যদিও ও বাড়িতে বেশি রাতেই চলে যেতে চেয়েছিল। আগে বলেছিল, মার কাছে গিয়েই খেয়ে নেব। তবু অরিন্দম বলেছিল, শেষ সন্ধ্যেটা আমায় দাও স্বাতী? খাবার টেবিলে ঝিলিককে নিয়ে আমরা দুজন–
হ্যাঁ, এই পরম সৌভাগ্যসুখটুকু ভিক্ষা চেয়েছিল অরিন্দম। যেটা নাকি সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস অবহেলায় পরিত্যাগ করে এসেছে।
অরিন্দম রাতে যখন ফেরে, ঝিলিকের তো তখন অর্ধেক রাত। ‘বাপীর সঙ্গে’ খাব বলে জেগে বসে থেকে থেকে মায়ের তাড়নায় খেয়ে নিয়ে হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
আজ অরিন্দম কাতর প্রার্থনা জানিয়েছে ঝিলিককে সঙ্গে নিয়ে খাবার টেবিলে বসবে।
কিন্তু এখন সেই পরম মুহূর্তে—
স্বাতী যখন বলে উঠল, অসভ্যতা কোরো না ঝিলিকি। খেয়ে নেবে চলো।
আর অরিন্দম ‘আয়’ বলে আবার তাকে কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল তখন ঝিলিক অসভ্যতার চূড়ান্ত করে বাপকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যাব না। খাব না তোমাদের সঙ্গে। থাকব না তোমাদের বাড়ি। আমি রাস্তায় চলে যাব। ‘রাস্তার মেয়ে’ হয়ে যাব। ফুটপাথে ঘুমোব, খাবারের দোকান থেকে বাসি খাবার চেয়ে চেয়ে খাব-ছেঁড়া জামা পরে—গায়ো ধুলো মেখে–
ঝিলিক!
স্বাতী প্রায় বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বলে, বড় বাড় বাড়িয়েছ দেখছি। এসব অসভ্য কথা শিখছ কোথা থেকে, অ্যাঁ! যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছ। মানেটা কী? কোথা থেকে শিখছ এসব বিচ্ছিরি কথা?
অরিন্দম একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, আশা করি ও ব্যাপারে আমায় সন্দেহ করছ না!
থামো। তোমার প্রশ্রয়েই এরকম হয়েছে। সন্তান সম্পর্কে দায়িত্ববোধ নেই, কর্তব্যের বালাই নেই, আছে শুধু আদিখ্যেতা দেওয়া আদর। …ঝিলিক! ও কী! ওটা কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে। দেখে চীৎকার করে ওঠবারই কথা।
ঝিলিক তার গায়ে পরে থাকা হালকা সুন্দর রেশমি ফ্রকটার ঝালর তুলে দাঁত দিয়ে টেনে টেনে ছিড়ছে।
ধৈর্য রাখা সত্যিই সম্ভব নয়।
নিজের জীবনের সমস্ত ছন্দ, সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য সম্পদ আরাম আয়েস জৌলুস ব ভেঙেচুরে ছিঁড়ে তছনছ করে চলে যেতে হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণার সময় ওই ক্ষুদে মেয়েটা এইভাবে শত্রুতা করতে বসল।
জামা ছিঁড়ছিস যে?
ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল স্বাতী ছোট্ট মেয়েটার ফুলের মতো গালে।
কিন্তু মেয়েও আজ নির্ভীক, অনমনীয়।
ছিঁড়বই তো জামা। কাদা মাখাব। এই এমনি চুল করব—
বলে দুহাতে চুলগুলো নুড়ো নুড়ো করে মুখ চোখে ছড়িয়ে দেয়।
হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, রাস্তার মেয়েছেলেরা বুঝি ভাল জামা পরে? ভাল করে চুল আঁচড়ায়?
অরিন্দম তাকিয়ে দেখে। মেয়েটার গালে ‘ঠাস’-এর চিহ্নটা দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। ওর কাছে গিয়ে কোলে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন আর ঝিলিক বাবারও নয়।
হাত পা ছুঁড়ে কোলে ভোলা আটকে বলে, না! কোলে নেবে না। রাস্তার ছেলে-মেয়েদের বাবা থাকে না, মা থাকে না, কেউ থাকে না। তারা কারুর কোলে চাপে না।
এই শোন লক্ষ্মী মেয়ে। হঠাৎ রাস্তার ছেলেমেয়ের মতন হতে যাবার খেয়াল চাপল কেন?
ঝিলিক সতেজে বলে, চাপবেই তো। কেন চাপবে না? যাদের বাড়ি-টাড়ি কিছু থাকে না, তারা তো রাস্তারই।
ঝিলিক! এবার আরো একটা চড় খেতে চাও? হঠাৎ এত সাহস এল কোথা থেকে? অ্যাঁ। কেন, মামার বাড়িতে যাও না কখনো? থাকো না সেখানে?
ঝিলিক একমনে চুলের পাট ভেঙে নুড়ো নুড়ো করতে করতে বলে, সে তো বেড়াতে! রোজ রোজ থাকতে যাই?
অরিন্দম একবার স্বাতীর দিকে তাকায়। স্বাতীর চোখ অন্যদিকে। অরিন্দম গাঢ়গম্ভীর গলায় বলে, রোজ রোজ থাকতে যাচ্ছিস এ কথা তোকে কে বলেছে রে? তুই তো এমনিই যাচ্ছিস! আবার কাল পরশু মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে কথা।
ঝিলিক দাঁড়িয়ে উঠে জামাটা ফালি ফালি করে ছিঁড়ে গা থেকে খোসা ছাড়ানোর মতো ছাড়াতে ছাড়াতে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলে, আমি যেন কিছু বুঝতে পারি না। নিজেরা কেবল ঝগড়া করবে, মা ঝগড়া করে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে দিদাদের বাড়ি থাকতে যাবে আর আমায় সেইখানে নিয়ে গিয়ে আর আসতে দেবে না! ভারী মজা পেয়েছে। নিজেরা ঝগড়া করবে আর আমায় যত ইচ্ছে কষ্ট দেবে! আমি যেন একটা মানুষ নই? নিজেরাই শুধু মানুষ। নিজেদের যা খুশি তাই চালাবে। না?… ঠিক আছে। যেও তুমি দিদার বাড়ি। আমি তো রাস্তার লোক হয়ে যাব। রাস্তায় পড়ে পড়ে মরে যাব। বেশ হবে। ঠিক হবে। তখন ভ্যা ভ্যা করে কেঁদো।
বলেই এতক্ষণের সমস্ত তেজ গৌরব ধূলিসাৎ করে নিজেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলে উপুড় হয়ে পড়ে মাটিতে মুখ ঘষতে থাকে।
আর দু’জোড়া পাথরের চোখ স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।
কিন্তু ওই পাথরে চোখ দুটো কি একটা শিশুর এই দুরন্ত যন্ত্রণা দেখে মমতায় কোমল হয়ে আসবে? সেই কোমলতায় ওই যন্ত্রণার কাছে নিজেদের অসহিষ্ণুতার যন্ত্রণা খাটো করে দেখবে?
হুঁ। অত সোজা নয়।
যেই একজোড়া চোখ কোমল হয়ে মিনতি দৃষ্টিতে অপর জোড়ার দিকে তাকাবে, সেই অপর জোড়ায় জ্বলে উঠবে আগুনের ফুলকি। বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ওই শিশুটার ওপর। হিঁচড়ে টেনে তুলে নিয়ে মারতে মারতে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঠাবে।
দাঁতে দাঁত পিষে বলবে, বদমাশ মেয়ে, তোমার থিয়েটার করা বার করছি। আদর পেয়ে পেয়ে বাঁদর হয়ে উঠেছ। দেখবে চলো এবার কী করে শায়েস্তা করতে হয় দেখাচ্ছি। আমায় এখনো চেনো না তুমি।