পিসিমা রাত জাগবেন, সুদক্ষিণার কর্তব্য প্রহরে প্রহরে হিটার জ্বেলে চা বানিয়ে খাওয়ানো। কেননা পিসিমা অবিরত তার শ্বশুরবাড়ির মেয়েদের শিক্ষা সহবৎ আর কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনী শোনাচ্ছেন। পিসিমার মেয়েরা দয়া করে রোগীর বাড়ি এসেছে, এই দাবিতে তাদের চারবেলার খাওয়ার সমস্ত তদারক করতে হত রোগীর মেয়েকে।
সুদক্ষিণার ইচ্ছে হত বলে, পিসিমা, তোমার মেয়ে দুটিও তো তোমার শ্বশুরবাড়ির।
সে যাক, বাবার মারা যাওয়া কালীন স্মৃতি থেকেই সুদক্ষিণার আত্মীয়ভীতি। অথচ দ্বিতীয় কেউ একটা না থাকার অসুবিধেও অনুভব করে। বৌদি তো ওই, নিজেও সে একেবারে কিছু না, তা ভাল করেই জানে। কিন্তু মাকে যে একটু দেখা দরকার, তাও তত বোঝে।
এই তো কতদিন এমন হয়েছে, সুদক্ষিণা সবিস্ময়ে বলেছে, মা, তুমি ভাত খেলে না?
সুলক্ষণা হেসে বলেছেন, নাঃ, খেলাম না। আড়ি করে দিয়েছি আজ ভাতের সঙ্গে।
সদক্ষিণা মরমে মরে গেছে।
সুদক্ষিণা চুপি চুপি বংশীকে জিগ্যেস করেছে, হারে বংশী, আজ একাদশী?
মার একেবারে হাতের কাছে একজন কেউ থাকলে যে ভাল হয় সে কথা বুঝে ফেলেই আরও অস্বস্তি সুদক্ষিণার।
তাই চৈতালী যখন মরিচের গুড়োর শিশি রেখে চলে গেল, সুদক্ষিণা ভাবল, হিস্ট্রিটায় একেবারে যে চোর। নইলে এমন কিছু মন্দ নয়। কিন্তু আশ্চয্যি, দেখে কিছুতেই মনে হচ্ছে না ওই মেয়েটা কাল রাত্রের সেই বিটকেল ঘটনার নায়িকা!
.
তা নিজের শাড়ীটাড়ী পরিয়ে বেশ তো মানুষ করে তুলেছ দেখছি এখন, কৌশিক বলে, ওর পেছনের ব্যক্তিরা যদি হঠাৎ বাড়ি-চড়াও হয়ে তোমাকে মেয়ে আটকানোর দায়ে ফেলে?
ও নাবালিকা নয়।
বেগতিক দেখলে ও উলটো স্টেটমেন্ট দেবে।
সুলক্ষণা সামান্য হেসে বলেন, বেগতিক দেখে কে কি না করতে পারে! নিতান্ত নিরীহ একটা লোক খুন করেও বসতে পারে।
কৌস্তুভ মার মুখের দিকে তাকায়, উঠে পড়ে।
বৌকে বলে, আটটার সময় ডাক্তারবাবু আসবেন মনে আছে তো? হাঁ ভাল কথা মা, মেয়েটা সম্বন্ধে একেবারে বিশ্বাসের নিশ্চিন্ত রাখা ঠিক নয়। মানুষ চেনা শক্ত।
সুলক্ষণা মৃদু হাসেন, তা শক্ত বৈকি বাবা!
এই মজলিশের মধ্যে আরও একবার এসে পড়ে চৈতালী, খালি পেয়ালাগুলো গুছিয়ে নিয়ে যেতে।
সুলক্ষণা বললেন, এত সব তুই করিস না চৈতালী, বংশী তাহলে বেকার হয়ে যাবে। তুই রান্নাটা কর পরিপাটি করে। যেমন বলে দিয়েছি আঁশ নিরামিষ করে–
সুদক্ষিণা মার কথায় চমকে উঠে বসেছিল।
ও চলে যেতেই বলে, নামটা কি বললে?
চৈতালী।
চৈতালী! চৈতালী নিজের নাম ওর? নাকি শাড়ীর মত এই নামটিও তোমার দান মা?
না রে বাপু। সুলক্ষণা জোরে হেসে ওঠেন, ওর নিজেরই। আমিও প্রথমটা নামের বাহার দেখে চমকে গিয়েছিলাম। তা দেখলাম, আসলে ভাল ঘরেই উদ্ভব। তারপর এই ভবের খেলায় পড়ে।
কৌশিক না-পড়া খবরের কাগজখানা হাতে পাকাতে পাকাতে বলে, তা যাক, আপাতত ভবার্ণব পার হবার তরণীটি ওর ভালই জুটল দেখা যাচ্ছে। বেশ সুলক্ষণাক্রান্ত। এখন সুবাতাসের দাক্ষিণ্য পেলেই– বলে সুদক্ষিণার দিকে একটি নিরীহ কটাক্ষপাত করে।
সুদক্ষিণা গম্ভীর ভাবে বলে, আমি তোমাদের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই।
তা নেই বটে। তুই শুধু প্যাঁচে আছিস। বলে হাসতে হাসতে উঠে যায় কৌশিক।
আর এই সব ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহানুভূতি সমালোচনা সব কিছুর মধ্যে এক অলিখিত দলিলে স্থিরীকৃত হয়ে যায় চৈতালীর এখানের বাসটা পাকাই হল।
না হবেই বা কি করে।
একবেলাতেই যে কাজে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সে। তা ছাড়া একটানা বংশীর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ আর জঠর যে কতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সকলের, তা যেন বংশীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্পষ্ট ধরা পড়ল।
বংশী তুই একটু চোখে চোখে রাখিস…
দুপুরের দিকে বাইরের দরজাটা চাবি দিলে ভাল হয়, রুপোর বাসনগুলো কিছুদিন তুলে ফেললে হত না? এই ধরনের ক্ষীণ দুএকটা মন্তব্য দুএকবার উচ্চারিত হল।….
অথচ সকলেই মনে মনে ধরে নিল, ওগুলো প্রতিপালিত হবে না। মনে হল, এগুলো যেন। বাহুল্যই বলা হচ্ছে।
আশ্চর্য!
এই মেয়েটা মাঝরাত্তিরে চুরি করতে বেরিয়েছিল!
.
ইনজেকশনের পর কিছুক্ষণ অপর্ণার কাছে থেকে সুস্থ করে না গেলে বেরোবার উপায় নেই কৌস্তুভের। পাখার রেগুলেটারকে শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলেও বইখাতা নেড়ে বাতাস করতে হয়, বার বার নাড়ি দেখতে হয়। শাকবর্ণ মুখের স্বাভাবিক ফ্যাকাশে রঙটা ফিরতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে।
সাত রাজ্য খুঁজে সুন্দরী বৌ এনেছিলেন সুলক্ষণা। সে সৌন্দর্যের অবশিষ্টাংশ আজ শুধু করুণাই জাগায়।
সাদা ফরসা রঙটা এখন ফ্যাকাশে বিবর্ণ খড়ির মত। কপালের মাপ অনেকখানি বেড়ে গেছে, সামনের চুল উঠে গিয়ে আর পাতলা হয়ে গিয়ে। গালের হাড় উঁচু, চোয়ালের হাড় কোণাচে, চোখের দৃষ্টিতে শুধু এক অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ।
পানের মত নিটোল মুখে গভীর কালো দুটি চোখ আঁকা সরস্বতী প্রতিমার মত বৌটি সুলক্ষণার এখন শুধু স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দেয়ালে ঝুলছে। বিয়ের সময় অনেক আহ্লাদ করে বরকনের। রঙিন ফটো তুলিয়েছিলেন সুলক্ষণার স্বামী।
এই সব কথা মনে পড়লে সদা আনন্দময়ী সুলক্ষণার মনও বুঝি বেদনায় ভরে ওঠে।
.
অপর্ণার চোখে অসীম ক্লান্তি।
ক্লান্তি নেই কৌস্তুভের।
বিধাতার নিষ্ঠুরতা থেকে ও যেন ছিনিয়ে রাখবেই অপর্ণাকে। টিকিয়ে রাখবে এই পৃথিবীতে।