- বইয়ের নামঃ কুমিরের হাঁ
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. নিজের সেই সত্যিকারের নামটা
না, এখন আর আমার নিজের সেই সত্যিকারের নামটায় কেউ ডাকে না। জানেও না অনেকে। যারা জানত তারাও ভুলে গেছে।
তাদের স্মৃতিশক্তির প্রতি অভিযোগ করে লাভ নেই, আমি নিজেই তো প্রায় ভুলতে বসেছি। আমি আমার ছদ্মনামের খোলসের কাছে আমার সত্তাকে সমর্পণ করেছি। ওই খোলসটা আশ্চর্যরকম সেঁটে বসে গেছে সেই সত্তার উপর, ওকে আর ওর থেকে পৃথক করে বার করে আনা যাবে এমন মনে হয় না।
অথচ দীর্ঘকাল ধরে ভেবে এসেছি বার করে আনাটা আমার ইচ্ছাধীন। যখন প্রয়োজন ফুরোবে, তখন ওই খোলসটাকে ভেঙে ফেলে বার করে আনব আমার আমিটাকে। এখন প্রয়োজন রয়েছে, এখন আমাকে ছদ্মবেশের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে হবে।
এই ছদ্মবেশ যেদিন ভেঙে ফেলব, সেদিন প্রকাশিত হব, বিকশিত হব, উদ্দাম হব, প্রমত্ত হব। সেদিন হাততালি দিয়ে বলে উঠব সবাইকে, দেখ, এতদিন কেমন ঠকিয়ে এসেছি তোমাদের। তোমাদের হাত থেকে নিস্তার পেতে কেমন ছল করেছি।
সেই অনাগত দিন-রাত্রিকে চিন্তা করতে করতে আমার এই ব্রহ্মচর্যে শীর্ণ দেহটার মধ্যেকার প্রবাহিত রক্তস্রোতে ঘুঙুর বেজেছে দ্রুত ছন্দে। গভীর রাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্থির পদচারণায় জেগে কাটিয়েছি।
জেগে কাটিয়ে আর একজনের চোখে নিজেকে দেখে থরথরিয়ে কেঁপেছি, দেহটাকে নিয়ে জর্জরিত হয়েছি, তার খাদ্য যোগাতে না-পেরে দিশেহারা হয়ে মাঝরাত্রে স্নানের ঘরে গিয়ে শাওয়ার খুলে মাথা পেতেছি।
চুলে-ভরা মাথাটা ভিজিয়ে ভিজিয়ে জলের সেই ধারাবর্ষণ গড়িয়ে পড়ছে আমার অনাবৃত বুকে পিঠে, গড়িয়ে পড়েছে আরও নীচে পা বেয়ে অনেক-অনেকক্ষণ ধরে। আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে রক্ত, থেমে গেছে ঘুঙুরের ঝমঝমানি। ঘরে এসে শুকনো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে, ভিজে চুল বালিশে ছড়িয়ে সাধনা করেছি উধাও হয়ে যাওয়া ঘুমকে ফিরিয়ে আনবার।
আমার এই ছোট্ট ঘরখানার অপর কোনো অংশীদার নেই, তাই আমার এই নৈশচারণের সাক্ষী থাকে না। যদিও জানি আমার মায়ের মনটা ভেঙে গিয়েছিল আমি হঠাৎ তার শয্যাংশ ছাড়তে চাওয়ায়। করুণ করুণ মুখে বারবার বলেছিলেন তিনি, শুধু রাতটুকু শুবি বৈ তো নয়, ভোরবেলা উঠে নিজের কাজ করিস না বাপু!
কিন্তু মা-র সে অনুরোধ আমি রাখিনি।
আমার যে মমতা হয়নি তা নয়, আমি মায়ের কোলের মেয়ে, জন্মাবধি বাইশ বছর বয়েস পর্যন্ত মায়ের কাছেই শুয়েছি, নতুন কোনো ভাগীদার এসে আমাকে স্থানচ্যুত করেনি, তাই বোধ হয় বড়ো
বেশি শূন্যতা বোধ হয়েছিল মা-র।
কিন্তু কি করা যাবে?
বিয়ে হয়ে বরের ঘরে চলে যেতে পারতাম তো এতদিনে! তখন মা-র সেই শূন্য শয্যা পূর্ণ করতে কে আসত? এই ভেবেই মনকে শক্ত করে নিয়েছিলাম আমি।
বাবা বেঁচে থাকতে মা আর আমি বড়ো একটা চৌকিতে শুতাম, বাবা তার সেই বিয়ের সময়কার ফুল-পাখিদার পালঙ্কে। বাবা মারা যাবার পর মা পালঙ্কটাকে খুব মূল্যবান বলেই দাদার ঘরে নিইয়ে দিলেন। তখন দাদার বিয়ের কথা চলছিল, শুধু বাবা মারা যাওয়ার জন্যে পিছিয়ে গিয়েছিল কিছুটা।
মা বলেছিলেন, এই খাটে আমার ফুলশয্যে হয়েছিল, আমার খোকারও হবে। কিন্তু মা-র সেই সাধ পূর্ণ হয়নি, দাদার শ্বশুরবাড়ি থেকে সাদা পালিশের জোড়াখাট পেল দাদা, বাবার খাট ঠেলামারা হয়ে পুরনো ঘরে ফিরে এল।
মা নিশ্বাস ফেলে বললেন, খোকা তো নিল না, যখন আমার ছোটোজামাই আসবে, এই খাটে বিছানা করে দেব। হেসে বলতাম ছোটোজামাইয়ের স্বপ্নটা একটু কম করে দেখ মা, স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে।
মা রেগে উঠে বলতেন, কেন? কী ভেবেছ তুমি? বিয়ে করবে না?
করব না এমন প্রতিজ্ঞা করছি না, হেসে বলে উঠতাম, তবে তোমার জীবদ্দশায় নাও হতে পারে।
মা বলতেন, ক্রুদ্ধ আর গম্ভীর গলায়, তা বেশ। তাহলে খোকাকে বলে যাব, যেন এই খাটখানাতে চাপিয়েই শ্মশানে নিয়ে যায় আমায়।
আমি মায়ের রাগ দেখে হেসে ফেলতাম। বলতাম, তাহলে তো তোমার ছেলের কাঁধে চড়া হবে না মা, গোটা বারো অন্তত মুটে ডাকতে হবে।
বাস্তবিক সেকেলে সেই ফুল-লতা-পক্ষীদার আর গুমো গুমো পায়া দেওয়া ওই পালঙ্কটা একেবারে রাক্ষুসে ভারী। কিন্তু পালঙ্কটা আমরা না-পছন্দ বলেই তো মা-র ঘর ছাড়িনি সত্যি, আসলে আমার দেহ-মন নির্জন রাত্রির স্বাদের আশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। মা যখন শুতে এসে তাঁর ঘামে-ভেজা আর স্নেহে-ভেজা হাতটা আমার গায়ের উপর রাখতেন, স্বীকার করতে লজ্জা হলেও স্বীকার করব, মনটা কেমন একটা বিরস স্বাদে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠত। অথচ জানতাম মা-র মনের মধ্যে একটু প্রত্যাশার প্রতীক্ষা। জানতাম, মা অনেকক্ষণ পর্যন্ত আশা করতেন আমিও তার গায়ের উপর একটি হাত রাখি।
সেই বিনিময়ের সূত্রে মা একটু সাহস সঞ্চয় করতে পারেন, আমার সঙ্গে আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে আসতে পারেন, ফিসফিসিয়ে দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইতে পারেন।
সুখের নয়, দুঃখেরই।
বউদি আসার পর থেকে মা-র যে চিরদিনের অপ্রতিহত কর্তৃত্ব-গৌরব ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সে দুঃখকে মা বহন করছেন বটে, কিন্তু কিছুতেই যেন পরিপাক করে নিতে পারছেন না। অপরিপাকের সেই গ্লানি ব্যক্ত করে কিছুটা হাল্কা হতে চান মা। কিন্তু কেন জানি না, আমার সহানুভূতি আসে না, আমার ওই। ফিসফিসিনি অসহ্য লাগে। মা-র ওই সহানুভূতি-প্রত্যাশী মনের বাহক হাতখানাকে ক্লেদাক্ত লাগে। যা অনিবার্য, যা চন্দ্র-সূর্যের নিয়মের মতোই অমোঘ, তার বিরুদ্ধে ওই প্যানপ্যানানিতে অরুচি আসে আমার, তাই মা-র সেই ভিজে ভিজে হাতখানাকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলবার জন্যে কৌশলে ঘুমের ভান করে পাশ ফিরি।