তখন টান মেরে ফেলে দেব লোটা-কম্বল।
শানু বিশ্বাস করল না। বলল, এ তুমি আমাকে স্তোক দিয়ে বলছ
না শানু, সত্যিই বলছি। আর সত্যিই তোমায় উপদেশ দিচ্ছি, জীবন জিনিসটা এমন তুচ্ছ নয় যে তুমি শুধু তুচ্ছ একটু লোকলজ্জার মুখ চেয়ে সেটা বরবাদ দেবে। তুমি আবার ভালোবাস, ভালোবাসা নাও।
শানু একটু বিষণ্ণ হাসল। বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন আমার জন্যে কী, একখানা ভালোবাসা অপেক্ষায় বসে আছে। ভালোবাসাটা আসছে কোথা থেকে?
আজ নেই, কাল আসতে পারে। তোমার মনটা প্রস্তুত রেখে তাকে গ্রহণ করবার জন্যে।
শানু আস্তে উঠে গেল।
শানুর নিশ্বাসটা ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
আর শানু চলে যেতেই আমার রক্ত উত্তাল হয়ে উঠল। যে ভালোবাসা আমার জন্যে প্রহর গুনছে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে, তার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম। ইচ্ছে হল ছিঁড়ে ফেলি এই খোলশ, সবাইকে ডেকে ডেকে বলি, শোন তোমরা, আমার ভালোবাসা আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে মরুভূমিতে সোনা কুড়োতে গেছে। অতীতের সব গ্লানি মুছে ফেলে, সব ঋণ শোধ করে ফেলে ও আমায় নিয়ে ঘর বাঁধবে, তাই আমার এই শবরীর প্রতীক্ষা।
কিন্তু আবেগকে শাসন করে বুদ্ধি। তাই আমি কিছু বলি না। শুধু আমার ছদ্মনামের খোলশেই স্থির হয়ে বসে থাকি। যখন মা কাঁদো-কঁদো মুখে বলেন, কোনোদিন ভাবিনি তুই এমন হয়ে যাবি তখন মৃদু হেসে বলি, কেন মা, এ তো বেশ। তোমার কাছেই রয়ে গেছি, ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি না–
মা নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমার কাছেই বটে!
বলেন, কারণ মা-র ধারণা আমি এখন আর মা-দের এই জানা পৃথিবীর মানুষ নই, আমি অন্য এক গ্রহের! যেখানে বাসনা নেই, কামনা নেই, বরং ভোগ-সুখের প্রতি তীব্র বিরাগ। সেই এক নির্মল জ্যোতিলোকে বিরাজ করছি আমি আমার ভগবতী সত্তা নিয়ে।
কিন্তু আমি তো জানি, আমি তোমাদেরই লোক।
আমি যখন একটি বিরল নির্জনতার আশায় বলেছিলাম, আলাদা একটা ঘর না হলে আমার ধ্যান-ধারণার অসুবিধে হয়, তখন সে কোন্ ধ্যানের কথা বলেছিলাম?
সে ধ্যান কি শঙ্কর মহারাজের দেওয়া ইষ্ট-মূর্তির? তা যদি হয়, সে ধ্যান জননীর স্নেহ বাহুবেষ্টনের মধ্যে থেকেও হতে পারত না?
কিন্তু সে ইষ্ট-মূর্তির ধ্যান তো করতে চাইনি আমি। একক শয্যায় শুয়ে ধ্যানে বিভোর হই আমি একটি বলিষ্ঠ পুরুষ-মূর্তির।
রক্ত-মাংসের সজীব পুরুষ।
পাথরের নওল কিশোর নয়। যার প্রেমকাহিনী নিয়ে শঙ্কর মহারাজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীর্তন করেন, ব্যাখ্যা করেন। শুনি তিনি নাকি বিশ্বের সমগ্র নারীর প্রেমাস্পদ। আর বিশ্বের সবাই তো নারী। তিনি ছাড়া পুরুষ কই এই বিশ্ব ব্রজভূমিতে? হ্যাঁ, এসব কথা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে, কারণ মুখস্থ করার ক্ষমতাটা নাকি আমার অদ্ভুত। এসব কথা আমিও গুছিয়ে বলতে পারি মহারাজের প্রধান শিষ্যা বৃন্দাদির মতোই। যার জন্যে বৃন্দাদি আজকাল আমায় বিষনজরে দেখতে শুরু করেছেন।
১৬-২০. রঙ্গমঞ্চের ভূমিকার সংলাপ
কিন্তু ওসব তো রঙ্গমঞ্চের ভূমিকার সংলাপ।
রাত্রে যখন অভিনয়ের রঙ মুছে নিজের কাছে নিজে ধরা দিই?
তখন কি ধরা দিই না একটি তীব্র রোমাঞ্চময় কল্পনার কাছে? দিই।
তখন ধ্যান করি এক রক্ত-মাংসের পুরুষের। ধারণা করতে চেষ্টা করি কী তীব্র সুখময় সেই বলিষ্ঠ বাহুর নিষ্পেষণ।
সেই ধ্যান-ধারণার দাহে কোনো কোনোদিন আমি যখন ঘরে টিকতে পারি না, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দাকে করি নৈশচারণার ক্ষেত্র, তখন সেই বারান্দার একাংশে অবস্থিত দাদা-বউদির পর্দাফেলা জানলাটার দিকে তাকিয়ে হিংসেয় সর্বাঙ্গ জ্বালা করে ওঠে আমার। আর কোনো কোনোদিন অদম্য হয়ে ওঠে একটা অন্যায় ইচ্ছার আকর্ষণ। আমার থেকে তেরো বছরের বড় দাদার ঘরের রাত্রির রহস্য যেন আমাকে তীব্রবেগে টানে অন্ধকারের আড়ালে গা ঢেকে ওই পর্দাকে ঈষৎ উন্মোচিত করে ভিতরে চোখ ফেলতে।
সেই ইচ্ছের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে শঙ্কর মহারাজের দীক্ষামন্ত্র নয়, নিতান্তই আমার চিরদিনের সভ্যতার সংস্কার, শিক্ষার সংস্কার, শালীনতার সংস্কার।
কিন্তু এসব কি বর্তমান? বুঝতে পারছি না।
অতীতে আর বর্তমানে মিশে গিয়ে যেন একটা কুয়াশার পর্দা দুলছে আমার মধ্যে। আমি বুঝতে পারি না আমার দিনের বেলার আমিটা আর রাত্রে বেলার আমিটা অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে, না একজন অপরজনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
যদি আত্মসমর্পণ করে থাকে তো স্নায়ুতে শিরাতে এত চাঞ্চল্য কেন? কেন ওর খবরের জন্যে এত ছটফটানি?
.
১৭.
আমার দিক থেকে খবর নেবার কোনো উপায় ছিল না কারণ, দুরন্তর ঠিকানার কোনো ঠিক নেই। কোথায় না কোথায় ক্যাম্প পড়ে ওদের, কখন না কখন চিঠি দেবার সময় পায়। তাও তো সে চিঠি আসে আমার এককালের সহপাঠিনী শিপ্রার শ্বশুরবাড়িতে তার স্বামীর নামে। এই ব্যবস্থা করে গিয়েছিল ও।
শিপ্রা কোনো গতিকে আমায় সে চিঠি পৌঁছে দিত। নিতান্তই দীর্ঘ ব্যবধান ছিল সেই চিঠি আসায়।
তার মধ্যে আবোল-তাবোল কথাই বেশি থাকত, তার মধ্যে প্রকাশ পেতে শুধু তার আকুলতা, প্রকাশ পেত বিশ্বাস আর আশ্বাসের ব্যাকুলতা। তবু ওরই মধ্যেই টের পেয়েছিলাম, কাজটা ওর বন কেটে নগর বসাবার। কুলি খাটাতে হয়, বন কাটাতে হয়, অরণ্যের দেবতার অভিশাপ কুড়িয়ে সেখানে আগুন জ্বালাতে হয় শুকনো পাতাকে ভস্ম করতে।