এখানের সবাই আপনার মা।
তুই হচ্ছিস ব্রহ্ময়মী মা।
না। আমি সাধারণ একটা মেয়ে।
উনি মিষ্টি হেসে বলেন, তুই কি, তা কি তুই নিজে জানিস? তুই কি নিজেকে দেখতে পাস? যেমন আমি পাচ্ছি?
আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।
আমার মনে হল সার্চলাইট জ্বেলে উনি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন।
ভয়ে থর থর করে উঠল ভিতরটা।
আমার ভিতরে এখন কিসের কুটিলতা উঁকি মারছে সে তো আমি জানি। জানি, সেকথা ওই দেবোপম প্রৌঢ় মানুষটি সম্পর্কে ভাবাও মহানরক, তবু আমার মনের মধ্যে ছিল সে সন্দেহের গ্লানি।
আমি ভাবছিলাম ওঁর ওই কাজল পরার মতো চোখে যে দৃষ্টি, সে কি পিতৃদৃষ্টি? যে কণ্ঠ আমায় দেবীমা বলে আদরের সম্বোধন করছে, সে কি পিতৃকণ্ঠ?
এ সন্দেহ দেখতে পাচ্ছেন তবে উনি?
আমার কিছুক্ষণ আগের সাহসটা হারিয়ে গেল। আমি আস্তে বললাম, তা তোক আমার লজ্জা করে। সবাই তো শিষ্য, সবাই সমান।
উনি বললেন, এই তো পরীক্ষায় জয়ী হলি। আরও পরীক্ষা আসবে। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তবে তো সীতাদেবী হবি।
তখন মনে হল ওঁর দৃষ্টিতে যে আলো, সে আলো স্বর্গের আলো। ওঁর কণ্ঠে যে মাধুর্য, সে মাধুর্য মন্দাকিনীর ধারার। মরমে মরে গেলাম।
মাথা হেঁট করলাম।
.
২২.
সেদিন বাড়ি ফিরেই দেখলাম শিপ্রা এসেছে।
শিপ্রা আসা মানেই দুরন্তর চিঠি আসা।
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর ওপর।
মনে হল ও যেন আমার উদ্ধারকত্রী হয়ে এল। ভগবান বলে যদি সত্যি কেউ থাকে, তাহলে যেন এই চিঠিতে দুরন্তর ফেরার খবর থাকে।
কিন্তু থাকবে কেন?
সাত বছরের পাঁচটা বছর তো মাত্র শেষ হয়েছে। আরও সবচেয়ে দীর্ঘ দুটো বছর।
সবচেয়ে দীর্ঘ বৈকি।
শুনেছি কোথায় নাকি কোন্ জেলখানায় একটা কুড়ি বছরের কারাদণ্ডের আসামি উনিশ বছর এগারো মাস কতদিন যেন কারাযন্ত্রণা ভোগ করে মুক্তির কয়েকটা দিন আগে যন্ত্রণা অসহ্য মনে হওয়ায় আত্মহত্যা করেছিল। জানি না গল্প না সত্যি, তবু এটা ঠিক প্রতীক্ষার শেষ প্রহরটাই সবচেয়ে দীর্ঘ।
শিপ্রা বলল, তোকে দেখে মনে হচ্ছে অমিতাভবাবু এসে মাথার চুল ছিড়বে। এ তো রীতিমতো বৈরাগিনী অবস্থা! ঘরে আবার এই সব ঠাকুর-দেবতা!
হেসে বললাম, তুই তো সবই জানিস।
জানি। কিন্তু এও জানি, জগতে সবচেয়ে বদলায় মানুষের মন।
তোর জানার জগতের বাইরেও অনেক কিছু আছে। বল এখন খবর। চিঠি আছে?
ও একটু হেসে বলল, আছে চিঠি, কিন্তু তোর দুরন্তর নয়, নিতান্তই আমার।
বলে একটা নেমন্তন্নর চিঠি বার করল। ছেলের অন্নপ্রাশন।
হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গেল।
জানি না কিসের সেই রাগ।
আশাভঙ্গের?
না হিংসার?
হয়তো তাই। মনে হল ও যেন আমার এই অস্বাভাবিক জীবনের সামনে ঘটা করে দেখাতে এসেছ ওর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের ঐশ্বর্যের ভাব।
রুক্ষ গলায় বললাম, তুমি তো জান, এখন আর এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিই না আমি।
শিপ্রা ম্লান গলায় বলল, খোকার মুখে-ভাত এ আর এমন কি সামাজিক ব্যাপার? কজনকে তো মাত্র বলছি।
কজনকে কেন? চিঠি-পত্তর ছাপিয়ে দিব্যি তো
ও আরও ম্লান গলায় বলল, চিঠিটা আমার সাধ। লোকেদের ছেলের ভাতে পাই। তা যাওয়া যদি নেহাত অসম্ভব হয়, জোর করব না।
আমি হঠাৎ হেসে উঠলাম।
বললাম, বাবা, মেয়ে একটু ঠাট্টা বোঝে না। যাব, যাব, যাব। তোর খোকাকে আশীর্বাদ করতে যাব। তবে জানিস তো বৈষ্ণবের ভেক? খেতে-টেতে বলিস না। বলিস ওর শরীর খারাপ।
ও কি বুঝল কে জানে।
বলল, আচ্ছা। তারপর আস্তে আস্তে উঠে গেল।
আর হাসল না।
হয়তো ভাবল আমি আর ওদের জগতে নেই।
ভাবলাম, নাঃ, একটু সেজে-গুঁজে যেতে হবে নেমন্তন্নে। কলেজের বন্ধুরা আসবে। হয়তো শিপ্রার মুখে আমার বৈষ্ণবের ভেক-এর গল্প শুনেছে, হয়তো কৌতূহলাক্রান্ত হয়ে আছে কেমন না
জানি হয়ে গেছি আমি। তাজ্জব করে দেব তাদের। সাজে ঝলসাব, হাসিতে কথাতে ঝলসাব।
শিপ্রারও অভিমান ভাঙবে।
.
২৩.
কিন্তু শিপ্রার অভিমান ভাঙবার এত গরজ কেন আমার? ভালোবাসার দায়?
ভেবে দেখলাম তাই বটে, তবে সে ভালোবাসাটা শিপ্রার জন্যে নয়। দুরন্তর ভালোবাসার দায়ে আমি শিপ্রার মন রাখতে বসছি। শিপ্রা রেগে গেলে যদি চিঠির ব্যবস্থা বানচাল হয়ে যায়!
নমাসে ছমাসে তবু আসে তো খবর।
জানতে তো পারি ও বেঁচে আছে।
শিপ্রা চলে গেলে হঠাৎ খুব কাদলাম, জানি না কেন। শিপ্রাকে আঘাত করলাম বলে? চিঠি পাইনি বলে? নাকি সেই তখন মাথা হেট করে ফিরে আসতে হয়েছিল বলে?
মনে হল হয়তো তাই।
সেই গ্লানিই আমাকে রুক্ষ করে তুলেছিল।
তখন মনে হতে লাগল, দেবতা না ছাই, লোকটা সম্মোহন জানে। আর জানে কথার চাতুর্য। কথার চাতুরিতেই দেবতার আসনের টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছে।
যেই অসুবিধেয় পড়ে যায়, সেই কথার জাল ফেলে। অগ্নিপরীক্ষা, অনেক কিছু বলে আমাকে জব্দ করে ফেলে। আমি আর যাব না। আমার আর ভেক-এর দরকার নেই। মাকে বলব, আশা করে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছু পেলাম না ওখানে। বউদিকে বলব, তোমরা এত ভক্তি কর তাই বাজিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর বলব, আমি আবার পড়ব। এম. এটা দিয়ে ফেলব।
দুটো বছর ওতেই কেটে যাবে। তার মধ্যে আমাকে কেউ জ্বালাতে আসবে না। তাছাড়া মা-র সেই ভয়ঙ্কর আবেগটা চলে গেছে। মা যেন মেনেই নিয়েছেন আমার এই জীবন। আমি মা-র কাছে না-শুলেও মা-র হেঁসেলে যে খাই, সেটাতেই মা-র সুখ।