দুপুরবেলা হবিষ্যান্ন গ্রহণের পর্ব মিটলে দিবানিদ্রার বদলে পড়াশোনা করি, কিন্তু সে তো ধর্মগ্রন্থ। মঠের লাইব্রেরি থেকে আনা, মহারাজের টীকাভাষ্য সংবলিতও হয়তো।
তারপর যখন বেলা পড়ে আসে, তখন মঠ থেকে গাড়ি আসে আমার আর মা-র জন্যে, সন্ধ্যা-আরতি দেখতে যাবার কারণে। বিশেষ সমাদর, বিশেষ ব্যবস্থা।
গোড়ায় গোড়ায় বউদি বলত, লক্ষ্যটা তুমি, মা উপলক্ষ্য মাত্র।
এখন আর বলতে সাহস পায় না।
তা প্রথম প্রথম মা নিয়মিত যেতেন, হয়তো এতবড়ো মেয়েটাকে সন্ধ্যায় একা ছাড়তে সংস্কারে বাধত। কিন্তু ক্রমে সবই সয়। তাছাড়া, রোজ সন্ধ্যাবেলা কাজকর্ম ফেলে আরতি দেখতে যাবেন, এত ভক্তি-ঢলঢল মা-র মন নয়।
মা তার লক্ষ্মী-ষষ্ঠী-মনসা-ইতু বোঝেন, তার জন্যে উৎকণ্ঠিতও থাকেন, কিন্তু আরতি দেখতে রোজ মঠে যাবেন এত সময় বার করতে পারেন না। তাছাড়া, আরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে শুরু হয়ে যায় স্তব-স্তোত্র-কীর্তন। তার শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থাকা তো মা-র পক্ষে যম-যন্ত্রণার শামিল।
ক্রমশ তাই গাড়ির আরোহী হই একমাত্র আমি। বউদিকে জিগ্যেস করি, যাবে?
বউদি বলে, না, এখন কাজ রয়েছে।
শানু এক কীর্তি করার পর থেকে বউদি একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। বউদি আশঙ্কা করেনি শানুর মতো একটা ভীরু মেয়ে এমন বেপরোয়াভাবে একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারে।
লিখে রেখে গেছে নাকি, রেজিস্ট্রি বিয়ে করে স্বামী তাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে তার কর্মস্থলে। কিন্তু সেকথা কে বিশ্বাস করেছে? তাছাড়া সেটাও যদি হয়েই থাকে সত্যি, দ্বিতীয়বারের স্বামীকে প্রকৃত স্বামীর মর্যাদাটা দিচ্ছে কে? ওটা যেন পরচুল দিয়ে খোঁপা বাঁধা, ঝুটো মুক্তোর মালা গলায় দিয়ে সাজা।
.
১৯.
মা বললেন, মেয়েটাকে ওই শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েই ভুল করলে তুমি বউমা! শাশুড়ি নেই, বুড়ো শ্বশুর, জায়েরা যে যার নিজ নিজ সংসার নিয়েই ব্যস্ত। ওকে কে সামলেছে বল?
বউদি কপালে হাত রেখেছে।
বউদির মুখে জগতের দুঃখ বেদনা রাগ অপমান। বোনের দ্বারা যে তার মুখ পুড়ল, এটা যেন শুধু তার বোনেরই নয়, সেই দগ্ধ দৃশ্যের দর্শকদেরও অপরাধ।
একে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, আজকাল আর এসব না-হচ্ছে কোন্ সংসারে? কিন্তু অপরাধিনী বোনটাকে সামনে পেলে যে ধিক্কারে জীর্ণ করে ফেলত তাকে তাতে সন্দেহ নেই।
আশ্চর্য! বিধবা ছোটো বোনটার ওপর তো মমতার অবধি ছিল না তার, লুকিয়ে মাংসের চপ খাওয়াত। কিন্তু যেই সে নিজের জীবন গড়ে তুলতে গেল, অমনি সব মমতা কর্পূরের মতো উবে গেল? তার মানে মমতা ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি ভাগ্যহত! ভালোবাসা ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি নিজের সম্পর্কে অচেতন। সচেতন হয়েছ কি ভালোবাসাটি হারিয়েছ।
শানুর প্রতি আর ভালোবাসা নেই বউদির।
কিন্তু আমার?
আমারও শানুর ওপর ভালোবাসাটা উবে যেতে চাইল কেন? সে কী হিংসেয়? আমার এই দেবিত্বের আবরণ কি এতই ব্যর্থ? শানু যে সেইরকম জীবনটা পেয়ে গেল, যে-রকমটি নাকি একদার বেবি নামের মেয়েটার একান্ত কাম্য ছিল, সেটাই কি আমায় দগ্ধাল? নইলে শুনে এত জ্বালা ধরল কেন ভিতরে?
অথচ আমিই সাহস দিয়েছিলাম ওকে।
.
২০.
কিন্তু সকল জ্বালা প্রশমিত হয়ে যায় গাড়ি থেকে নেমে মঠের চৌহদ্দিতে পা দিতে দিতে। নিত্যসেবার সুবিধের জন্যে অনেকখানি জমি জুড়ে মালঞ্চ আর তুলসীবন। মালঞ্চে শৌখিন ফুল নেই, আছে দেশী ফুল। গোলাপ, চাঁপা, বেল, জুই, টগর, গন্ধরাজ, কাঠছাঁপা, গাঁদা, দোপাটি, কিন্তু কেয়ারির কী বাহার। গাছে গাছে আলোর সমারোহ।
জুড়িয়ে যায় চোখ জুড়িয়ে যায় মন।
তারপর উঠে যাই নাটমন্দিরে।
সুন্দর ডিজাইনের মোজেক টালি বসানো বিরাট চত্বর, আয়নার মতো নির্মল চকচকে। সেখানে নিঃশব্দ নিস্পন্দ ভক্তবৃন্দ বসে আছেন দুভাগে, মাঝখানে পথ রেখে। যে পথ শেষ হয়েছে গিয়ে বিগ্রহের পদপ্রান্তে। নাটমন্দিরের পরে অর্ধবৃত্তাকার অর্ধবেষ্টনী বারান্দা, সেখানেও ভক্তজনের শ্রেণীভাগ। একভাগে মহিলা, একভাগে পুরুষ, যেমন নাটমন্দিরে।
বারান্দার মধ্যে বসবার সৌভাগ্য যাঁদের হয়, তারা হচ্ছেন বিশেষ ভক্ত। বিগ্রহের পিছনে আলাদা কয়েকধাপ সিঁড়ি আছে তাদের ব্যবহারের জন্যে। যাঁরা অধিকারী তাঁরা এই নাটমন্দির না মাড়িয়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠেন, ভক্তপদরজঃ মাথায় ঠেকিয়ে। তারপর ঘেরা বারান্দা দিয়ে বিগ্রহের ঘর প্রদক্ষিণ করে আত্মস্থভাবে এসে বসেন নিজ নিজ স্থানে। নিত্য আসা-যাওয়ায় আপনা থেকেই স্থান একটা করে নির্বাচন হয়ে গেছে।
যেমন জানি, বৃন্দাদি বসবেন একেবারে ঠাকুরঘরের দরজা ঘেঁষে, সত্য ব্রহ্মচারী মোটা থামটার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে, বারান্দার গায়ে গায়ে ছেলেদের দিকে ব্রহ্মচারী অভয়, বীরেশ্বরভাই, নিত্যমহারাজ, অচ্যুতানন্দ, মেয়েদের দিকে সুধাদি, অমলাদি, নীলিমাদি, বুড়িমহামায়া মা, রাইকমল, ব্রজরাধা।
এঁদের দুজনেরও শঙ্করজীর দেওয়া নাম। এই বারান্দার এদিকের এঁরা সবাই এই আশ্রম বা মঠের অধিবাসী, এঁদের এখানে কিছু কিছু ভূমিকা থাকে।
যেমন আরতির পর কীর্তনের সময় ব্রহ্মচারী অভয় আর বীরেশ্বরভাই খোল বাজান, এঁরা সবাই দোহার দেন।
মূল গায়েন শঙ্করজী।
আরতিও তিনিই করেন।