খুব স্পষ্ট করে কিছু লিখতে পারে না। মনে হয় স্পেন্সারের ব্যাপারটা কড়া, তাই লেখে ভালো আছি। আর মাঝে মাঝে লেখে দিন গুনছি।
আমি ওর খবর পাই, কিন্তু ও আমার কোনো খবর পায় না।
এক এক সময় ওর অবস্থা ভুলে নিতান্ত সহানুভূতিহীন নিমর্ম বিচার করে বসি আমি। বলি, দিব্যি তো নিশ্চিন্তে বসে দিন গুনছি, দিন গোনর সঙ্গে সঙ্গে যে দিন ফুরোয় তা খেয়াল আছে? তুমি কি জানতে পারছ আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি? জানতে পারছ কি, কিভাবে আমার দিন কাটছে?
আমি না হয় অদ্ভুত একটা হাতিয়ার হাতে পেয়ে গিয়ে আমার শত্রুপক্ষকে ঠেকিয়ে রেখেছি। তারা এই অভাবনীয় অস্ত্রটা দেখে ভয় পেয়ে গেছে, তারা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলছে, স্বপ্নেও ভাবিনি তুই এমন হয়ে যাবি।
কিন্তু তুমি? তুমি কি জানতে পারছ এসব?
আমার এই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ কোথায় তোমার? অথচ তুমি দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছ। কারণ তুমি আমায় প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছ, ঠিক থাকব আমি, বদলাব না।
এ পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কিনা খোঁজ করতে একদিন রমেশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেকটা বুড়ো হয়ে গিয়েছেন যেন। ভারী যেন অসহায়। চুপচাপ বসে রইলেন।
কথা বললেন তার স্ত্রী।
বললেন, এই দেখ মানুষ, একটা পরের ছেলেকে পুষে এমন মায়ায় জড়ালেন নিজেকে যে, তার বিহনে একেবারে জবুথবু হয়ে গেলেন। অথচ তার ব্যবহার দেখ। চাকরি করতে বিদেশ যাচ্ছি বলে চলে গেল, না খবর না কিছু। নেমকহারাম যাকে বলে!
ভাবলাম, ইচ্ছে করলে কি ও টাকা পাঠাতে পারত না?
হয়তো পারত, হয়তো পারত না।
হয়তো ওই অবিশ্বাস্য মাইনেটা ফাঁদ মাত্র। হয়তে বিনিমাইনেয় খাঁটিয়ে নিচ্ছে ক্রীতদাসের মতো। কে জানে! প্রাণটা কেমন করে উঠল।
চলে এলাম। আর যাইনি। তাছাড়া যাবার সময়ই বা কোথায়?
.
১৮.
সময় নেই।
সময়টা আমার আঁটসাঁট একটা ছন্দের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে আছে যেন। একটা অক্ষরেরও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে গুরুর দেওয়া ইষ্ট-মূর্তির পট সামনে রেখে মঙ্গল-আরতি করি, ধূপ জ্বালি, ফুল বাছি, মালা গাঁথি, চন্দন ঘষি। তারপর চোখ বুজে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা।
আমার সেই তপস্বিনী মূর্তি দেখে দেখে ক্রমশ বাড়ির লোকেরাও আমায় ভক্তি করতে শুরু করেছে। মা মালি দিয়ে নিত্য ফুলের যোগান করিয়ে দিয়েছেন, ফুল মিষ্টি দই ক্ষীর আনিয়ে রাখছেন ভোগের জন্য, সারা সকাল নিঃশব্দে সংসারের কাজ করেন, বাড়ির সকলকে সামলে রাখেন গোলমাল করা থেকে, পাছে পূজারিণীর পূজার ব্যাঘাত হয়। বউদি পর্যন্ত আজকাল আর মুখে-চোখে ব্যঙ্গহাসির ছুরি উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায় না, ঔদাসীন্যের ছবি হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ভাবটা যেন এ সংসারের নৈবেদ্যের ভাগটা তো তুমিই লুঠে নিলে, আমার আর এখানে থাকাই বা কেন!
যাক, মনের কথা দেখতে নেই, মোটের মাথায় আছি ভালো। যে দাদা প্রথম-প্রথম কত রাগ দেখিয়েছে, কত তাচ্ছিল্য করেছে, সেই দাদাই দেখি কাজে বেরোবার কালে একবার আমার ঠাকুর ঘরের দরজায় এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাতটা জোড় করে কপালে ঠেকায়।
না, আলাদা কোনো ঠাকুরঘর নয়, আমার শোবার ঘরই আমার ঠাকুরঘর। সেই সরু একফালি ঘরেরই একপাশে চৌকি পেতে বসিয়েছি আমার গুরুর ফটো, আমার ইষ্টের পট। তার সঙ্গে অসুর নাশিনী দুর্গারও।
শঙ্কর মহারাজের কাছে সর্বধর্মসমন্বয়। তিনি বলেন, হলই বা বৈষ্ণবমন্ত্র, অসুরনাশিনী মূর্তিও সামনে রাখা দরকার। মনের মধ্যেকার পাপাসুরকে দমন করতে হবে যে। মা, মা হচ্ছেন আশ্রয় আর উনি? ওই নওলকিশোর? উনি হচ্ছেন সখা, বন্ধু, প্রিয়তম, প্রেমাস্পদ। উনি আধার, উনি প্রাণারাম।
চৌকির উপর অতএব তিন দেবতার ছবি সাজিয়ে রেখেছি ফুলে চন্দনে, ছোট্ট চেলির কাপড়ে, রুপোর বাঁশীতে। ধূপের সৌরভে ঘরের বাতাস পবিত্র হয়ে ওঠে, সকালের আলো এসে আমার মুখে চোখে চুলে ছড়িয়ে পড়ে এনে দেয় একটা দিব্যদৃতি, আমার মুদিত চোখের পল্লব কাঁপে না। এসব আমার সাধনা।
আমার সুন্দর সুন্দর সিল্কের শাড়িগুলো পরি আমি পুজো করবার সময় অযত্নে অবহেলায়। কারণ, আমি তো আর বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্নে যাই না, যাই না সিনেমা দেখতে, থিয়েটার দেখতে।
যাবার মধ্যে মঠে।
সেখানে সাদা শাড়ি।
দুধ-সাদা ধবধবে।
গুরু যাতে বলতে পারেন, বাইরের মতো মনটিও করতে হবে।
আমি যখন ধ্যান-ধারণা সেরে আবার নরলোকে ফিরে আসি, তখন দাদা অফিস চলে গেছে, দাদার ছেলেটা স্কুলে। বউদি রান্নাবান্না সেরে নিয়েছে। আগে আগে বউদি ওই রান্না-রান্না করে রাগারাগি করত, মস্তবড় একটা আইবুড়ো মেয়ে যে একদিন ভাত রাঁধতে পারে না, এর জন্যে অনুযোগ করত, কিন্তু এখন বউদির মুখে চাবি পড়ে গেছে। বউদির রান্নাঘরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? আমি তো আমার মায়ের রান্নাঘরে খাই, বিশুদ্ধ, আমিষ-বর্জিত।
পুজোর পর ঠাকুরের ফল-মিষ্টির প্রসাদ, আর পাথরের গ্লাসে চা খেয়ে পেড়ে বসি সেই জপের খাতা। হাজার জপ লিখতে হবে। এতে নাকি কাজ আরও বেশি হয়। অক্ষরের মধ্যেই নাকি ব্রহ্ম।
গল্পের বই বলে পাগল ছিলাম আগে, লাইব্রেরি বইতে শানাতো না, পাড়াপড়শীর দরজায় হাত পেতে পেতে তবে মিটত কুম্ভকর্ণের ক্ষুধা।
কিন্তু এখন ওসব বই নিষিদ্ধ খাদ্যের মতোই পরিত্যাগ করতে হয়েছে। গল্পের বই, নাটক-নভেল পড়ে সময়ের বৃথা অপব্যবহার করার মতো বোকামীতে মহারাজের বিশেষ ঘৃণা। আর যাতে তার ঘৃণা, তা করতে লজ্জা হবে না?