.
এ বাড়ির সব কটা প্রাণীর মধ্যে সুদক্ষিণাই সুখী। সে সব কিছুর মধ্যে অত তলাতে যায় না।
নিজেকে নিয়েই মশগুল।
তা ছাড়া হয়তো বা বোধটাও একটু কম। চৈতালীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে সে ছোড়দাকে, তাই বলে সেটা নিয়ে যে সত্যি মাথা ঘামানো যেতে পারে, এ তার বুদ্ধির বাইরে।
তাই কথার মাঝখানে হঠাৎ চৈতালীকে চলে যেতে দেখে ও একটু চমকালো।
শুধু তো চলে যাওয়া নয়, মুখের চেহারাখানাও খুব খারাপ ঠেকল। ছোড়দার দিকে তাকাল।
ভুরু কুঁচকে বলল, ছোড়দা!
আজ্ঞা হোক!
ঠাট্টা ছাড়। ও মুখটাকে অমন করে চলে গেল কেন?
সেটা ওর মুখকেই জিগ্যেস করলে ভাল হয়।
না। তোর চোখ থেকেই উত্তর চাইছি।
তাহলে চোখের ভাষা পড়তে শেখ। ওটা জিগ্যেস করে হয় না।
হুঁ!… তাহলে তলে তলে সত্যিই এটি ঘটাচ্ছ?
ঘটাচ্ছি না। ঘটছে।
কিন্তু ছোড়দা, ব্যাপারটা কি ভাল হচ্ছে?
জগতে কি যেটা ভাল, শুধু সেটাই ঘটে?
কিন্তু না না ছোড়দা, ভয়ানক অস্বস্তি হচ্ছে।
হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ নিয়ে মাথাটা বেশী নাই বা ঘামালি?
তা না ঘামালে? পরিণতিটা ভাবতে হবে তো?
সমস্ত ব্যাপারেরই একটা ছকে বাঁধা সুষ্ঠু পরিণতি হবে, এমন ভাববার দরকার কি? কালের হাতে ছেড়ে দিয়েও দেখতে হয় কিছু কিছু। অনেক নদীই মরুপথে ধারা হারায়।
হুঁ, ব্যাপারটা যতটুকু ভাবছিলাম তার থেকেও ঘোরালো মনে হচ্ছে।
হেতু?
তোর মুখে দার্শনিক উক্তি!
ছেড়ে দে ওসব কথা। একটা অনুরোধ করি তোকে, ওকে কিছু বলতে যাস না।
ওকে বলব না, মাকে বলব।
ক্ষেণু! বেশী পাকামি করতে যাস না, বলবার দরকার বুঝি, আমিই বলব। তোকে উকিল ধরতে যাব না।
তুই বলবি? পারবি?
কেন পারব না? দরকার বোধ করলে সবই পারা যায়।
তা সে দরকারটা এখন বোধ করছিস না?
না।
.
না, সে দরকার এখন বোধ করছে না কৌশিক, করবে না।
সে হালকা স্বভাবের হতে পারে, হালকা বুদ্ধি নয়। চারাগাছকে মহীরুহ ভাবতে বসছে না সে।
হয়তো কৌশিক এদের এই গতানুগতিক সমাজবোধকে খুব একটা মূল্য দেয় না, কিন্তু অকারণ তাল ঠুকতেও সে চায় না।
তা ছাড়া চৈতালী?
তার কুণ্ঠিত সংকুচিত জীবনকে আগে বিকাশের পথ দেখিয়ে দেওয়া উচিত। তারপর সে জীবনের সার্থকতার প্রশ্ন।
.
তবু চোখে চোখ পড়লেই চোখের ভাষা মুখর হয়ে ওঠে।
একজোড়া ত্রস্ত সেখ বলতে চায়, এ তুমি কি করছ?
আর একজোড়া অভয় হাসি হেসে বলে, তাতে কি? জগতে কি এ রকম ঘটে না?
একজোড়া বলে, লোকে আমায় কি বলবে?
আর একজোড়া বলে, বলুক না। তুমি তো একা নও। আমিও তো রয়েছি
কিন্তু মুখের ভাষা কৌশিকের এখনো তেমনি। খেতে বসেই হাঁকডাক করে, রান্না যে আজকাল মুখে করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে যথেচ্ছ মন্তব্য প্রকাশ করে, আবার চেয়ে খায়। তাকেই যে বিশেষ করে অবহেলা করা হচ্ছে এই ছুতো তুলে সুলক্ষণাকে ডেকে নালিশ জানায়, সালিশ মানে, আর মায়ের অসাক্ষাতে হেসে বলে, কেমন জব্দ!
কিন্তু এই সহজ ভঙ্গীটাই যে সন্দেহজনক, সে বোধ কি আছে কৌশিকের?
নেই।
জগতের সমস্ত নবীনের মত সেও প্রবীণকে অবোধ ভাবে। সমস্ত যৌবন অতিক্রম করে, জগতের সর্ববিধ রূপ রস রহস্য, রঙ্গের রহস্য ভেদ করে আর আস্বাদন করে করে তবে যে ওরা প্রবীণ হয়েছে, সে কথা খেয়ালে আনে না। খেয়ালে আনে না–তোদের মুখের রঙের আভাস মাত্র দেখলেই ওরা ধরে ফেলে, কোথায় চলছে কতটা রঙের খেলা।
সুলক্ষণা বিধবা, সুলক্ষণা বুড়ী হয়ে গেছেন, অতএব সুলক্ষণা এ রহস্য বুঝতে পারছেন না। এটাই হিসেব।
কিন্তু সুলক্ষণা বুঝছেন।
তাই সুলক্ষণা শঙ্কিত হচ্ছেন।
আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন।
সুলক্ষণার কণ্ঠে আর যেন তেমন প্রশ্রয়ের সুর নেই। নিজের নিভৃতে ভাবতে থাকেন সুলক্ষণা, কৌশিকের কথা তো আগে ভাবিনি আমি।
ওকে যে আমি অনেক উঁচু জগতের মানুষ বলে জানতাম! আমি ওর সহৃদয়তাটুকুকে ভরসা করেছিলাম, ওর মমতাকে তো ভয় করিনি।
ওটাও কি তাহলে একেবারে সাধারণ?
আমি যে তাহলে হেরে গেলাম।
ঘি আর আগুনের সেই চিরপ্রচলিত কুৎসিত প্রবাদটার কাছেই মাথা নোয়াতে হল আমাকে?
.
দুপুরবেলা যখন চৈতালী এসে পায়ের কাছে বসে, পা গুটিয়ে নেন সুলক্ষণা। বলেন, থাক, তুই সরে যা। ঘুম পাচ্ছে আমার।
চৈতালী ভয় পায়।
আগের মত আর নিয়ে চুল নিয়ে জবরদস্তি করে না। আস্তে সরে যায়, নিজের জন্যে নির্দিষ্ট সেই ছোট ঘরটায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তারপর অনেকক্ষণ হয়ে যায়।
এক সময় নিঃশ্বাস ফেলে বইখাতা নিয়ে বসে।
সুদক্ষিণা বলেছে, বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তারপর তোমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে।
চৈতালী এসব কথায় ম্লান হয়ে যায়।
বলে, এসব কি দরকার দিদি? এই তো আমি বেশ আছি।
বেশ আছছ? রাতদিন শুধু ভাত রাঁধছে, কাপড় কাঁচছে, ঘর মুছছে, বাসন ধুচ্ছ, গুল পাকাচ্ছ, মোচা কুচোচ্ছো, আর কোনও কিছু নেই, এ একটা জীবন! একে বলে বেশ থাকা?
আর কীই বা থাকে দিদি আমাদের মত মেয়েদের?
থাকে লক্ষ্য। থাকে উদ্দেশ্য। তোমার কি আছে?
স্রোতের কুটোর কি কোন লক্ষ্য থাকে? কোন উদ্দেশ্য থাকে?
তা স্রোতের কুটো হয়েই থাকবে নাকি চিরকাল?
ক্ষতি কি?
আমার ক্ষতিবোধ আসে। নিশ্চিন্ত চিত্তে একটা জীবনের অপচয় চোখের ওপর দেখতে ইচ্ছে করে না।
আমি তো মনে করি না অপচয়। তোমাদের বাড়িতে এই আশ্রয়টুকু পেয়ে আমি তো নিজেকে ধন্যই মনে করি।