অতএব আমি দেবী মার খোলসে ঢুকে পড়লাম।
খুব নরম মিষ্টি আর করুণার হাসি হেসে বললাম, সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায় শানু!
শানুর বরটা একটু প্রগভের মতো বলে উঠল, আর আমায় বুঝি খুব খারাপ দেখছেন?
আমি আরও মিষ্টি হেসে ওকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললাম, তোমায় তো আগে দেখিনি ভাই! মনে হল অনেকটা উঁচুতে উঠে গেলাম ওদের থেকে।
তারপর ওদের হাতে আমার ঠাকুরের প্রসাদ দিলাম।
আর তারও পর শানু ছোট্ট একটি রুপোর মালা দিয়ে আমার ঠাকুরকে প্রণাম করে লাজুক হেসে বলল, আমার মানত ছিল।
চলে গেল তারপর।
অনেকদিন পরে এ বাড়িতে হাসি আমোদ হই হুল্লোড় শোনা গেল। দাদার খোলা গলার হাসিটা যেন অপরিচিত মনে হল।
ছোট্ট একটি পাষাণ দেবতার ভারে পাহাড় চাপিয়ে রেখেছি আমি সংসারে, আজ ওরা সে সংসারে আর একটা জানলা খুলে একটু নিশ্বাস নিচ্ছে।
শুনলাম দাদার ছেলেটা নাকি এই কঘণ্টাতেই মেসোর পরম ভক্ত হয়ে গেছে। বলছে নাকি মাসির সঙ্গে আসানসোলে চলে যাবে।
আচ্ছা, নিত্য হাজার ইষ্টনামের অবদানেও ঈর্ষা জিনিসটা যায় না কেন?
মঠে দিদিরা আমায় ঈর্ষা করে, আমি তুচ্ছ শানুকে ঈর্ষা করছি। অথচ ওই ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকাই না আমি, যে ছেলেটা পিসিকে না ভজে মাসিকে ভজতে চাইছে।
২৬-৩৩. এই বউদি শোন
পরদিন বউদিকে তাজ্জব করে দিয়ে ওর ঘরে গিয়ে বললাম, এই বউদি শোন, তোমার কী সব বেনারসী-টেনারসী আছে বার কর তো! আমায় ধার দাও একটা ঘণ্টাকয়েকের জন্যে।
বউদি হাঁ করে তাকাল।
আমি মজা পেলাম।
আবার তেমনি হাল্কা গলায় বললাম, আরে শোন তাহলে, নিজের ভালো শাড়ি-টাড়ি তো পরে পরে ঠিক করেছি, এদিকে শিপ্রা ছেলের ভাতের নেমন্তন্ন করে গেছে। ভীষণ নাকি ঘটার ব্যাপার, খুব সেজেগুঁজে যাবার হুকুম।
এটা বানালাম। লজ্জা ঢাকলাম একটু।
কিন্তু তাতে কি?
আমার সব কিছুই তো বানানো। সবই তো মিথ্যে। সমুদ্রে শয়ন যার, গোস্পদে কি ডর তার?
বউদি কৃতাৰ্থমন্য হয়ে ওর সমস্ত দামী শাড়িগুলো আলমারি থেকে বার করে খাটের ওপর স্থূপাকার করে রাখল। তারপর একখানা সাদা জরির ছোটো ফুটকি দেওয়া গাঢ় সবুজের হালকা বেনারসী তুলে সাবধানে বলল, এটা তোমায় খুব মানাবে।
সরু একটা মুক্তোর মালাও দিল ভয়ে ভয়ে, দিল মুক্তোর কানবালা। আমার ঘরে আয়না নেই, বউদির ঘরেই সাজতে বসলাম আয়োজন উপকরণ নিয়ে।
বউদি খুব সাবধানে বলল, ড্রেসিং-টেবিলে পাউডার-টাউডার সবই আছে। তোমার পুরনো বন্ধুবান্ধবরা আসবে সবাই। কত সাজবে তারা!
বলে চলে গেল।
হঠাৎ ভারী আশ্চর্য লাগল। আর ভারী লজ্জা হল।
মনে হল বউদির প্রতি এতদিন অবিচার করে এসেছি। মনে করেছিলাম শাড়ির প্রসঙ্গে বউদির মুখে হয়তো একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠবে।
কিন্তু বউদির চোখের কোণে বাস্পের আভাস দেখলাম।
তাই তাড়াতাড়ি পালাল বউদি।
তার মানে আমার জন্যে তার মনেও অনেকখানি মমতা সঞ্চিত আছে। আমার এই অকারণ কৃচ্ছসাধনে দুঃখ পায় বউদি। হয়তো গতকাল যখন শানুর পাতে ভেটকীর ফ্রাই ভেজে ভেজে দিচ্ছিল,
তখন আমার জন্যে ওর মন কেমন করছিল। জিনিসটা একদা ভারি প্রিয় ছিল আমার।
মনে ভাবলাম, কাল থেকে বউদির সঙ্গে আর একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে। বড্ড যেন অগ্রাহ্য করি। ওর আবিষ্কৃত মঠটাকে দখল করে নিয়ে আমি ওকে অবজ্ঞার চোখে দেখি। এটা ঠিক নয়, এটা অসভ্যতা।
তারপর বউদির মান রাখতেই যেন বউদির বড়ো আয়নাদার ড্রেসিং-টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
.
২৭.
কিন্তু এ কী!
কতদিন পরে নিজেকে দেখলাম আমি!
এ কী হতশ্রী চেহারা হয়েছে আমার!
আমার মঠের দিদিরা আমায় বলে, কী রূপ!
আমি সে প্রশস্তি পরিপাক করি।
আমার গুরুদেব বলেন, মা আমার পূর্বজন্মে ব্রজের গোপিকা ছিল। আমি নতমুখে সে গৌরব গ্রহণ করি, আর বড়ো আরশীতে না দেখলেও নিজে মনে ভাবি আমি আমার এই কৃচ্ছ্বসাধনের জ্যোতিঃপ্রলেপমণ্ডিত কৃশতনুতে, এই তৈলবিহীন রুক্ষ চুলে ঘেরা মুখে, সত্যই অপরূপা।
আর এ-কথাও ভাবতে ছাড়ি না, মঠে আমার প্রাধান্যের মূলে হয়তো এই রূপও কিছু কাজ করে।
কিন্তু আজ এই এক দাম্পত্যজীবনের বহু চিহ্নমণ্ডিত ঘরের যুগলশয্যায় সূপীকৃত করা শাড়ির পাহাড়ের চোখ-ধাঁধানো বর্ণবৈচিত্র্যের মাঝখানে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের খালি হাত আর সরু হলদে পাড় ধুতি পরা হতশ্রী চেহারাটা এনে আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গহাসি হাসল।
যেন দুয়ো দিল আমায়।
যেন বলে উঠল, কী মুখ, কী মুখ! মশা মারতে কামান দেগেছে!
সেই ব্যঙ্গহাসির দিকে তাকিয়ে আমি সহসা হিংস্র হয়ে উঠলাম। উগ্র হয়ে উঠলাম। আমি বউদির সাজসজ্জার সমস্ত উপকরণ নিয়ে নিখুঁত করে সাজালাম নিজেকে।
আশ্চর্য, কিছুই তো ভুলে যাইনি।
কাজল পরলাম সরু রেখায়, কুঙ্কুমের টিপটি আঁকলাম সযত্নে, কানে দোলালাম মুক্তোর কানবালা, গলায় সরু মুক্তোর হার।
হিংস্র জবাবের মনোভাব থেকে কখন যেন শোকাচ্ছন্নের মতো অবস্থা ঘটল। মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে রইলাম নিজের প্রতিচ্ছায়ার দিকে।
মনে হল বিয়ের সাজ সাজছি আমি।
জানলা দিয়ে এসে পড়া পড়ন্ত সূর্যের কনে দেখা আলো সেই ভাবনাকে আরও মধুর করে তুলল।
কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানি না, দাদা ঘরে ঢুকল অফিস থেকে এসে। কোমল স্নেহের গলায় বলল, নেমন্তন্নে যাচ্ছিস? বন্ধুর ছেলের ভাতে? পৌঁছে দিয়ে আসব?