সে এক অপূর্ব নৃত্যভঙ্গিমা! কত তার মুদ্রা, কত তার ছন্দ! প্রৌঢ় শরীরেও কী শক্তি? আরতির সময় এদিক থেকে শুধু পিঠটি দেখা যায়, আর আবিষ্ট আচ্ছন্ন হয়ে দেখতে হয় সেই স্বাস্থ্য-সংগঠিত সুগৌর পিঠ, পাঁজর, কাঁধ আর দুটি পা। গরদের ধুতি থাকে পরনে, গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায় সেই দুধে-গরদের ধুতি। কাঁধে থাকে একখানি পাট-করা উত্তরীয়, বার বার খসে খসে পড়ে, বার বার তাকে কাঁধে তোলেন, সেও এক মধুর ভঙ্গি।
তারপর যখন আরতি শেষ হয়, ঘুরে দাঁড়ান শঙ্করজী, তখন তাঁর শ্বেতচন্দনচর্চিত ললাট, কুঁদে কাটা মুখ, আজানুলম্বিত গোড়েমালা পরা বুক আর আশ্চর্য উদাস দুটি পদ্মপলাশ চক্ষু, দেখে সকলের মনেই একটি প্রশ্নের উদয় হয়, নদীয়ার গৌরাঙ্গ কি আবার অবতীর্ণ হয়েছেন এই কলির শেষপাদে?
প্রৌঢ় শরীরে এত লাবণ্য?
প্রৌঢ় মুখে এত দীপ্তি?
প্রৌঢ় চোখে এত আলো?
নিত্য দেখা চোখ, তবু প্রৌঢ়া বৃদ্ধা নির্বিশেষে মহিলাকুল বিহ্বল দৃষ্টি মেলে বলেন, কী চোখ দেখেছ? যেন কাজলপরা! হাত-পায়ের তেলোর রং দেখেছ? যেন আলতা-মাখা! মহাপুরুষের পরিচয়ই তো এইসব লক্ষণে।…আহা, নদের গৌরাঙ্গ না দেখার আক্ষেপ মেটালেন বাবা!
কেউ বলে বাবা, কেউ বলে মহারাজ, কেউ বলে ঠাকুর
আমি কিন্তু ওসব কিছু বলি না, বলি গুরুদেব। আমি ওটা শিক্ষক অর্থে বলি। এসেছিলাম তো সন্দেহ কৌতুক আর তাচ্ছিল্যের মনোভাব নিয়ে, তাই প্রচলিত সম্বোধনগুলো হাস্যকর ঠেকেছিল আমার কাছে।
কিন্তু সন্ধ্যারতির সময়কার ওই পঞ্চ-প্রদীপের শিখার কম্পনে, নিয়নের নীল আলোয়, ভারী ঘন্টার গম্ভীর ধ্বনির ছন্দময় ধাক্কায়, আর গোড়েমালা পরা এই দেবপ্রতিম মূর্তির লাবণ্যে ক্রমশ আমিও যেন আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি। একদা যে কৌতুক আর তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়েছি, সেকথা ভেবে লজ্জিত হচ্ছি, আর যখন বহু গুণীজ্ঞানী পণ্ডিত, বহু মানগণ্য বুদ্ধিজীবী, চিন্তাজীবী এসে এই পদপ্রান্তে মাথা লোটান, তখন মনে হয়, আচ্ছা, এঁরা কি সবাই অন্ধ অবোধ? যত বুদ্ধিমান আমি?
আবার যখন সরে আসি সেই আবেষ্টন থেকে, তখন ভাবি, আসেন তো (গুরুদেবের ভাষায়) তিতাগ জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু সে আশ্রয় কি মেলে এঁদের? প্রশ্ন তো সেইখানেই। এঁরা যে মন নিয়ে লটারির টিকিট কেনেন, সেই মন নিয়েই হয়তো ঠাকুরের কাছে আসেন। যার জীবনে যত ফাঁকি, যত ফাঁক, তার তত ব্যাকুলতা।
২১-২৫. বিকেল না হতেই মন টানতে থাকে
তবু বিকেল না হতেই মন টানতে থাকে। স্নান করে, কপালে একটু চন্দন-রেখা এঁকে, দুধ-সাদা, শাড়ি-ব্লাউজ পরে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকি গাড়ি আসার আশায়।
এই গাড়ি পাঠানোর ব্যাবস্থার পর থেকে মঠের কেউই আর আমায় সুচক্ষে দেখে না, প্রত্যেকের চোখেই যেন বিরক্তির বিরূপতা, হিংসের জ্বালা। মুখভঙ্গিতে যেন এই অভিযোগ ফুটে ওঠে, খুব দেখালে বাবা! উড়ে এসে জুড়ে বসলে একেবারে!
কিন্তু আমি কি করব?
আমার কি দোষ?
আমি তো আর আবদার করে এ সুযোগ আদায় করে নিইনি। শঙ্করজী নিজেই নাকি বলেছেন, দেবীমা না এলে কীর্তনে প্রাণ আসে না।
আর নিজেই নাকি রোজ হুশ করে ড্রাইভার হরিচরণকে বলে দেন, ওরে দেবীমাকে ঠিক সময় আনতে যাস।
কেন এই পক্ষপাতিত্ব?
সত্যিই কি তবে আমি ভগবতীর অংশ?
ভগবান ভগবান করলে মানুষ যেন কেমন ভোতা হয়ে যায়। বিশেষ করে মেয়েমানুষ। গুরুর এই পক্ষপাতিত্বে সুধাদি, অমলাদি, রাইকমল, ব্রজরাধা ঈর্ষায় জ্বলে মরে, টেনে টেনে বাঁকা বাঁকা কথা শোনায় আমায়, কিন্তু কই, গুরুর কাছে গিয়ে সোজা সতেজ কৈফিয়ত চায় না তো, দেবী না এলে যদি কীর্তনে প্রাণ আসে না, তবে এতদিন কি আপনি আমাদের প্রাণহীন গান শুনিয়ে রেখেছিলেন?
চায় না কৈফিয়ত।
কিন্তু আমি হলে চাইতাম।
আমি চেয়েওছি, অন্য কারণে।
প্রথম প্রথম যখন দেখেছি প্রসাদ পাবার দিন পংক্তি-ভোজনে বসেও প্রসাদের দুর্লভ অংশটুকু পড়ল আমার পাতে, অথবা হরির লুঠের সময় সন্দেশের জোড়াটি পড়ল আমার হাতে, তখন লজ্জায় কুণ্ঠায় মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
চাইলাম একদিন কৈফিয়ত।
যখন দুপুরের বিশ্রামের পর বিগ্রহের সামনের সেই অর্ধ-বৃত্তাকার বারান্দায় পায়চারি করছেন অলস চরণে, নবীনদার অপেক্ষায়। চারটে বাজলে নবীনদা এসে ঘণ্টা দেয়, বিগ্রহের দরজার ভারী তালাটা খুলে ফেলে দরজা হাট করে দেয়।
তখনও চারটে বাজেনি (আমি সেদিন প্রসাদ পাবার পর মঠেই রয়েছি কী একটা উৎসব বাবদ) আমি গিয়ে উঠলাম সেই বারান্দার সামনে নাটমন্দিরে। স্পষ্ট সতেজ গলায় প্রশ্ন করলাম, সবাই তো আপনার শিষ্য, আমাকে তবে বিশেষ করেন কেন?
হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন উনি। হয়তো এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি ওঁকে কোনোদিন। হয়তো ওর উল্টোটা শুনে থাকবেন কোনো জল-ভরা চোখ আর অভিমানরুদ্ধ কণ্ঠ থেকে।
এটা অপ্রত্যাশিতই।
তাই হাঁটা থামিয়ে বললেন, কি বলছিস মা?
আমি আমার প্রশ্নের পুনরুক্তি করলাম। বললাম, উত্তর দিন।
এবার আস্তে আস্তে ওঁর সেই নিখুঁত কাটের সুগৌর মুখে ছড়িয়ে পড়ল একটি প্রসন্ন হাসির আলো। ওঁর আলতা-রাঙা ঠোঁটে ফুটে উঠল একটু মৃদু মধুর হাসির আভাস।
বললেন, এ প্রশ্নের আবার উত্তর কি রে? তুই আমার মা যে, তাই।