিগ্রহের ঘরের পিছনে। ভক্তপদধূলি মাথায় ঠেকিয়ে সিঁড়িতে পা দিলাম। উঠে গিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে বিগ্রহের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
দাঁড়ালাম যেখানে শঙ্কর মহারাজও দাঁড়িয়ে আছেন জীবন্ত বিগ্রহের মতো। সেই দীঘোন্নত গৌরকান্তি, সেই গায়ের রঙে এক হয়ে যাওয়া দুধে-গরদের ধুতি-চাদর, সেই আজানুলম্বিত গোড়েমালা, সেই শুভ্র ললাটে ইন্দু সমান চন্দনচর্চা। মাথা নুইয়ে এল।
সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলাম।
এই প্রথম এই প্রণাম।
আমি কখনও আমার ওই মঠের দিদিদের কিংবা ব্রহ্মচারী দাদাদের মতো সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি না, ওটা দেখলে আমার হাসি পায়, সেকেলে লাগে, অতিভক্তি মনে হয়। আমার প্রণামের ভঙ্গি নতজানু। হয়ে আস্তে চরণে মাথা ঠেকানো। চরণে মানে চরণের প্রান্তে। চরণ স্পর্শ করা নিষেধ।
কিন্তু আজ আমি সেকেলের মতো লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বহে গেল। লজ্জার নয়, আনন্দের।
গুরুদেব আজ ইচ্ছে করে নিয়ম ভাঙলেন, স্পর্শ দিলেন মাথায়। তার মানে বুঝতে পেরেছেন। আমার চাঞ্চল্য। তাই তাকে প্রশমিত করতে–
কী দয়া, কী করুণা!
ভাগ্য আমার জন্যে এত ঐশ্বর্যও তুলে রেখেছিল।
আরতি অন্তে হরিরলুঠের কাড়াকাড়ির সময় গুরুদেব নিজে আমার হাত টেনে নিয়ে একটি সন্দেশ তুলে দিলেন, বললেন, মায়ের মনে আজ বড়ো চাঞ্চল্য, তাই না? বড়ো ভয় পেয়েছিস?
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সত্যিই কি অন্তর্যামী?
নইলে কেমন করে জানলেন, ভয় পেয়েছি! আগে হলে হয়তো ভাবতাম, বুঝতে পারবেন না কেন, মানুষ চরানোই তো পেশা। হয়তো ভাবতাম, গুরু হবার আগে থরিডিংটা শিখে নিতে হয় বোধহয়।…কিন্তু আজ আর সে কথা মনে এল না। আজ আমি অবাক হলাম, বিহ্বল হলাম। তার মানে খোলসের চাপে আমার সত্তাটা তরলিত হয়ে যাচ্ছে।…ছদ্মনামের আড়ালে আমার সত্যিকার নামটা ঢেকে যাচ্ছে। আর তাতে আমি প্রতিবাদ করে উঠছি না, বরং যেন একটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি।
আচ্ছা, আজও কি রাত্রে বিনিদ্র শয্যায় শুয়ে ভাবব, লোকটা জাদু জানে? ভাবব, আমাকে কবলিত করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে কেন ও?
কিন্তু বিনিদ্র শয্যায় শুয়ে চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত কি হই আজকাল? রাত্রে কি পায়চারি করি? স্নানের ঘরে গিয়ে শাওয়ারের তলায় মাথা পাতি?
কই, মনে পড়ছে না তো?
কবে শেষ এ রকম করেছিলাম?
ভুলে গেছি।
আজকাল বহুক্ষণ কীর্তনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মিলিয়ে দোহার দিতে, আর কীর্তন গান গাইতে এত পরিশ্রম হয় যে, রাতে যে-পাশে শুই, সকালে সেই পাশে উঠি। তার মানে খোলসটা ক্রমশ এঁটে বসছে। আমি সেটা রোধ করতে পারছি না। আমি যেন দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করছি।