আর—আর হয়তো বা—এই সংসার রণক্ষেত্রে প্রবল প্রতিপক্ষের সামনে একান্ত নিঃসহায় হয়ে পড়ার থেকে, এই পৃষ্ঠবলটুকু মা-র কাছে এখন ভাগ্যের দান বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া বউদির বোনের সঙ্গে মা-র মেয়েকে তুলনা করে মা যেন অনেকটা উঁচু আসনে উঠে গেছেন।
দিদি থাকে রেঙ্গুনে, মেজদি কোয়েম্বাটুরে।
ওরা কদাচ আসে। অথবা আসে না। ওদের সঙ্গে এ সংসারের নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়ে গেছে, হয়তো বা মা-র সঙ্গেও। দূরে থাকতে থাকতে বুঝি মন থেকেও দূরে চলে যায়। মা-র ব্যবহার দেখলে মনে হয়, একটাই মেয়ে আমি মা-র।
দু-এক বছরে দিদিরা কেউ একটা চিঠি দিলে, মা আমায় বলেন, ওরে বেবি, তুই-ই একটা উত্তর দিয়ে দে। আমার তো সেই সাতজন্ম দেরি হবে!
বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে আমার জন্মের আগে, মেজদির আমার নিতান্ত শৈশবে। দেখেছিই বা কবে? তবু আমিই চিঠি লিখি গুছিয়ে গুছিয়ে। অনেকদিন পরে দিদিরা সে চিঠির উত্তর দেয়, আমাকে নয়, মাকে। হয়তো লেখে, বেবি বেশ গুছিয়ে চিঠি লিখতে শিখেছে। হয়তো লেখে, বেবির বিয়ের বয়েস পার হয়ে গেল। আমাদের কোকালে বাড়িছাড়া করে দিয়েছ। কোলের মেয়েটিকে বেশ কোলে রেখে দিয়েছ।
দূরে থাকলেও বয়সের হিসেবটা ঠিক রেখেছে।
কিন্তু আর কি চিঠি আসে দিদিদের?
কই?
বহুদিন তো আসেনি। মা
কে হঠাৎ জিগ্যেস করলাম।
মা ভাঁড়ারের দরজায় বসে চালের কাকর বাছছিলেন। আমার ঠাকুরের ভোগ হয়, একটি কাকর থাকলে চলে না।
আশ্চর্য, এ সব যে আমি শিখলাম কোথা থেকে!
মা হঠাৎ আমার মুখে এরকম একটা সংসারী কথা শুনে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এসেছিল।
কার? বড়দির? না মেজদির?
আঃ, কতদিন এই নামগুলো উচ্চারণ করিনি। বেশ লাগল।
মা তেমনি ভাবেই বললেন, দুজনেরই।
কই বলনি তো আমায়?জবাব দেওয়া হল না।
মা আস্তে বললেন, দিয়েছি। আমিই দিয়ে দিয়েছি। তুমি ব্যস্ত থাক।
সহসা লক্ষ্য পড়ল, মা আর আমায় তুই বলেন না। কতদিন বলেন না?
আমার অভিমান হল। বড়ো মেয়েদের চিঠি মা নিজে লিখেছেন বলে নয়, আমাকে তুমি বললেন বলে।
অথচ মা আমায় তুমি করে কথা বলছেন অনেকদিন। বেবির বদলে আলতো করে দেবীও বলেছেন কতদিন যেন। দাদাও যেন ওই ব আর দয়ের মধ্যবর্তী কি বলে।
বউদি অবশ্য দেবী বলে না, কিন্তু বেবিই বা কবে বলে? ডাকেই না তো!
হঠাৎ আমার সেই পুরনো নামটার জন্যে ভয়ানক মন কেমন করে উঠল। মনে পড়ে গেল দুরন্তর সেই প্রথম আদরের অভিব্যক্তি।
বেবি, বেবি! কচি খুকু! আহা-হা! লজেন্স খাবে খুকু? ড পুতুল নেবে?
মনে হল এসব নিশ্চয়ই আর মনে নেই ওর। ও বিচ্ছিরী রকম বদলে গেছে। ও হয়তো কাটখোট্টা হয়ে গেছে, হয়তো নিগ্রোদের মতো দেখতে হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে ভাবতে বসলাম ওইসব, তারপর কঁদতে বসলাম।
বসলাম ঘরের দরজা বন্ধ করে সন্ধ্যার ধ্যান-ধারণার ছুতোয়।
কেঁদে কেঁদে বললাম, জীবনের সব সোনার দিনগুলো বরবাদ করে দিয়ে সোনা কুড়াচ্ছো তুমি! ফিরে এসে যদি আমায় না পাও?
তারপর চোখ মুছে উঠলাম।
মনের জোর করে বললাম, পাবে না কেন, আমি তো আর সত্যি বদলাচ্ছি না।
আর ও যদি বদলে আসে? ভেঙে চুরে তন করে দেব সেই বদল।
.
২৪.
পরদিন বাড়িতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
শানু এল তার নতুন বরকে নিয়ে।
শুনলাম আগে থেকে নাকি নেমন্তন্ন করা হয়েছে।
বউদি দেয়ালকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, কী আর করব, মায়ের পেটের মা-মরা ছোটোবোন, ফেলব কি করে? ভাই-ভাজ তো ত্যাগ করেছে, ও বেচারী যায় কোথায়?
সত্যি, যায় কোথায়? আদর খাবার একটা জায়গা তো দরকার ওর।
অতএব এল।
নতুন শাড়ি-গহনায় ঝলমলিয়ে ঠিক নববিবাহিতার মূর্তিতেই এল। চোখের কোণে সেই ঔজ্জ্বল্য, মুখের হাসিতে সেই মাধুর্য। আগেকার লাজুক লাজুক কুণ্ঠিত কুণ্ঠিত ভাবটা আর নেই, মুখে চোখে আর এক মোহময় লজ্জার আবেশ।
আগে আমি দেখিনি, মা এসে চুপি চুপি বলেছিলেন, যা-ইচ্ছে হচ্ছে এখন সংসারে। শানু তো বর নিয়ে নেমন্তন্নে এল। মাংস রান্না হচ্ছে ঘটা করে। চপ-কাটলেটও হবে মনে হয়।
সব কিছু শুনে হঠাৎ মনে হল, এখন খাবার ঘরের টেবিলে বসেই ওসব খেতে পারবে শানু সবার সামনে।
তার মানে বাধা জিনিসটা কেবলমাত্র একটা লোকাঁচার।
লজ্জা জিনিসটা শুধু একটা কাগজের দেয়াল।
তাহলে আমারও কিছু ভাবনার নেই।
আমিও আবার আমার এই ব্রহ্মচর্যের খোলস ফেলে সহজেই রঙে রসে উথলে উঠতে পারব।
মা বললেন, সিঁদুর পরেছে সিঁথি জুড়ে।
বিরক্ত হয়ে বললাম, বিয়ে হয়েছে, পরবে না কেন?
মা ভয়ে ভয়ে সরে গেলেন।
মা-র তার এই দেবীকন্যার বিরক্তিতে বড়ো ভয়।
.
২৫.
আমি অবশ্য নিজে উঠে দেখা করতে গেলাম না। শানুই এল একসময়।
ঘরের বাইরে অস্ফুট একটু কণ্ঠ শুনলাম, এই হচ্ছে দিদির ননদের ঠাকুরঘর।
শানুও আমায় আর বেবি বলল না, বলল দিদির ননদ।
তারপর ঘরে এসে দাঁড়াল দুজনে হাসিমুখে।
শানুর মুখে নবোঢ়ার রং, শানুর বরের মুখে নতুন বরের খুশি। ওরা যে পরস্পরকে ভালো বেসেছে তাতে সন্দেহ নেই।
এতক্ষণ ভাবছিলাম, দেখা হলে বলব শানুকে, দেখলে তো শানু, জীবন জিনিসটা কত দামী? দেখলে তো ওকে হারিয়ে ফেললেই হারিয়ে গেল বলে পরকালের পথ খুঁজতে বসতে নেই। আবার তাকে আহরণ করে নিতে হয়।
কিন্তু বলতে পারলাম না।
হঠাৎ ওদের সামনে নিজেকে ভারি বেচারি মনে হল। মনে হল, আমাকে ওরা করুণার দৃষ্টিতে দেখছে। আমি ওসব কথা বললে ওরা হেসে উঠবে। বলবে, তুমি জীবনের বোঝ কি হে?